Logo
×

Follow Us

বিনোদন

ক্ল্যাসিক সৌন্দর্য যুগে যুগে

Icon

কাজী সানজীদ

প্রকাশ: ২৭ জুন ২০২৪, ১৯:৪২

ক্ল্যাসিক সৌন্দর্য যুগে যুগে

মধুবালা। ছবি: সংগৃহীত

আজ একটি খবর পড়ে এ বিষয়ে কলম মানে কিবোর্ড ধরতে মন চাইল। এবারের বিষয় ক্ল্যাসিক মানে ধ্রুপদী সৌন্দর্য, অবশ্যই মানুষের। ছবিতে বা সিনেমায় আমার জীবনে দেখা শ্রেষ্ঠ সুন্দরীরা হলেন মেরিলিন মনরো, ওয়ান্ডার উওম্যান খ্যাত লিন্ডা কার্টার, ব্রুক শিল্ডস, পাকিস্তানের জেবা, ভারতের জিনাত আমান, শ্রীদেবী, মাধুরী দীক্ষিত, রাভিনা ট্যান্ডন, শিল্পা শেঠি এবং ঐশ্বরিয়া রাই। 

মেরিলিন মনরোর অনেক আলোকচিত্র দেখলেও তার সমকক্ষ সুন্দরী এবং সম্ভবত শ্রেয়তর অভিনেত্রী মধুবালার নাম শুধু মা-বাবার মুখেই শুনেছি, আলোকচিত্র দেখা হয়নি। সাম্প্রতিক একটি পোস্ট দৃষ্টি সেদিকে টেনে নিলো। স্বাভাবিকভাবে ছবিও খুঁজে বের করতে হলো।

অনেক পর্যবেক্ষকের ধারণা কোনো ছায়াছবি অথবা আলোকচিত্রে মধুবালার আসল সৌন্দর্য ফুটে ওঠেনি। এই লেখকও তার সঙ্গে একমত। তিনি সম্ভবত সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সুন্দরী। মুঘল-ই-আযম সিনামাটি দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। সেখানেও মনে হয়েছে, ক্যামেরা তার মৌলিক সৌন্দর্য ফ্রেমবন্দি করতে ব্যর্থ। 

দিল্লিতে ১৯৩৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি অর্থাৎ ভ্যালেন্টাইন ডেতে মধুবালার জন্ম। আসল নাম মুমতাজ জাহান বেগম দেহলভি। পিতা আতাউল্লাহ খান, মাতা আয়শা বেগম। ১৯৪২ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত তিনি ছায়াছবিতে সক্রিয় ছিলেন। অনেক বিখ্যাত ছবিতে অভিনয় করেছেন। তার মধ্যে আছে ফাগুন, বারসাত কি রাত, মোঘল-ই-আজম ইত্যাদি। অনেকের মতে মোঘল-ই-আজম ছবিটিই তাকে উপমহাদেশব্যাপী খ্যাতি এনে দেয়। বিষাদভিত্তিক চরিত্র তিনি চমৎকার ফুটিয়ে তুলতে পারতেন। আবার গানের দৃশ্যেও ছিলেন অত্যন্ত সাবলীল।

সাধারণত সুন্দরী নায়িকারা ভালো অভিনেত্রী হন না, মধুবালা ছিলেন তার ব্যতিক্রম। দর্শক তার অপরূপ মুখমণ্ডল হাঁ করে দেখত, অভিনয় খেয়াল করা ভুলে যেত। অথচ ক্ল্যাসিক সৌন্দর্যের অধিকারী হয়েও তিনি অভিনয়ে মনপ্রাণ ঢেলে দিতে পারতেন। ছায়াছবিতে তার ক্যারিয়ার নিয়ন্ত্রণ করতেন তার বাবা আতাউল্লাহ খান। তবে এই নিয়ন্ত্রণের কারণেই মধুবালা বেশ কিছু সাধারণ মানের চরিত্রে অভিনয় করেছেন যেখানে প্রতিভা বিকাশের সুযোগ কম ছিল।

মধুবালা হলিউডের দৃষ্টি কাড়েন যখন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত আলোকচিত্রী জেমস্ বার্ক ১৯৫১ সালে ভারত ভ্রমণ করেন। তিনি এই সুন্দরীর অসংখ্য ছবি তোলেন এবং ফিরে গিয়ে লাইফ ম্যাগাজিনে তাকে নিয়ে বিশাল ফিচার করেন। তিনি মন্তব্য করেন মধুবালা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রে সবচেয়ে বড় তারকা অথচ তিনি হলিউডে নেই কেন! তখন হলিউডের প্রখ্যাত পরিচালক ফ্র্যাংক ক্যাপরা তাকে সেখানকার ছবিতে অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব দেন; কিন্তু মধুবালার বাবা সে প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন এই বলে, মধুবালা সৃষ্টি হয়েছে ভারতে অভিনয় করার জন্য, অন্য কোথাও নয়। 

আজ মধুবালার রঙিন ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আলোচনা করতে মন চাইছে। কারণ সেখানেও রয়েছে রূপকথা।

সুন্দরী নায়িকাদের প্রতি নায়কদের আকৃষ্ট হওয়া নতুন কিছু নয়। মধুবালাও ব্যতিক্রম ছিলেন না। তবে প্রেম নিবেদক কাউকেই তিনি ‘না’ বলতে পারতেন না। সে কারণেই তার প্রেমিক ছিলেন দিলীপ কুমার, সুনীল দত্ত এবং কিশোর কুমার। সুনীল দত্ত একবার পা ভেঙে এক মাস হাসপাতালে পড়ে ছিলেন। তখন মধুবালা রোজ ফুল নিয়ে তাকে দেখতে যেতেন। দিলীপ সেসব জানতেন এবং কষ্ট পেতেন।

এটা ভাবা মোটেও সমীচীন নয় যে পাকিস্তানি পুরুষদের সঙ্গে মুম্বাই নায়িকাদের সখ্য ইমরান খানকে দিয়ে শুরু। বরং এই ধারা অনেক পুরোনো। সিন্ধু প্রদেশের লারকানার জমিদার পরিবারে আকর্ষণীয় এক যুবক ছিলেন। একেই ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান, তার ওপর আবার পাশ্চাত্যের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত। পঞ্চাশের দশকের সেই দুর্ধর্ষ যুবকের নাম জুলফিকার আলী ভুট্টো। ভারতেও তাদের বেশ কিছু সম্পত্তি ছিল। সেগুলোর দেখাশোনা করার জন্য তিনি প্রায়ই সে দেশে যেতেন। ঘটনাক্রমে মধুবালার সঙ্গে তার পরিচয় হয়, তা থেকে ঘনিষ্ঠতা। স্বাভাবিকভাবেই ভুট্টোর মুম্বাই যাতায়াত বেড়ে গেল বহুগুণ। তিনি নিয়মিত মোঘল-ই-আজম ছবির সেটে গিয়ে বসে থাকতেন এবং মধুবালার কাজ দেখতেন। তারপর তারা বাইরে ঘুরে বেড়াতেন এবং একসঙ্গে লাঞ্চ করতেন। এভাবে কিছুদিন চলার পর ভুট্টো একসময় মধুবালাকে বিয়ের প্রস্তাব করেন। শুনে তার বাবা আতাউল্লাহ বেজায় খুশি। রাজি হয়ে গেলেন।

একসময় আতাউল্লাহর মনে হলো হবু জামাইয়ের বাড়িঘর দেখে আসা দরকার। সে মোতাবেক তিনি পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশে গেলেন। গিয়ে আবিষ্কার করলেন ভুট্টোর অলরেডি দুটো বিয়ে করা হয়ে গেছে। দ্বিতীয় স্ত্রীর সন্তান বেনজির ভুট্টো। আতাউল্লাহ প্রচণ্ড রেগে গেলেন এবং দেশে ফিরে এলেন। এসে ভুট্টোর সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাব বাতিল করে দিলেন।

এরপর দিলীপ কুমার-মধুবালা প্রেম কাহিনির শুরু। যদিও দিলীপ মধুবালার প্রতি মোহগ্রস্ত থাকার কথা সরাসরি স্বীকার করেননি, মুম্বাইয়ের আরেক দিকপাল শাম্মী কাপুর বিষয়টির ওপর স্বচক্ষে দেখা অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আলোকপাত করেছেন। তিনি বলেছেন দিলীপ-মধুবালা পরস্পরের প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট ছিলেন। তিনি বলেন, আমার মনে আছে পুনায় প্রভাত টকিজের নাকাব ছবিটি তৈরি হওয়ার সময় দিলীপ তার প্রেমিকাকে দেখার জন্য নিয়মিত গাড়ি চালিয়ে বম্বে থেকে পুনায় সেই ছবির শুটিং লোকেশনে চলে যেতেন। সেই মুহূর্তে শুটিং চলমান থাকলে, তিনি ক্যামেরার আওতার বাইরে দাঁড়িয়ে প্রেমিকাকে বিরক্ত না করে তার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকতেন। তবে তাদের প্রেম বেশিদূর এগোতে পারেনি, ইগো সেখানে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। দিলীপ চেয়েছিলেন বিয়ের পর মধুবালা ছবিতে অভিনয় ছেড়ে দেন; কিন্তু মধুবালা রাজি থাকলেও আতাউল্লাহ তা প্রত্যাখ্যান করেন। কারণ তেমনটি ঘটলে তার মানি মেকিং মেশিনটি তো বন্ধ হয়ে যেত। সে পরিবারটি খুব সচ্ছল ছিল না এবং অনেকটাই মধুবালার উপার্জনের ওপর নির্ভরশীল ছিল।

এরপর মধুবালা কিশোর কুমারের প্রতি আকৃষ্ট হন। ঢাকে কি মালমাল ছবির শুটিংয়ের সময় মধুবালার সঙ্গে কিশোর কুমারের পরিচয় হয়। তাদের প্রেমপর্ব চলে চালতি কা নাম গাড়ি এবং হাফ টিকেট পর্যন্ত। দিলীপের কাছ থেকে পাওয়া প্রত্যাখ্যান ও যন্ত্রণার পর মধুবালা, কিশোর কুমারের প্রাণবন্ত ব্যক্তিত্বের মধ্যে স্বস্তি খুঁজে পান। কিশোর তাকে হাসাতে পারতেন যা মধুবালা পছন্দ করতেন। সে সময় কিশোর এবং তার গায়িকা-নায়িকা স্ত্রী রুমা দেবী গুহ ঠাকুরতার মধ্যে বিবাহ-বিচ্ছেদের প্রক্রিয়া চলছিল। সে বিচ্ছেদের পর কিশোর কুমার এবং মধুবালা ১৯৬০ সালে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। 

শৈশবে লতিফ নামে মধুবালার এক বন্ধু ছিলেন। মুম্বাইয়ের উদ্দেশে রওনা হওয়ার আগে মধুবালা লতিফকে একটি গোলাপ উপহার দেন যা ছিল তার ভালোবাসার প্রকাশ। লতিফ গোলাপটি রেখে দেন। মধুবালা চলে যাওয়ার পর তিনি বেশ বিমর্ষ হয়ে পড়েন। পরবর্তী সময়ে তিনি একজন আইএএস অফিসার হন। মধুবালার অকাল মৃত্যুর পর সেই গোলাপটি তিনি মধুবালার কবরে রেখে আসেন। সেই থেকে তিনি আজ পর্যন্ত প্রতিবছর মধুবালার মৃত্যুদিবস ২৩ ফেব্রুয়ারি তার কবরে একটি গোলাপ রেখে আসেন। ১৯৬০ সালে বিয়ের পর কিশোর কুমার মধুবালাকে নিয়ে লন্ডন ভ্রমণে যান। সেখানে এক ডাক্তার তাকে পরীক্ষা করে বলেন যে তিনি আর মাত্র দুই বছর জীবিত থাকবেন। তবে সে ডাক্তারের ভবিষ্যদ্বাণী ভুল প্রমাণ করে এই বিরল প্রতিভার খ্যাতনামা সুন্দরী বেঁচে ছিলেন আরও নয় বছর। ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তিনি পরলোক গমন করেন। তখন তার বয়স হয়েছিল মাত্র ৩৬। 

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫