লালন গানের ‘প্রাণভোমরা’ ফরিদা পারভীন এন আই বুলবুল

এন আই বুলবুল
প্রকাশ: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৬:২৪

ফরিদা পারভীন
বাংলাদেশের লালনসংগীতের সঙ্গে যার নাম অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে, তিনি ফরিদা পারভীন। তার কণ্ঠের মাধুর্যে মুগ্ধ হয়েছে বাংলাদেশ। তার দৃপ্ত গায়কির আকর্ষণ আচ্ছন্ন করেছে বাংলা গানের শ্রোতাদের। ‘লালন সম্রাজ্ঞী’ বলা হয় ফরিদা পারভীনকে।
লালন সাঁইজির গানের প্রসঙ্গ উঠলে প্রথমেই কানে ভেসে আসত তার কণ্ঠস্বর। দীর্ঘ সংগীত জীবনে তিনি লালনের গানকে বিশ্ব পরিসরে পৌঁছে দিয়েছিলেন। তবে তিনি আজ আর আমাদের মাঝে নেই। ১৩ সেপ্টেম্বর না ফেরার দেশে পাড়ি জমান এই কিংবদন্তি। দীর্ঘদিন ধরে কিডনি জটিলতাসহ নানা রোগে ভুগেছেন ফরিদা পারভীন।
ফরিদা পারভীনের কণ্ঠে প্রজন্মের পর প্রজন্ম লালন গীতিতে মুগ্ধ হয়েছে। তার কণ্ঠে ‘খাঁচার ভেতর অচিন পাখি’, ‘সময় গেলে সাধন হবে না’ কিংবা ‘বাড়ির কাছে আরশি নগর’ শোনেনি এমন শ্রোতার সংখ্যা খুবই কম। লালন ফকিরের ‘সত্য বল সুপথে চল’ গান দিয়েই লালন গানে তার যাত্রা শুরু হয়। গুরু মোকছেদ সাঁইয়ের অনুরোধে স্বাধীনতা-পরবর্তী ১৯৭৩ সালে কুষ্টিয়ার ছেঁউরিয়াতে দোল পূর্ণিমার উৎসবে তিনি প্রথম এই গানটি করেন। প্রয়াত এই সংগীতশিল্পী বিভিন্ন সময়ে লালনের গানের শুরু প্রসঙ্গে এভাবেই জানান।
ফরিদা পারভীনের গানে হাতেখড়ি পাঁচ বছর বয়সে। ওস্তাদ কমল চক্রবর্তীর কাছে তার প্রথম গান শেখা। নজরুলসংগীত দিয়ে তার শিল্পীজীবনের সূচনা হয়। ১৯৬৮ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে তিনি রাজশাহী বেতারে তালিকাভুক্ত নজরুলসংগীত শিল্পী হন। কিন্তু ভাগ্য যেন তাকে অন্য পথে নিয়ে যেতে চাইছিল, সেই পথের নাম লালন।
লালন সাঁইজির গানের বাণী ও সুরকে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে ফরিদা পারভীনের অবদান সর্বজনস্বীকৃত। লালনের বাণীগুলো তিনি অন্তর থেকে আত্মস্থ করতেন। তার মতে, হৃদয়ের গভীর উপলব্ধি থেকে লালনচর্চার কোনো বিকল্প হতে পারে না। তিনি লালনের জীবন ও দর্শনকে গভীরভাবে আত্মস্থ করেছিলেন এবং তার গানের মাধ্যমে সেই জীবন দর্শনকে মানুষের কাছে তুলে ধরেছেন। লালনসংগীতের বাণী ও সুরের প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল ছিলেন এই লোকসংগীত শিল্পী। কখনোই লালনের গানের বিকৃতি ঘটাননি, বরং এর মৌলিকতা ও গভীরতা বজায় রেখেছেন, যা তার ‘লালন সম্রাজ্ঞী’ উপাধি অর্জনে ভূমিকা রাখে।
ফরিদা পারভীনের কণ্ঠে লালন যেন নতুন ভাষা খুঁজে পেত। তিনি নিজেই এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘লালনের গান গাইতে গাইতে বুঝেছি, তার বাণীতে যে আধ্যাত্মিকতা আছে, তা আমাকে ভেতর থেকে নাড়া দেয়। এই গান ছাড়া আমি অন্য কিছু ভাবতেই পারি না।’
শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বদরবারেও ফরিদা পারভীন লালন সাঁইয়ের বাণী ও সুরকে প্রচারের কাজে নিয়োজিত ছিলেন। জাপান, সুইডেন, ডেনমার্ক, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বহু দেশে লালনসংগীত পরিবেশন করেছেন তিনি। ২০০১ সালে ‘ফরিদা পারভীন প্রজেক্ট কমিটি’র উদ্যোগে তিনি জাপানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে লালনের গান পরিচয় করিয়ে দেন। পরে গড়ে তোলেন ‘ফরিদা পারভীন ট্রাস্ট’, যার লক্ষ্য লালনের গান সংরক্ষণ, স্বরলিপি তৈরি এবং বাদ্যযন্ত্রের আর্কাইভ তৈরি করা।
লালনসংগীতে অবদানের জন্য ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশ সরকারের একুশে পদক পান ফরিদা পারভীন। ২০০৮ সালে জাপানের মর্যাদাপূর্ণ ফুকুওয়াকা পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি। ১৯৫৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর নাটোরের সিংড়া থানার শাঁঔঁল গ্রামে জন্ম ফরিদার। শৈশবের দিনগুলো কেটেছে মাগুরা, নাটোর, কুষ্টিয়াসহ দেশের নানা প্রান্তে।