দক্ষিণ ভারতের কেরালায় একটি প্রস্তাবিত চলচ্চিত্রকে ঘিরে বিতর্ক বেঁধেছে। প্রায় একশো বছর আগে, ব্রিটিশ সৈন্যদের গুলিতে নিহত এক মুসলিম নেতার জীবন নিয়ে একটি ওই চলচ্চিত্র প্রস্তাবিত হয়। ভারিয়ানকুন্নাথু কুঞ্জাহামেদ হাজী নামের ওই নেতা মালাবার বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আর ব্রিটিশ শাসন উপেক্ষা করে প্রায় ছয়মাস নিজের সরকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
তাকে এতদিন বিদ্রোহী নেতা হিসাবেই মনে করেছেন ঐতিহাসিকরা। কিন্তু নতুন একটি সিনেমা তৈরির ঘোষণা হওয়া মাত্রই দক্ষিণপন্থী ঐতিহাসিকদের একাংশ বলছেন কুঞ্জাহামেদ বিদ্রোহী কখনই ছিলেন না, তিনি ছিলেন লুটেরা এবং হিন্দু হত্যাকারী এক ব্যক্তি।
ভারিয়ানকুন্নাথু কুঞ্জাহামেদকে নিয়ে ছবি অবশ্য এই প্রথম নয়। ১৯৮৮ সালে এক কোটিরও বেশি টাকা খরচ করে তৈরি হওয়া একটি সফল ছবি হয়েছিল তাকে নিয়ে। ছবিটির নাম ছিল নাইন্টিন টুয়েন্টি ওয়ান। প্রচলিত ইতিহাস অনুযায়ী, উত্তর কেরালার নানা অঞ্চলে ব্রিটিশ বিরোধী প্রচার চালাতেন মালায়ালাম, আরবী আর কিছুটা ইংরেজি শিক্ষিত কুঞ্জাহামেদ হাজী।
প্রচারের সময়ে তিনি ব্যবহার করতেন কেরালার নিজস্ব মার্শাল আর্টসের নানা কায়দা, পল্লীগান প্রভৃতি। সেভাবেই তিনি গড়ে তুলেছিলেন প্রায় ৭৫ হাজার মানুষের এক বাহিনী। ১৯২০ সালের অগাস্টে একটি মসজিদে হামলার পরেই সেই বাহিনী নানা দিকে ব্রিটিশ থানা ও সরকারি দপ্তরে হামলা চালায়।
প্রায় একবছর ধরে সেই লড়াইয়ের পরে ১৯২১ সালের অগাস্টে ভারিয়ানকুন্নাথু কুঞ্জাহামেদ ব্রিটিশদের তাড়িয়ে দিয়ে গড়ে তোলেন তার নিজস্ব প্রশাসন। কিন্তু মাস ছয়েকের মধ্যে গ্রেফতার হন তিনি, আর গুলি করে মেরে ফেলা হয় তাকে।
এই ঐতিহাসিক চরিত্রকে নিয়েই আবারো একটি সিনেমা বানানোর কথা ঘোষণা করেছেন মালায়লাম সিনেমার খ্যাতনামা পরিচালক আশিক আবু। আর তারপরেই শুরু হয়েছে ওই ঐতিহাসিক চরিত্রকে কেন্দ্র করে বিতর্ক।
আশিক আবু বলছিলেন, বিতর্ক হচ্ছে কারণ ছবির মূল চরিত্রটাই যথেষ্ট বিতর্কিত আর আলোচিত। ভারিয়ানকুন্নাথু কুঞ্জাহামেদকে নিয়ে ব্রিটিশদের তৈরি করে দেওয়া একটা ভাষ্য আছে, সেটা অনেক মানুষ বিশ্বাসও করেন। ঐতিহাসিকরা অবশ্য প্রমাণ করে দিয়েছেন যে সেই ভাষ্যটা মিথ্যা।
তিনি আরো বলছিলেন, একদিকে ছবিটার বিষয়বস্তু নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়ে ভালই হয়েছে। মানুষ এখন ভারিয়ানকুন্নাথু কুঞ্জাহামেদকে নিয়ে পড়াশোনা করছে, জানার চেষ্টা করছে। কিন্তু দক্ষিণপন্থী হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো আর ইতিহাসবিদদের একাংশ বলছেন ভারিয়ানকুন্নাথু কুঞ্জাহামেদ আসলে একজন দস্যু ও লুটেরা ছিলেন। যিনি হাজার হাজার নিম্নবর্ণীয় হিন্দুদের জোর করে ধর্মান্তরিত করেছিলেন, নির্মমভাবে হত্যা করেছিলেন বহু মানুষকে।
ভারতের ইতিহাস গবেষণার সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ হিস্টোরিকাল রিসার্চ বা আইসিএইচআরের সদস্য অধ্যাপক সি আই আইজ্যাক বলছিলেন, ভারিয়ানকুন্নাথু কুঞ্জাহামেদ একদিকে ছিলেন একজন ধর্মান্ধ, আর অন্যদিকে দস্যুদলের নেতা। ইসলাম ধর্মের অন্ধ অনুসারী ছিলেন তিনি। ১৯২১ সালের যে ঘটনার কথা বলা হয়, সেটা আদতে ছিলো একটা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা।
তিনি বলেন, তিনি ওই দাঙ্গা লাগিয়ে হাজার হাজার হিন্দুকে হত্যা করেছিলেন, ধর্মান্তরিত করেছিলেন। তার উদ্দেশ্যই ছিলো নিজে এই অঞ্চলে খিলাফত প্রতিষ্ঠা করবেন আর নিজে খলিফা হবেন। যাদের তিনি আর তার দল হত্যা করেছিল, তারা বেশিরভাগই ছিল নিম্নবর্নীয় হিন্দু - তাদের জমিজমা কিছুই ছিল না। উচ্চবর্ণীয় হিন্দুরা তো পালিয়ে যেতে পেরেছিল।
কেরালার কমিউনিস্ট আর কংগ্রেস সরকার এইরকম এক ব্যক্তিকে ব্রিটিশ বিরোধী বিদ্রোহী বানিয়েছে বলে মন্তব্য অধ্যাপক সি আই আইজ্যাকের।
ব্রিটিশ আর কেরালার জমিদার শ্রেণীর তৈরি করা যে ভাষ্যের কথা বলছিলেন আশিক আবু, বা অধ্যাপক সি আই আইজ্যাক যেভাবে ভারিয়ানকুন্নাথু কুঞ্জাহামেদকে ধর্মান্ধ আর দস্যু দলের নেতা বললেন, সেগুলোর কি আদৌ কোনও ভিত্তি আছে?
ইতিহাসের অধ্যাপক আব্দুর রেজ্জাক বলছেন, কে এন পানিক্কর থেকে শুরু করে বহু ইতিহাসবিদ মালাবার বিদ্রোহ নিয়ে গবেষণা করেছেন। কোনো বইতেই ওই ঘটনাকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বলা হয় নি। ইতিহাস বলছে ভারিয়ানকুন্নাথু কুঞ্জাহামেদ বরঞ্চ তার দলের সেই সব সদস্যদের কঠোর শাস্তি দিতেন, যারা লুটপাট চালাতো বা জোর করে ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা করত।
তার ব্যাখ্যা, আসলে ব্রিটিশ আর জমিদার শ্রেণী তার বাহিনীর কাছে নাস্তানাবুদ হয়েছিল, সেজন্যই তারা বিদ্রোহ হিসাবে না দেখিয়ে ১৯২১ এর ঘটনাকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বলার চেষ্টা করেছে। আর এই প্রচেষ্টা এখন নয়, ওই সময় থেকেই চলে আসছে। আগামী বছর তো বিদ্রোহের শতবর্ষ, তাই সিনেমাটা যদি নাও হত, তাহলেও হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো এই বিতর্ক তুলতই রাজনীতি করার জন্য। যেভাবে টিপু সুলতানকে নিয়ে বিতর্ক করেছিল, একই ভাবে ভারিয়ানকুন্নাথু কুঞ্জাহামেদ নিয়ে বিতর্ক তুলে দিয়ে সাম্প্রদায়িক বিভাজন করার চেষ্টা এটা," বলছেন ইতিহাসের অধ্যাপক আব্দুর রেজ্জাক।
ভারিয়ানকুন্নাথু কুঞ্জাহামেদকে নিয়ে এই বিতর্ককে পরিচালক আশিক আবু অবশ্য খুব একটা গুরুত্ব দিতে চাইছেন না। বলেন, এরকম বিতর্ক আর হুমকির মুখোমুখি আমাকে আগেও হতে হয়েছে। আর শুধু আমার ক্ষেত্রে নয়, ভারতে সাম্প্রতিক সময়ে যে কেউই নিজের মতামত স্পষ্ট করে বলতে গেলেই তাকে একই রকম হুমকির মুখে পড়তে হচ্ছে।
ভারিয়ানকুন্নাথু কুঞ্জাহামেদ নিয়ে ছবির কাজ এখনো শুরু হয় নি, তাই ছবিটাতে ঠিক কী দেখানো হচ্ছে, কোন ভাষ্য উঠে আসছে, তার জন্য অপেক্ষা করা উচিত বলে মনে করেন কোচির সেক্রেড হার্ট কলেজ অফ কমিউনিকেশনসের ডিন এবং নারী চলচ্চিত্রকার আশা আচি যোশেফ।
মিজ যোসেফের কথায়, বিতর্ক হচ্ছে ঠিক আছে, সেটা প্রয়োজনও। কিন্তু ছবিটা তো আগে তৈরি হোক - লোকে দেখুক আশিক আবু তার ছবিতে ঠিক কী দেখাচ্ছেন, কী বলছেন ভারিয়ানকুন্নাথু কুঞ্জাহামেদকে নিয়ে! তার কাজের ধরণের সঙ্গে যারা পরিচিত, তারাই জানেন তিনি এমন একজন পরিচালক, যিনি ইতিহাস বিকৃত করেন নি কখনও। আর তার গবেষণার টিমটিও খুবই পারদর্শী। তাই এবারেও সঠিক ইতিহাসই তিনি তুলে ধরবেন, এমনটা আশা করাই যায়।
আগামী বছর মালাবার বিদ্রোহের শতবর্ষ। তাই শুধু আশিক আবু নয়, আরো তিনজন পরিচালক ভারিয়ানকুন্নাথু কুঞ্জাহামেদ আর মালাবার বিদ্রোহ নিয়ে ছবি করার ঘোষণা করেছেন।-বিবিসি