
হীরালাল সেন
ইতিহাসের এক নিদারুণ ট্র্যাজেডির নায়ক হীরালাল সেন। তার হাতেই জন্ম হয় উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের; কিন্তু এর আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতিটুকুও তিনি পাননি।
তার প্রথম ছবি মুক্তি পায় ১৯০৩ সালে। অথচ ১৯১৩ সালে দাদাসাহেব ফালকের ‘রাজা হরিশ্চন্দ্র’ ছবিটি মুক্তি পাওয়ার সুবাদে তার নাম ভারতীয় সিনেমার অগ্রনায়ক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।
আরো দুর্ভাগ্যজনক হলো বাংলাদেশের এই কৃতী সন্তান, সমগ্র ভারতীয় চলচ্চিত্রের জনক হওয়ার পরও আমাদের দেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে বা স্মরণে তার স্থান নেই।
মানিকগঞ্জ জেলার বগজুরি গ্রামে ১৮৬৬ সালের ২ আগস্ট ভারতীয় উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের জনক হীরালাল সেন জন্মগ্রহণ করেন। স্কুলের ছাত্রাবস্থা থেকেই ফটোগ্রাফির প্রতি ছিল তার দারুণ আগ্রহ। বায়োস্কোপ দেখার নেশা ছিল তার। প্রতিদিন বিকেলে স্থানীয় তাঁবুতে গিয়ে বায়োস্কোপ দেখতেন।
পিতা চন্দ্রমোহন সেন ছেলের আগ্রহ দেখে বায়োস্কোপ কিনে দেন। ১৮৯০ সালের প্রথমদিকে মানিকগঞ্জের নিজ বাড়িতে হীরালাল এইচএল সেন অ্যান্ড ব্রাদার্স নামে একটি ফটোগ্রাফিক স্টুডিও খোলেন। ১৮৯৮ সালে সেই সময়ের তুলনায় অবিশ্বাস্য দামে (পাঁচ হাজার টাকায়) জন ইলিয়ট কোম্পানির মাধ্যমে ইংল্যান্ড থেকে সিনেমাটোগ্রাফ যন্ত্র কেনেন হীরালাল সেন। সেসময় তিনি তার ভাই মতিলাল সেনের সাহায্য নিয়ে বায়োস্কোপ প্রদর্শনের জন্য একটি কোম্পানি খোলেন, নাম দেন দ্য রয়্যাল বায়োস্কোপ কোম্পানি।
হীরালাল স্থিরচিত্র তোলার ব্যাপারে খুবই পারদর্শী ছিলেন। এই সময়ে প্যারিসের ফ্রেরেস স্টুডিওর কলাকুশলীরা চলচ্চিত্র তোলা ও প্রদর্শন প্রসঙ্গে কলকাতায় আসেন। তখন হীরালাল তাদের সাথে যোগ দেন ও তাদের সাহায্য নিয়ে তার প্রথম চলচ্চিত্র ‘পারস্যের ফুল’ নাটকের একটি নাচের দৃশ্যে ঝড় তোলেন।
এই ছবিটির পর তিনি আরো ৪০টির মতো স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি তোলেন। অমরেন্দ্র দত্তের ক্ল্যাসিক থিয়েটারে যেসব নাটক অভিনীত হতো, তার নির্বাচিত অংশ চিত্রগ্রহণ করেন। তার তিনটি উল্লেখযোগ্য নাটক হলো- বঙ্কিম চন্দ্রের সীতারাম, তারনাথের সুবল ও আলীবাজ।
১৯০১ সালে তিনি সিনেমার কাজে হাত দেন। ১৯০৫ সালে কলকাতার টাউন হলে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের যে ছবি তিনি তোলেন, সেটাই বোধহয় রাজনৈতিক ঘটনাকে চলচ্চিত্রে ধরে রাখার প্রথম ভারতীয় প্রয়াস। এছাড়াও হীরালাল সেনই ভারতে প্রথম বিজ্ঞাপনের জন্য চলচ্চিত্রের ব্যবহার করেছেন। জবাকুসুম তেল ও এডওয়ার্ডস টনিকের বিজ্ঞাপন তিনিই তৈরি করেছিলেন।
প্রথম মুভি ক্যামেরা চালিয়ে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণে সফল হলেও হীরালালের জীবনের শেষ কয়েক বছর সুখকর ছিল না। ছবি বানাতে গিয়ে জীবনের শেষপ্রান্তে এসে দেনার দায়ে নিজের ক্যামেরাটিও বিক্রি করে দিতে হয়েছে তাকে। মাত্র ৫১ বছর বয়সে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ১৯১৭ সালে প্রয়াত হন ভারতীয় সিনেমার এই অগ্রনায়ক। ক্যান্সার, অর্থকষ্ট ও হতাশা তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল জীবনের শেষ দিনগুলোতে।
বাংলা ফিল্ম জগতের পরম দুর্ভাগ্য যে, হীরালালের তোলা সমস্ত ছবিই ১৯১৭ সালে তার মৃত্যুর কয়েক দিন আগে আগুন লেগে ধ্বংস হয়ে যায়।