
আলী যাকের
মনটা বিষণ্নতায় ভরে গেল তার মৃত্যুর সংবাদ শুনে। একে একে গুণীজনরা আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। চলে গেলেন আলী যাকেরও। গত কয়েক বছর ধরে ক্যান্সারের সাথে লড়ছিলেন তিনি।
নভেম্বর মাসের প্রথম দিকে ফোনে কথা হয় যাকের ভাইয়ের সাথে। উদ্দেশ্য একটাই দেশকাল পত্রিকার শিল্পী দম্পতি বিভাগে সাক্ষাৎকার দেয়ার অনুরোধ করি। তার সাথে আমার দুইবার সরাসরি কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। একবার সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের বিজয় দিবস অনুষ্ঠানের কর্মিসভায় এবং আরেকবার এশিয়াটিকে আরেক বরেণ্য অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূরের কক্ষে। আমার সংগঠন স্বরূপ সাংস্কৃতিক সংসদের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর জন্য নূর ভাইয়ের কাছে গিয়েছিলাম শুভেচ্ছা বাণী আনতে। তখন নূর ভাই সরকারের মন্ত্রী ছিলেন না। বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের সভাপতি। আমি নূর ভাইয়ের কক্ষে সোফাতে বসেছিলাম।
আলী যাকের ও আসাদুজ্জামান নূর- দুইজন অন্য আলাপচারিতায় ব্যস্ত ছিলেন। তাদের কথা শেষে যখন যাকের ভাই বের হবার জন্য উঠে দাঁড়ালেন, তখন নূর ভাই আমাকে তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন এবং তাকে বললেন, ওর সংগঠনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর জন্য একটা শুভেচ্ছা বাণী দিও। নূর ভাইয়ের রুম থেকে বেরিয়ে আমি যাকের ভাইয়ের রুমে গেলাম। তখন লাঞ্চ টাইম ছিল। তিনি আমাকে তার সাথে বসিয়ে লাঞ্চ করালেন। সংগঠন সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিলেন এবং একটি শুভেচ্ছা বাণী লিখে দিলেন। এটি ২০১২ সালের কথা।
তারপর তার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। দেখা হলে সৌজন্য কথা হতো; কিন্তু এ বছর নভেম্বরে যখন শিল্পী দম্পতি বিভাগে সাক্ষাৎকারের ব্যাপারে কথা বলেছিলাম, উনি তাতে সম্মতি দিয়েছিলেন। আমার দুর্ভাগ্য দেশবরেণ্য গুণী এই শিল্পী দম্পতিকে নিয়ে লেখার আর কোনো সুযোগ থাকল না। আক্ষেপটা থেকেই গেল আমার।
ডাক নাম ছোটু। পুরো নাম আলী যাকের। মঞ্চ ও টিভি নাটকের অনন্য এক অভিনেতা। টেলিভিশন ও মঞ্চের পাশাপাশি চলচ্চিত্রেও রেখেছেন সুঅভিনেতার স্বাক্ষর। ১৯৪৪ সালের ৬ নভেম্বর চট্টগ্রামের তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক মোহাম্মদ তাহের ও তার স্ত্রী রিজিয়া তাহেরের ঘরে আলী যাকেরের জন্ম। চট্টগ্রামে জন্ম হলেও আলী যাকেরের পৈতৃক নিবাস ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে। বাবা মোহাম্মদ তাহেরের বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসের চাকরির সুবাদে ছেলেবেলায় এক শহর থেকে আরেক শহরে ঘুরে বেড়িয়েছেন আলী যাকের। ফেনী, খুলনা, কুষ্টিয়া ঘুরে বাবা যখন প্রাদেশিক সরকারের সচিব হলেন, তখন আলী যাকেরের পরিবার থিতু হয় ঢাকায়। সেন্ট গ্রেগরি থেকে ম্যাট্রিক ও নটর ডেম কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট করে আলী যাকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ বিভাগে ভর্তি হন।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেই জড়িয়ে পড়েন নাট্যচর্চায়, সেই সঙ্গে ছাত্ররাজনীতিতে। তিনি তখন ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। ছাত্র ইউনিয়ন মস্কোপন্থি ও পিকিংপন্থি দুই শিবিরে ভাগ হয়ে গেলে তিনি মতিয়া চৌধুরীর নেতৃত্বে মস্কোপন্থি ছাত্র ইউনিয়নে থাকেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া শেষ করে করাচিতে যুক্তরাজ্যভিত্তিক বিজ্ঞাপনী সংস্থা ডব্লিউ এস ক্রফোর্ডাসে ট্রেইনি এক্সিকিউটিভ হিসেবে আলী যাকেরের কর্মজীবন শুরু। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে যাত্রা শুরু হয় এশিয়াটিক থ্রিসিক্সটির, এ কোম্পানির চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আলী যাকের প্রথমে ভারতে গিয়ে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেন। চলচ্চিত্র পরিচালক ও সাংবাদিক আলমগীর কবির তাকে উদ্বুদ্ধ করেন প্রচারযুদ্ধে অংশ নিতে। তিনি যুক্ত হন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ইংরেজি বিভাগের অনুষ্ঠান প্রযোজক ও উপস্থাপক হিসেবে কাজ শুরু করেন আলী যাকের। যুদ্ধ যখন শেষের পথে তখন বন্ধু নাট্যকার মামুনুর রশীদকে জানালেন তার ইচ্ছার কথা। স্বাধীন দেশে নাটক করবেন তিনি।
তারপর ১৯৭২ সালে আলী যাকের আরণ্যক নাট্য দলের হয়ে মামুনুর রশীদের নির্দেশনায় মুনীর চৌধুরীর ‘কবর’ নাটকটিতে প্রথম অভিনয় করেন। এভাবে ১৯৭২ সালে আলী যাকেরের মঞ্চে পথচলা শুরু। এই নাটক দেখে পরে জিয়া হায়দার ও আতাউর রহমান তাকে নিয়ে যান তাদের দল নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ে। মৃত্যু পর্যন্ত আলী যাকের এই নাট্য দলের সভাপতি ছিলেন।
মঞ্চে নূরলদীন, গ্যালিলিও ও দেওয়ান গাজীর চরিত্রে আলী যাকেরের অভিনয় দর্শক প্রিয়। ‘বহুব্রীহি’, ‘তথাপি পাথর’, ‘আজ রবিবার’-এর মতো টিভি নাটকে অভিনয় করেও তিনি প্রশংসা পেয়েছেন। ‘অচলায়তন’, ‘বাকি ইতিহাস’, ‘সৎ মানুষের খোঁজে’, ‘তৈল সংকট’, ‘এই নিষিদ্ধ পল্লীতে’সহ বেশ কয়েকটি মঞ্চ নাটকের নির্দেশনা দিয়েছেন আলী যাকের। বেতারে অর্ধশতাধিক শ্রুতি নাটকেও কাজ করেছেন। অভিনয়, নির্দেশনার বাইরে তিনি ছিলেন একজন নাট্যসংগঠক; পাশাপাশি যুক্ত ছিলেন লেখালেখির সাথে।
নাটকে অবদানের জন্য ১৯৯৯ সালে সরকার তাকে একুশে পদকে ভূষিত করে। এছাড়া দীর্ঘ কর্মজীবনে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার, বঙ্গবন্ধু পুরস্কার, মুনীর চৌধুরী পদক, নরেন বিশ্বাস পদকসহ বিভিন্ন সম্মাননা পেয়েছেন আলী যাকের। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম ট্রাস্টি আলী যাকের যুক্তরাজ্যের রয়্যাল ফটোগ্রাফিক সোসাইটিরও সদস্য ছিলেন।
আলী যাকেরের স্ত্রী সারা যাকেরও মঞ্চ আর টেলিভিশনের এক সময়ের জনপ্রিয় অভিনেত্রী। তাদের বিয়ে হয় ১৯৭৭ সালে। তাদের দুই ছেলেমেয়ে ইরেশ যাকের ও শ্রেয়া সর্বজয়াও অভিনয়শিল্পী।