
‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এর বড় আকর্ষণ ছিলেন বব ডিলান ও জর্জ হ্যারিসন। জর্জ হ্যারিসন আটটি গান গেয়েছিলেন। এর একটি ছিল বব ডিলানের সঙ্গে। বব ডিলান গেয়েছিলেন পাঁচটি গান। এরপর দেশে দেশে মানবতার কল্যাণে কত বড় বড় কনসার্ট হয়েছে দুনিয়াজুড়ে; কিন্তু সেসবেরই পথিকৃৎ হয়ে আছে ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’
১৯৭১ সালের ১ আগস্ট নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনের ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এর প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন জর্জ হ্যারিসন। আর সেই কনসার্টে জর্জ হ্যারিসনের গাওয়া শেষ গান ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’ শতবার শোনার পরও এখনো আমাদের হৃদয়ে জেগে ওঠে মহান মুক্তিযুদ্ধের সেই সব স্মৃতি । আর চোখে পানি চলে আসে বারবার। এ জন্যই জর্জ হ্যারিসন এত বেশি প্রিয় বাংলাদেশিদের কাছে। বাংলাদেশের সঙ্গে একটা আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল জর্জ হ্যারিসনের। বাংলাদেশের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা আর গণহত্যা তার অন্তরকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল। তবে কনসার্টটির অন্যতম কারিগর রবিশঙ্করের কথা ভুললে চলবে না।
একাত্তরে বাংলাদেশের গণহত্যা, ধ্বংস আর হানাহানি বিপর্যস্ত করে তুলেছিল রবিশঙ্করকে। এ নিয়ে মনঃকষ্টে ছিলেন তিনি। অন্যদিকে জর্জ নিজের রেকর্ডিং নিয়েও ব্যস্ত ছিলেন। সত্তরে বিটলস ভেঙে যাওয়ায় নতুন করে জীবন গড়তে মনোযোগী হয়ে উঠেছিলেন তিনি। সেই সময়েই রবিশঙ্কর বাংলাদেশের জন্য তহবিল সংগ্রহে একটি কনসার্ট করতে চান। এই উদ্যোগে জর্জকে পাশে পেতে চান তিনি। জর্জেরও মনে হলো, এ কাজে তার যুক্ত হওয়া উচিত। তার ডাকে অনেকে সাড়া দেবে।
জর্জ কনসার্টের জন্য বব ডিলান, এরিক ক্ল্যাপটন, রিঙ্গো স্টার, লিওন রাসেল ও অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। বব ডিলান আর এরিক ক্ল্যাপটন অনুষ্ঠানের এক দিন আগে নিউইয়র্কে এসে উপস্থিত হন। আর ‘ইমাজিন’ গানের অমর শিল্পী জন লেনন অনুষ্ঠানের এক সপ্তাহ আগে তার অপারগতার কথা জানান জর্জকে। জর্জ হ্যারিসন কীভাবে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এর সঙ্গে জড়িয়ে গেলেন, এ বিষয়ে বেশ বিস্তারিত বলেছেন তার নিজের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ আই মি মাইন-এ। জর্জ হ্যারিসন ষাটের দশকের মাঝামাঝিতে (১৯৬৫) রবিশঙ্করের কাছে সেতারবাদন শিখতে শুরু করেন। একই সঙ্গে যোগসাধনাও করেছেন। ভারতে এসেছেন কয়েকবার। তিনি ভারতীয় দর্শন দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন; কিন্তু ১৯৬৮ সালে এসে জর্জ বুঝতে পারেন যে তার পক্ষে ভালো সেতারবাদক হওয়া সম্ভব নয়; কিন্তু তাদের মধ্যকার গুরু-শিষ্য সম্পর্ক ও বন্ধুত্ব শেষ জীবন পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।
আই মি মাইন বইয়ে জর্জ হ্যারিসন লিখেছেন, ‘মোদ্দা কথা হচ্ছে, বাংলাদেশের ঘটনাবলির ব্যাপারে আমরা দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলাম। আমরা যখন কনসার্টের প্রস্তুতি নিচ্ছি, মার্কিনরা তখন পাকিস্তানে অস্ত্র পাঠাচ্ছে। প্রতিদিন হাজার হাজার মৃত্যু হচ্ছে, কিন্তু সংবাদপত্রে শুধু কয়েক লাইন, ‘ও, হ্যাঁ, এখনো এটা চলছে।’ আমরা ব্যাপক মনোযোগ আকর্ষণ করতে পেরেছিলাম। এখনো বাঙালি রেস্তোরাঁয় এমন সব ওয়েটারের সঙ্গে আমার দেখা হয়, যারা বলেন, ‘ওহ, মিস্টার হ্যারিসন, আমরা যখন জঙ্গলে লড়াই করছিলাম, তখন বাইরে কেউ আমাদের কথা ভাবছে, এটা জানাটাও আমাদের জন্য ছিল অনেক কিছু।’
‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এর বড় আকর্ষণ ছিলেন বব ডিলান ও জর্জ হ্যারিসন। জর্জ হ্যারিসন আটটি গান গেয়েছিলেন। এর একটি ছিল বব ডিলানের সঙ্গে। বব ডিলান গেয়েছিলেন পাঁচটি গান। রিঙ্গো স্টার ও বিলি প্রেস্টন একটি করে গান করেছিলেন। লিওন রাসেল একটি একক এবং ডন প্রেস্টনের সঙ্গে একটি গান করেছিলেন। অনুষ্ঠানের শেষ পরিবেশনা ছিল জর্জ হ্যারিসনের সেই অবিস্মরণীয় গান ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’। গানটি লিখেছেন জর্জ হ্যারিসন এবং সুরও তার। গানের মূল কথাই ছিল বিশ্বের মানুষের কাছে বাংলাদেশের মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান। গানের কথায় এমন আবেদন ছিল যে ‘সকলের কাছে মিনতি জানাই আজ আমি তাই/ কয়েকটি প্রাণ এসো না বাঁচাই’ বা ‘এত যে বেদনা রাখি দূরে/দেবে না তোমার ক্ষুধিতকে রুটি সামান্য দুটি/মানুষগুলোকে সহায়তা দাও।’ জর্জ হ্যারিসন পুরো গানটা গেয়েছেন উচ্চ স্বরে করুণ বিলাপের সুরে গভীর মানবিক আবেদন নিয়ে। সে জন্য গানের সেই সুর আজও আমাদের উজ্জীবিত করে।
‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এর পর দেশে দেশে মানবতার কল্যাণে কত বড় বড় কনসার্ট হয়েছে দুনিয়াজুড়ে; কিন্তু সেসবেরই পথিকৃৎ হয়ে আছে ৪৯ বছর আগের ওই আসর। ২০০৫ সালে নতুন করে প্রকাশিত হয়েছে দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ অ্যালবামের ডিভিডি। দুটি ডিভিডির একটি সেট এখনো বিশ^জুড়ে বাজারে পাওয়া যায়। একটি সিডিতে রয়েছে পুরো গানের অনুষ্ঠান। আরেকটি সিডিতে রয়েছে শিল্পী-কলাকুশলীদের সাক্ষাৎকার, যাতে কনসার্টটি আয়োজনের নেপথ্য কাহিনি তুলে ধরা হয়েছে। আরও আছে মহড়ার কিছু চিত্র ও গান। এর সঙ্গে আছে একটি সচিত্র পুস্তিকা। এই ডিভিডি বিক্রির অর্থ যাচ্ছে জর্জ হ্যারিসন ফান্ড ফর ইউনিসেফে। এই নতুন ডিভিডির ভূমিকায় পন্ডিত রবিশঙ্কর বলেছেন, ৭৫ বছরের সংগীতজীবনে যত কনসার্ট করেছেন, তার মধ্যে সবচেয়ে স্মরণীয় হয়ে আছে ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনের ওই কনসার্টটিই।