
মিতা হক
মিতা হক নেই। গত ১১ এপ্রিল সকালবেলার রৌদ্র যতটা পশ্চিমে হেলেছিল ততটাই শোক যেন আছড়ে পড়ছিল। অনলাইনগুলো ভরে উঠেছিল শোক সংবাদে। সাংস্কৃতিক অঙ্গনে মুহূর্তেই আচড়ে পড়ছিল শোক।
বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো বিস্মিত হচ্ছিল স্বজন-শুভানুধ্যায়ীরা। তবুও মৃত্যুই অমোঘ এই সত্যতা নিয়ে ছুটে চলছিল তার লাশবাহী গাড়ি। একের পর এক প্রতিভাধর মানুষগুলো চলে যাচ্ছে।
বেলা ১১টায় মিতা হকের মরদেহ তার স্মৃতিভরা ছায়ানট সংস্কৃতিভবনে গেলে যে শোকের নদী উছলে ওঠে, তা দেখার মতো নয়। বহুদিনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী-শিক্ষার্থী, স্বজন, শুভানুধ্যায়ীরা ফুল দিয়ে মিতা হককে শেষ শ্রদ্ধা জানান। তার পছন্দের ছায়াঢাকা পাখি ডাকা গ্রামে মা-বাবার কবরের পাশে শেষ ঘুমে যান তিনি।
ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খান ও সনজীদা খাতুনের কাছে গান শেখেন তিনি। ১৯৭৬ সাল থেকে তিনি তবলাশিল্পী মোহাম্মদ হোসেন খানের কাছে গান শেখা শুরু করেন। তারপরে আর থামেননি। আমাদের দেশে শিল্পী নেহাত কম নয়। সুর ও সংগীতের সাধক কজন সেটা হাতের কর গুনে বলা যায়। মিতা হক ছিলেন বিরলপ্রজ এক সুরের সাধক। ওয়াহিদুল হকের সাধন ভজনের পথ ধরেই চলছিলেন তিনি। যিনি রবীন্দ্রনাথের দর্শন ধারণ করেছিলেন জীবনের পরতে পরতে। এমন শিল্পবোধের মানুষ, রবীন্দ্র সাধনের এমন আলোকবর্তিকাবাহী নির্মোহ মানুষটিকে আমরা অকালে হারালাম। এই শূন্যতা পূরণের নয়।
মিতা হক নিজের মতো করে একটি প্রতিষ্ঠান গড়তে চেয়েছিলেন, নাম সুরতীর্থ। একদম বাণিজ্যিক নয়। সেখানে অনেক স্কুলের মতো জামা-কাপড় বিক্রি হতো না। বিশুদ্ধ রবীন্দ্রচর্চা শেখানো হতো। শুধু গানই না, রবীন্দ্রনাথকে পড়ানো হতো, যাতে ছাত্ররা তাদের অনুভূতিতে রবীন্দ্রনাথকে ধারণ করতে পারে; কিন্তু সুরতীর্থ, ছায়ানট সব কিছু ফেলে তিনি আজ নিরন্তরের পথে।
আমাদের দেশের রবীন্দ্রচর্চার প্রেক্ষাপটে আমরা দেখি মুক্তিযুদ্ধের পরে অনেকেই রবীন্দ্রসংগীত চর্চা করেছেন। এর মধ্যে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের তপন মাহমুদ অন্যতম। তারপরে জনপ্রিয় ছিলেন পাপিয়া সারোয়ার (আরও অনেকেই এ চর্চায় ছিলেন আমি সংক্ষেপে বলছি); কিন্তু আশির দশকের শুরুতে রবীন্দ্রসংগীতে যারা জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন তারা সবাই শান্তি নিকেতন থেকে আসা। এদের মধ্যে ছিলেন রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, আমিনুর রহমান নিঝু ও সাদী মেহাম্মদ। এ সময় রবীন্দ্র সংগীত যেন নতুন করে প্রাণ পায়।
তারপরেই সংগীত জগতে পা রাখেন মিতা হক। উদাত্ত ও সুরেলা কণ্ঠ- সাধনায় সিদ্ধি লাভ করা এক প্রাণভরানো শিল্পীর গান দ্রুত মানুষকে মুগ্ধ করে। খুব স্বল্প সময়ে তিনি শ্রোতাদের মন জয় করেন। ১৯৯০ সালে বিউটি কর্নার থেকে প্রকাশিত হয় তার প্রথম রবীন্দ্রসংগীতের অ্যালবাম ‘আমার মন মানে না’, দুই শতাধিক রবীন্দ্রসংগীতে কণ্ঠ দিয়েছেন মিতা হক। এককভাবে মুক্তি পেয়েছে তার মোট ২৪টি অ্যালবাম। এর ১৪টি ভারত থেকে ও ১০টি বাংলাদেশ থেকে।
তিনি তার সাধন ভজনের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৬ সালে শিল্পকলা পদক লাভ করেন। সংগীতে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে ২০২০ সালে একুশে পদক প্রদান করেন।
কিন্তু নিরহংকতারী এই শিল্পী খুব ভেঙে পড়েন তার স্বামী খালেদ খানের মৃত্যুর পর। খালেদ খানের মৃত্যুর পর প্রাণবন্ত এই মানুষটি যেন পুষ্পবৃক্ষের মতো শুকিয়ে যাচ্ছিলেন। ধীরে ধীরে কিডনির অসুখ বাড়তে থাকে। তারপর করোনায় আক্রান্ত হয়ে ভালো হলেও দুর্বল হয়ে যান। আবার হাসপাতালে নিলে তিনি আর ফেরেননি।