
কবরী
বিদায় কথাটি বেদনাদায়ক। বৈশ্বিক মহামারিতে আমরা প্রিয়জনদের হারাচ্ছি। পুরো বিশ্ব যেন মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে।
দেশের স্বনামধন্য গায়িকা মিতা হকের শোক কাটিয়ে উঠতে না উঠতে করোনার কাছে পরাজিত হয়ে সবাইকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন ঢাকাই সিনেমার মিষ্টি হাসির মেয়ে কবরী।
একজীবনে এই মিষ্টি মেয়ে রুপালি পর্দার নায়িকা হিসেবে যতটা জনপ্রিয়তা পেয়েছেন তা মেপে দেখা কারও পক্ষে সম্ভব না। সত্তর ও আশির দশকে বাংলাদেশের গ্রাম-গঞ্জের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে শহুরে মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্তরাও কবরীকে যতটা নিজেদের মানুষ হিসেবে ভাবতে পেরেছিলেন, ততটা হয়তো বাংলাদেশের সিনেমা জগতে অন্য কোনো অভিনেত্রীর ক্ষেত্রে পারেননি। আর সেজন্যই ‘মিষ্টি মেয়ে’ নামে দর্শকদের কাছে জনপ্রিয় ছিলেন তিনি।
১৯৫০ সালে চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে জন্ম নেন মিনা পাল। তিনি ছোটবেলা থেকেই তার বাকি ১২ ভাইবোনদের ভিড়েও একদমই আলাদা ছিলেন। সেসময়ই তিনি নাচে, গানে অভিনয়ে ছিলেন অনবদ্য, যার ফলে মাত্র ১৩ বছর বয়সেই মঞ্চে নৃত্যশিল্পী হিসেবে ওঠেন এবং পরবর্তীতে টেলিভিশনে কাজ করার সুযোগ অর্জন করেন। চলচ্চিত্রে আসতেও সময় নেননি তিনি।
সে বছর কিংবদন্তি নির্মাতা সুভাস দত্ত তার নতুন ছবি বানাবেন, ছবির জন্য নায়িকা খুঁজছিলেন। ছবির নাম সুতরাং। এই সুতরাং ছবির নায়িকা চরিত্রের জন্যই মিনা পালকে মনে ধরে সুভাষ দত্তের। আর এভাবেই সুভাষ দত্তের হাত ধরে রুপালি পর্দায় পা রেখে মিনা পাল হয়ে ওঠেন কবরী। সুতরাং ছবিটি কবরীর অনবদ্য অভিনয় ও মিষ্টি হাসির গুণে যেমন ঝলমল করে উঠেছিল তেমনই কবরীকেও নিয়ে গিয়েছিল আবহমান বাংলার সিনেমাপাগল বাঙালি হৃদয়ে।
এখানেই ঘটনার শেষ নয়। প্রথম সিনেমা দিয়েই কবরী পরিচিতি পান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র অঙ্গনে, অর্জন করেন আন্তর্জাতিক খ্যাতি। কেননা ১৯৬৪ সালে নির্মিত এই সুতরাং চলচ্চিত্রটি ১৯৬৫ সালে ফ্রাংকফুট আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা দ্বিতীয় চলচ্চিত্রের সম্মান অর্জন করে। এক সিনেমা দিয়েই দেশ-বিদেশে আলোড়ন সৃষ্টিকারী কবরীকে এরপর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। একের পর এক তুমুল জনপ্রিয় চলচ্চিত্র উপহার দিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন সেসময়ের বাংলা চলচ্চিত্রের নির্ভরযোগ্য নায়িকা।
কখনো তিনি পর্দায় হাজির হন সারেং বৌ হয়ে, কখনো পার্বতী আবার কখনো বা শহরের কোনো এক রংবাজের জন্য ফুলের মালা নিয়ে বসে থাকা পাগল আহ্লাদী প্রেমিকা হিসেবে। এ সময়টি ছিল কবরীর শুধুই সামনে এগিয়ে যাওয়ার পালা। কবরীও সময় অপচয় করেননি। নীল আকাশের নিচে, সারেং বৌ, রংবাজ, দেবদাসের মতো একের পর এক ব্যবসাসফল ও কালজয়ী চলচ্চিত্র উপহার দিয়ে সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে উঠে যান জনপ্রিয়তার স্বর্ণ শিখরে।
কবরী তার সমসাময়িক প্রায় সব নায়কের সঙ্গেই জুটি বেঁধে ব্যবসাসফল ও প্রশংসিত চলচ্চিত্র উপহার দিয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ চিত্রনায়ক ফারুকের সঙ্গে তার অভিনীত ইতিহাস সৃষ্টিকারী চলচ্চিত্র সারেং বৌ কিংবা সুজন সখী এবং বুলবুল আহমেদের বিপরীতে অভিনীত দেবদাস চলচ্চিত্রের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। দেবদাস ছবিটিতে কবরীর অভিনয় এতটাই অনবদ্য ছিল যে, পরবর্তীতে আরো কয়েকবার দেবদাস চলচ্চিত্রটি নির্মিত হলেও কবরী অভিনীত পার্বতী চরিত্রটিকে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি কেউই।
এছাড়া চিত্রনায়ক সোহেল রানা প্রযোজিত ও অভিনীত থ্রিলার চলচ্চিত্র মাসুদ রানার কথাও বলা যেতে পারে। অবাক করা কথা হলো, এসব জুটিই ছিল সফল ও দর্শকনন্দিত।
তবে নায়ক রাজ রাজ্জাক-কবরী জুটির কথা কখনোই ভোলার নয়। নীল আকাশের নিচে, রংবাজসহ রাজ্জাক-কবরী অভিনীত ছবিগুলো এতটাই আলোড়ন তৈরি করেছিল যে, চলচ্চিত্র ইতিহাস জরিপ করে এই জুটিকে বোদ্ধারা সর্বকালের সেরা জুটি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। আর এই চলচ্চিত্রগুলোর মাধ্যমেই সাবলীল অভিনয় ও মিষ্টি হাসির গুণে মিষ্টি মেয়ে কবরী হয়ে উঠেছিলেন বাঙালির ঘরের মেয়ে, বাঙালির আপনজন।
এই মিষ্টি মেয়ে আজ আর পৃথিবীতে নেই। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে চলে গেলেন পৃথিবী ছেড়ে; কিন্তু মিষ্টি মেয়ে কী চাইলেই চলে যেতে পারে? মিষ্টি মেয়ে কবরী রয়েছেন এদেশের সব মানুষের হৃদয়ে আর মুক্তিযোদ্ধা কবরীকে খুঁজে পাওয়া যাবে এদেশের সবুজ ঘাসে, লাল সূর্যে। পতাকায় ভেসে উঠবে তার মিষ্টি হাসি।