
ফেরদৌস ওয়াহিদ ও আজম খান। ফাইল ছবি
বাংলাদেশের সংগীতের এক নতুন দিক উন্মোচনকারী কণ্ঠশিল্পী পপসম্রাটখ্যাত আজম খান। সেসময় বাংলা সংগীতের এই বিপ্লব সৃষ্টিতে আজম খানের সঙ্গে আরও যারা ছিলেন তারা হলেন সিরাজ সাঁই, ফকির আলমগীর, ফেরদৌস ওয়াহিদ ও পিলু মমতাজ।
আজম খান হলো বাংলাদেশের এমনই এক ব্যক্তি, যার মাথায় প্রথম নতুন আঙ্গিকে, সুরে, ঝংকারে, কথায়, ঢঙে সবকিছু নিয়েই গান ওর মাথায় আসে। ওকে সবাই বলে পপশিল্পী। আসলে ও রক। হি ইজ এ কিং অব রক। বব ডিলানের মতো। বব ডিলানতো পপ আর্টিস্ট না। মাইকেল জ্যাকসন পপ আর্টিস্ট। মাইকেল জ্যাকসন আর বব ডিলানের মধ্যে কিন্তু তফাৎ আছে। এই তফাৎটা ছন্দে, পারফরমেন্সে ও গানের কথায়।
রকের মধ্যে দেখবেন কোনো পোশাকের বালাই নেই, সাজগোজের বালাই নেই, চুলের বহরের বালাই নেই; কিন্তু তাদের গানের কথা এতই বেশি ভারি যা মানুষকে সেভাবে টানে। আজম খানের অবস্থা ঠিক তাই। যার কথার টানে ঢঙে মানুষ উত্তাল হয়ে যায়।
রবীন্দ্রনাথের একটি কথা আছে, বাংলাদেশের মানুষ শুধু গান শোনে কিন্তু ইউরোপের মানুষ গান শোনে, কেমন গাইলো, কেমন কথা সবই খেয়াল করে। আমাদের মধ্যে প্রথম আজম খানই বাঙালির মাঝে আমি বলব খুব সহজভাবে, খুব সাবলীলভাবে ঢুকে গিয়েছে। এটাই ওর কৃতিত্ব আমি বলব। আজম খানের সঙ্গে আমার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ছিল। ওর প্রথম রেকর্ড যখন বের হয় তখন ও জানে না কিন্তু আমি জানি। কোম্পানি ডেকে আমার হাতে দিয়েছিল রেকর্ডটি। আমি যখন রেকর্ডটি নিয়ে ওকে দিতে যাই ও বলল বন্ধু-বান্ধব ডাক, বসা। আমি বললাম কিছু খাওয়া, শিঙাড়া টিঙাড়া আনা। ও বলে, কি খাবি বল? আমরা ১০-১২ জন খেলাম। তারপর আমি রেকর্ডটি ওর হাতে দিলাম। ও একবার রেকর্ডটির দিকে তাকায় আবার একবার আমার দিকে তাকায়। সেদিন ওর ভিতরে আমি যে আনন্দ দেখেছি, মানুষ যখন নতুন কিছুর ছোঁয়া উপলব্ধি করে সেই অনুভূতি না দেখলে বোঝা যায় না। আমি ওর চোখে সেই আনন্দটা দেখেছিলাম।
যাই হোক ওর গান বাজারে এলো। তৎকালীন সময়ে ওর ৫০ হাজার রেকর্ড বিক্রি হলো। নতুন সুর, নতুন ঢং। আজম খানের গানে বাংলাদেশের আকাশ বাতাস ভরে গেল। হয়ে গেল এক নতুন বাংলাদেশের সূচনা, এক নতুন আলোড়ন। যে আলোড়নের নাম আজম খান। বাংলাদেশের মিউজিকে এই বিপ্লবের সূচনা করেছিল ফিরোজ সাঁই। ফিরোজ সাঁইকে ছাড়া ওর একার পক্ষে এতকিছু করা সম্ভব হতো না। আর ও এই বিপ্লবকে গতি দিয়েছে, মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছে। আর ওর এই রাজকীয় আগমনে মনে হয়েছিল রাজপুত্রের আগমন ঘটল বাংলাদেশের সংগীত অঙ্গনে।
আমি বলব বাংলাদেশের আকাশ যদি সংগীতের রাজ্য হয় তাহলে আজম খান সেই রাজ্যের রাজপুত্র যাকে আমরা বলি কিং অব পপ। আসলে ও হলো কিং অব রক। আমাকে ব্যক্তিগতভাবে যদি জিজ্ঞেস করেন তবে আমি বলব ও একজন চমৎকার বন্ধু এবং চমৎকার সাংস্কৃতি কর্মী ছিল। আমরা প্রায়ই একসঙ্গে রিকশায় ঘুরতাম। ও খুব রসিক ছিল। একবার ওর শো বেলা ৩টায় জোনাকি হলে। অর্থাৎ খুব কাছেই। হঠাৎ ও বলছে ‘আমার ভালো লাগছে না। আমি যাব না।’ তখন কেউ বলছে তাহলে গাড়ি পাঠাই? কেউ বলছে অ্যাম্বুলেন্স আনি। ও তখন বলল, ‘না, আমি ভ্যান গাড়িতে করে যাব। ও এইরকম সহজ সরল ও রসিক ছিল। ও এরকম মাঝে মাঝে করত। ওর এই জিনিসগুলো আমার খুব ভালো লাগতো।
আমার সবচেয়ে দুঃখের যেটি, ওর মৃত্যু ৫ তারিখ। আর আমি ১-২ তারিখের দিকে ওমরাহ হজ করতে চলে যাই। ওখান থেকে শুনি যে ও আর নেই। আমি তাকে পাইনি। তবে যাওয়ার আগে আমার সঙ্গে ওর ফোনে কথা হয়েছিল। ও আমাকে বলল, ‘দ্যাখ, চারদিকে যা হচ্ছে আমি তো কিছুই বলব না। তবে মাঠের অবস্থা ভালো না। তুই কিন্তু গান বাজনা ছাড়িস না।’ এখন আমিও গান বাজনা ছেড়ে দিয়েছি। ও বেঁচে থাকলে কারণটা ওকে বুঝিয়ে বলতাম। আমার কথা না হয় বাদই দিলাম।
একজন আজম খান যে এদেশের মানুষের এত তাকে নিয়ে আমার একটি দুঃখ আছে, ক্ষোভ আছে। দুঃখটা হলো সরকার যাও তাকে একুশে পদক দিল, মৃত্যুর পর। জীবিত অবস্থায় পেল না। ও নিজ হাতে পুরস্কারটি নিতে পারলে আমি সবচেয়ে বেশি আনন্দিত হতাম।