
দিলীপ কুমার
না ফেরার দেশে চলে গেলেন কিংবদন্তী অভিনেতা দিলীপ কুমার। জনপ্রিয় এই অভিনেতার বয়স হয়েছিল ৯৮। ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্যের মুম্বাইয়ের হিন্দুজা হাসপাতালে আজ বুধবার (৭ জুলাই) স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ৭টার দিকে তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার স্ত্রী অভিনেত্রী সায়রা বানু বিষয়টি গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করার পর থেকেই বলিউডে বইছে শোকের মাতম।
দিলীপ কুমারের জন্ম ১৯২২ সালে অবিভক্ত ভারতের পেশোয়ারে। বর্তমানে স্থানটি পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনওয়ালার অন্তর্ভুক্ত। তার পারিবারিক নাম ইউসুফ খান, তার মাতৃভাষা হিন্দকো। পাঠানদের অন্যতম গোত্র আওয়ান পরিবারের সন্তান তিনি। তারা ছিলেন ১২ ভাইবোন। বাবার নাম লালা গুলাম সরোয়ার। বাবা ছিলেন ধনাঢ্য ফল ব্যবসায়ী। পেশোয়ার ও মহারাষ্ট্রের দেওলালিতে ছিল নিজস্ব বাগান।
দিলীপ কুমার লেখাপড়া করেন দেওলালির বিখ্যাত বার্নস স্কুলে। ত্রিশ দশকের শেষ দিকে ইউসুফ খানের পরিবার স্থায়ীভাবে মুম্বাইয়ে বসবাস শুরু করে। চল্লিশের দশকের শুরুতে দিলীপ কুমার পুনেতে নিজস্ব ব্যবসা শুরু করেন। তিনি একটি ক্যান্টিন চালাতেন এবং স্থানীয় বাজারে শুকনো ফল সরবরাহ করতেন।
ব্যবসার কাজেই একসময় ইউসুফ খানের পরিচয় হয় সেসময়কার প্রখ্যাত সাইকোলজিস্ট ডা. মাসানির সাথে, যিনি তাকে কে পরিচয় করিয়ে দেন ‘বোম্বে টকিজ’এর মালিকের সাথে। ১৯৪৩ সালে বোম্বে টকিজ ইউসুফ খান যান চাকরি খুঁজতে, কিন্তু সেখানকার স্বত্বাধিকারী দেবিকা রানী তাকে অভিনেতার হওয়ার প্রস্তাব দেন। তার সিনেমার নাম বদলে দিলীপ কুমার রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
১৯৪৪ সালে মুক্তি পায় দিলীপ কুমারের প্রথম ছবি ‘জোয়ার ভাটা’। প্রথম দিকে দিলীপ কুমারের কয়েকটি ছবি ব্যবসা সফল ছিল না। ১৯৬০ সালে ভারতের ইতিহাসের অন্যতম ব্যবসাসফল সিনেমা ‘মুঘল এ আজম’ দিলীপ কুমারের ক্যারিয়ারে মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
দিলীপ কুমার তার ছয় দশকের ক্যারিয়ারে মাত্র ৬৩টি সিনেমায় অভিনয় করেছেন। কিন্তু তিনি হিন্দি সিনেমায় অভিনয় শিল্পকে নতুন রূপ দিয়েছিলেন। খালসা কলেজে পড়ার সময় দিলীপ কুমারের সহপাঠী ছিলো রাজ কাপুর। তারা ঘোড়ার গাড়িতে করে প্রায় ঘুরে বেড়াতেন। এসময় রাজ কাপুর পার্সি মেয়েদের সাথে ফ্লার্ট করতেন তখন দিলীপ কুমার এক কোনায় গিয়ে চুপ করে বসে থাকতেন এবং তাদের দিকে কমই তাকাতেন। কেউ জানতো না যে এই ব্যক্তিই একদিন ভারতীয় সিনেমাকে নীরবতার ভাষা সম্পর্কে শেখাবেন যা অনেক দীর্ঘ সংলাপের চেয়ে বেশি শক্তিশালী হবে।
বিখ্যাত গল্প লেখক সালিম তার এক লেখায় লেছেন, ‘দিলীপ কুমার যেসব চরিত্রে অভিনয় করতেন তার সূক্ষ্ণ বিষয়গুলো পর্দায় ফুটিয়ে তুলতেন এবং ইচ্ছাকৃতভাবে নীরব হয়ে যেতেন কিন্তু সেটাও দর্শকের ওপর গভীর ছাপ রেখে যেতো’।
মুঘল-ই-আযম ছবিতে প্রখ্যাত অভিনেতা পৃথ্বীরাজ কাপুরের চরিত্র ছিলো খুবই প্রভাবশালী ও বলিষ্ঠ। তার মতো করে আর কেউই চরিত্রটি ফুটিয়ে তুলতে পারতেন না। কিন্তু দিলীপ কুমার তার কণ্ঠকে নিচু স্বরে এমন অভিজাতভাবে ও দৃঢ়তার সাথে সংলাপ ছুড়ে দিতেন যা দর্শকের ভক্তি কুড়িয়েছে।
দিলীপ কুমার, রাজ কাপুর ও দেব আনন্দকে বলা হতো ‘ত্রিমূর্তি’ বা চলচ্চিত্রের তিন বিখ্যাত আইকন। কিন্তু দিলীপ কুমারের মতো বহুমাত্রিক অভিনয় দক্ষতা রাজ কাপুর ও দেব আনন্দের ছিলো না। রাজ কাপুরের রোল মডেল ছিলো চার্লি চ্যাপলিন আর দেব আনন্দ কখনো গ্রেগরি পেকের প্রভাব থেকে বেরুতে পারেননি।
গঙ্গা যমুনায় অশিক্ষিত এক গ্রামীণ চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন দিলীপ কুমার এবং সেখানেও তিনি এতো সাবলীল ছিলেন যেমনটি তিনি ছিলেন মুঘল-ই-আযমে প্রিন্স সেলিমের চরিত্রে।
দেবিকা রাণীর সাথে এক দুঃখজনক সাক্ষাৎ পরিবর্তন এনে দেয় দিলীপ কুমারের জীবন। যদিও চল্লিশের দশকে দেবিকা রাণী নিজেই ছিলেন ভারতীয় সিনেমার বিশাল তারকা। কিন্তু তারপরেও সম্ভবত হিন্দি সিনেমায় তার বড় অবদান হলো পেশওয়ারের ফল বিক্রেতার পুত্র ইউসুফ খানকে দিলীপ কুমারে পরিণত করা। সুদর্শন ইউসুফ খান প্রায়ই বোম্বে যেতেন সিনেমার শুটিং দেখতে এবং সেখানেই দেবিকা রাণীর চোখে পড়েন। তিনি দিলীপ কুমারের কাছে জানতে চান যে তিনি উর্দু পারেন কি-না। যখনি বললেন যে হ্যাঁ পারেন তারপরের প্রশ্নই ছিলো তুমি অভিনেতা হতে চাও কি-না। আর এর পরেরটুকু হলো ইতিহাস।
ইউসুফ খানের নাম পরিবর্তনের একটি বড় কারণ ছিলো যাতে করে তার রক্ষণশীল বাবা তার এই নতুন পেশার কথা যেন না জানতে পারেন। তার বাবা ফিল্ম পেশাজীবীদের নিয়ে তামাশা করতেন। মজার বিষয় হলো পুরো ক্যারিয়ারে দিলীপ কুমার মাত্র একবার মুসলিম চরিত্রে অভিনয় করেছেন এবং সেটি হলো মুঘল-ই-আযম।
তিনি অভিনয়ে নিজেকে পুরোপুরি চরিত্রের সাথে মিশিয়ে দিয়েছেন। উস্তাদ আব্দুল হালিম জাফর খানের কাছ থেকে কয়েক বছর সেতার শিখেছেন আর এটা করেছেন তিনি কোহিনূর সিনেমার একটি চরিত্রের জন্য যেখানে একটি গানের সাথে তাকে সেতার বাজাতে হতো। বিবিসির সাথে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, শুধু কিভাবে সেতার ধরতে হয় তা জানতে আমি কয়েক বছর ধরে সেতার বাজানো শিখেছি। এমনকি সেতারের তারে আমার আঙ্গুল আঘাত পেয়েছিলো।
একইসাথে দিলীপ কুমার টোঙ্গা (ঘোড়ার গাড়ি) চালনা শিখেছিলেন টোঙ্গা চালকদের কাছ থেকে। আর এটি তিনি করেছিলেন নয়াদৌড় সিনেমার একটি চরিত্রে অভিনয়ের জন্য। আর এসব কারণেই বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায় দিলীপ কুমারকে বলেছিলেন ‘মেথড অ্যাক্টর’ অর্থাৎ যিনি চরিত্রের সাথে মিশে যান।
দিলীপ কুমার লতা মুঙ্গেশকরের সাথে দ্বৈত সঙ্গীত গেয়েছেন যা সলিল চৌধুরী লিখেছিলেন হৃষিকেষ মুখার্জির মুসাফির ছবির জন্য।
দিলীপ কুমারের জীবনী লেখক মেঘনাথ দেশাই লিখেছেন, আমরা তার চুলের স্টাইল, পোশাক, সংলাপ ও আচরণগুলো অনুকরণ করতাম। পর্দায় তার চরিত্রটা আমরা আত্মস্থ করার চেষ্টা করতাম। তিনি সাদা রং পছন্দ করতেন। প্রায়ই সাদা জামা ও কিছুটা ঢোলা সাদা প্যান্ট পড়তেন। উর্দু কবিতা ও সাহিত্যে ব্যাপক আগ্রহ ছিলো তার। খুবই শিক্ষিত মানুষ ছিলেন তিনি, যিনি একই সাথে হিন্দি, উর্দু, ইংরেজি, পাঞ্জাবী ও পশতু ভাষা জানতেন। এমনকি মারাঠি, ভোজপুরি ও পার্সিয়ানও বুঝতেন ও কথা বলতে পারতেন।

দিলীপ কুমার তার তরুণ বয়সে ফুটবল খুব ভালোবাসতেন এবং উইলসন কলেজ ও খালসা কলেজের ফুটবল টিমের সদস্য ছিলেন। পরে ক্রিকেটে তার আগ্রহ তৈরি হয়। লখনৌর কেডি সিং বাবু স্টেডিয়ামে তিনি যখন মুশতাক আলী বেনিফিট ম্যাচ খেলছিলেন তখন ওই শহরেই তার গোপি সিনেমার প্রদর্শনী হচ্ছিলো। দিলীপ কুমার ব্যাডমিন্টনও খুব পছন্দ করতেন। সঙ্গীত পরিচালক নওশাদ উদ্দিন খাঁর সাথে প্রায়ই ব্যাডমিন্টন খেলতেন তিনি।
দীর্ঘ অভিনয় জীবনে পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার। সবচেয়ে বেশি পুরস্কারপ্রাপ্ত ভারতীয় অভিনেতা হিসেবে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসেও তার নাম রয়েছে।
১৯৯১ সালে পদ্মভূষণ পদক পেয়েছেন দিলীপ কুমার। ২০১৬ সালে তিনি পেয়েছেন ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খেতাব পদ্মবিভূষণ। তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং মুম্বাইতে তার বাসায় গিয়ে পদক হাতে তুলে দেন। এর আগে ১৯৯৫ সালে পেয়েছেন দাদাসাহেব ফালকে পুরষ্কার। অন্যদিকে ১৯৯৭ সালে পাকিস্তান তাদের সর্বোচ্চ খেতাব নিশা-ই-ইমতিয়াজ দেয় দিলীপ কুমারকে। তিনি নিয়মানুযায়ী ভারতের প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ীর কাছ থেকে ওই পদক গ্রহণের জন্য অনুমতি নিয়েছিলেন।
ভারত-পাকিস্তানের বৈরিতা কমিয়ে দুদেশের সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের জন্য দীর্ঘদিন কাজ করছেন এই অভিনেতা। বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে মিলে কাজ করেছেন সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের সেবায়। ভারতের রাজনীতিকদের বাইরে আফগানিস্তানের রাজা জহির শাহ এবং ইরানের শাহ রেজা পেহলভীও তার খুব ভালো বন্ধু ছিলেন।
১৯৬৬ সালে বলিউডের আরেক সাড়া জাগানো অভিনেত্রী সায়রা বানুকে বিয়ে করেন দিলীপ কুমার। তাদের বয়সের পার্থক্য তখন ২২ বছর। এই দম্পতির কোনো সন্তান নেই।