
জুয়েল আইচ ও বিপাশা আইচ
জাদু, শিল্পের একটি অন্যতম শক্তিশালী মাধ্যম। যে শিল্পদর্শনের মধ্য দিয়ে আত্মনিমগ্ন হওয়া সহজ। জাদু দেখার এক-দুদিন পর্যন্ত সেই আবহে নিমজ্জিত থাকতে হয়। এই গোলক ধাঁ-ধাঁ কাটিয়ে ওঠা সহজ নয়। শৈশবে আমরা যে জাদু দেখেছি, সেটাকে অ্যামেচার বললে ভুল হবে না। স্কুলের শুরুতে, সার্কাসের মধ্যে বা অন্য কোনো উৎসব অনুষ্ঠানের মধ্যে জাদু প্রদর্শনের বিষয়টি ছিল; কিন্তু এটিকে একটি পূর্ণাঙ্গ শো’র রূপ দিয়েছেন জাদুকর জুয়েল আইচ।
এক কথায় বলা যায়, জাদুকে যিনি বিনোদন থেকে পূর্ণাঙ্গ শিল্পের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন। হুমায়ূন আহমেদ তার উপন্যাস ‘ম্যাজিক মুনশি’র উৎসর্গে কয়েকটি লাইন লিখেছেন। ‘জুয়েল আইচ, জাদুবিদ্যার এভারেস্টে যিনি উঠেছেন। এভারেস্টজয়ীরা শৃঙ্গ বিজয়ের পর নেমে আসেন; কিন্তু ইনি নামতে ভুলে গেছেন’- কথাটি জুয়েল আইচের বেলায় একদম যথার্থ। জুয়েল আইচ কথা বললে মনে হয় জাদু, বাঁশি বাজালে মনে হয় এটাও তো জাদু! আর সবসময় মুখে তো লেগেই থাকে হাসির জাদু। বিশ্বের শিল্পাসরে বাংলাদেশকে তুলে ধরেছেন, নতুন এক আঙ্গিকে। দেশমাতৃকার এই বীরসন্তান ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধেও অংশ নিয়েছিলেন। এক কথায় বলতে গেলে জুয়েল আইচ শুধু একজন জাদুকরই নন বহুমাত্রিক শিল্পের অধিকারী। তিনি একজন বংশীবাদক, চিত্রশিল্পী, চিত্রকর ও লেখক। একাধারে এত গুণ থাকা সত্ত্বেও একদম নিরহংকারী তিনি। জাদুশিল্পে তার অসামান্য কীর্তির জন্য শুধু দেশেই নয়, পুরো বিশ্বে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করে চলেছেন এই সদা হাস্যোজ্জ্বল মানুষটি।
জুয়েল আইচের অনেক গুণের মধ্যে বাঁশি তার আরেক নেশা। আশ্চর্য রকমের সুরেলা তার বাঁশি। জাদুর মতোই মোহনীয় আবেশে বুঁদ করে রাখে তার সৃষ্ট সুর মূর্ছনা। গল্পচ্ছলে বলেন, ছোটবেলায় প্রতিবেশী নিতাই কৈবর্তের কাছে বাঁশির হাতেখড়ি নিয়েছিলেন। পরবর্তীতে ওস্তাদ আবদুর রহমানের কাছে অনেক দিন শেখেন। পণ্ডিত হরিপ্রসাদ এবং পণ্ডিত রবিশঙ্করের সঙ্গে বেশ ভালো সখ্য গড়ে ওঠে জুয়েল আইচের। বাঁশি বাজানোর সুবিধার জন্য নিজেই একটি বাঁশি তৈরি করলেন যার নাম দিলেন ‘জুয়েল বাঁশি’। তিনি খুব ভালো শিক্ষক ছিলেন। এলাকার খ্যাতিমান শিক্ষক, উচ্চাঙ্গ সংগীতের শিল্পী, চিত্রকর হলেও তিনি আন্তর্জাতিক মানেরই হতেন; কিন্তু সব কিছু রেখে আন্তর্জাতিক মানের এই জাদুকরের জীবনের বাঁক, গতিপথ বদল করে শেষে এসে স্থিত হয়েছে জাদুতে; কিন্তু বাকি ইতিহাস শুনতে হয় এক সূর্য গ্রহণের দিনে। উত্তরার ১১নম্বর সেক্টরের বাড়িতে। যেখানে স্ত্রী বিপাশা আইচ, কন্যা খেয়াকে নিয়ে তার সংসার।
জুয়েল আইচের জন্ম ১৯৫২ সালের ১০ এপ্রিল পিরোজপুর জেলার সমুদয়কাঠি গ্রামে। গ্রামটি এখন স্বরূপকাঠি উপজেলার ভেতরে। বাবা বি কে আইচ পেশায় ছিলেন ব্যবসায়ী। মা সূর্য আইচ নিপাট গৃহিণী। সংসারের সব দায়িত্ব একা হাতেই সামাল দিতেন তিনি। জাদু সম্বন্ধে তার আগ্রহ ছিল শৈশব থেকেই। শৈশবের বর্ণনা দিতে গিয়ে জুয়েল আইচ বলেন, সারাদিন হৈ চৈ করে দিন কাটাতে ভালো লাগতে তার। কাকাতো, নিজের ভাইবোন মিলে কম ছিলেন না তারা। ভাই-বোনদের সঙ্গে খাওয়া দাওয়া, গ্রামের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়িয়ে বর্ণাঢ্য শৈশব ছিল তার। গল্প বলার আসর বসতো। রাজা-রানী, দৈত্য, রাক্ষস, ভূত এসবের গল্প বলা হতো সে আসরে। গল্পের ভেতর বন্ধ বোতলের ছিপি থেকে বেরিয়ে আসা দৈত্যের গল্প তার মনে দাগ কাটতো। এসব গল্পই তার ভেতরে জাদুকর হওয়ার বীজতলা নির্মাণ করে। প্রতি বছর শীতে তাদের গ্রামে নদীর ঘাটে বেদের বহর এসে থামতো। বেদেদের কাজ ছিল সাপ খেলা দেখানো পাশাপাশি জাদুও দেখানো। তখন বেদের সম্পর্কে অনেক কথা প্রচলিত ছিল। বিশেষত সবার বিশ্বাস ছিল বেদেরা নানা ধরনের জাদুমন্ত্র জানে। জাদুর কথা শুনে জুয়েল আইচের ইচ্ছে হলো বেদেদের কাছ থেকে জাদু দেখবেন; কিন্তু তারা এমনিতে তো জাদু দেখাবে না। চাই এক সের চাল। অতঃপর মাকে ধরে একসের চাল দিয়ে জাদু দেখা। এভাবেই ভেতরে ভেতরে একটি জাদুকর সত্তা বিভিন্নভাবে তার ভেতরে বাসা বাঁধতে থাকে। খুব ছোটবেলা বাড়িতে বেদেবহর এসেছিল, তাদের কাছেই প্রথম জাদু দেখে ভালো লেগে যায় জুয়েল আইচের। সেই ভালোলাগা ভালোবাসায় পরিণত হয়। তারপরে বানারীপাড়া সার্কাস দলের এক জাদুকরের গলা কাটার জাদু দেখে তিনি যারপর নাই আলোড়িত হন। পরে ওই জাদুটিই এক বন্ধুর ওপর প্র্যাকটিস করে কিছুটা সফলও হন। জাদুর প্রতি তার ভালোবাসাটা উন্মাদনায় পরিণত হয় সিরাজগঞ্জের জাদুকর আবদুর রশিদের জাদু দেখে, আর বন্দে আলী মিয়ার রূপকথা পড়ে-একটু একটু করে জাদু শিখতে লাগলেন তখন থেকেই, বিভিন্নজনের কাছে। তার বিখ্যাত জাদু কাগজ থেকে ডলার বানানো, চোখ বেঁধে গাড়ি চালানো, কাটা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ জোড়া লাগানো ইত্যাদি।
১৯৬৫ সালের কথা, পিরোজপুরে আসে বিখ্যাত সার্কাস দল। জুয়েল আইচ তখন নবম শ্রেণির ছাত্র। ‘সাধনা লায়ন সার্কাস’। ওই সার্কাসে জাদু দেখান জাদুশিল্পী প্রফেসর আবদুর রশিদ। তার জাদু দেখে বিমোহিত হয়ে যান জুয়েল আইচ। অনুষ্ঠানের পর ভয়ে ভয়ে দেখা করলেন জাদুকরের সঙ্গে। আবদুর রশিদ জুয়েল আইচের ভেতরে জাদুর মোহ দেখতে পেয়ে সম্ভবত তিনি জহর খানা চিনেছিলেন। তাই আগ্রহে জুয়েল আইচকে তার জাদুর বিভিন্ন কৌশল দেখাতে লাগলেন। সেটাই ছিল জুয়েল আইচের জাদুবিদ্যার প্রথম হাতেখড়ি। এর পরে আসে মুক্তিসংগ্রামের দিন। পেয়ারা বাগানে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন তিনি।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এলাকায় ফিরে আসেন জুয়েল আইচ। এর মধ্যে ১৯৭২ সালে জগন্নাথ কলেজ (বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে তিনি স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। স্থানীয় সমুদয়কাঠি উচ্চবিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদানের মধ্য দিয়ে শুরু হয় তার কর্মজীবন। শিক্ষকতার পাশাপাশি জুয়েল আইচের জাদুর অনুশীলনীও চলতে থাকে পুরোদমে; কিন্তু জাদুর যন্ত্রপাতি ও অনুশীলনীর জন্য তার একটি নিরিবিলি জায়গার প্রয়োজন ছিল। স্থানীয় বন্ধু নিটুল কর তার জন্য নিজের বাড়ির একটি অংশ ব্যবহার করতে দিলেন। তখন জুয়েল আইচের জাদু প্রদর্শনী, গবেষণা, প্রশিক্ষণ ও অনুশীলনীর যাবতীয় উপকরণ ওই বাসাতেই রাখা ছিল। ১৯৭৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঘটল আরেক দুর্ঘটনা। রাতের আঁধারে কিছু দুর্বৃত্ত নিটুলের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায় বাড়িঘরসহ জুয়েল আইচের যাবতীয় জিনিসপত্র। এতে অসম্ভব ভেঙে পড়লেও দমে যাননি জুয়েল আইচ। শিক্ষকতা পেশা ছেড়ে দিয়ে পুনরায় জাদুর সরঞ্জাম তৈরির কাজে লেগে পড়েন তিনি। ১৯৭৭ সালেই নিজ এলাকা ছেড়ে ঢাকায় চলে আসেন।
বিপাশা আইচের সঙ্গে পরিচয়, প্রেম-ভালোবাসা ও পরিণয়-পরিণতি নিয়ে প্রশ্ন করলে একগাল হেসে শেষের শব্দটিকেই টেনে নিয়ে আগে উত্তর দিলেন, কথাটা ভালোই বলেছ, পরিণতি...! পরিণতি তো হলোই শেষ পর্যন্ত।’ পরের অংশে বিপাশা আইচ বলেন, বাবা বিভিন্ন কলেজে প্রিন্সিপাল হিসেবে কাজ করেছেন। তখন পিরোজপুরে ছিলাম। পিরোজপুরে ছিল জুয়েলের বাড়ি। আব্বুর কলেজে পড়ার সুবাদে জুয়েলের সঙ্গে বাবার খাতির। আমার ভাইয়ের সঙ্গেও ওর পরিচয় ছিল। বাসায় মাঝে মাঝে আসত।’
কিন্তু বিয়ে হলো কীভাবে? ‘বাসায় এলে দেখা-সাক্ষাৎ হতো, কথা হতো। তার কথা শুনতে ভালো লাগত। অন্যদিকে ওরও আমাকে ভালো লেগেছিল। সেটি একসময় ও প্রকাশ করেছিল। এভাবে তো একসময় বিয়েই হয়ে গেল’- সোজাসাপ্টা কথাগুলো বলে চললেন বিপাশা।
‘আসলে ও না বলে প্রকাশ করেছে আর আমি বলে প্রকাশ করেছি। আর চিঠি লেখা হয়েছে। ওই সময় তো সেলফোনের কোনো বালাই ছিল না। ওদের বাড়িতেও ল্যান্ডফোনও ছিল না। জুয়েল আইচ মজা করে কথাগুলো বললেন। এরপর কথার পিঠে কথা টেনে স্ত্রীর কথার ছোট্ট করে জবাব দিলেন, ‘ও কখনো চিঠির রিপ্লাই দেয়নি।’
বিয়ের আগে জুয়েল আইচ মধ্যপ্রাচ্য, আমেরিকা জয় করে আসা শিল্পী। আর বিপাশা আইচের কথা যদি বলি, তবে একথা অনস্বীকার্য যে একজন জুয়েল আইচকে পেতে এরকম একজন বিপাশারই দরকার। কীভাবে জাদুশিল্পের সঙ্গে জড়ালেন সেকথা জিজ্ঞেস করলে বিপাশা আইচ বলে ওঠেন- জাদুশিল্পের সঙ্গে তার একাকার হওয়ার গল্প। বিয়ের ৫/৬ দিন পরই ছিল জুয়েল আইচের জাদুর শো। সবাই রিহার্সাল করছে। ছোটাছুটি দৌড়াদৌড়ি তার মধ্যে বিপাশা আইচ দেখলেন তাকে কেউ কিছু বলছে না। তারপর তিনি নিজেই ঢুকে গেলেন কাজে। এবার তিনিই হয়ে ওঠেন দলের আসল অধিকর্তা। মানে সিদ্ধেশরী ইডেন কলেজ পেরিয়ে সোজা জাদুর মঞ্চে। জুয়েল আইচ ও বিপাশা আইচ জুটি জাদুকে শিল্পের রূপান্তরের মিথস্ক্রিয়ার সমান্তরাল ইতিহাস।
বিপাশা আইচের জন্ম বরিশালের আগৈলঝাড়া থানার খাজুরা গ্রামে, তার মামাবাড়ি এলাকার সুপরিচিত তালুকদার বাড়িতে। তার বাবার বাড়ি ছিল বাগের হাটের কচুয়াতে। বাবা অধ্যাপক দরবেশ আলী ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক। মা হোসনেয়ারা খান। বাবা প্রথমে পিরোজপুর সরকারি কলেজে অধ্যাপনা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। সেই কারণে মামাবাড়ির সঙ্গে যোগাযোগটা ভালো ছিল। তবে স্কুলে প্রথম পিরোজপুর ভর্তি হলেও পরে ঢাকায় চলে আসেন এবং ভর্তি হন অগ্রণী গার্লস স্কুলে। এরপরে বদরুন্নেসা কলেজ, সবশেষে ইডেন কলেজ। তিনি হাসতে হাসতে বলেন মূলত জীবনের লক্ষ্য ছিল লরা ইঙ্গলস ওয়াইল্ডার হওয়া; কিন্তু তা না হয়ে জুয়েল আইচকে বিয়ে করে ম্যাজিক করে জীবন পার করছি। কন্যা খেয়া ও জুয়েল আইচকে নিয়ে এখন সংসার।
জুয়েল আইচের জীবনে মনে রাখার মতো একটি অন্যতম জাদু হচ্ছে বৈদ্যুতিক কলে মানুষ কেটে সেই মানুষকে বাঁচানো। জুয়েল আইচের ভাষায় এটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। সময়ের সঙ্গে পুরোপুরি না মিললে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে; কিন্তু করাত কলে কাটা হবে কাকে? দলের সবাই সংশয়ে। এসময় মঞ্চে এলেন বিপাশা আইচ স্বয়ং। বিপাশা আইচকে টেবিলের ওপর শোয়ানো হলো এবং বৈদ্যুতিক করাত বারবার পরীক্ষা করে দেখা হলো। তখন আর কারও বুঝতে বাকি নেই জুয়েল আইচ কাকে দ্বিখণ্ডিত করতে চলেছেন। বৈদ্যুতিক করাত যখন নিচে নামানো হলো তখন বিপাশা কিছুটা চমকে উঠলেন। সঙ্গে সঙ্গে জুয়েল আইচ বিড়বিড় করে যেন কিছু বললেন। আবার বিপাশাকে ঘুম পাড়িয়ে বৈদ্যুতিক করাতকে নিচে নামানো হলো এবং বিপাশাকে দ্বিখণ্ডিত করা হলো। একটি কাচের আয়না বিপাশার দ্বিখণ্ডিত শরীরের মাঝে প্রবেশ করিয়ে দর্শকদের প্রমাণ দেখানো হলো। দর্শকরা উত্তেজনায় তখন আনন্দের চাইতে অনেক বেশি আতঙ্কিত ও কৌতূহলী হয়ে উঠেছিলেন। এরপর বিপাশার দেহ জোড়া লাগানোর পালা। জাদুকর বারবার হাতের ঘড়ির দিকে সময় দেখতে লাগলেন। বিপাশা জেগে উঠছেন না। জাদুকরের কপালে কিছুটা চিন্তার ঘাম যেন সকলের চোখে পড়লো। জাদুকরের মতো সমস্ত দর্শক অতি উৎকণ্ঠিত, বার বার ঘড়ি দেখছেন বরেণ্য জাদুকর। ঘেমে যাচ্ছেন তিনি। অবশেষে স্বস্তির নিঃশ্বাস। দর্শকদের হতবাক করে দিয়ে এবং অনেকটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে জাগিয়ে তুললেন বিপাশাকে। সেই থেকে সবার কাছে ভালো লাগা অতিমানবীয় একজন চরিত্র জাদুকর জুয়েল আইচ। এটাই তাকে সহযোগিতা করা আমার জীবনের সেরা জাদু বললেন বিপাশা।
প্রশ্ন করলাম, অনেক শোতেই দেখা যায় জুয়েল আইচ বাঁশি বাজাচ্ছেন আর পাশে দাঁড়ানো আপনি বাঁশির সুরে তন্ময় হয়ে ধীরে ধীরে চোখ বুঁজে ফেলেন। একসময় বাঁশির সুর বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আপনি ধীরে ধীরে শূন্যে ভাসেন। এটা কীভাবে সম্ভব? এটিই তো ম্যাজিক... হেসে ওঠেন তিনি। সব কিছু বলে দিলে তো আর রহস্য থাকবে না। বহুবার এই ম্যাজিক মঞ্চস্থ হয়েছে দেশে ও দেশের বাইরে।
এবারে জুয়েল আইচকে আবার জিজ্ঞেস করি তার প্রথম জাদু দেখানোর ঘটনা। সেটা তার এলাকায়, ১৯৭২ সালে। ততদিনে পিসি সরকারের লেখা ‘ম্যাজিকের খেলা’ ও আরেক জাদুশিল্পী আলাদিনের লেখা ‘অভিনব ম্যাজিক’ গ্রন্থ দুটি পড়ে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত। নিয়মিত প্র্যাকটিস চলছে। বিদেশি বই পড়ে নতুন প্র্যাকটিস চলছে, এসময় একদিন ঠিক হলো মঞ্চে জাদু দেখাবেন জুয়েল আইচ। স্থান, জলাবাড়ি বাজার। শোয়ের দিনে ভিড় উপচে পড়ছে, পাশের গ্রাম জলাবাড়ি হাটের বাজারে। জাদু দেখালেন জুয়েল আইচ। সবাই মুগ্ধ হলেন। এলাকার অযুত মানুষের হাততালি আর বুক ভরা ভালোবাসায় সিক্ত জাদুকর ভেতরে ভেতরে সেদিনই জাদুকর হয়ে উঠেছিলেন। সেদিনের কথা আজও ভোলেননি তিনি। এরপরে ১৯৭৩ সালে তার জাদুর শো হয় বরিশালে। সেখানেও বিপুল জনপ্রিয়তা পান। বিচিত্রার শেষ প্রচ্ছদে কভার করা হয় জুয়েল আইচের ছবি দিয়ে। আসলে তখন তার উত্থান পর্ব চলছে। ১৯৭৭ সালে বিটিভির ঈদ আনন্দমেলায় আবদুল্লাহ আবু সাঈদ মঞ্চে আনলেন জুয়েল আইচকে। এরপরে তার উপস্থাপনায় সাপ্তাহিক অনুষ্ঠান চতুরঙ্গে জুয়েল আইচ নিয়মিত হলেন। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন জুয়েল আইচ।
এরপর অনেক জল গড়িয়েছে। আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো সব ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ এই গুণী শিল্পী বহু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তার আন্তর্জাতিক পুরস্কারের মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সেরা জাতীয় পুরস্কার বেস্ট ম্যাজিশিয়ান অব দ্য ইয়ার। সোসাইটি অব আমেরিকান ম্যাজিশিয়ান ১৯৮১ সালে তাকে এ পুরস্কারে ভূষিত করে। এ ছাড়া ইংল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ফ্রান্স, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে পুরস্কৃত হন তিনি। জাদুশিল্পের পাশাপাশি উচ্চাঙ্গ সংগীতের ওপরে ঢাকায় এবং চলচ্চিত্র তৈরির ওপরে যুক্তরাষ্ট্রের হলিউড ফিল্ম স্কুল থেকে গ্র্যাজুয়েশন করেছেন। জুয়েল আইচ ইউনিসেফের পক্ষে গুডউইল অ্যাম্বাসেডর হিসেবে শিশুদের জন্য জনমত ও সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে নিয়মিত কাজ করছেন।
একটা সময় টিভির বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিয়মিত জাদু প্রদর্শন করতে দেখা গেলেও গত কয়েক বছর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না তাঁকে। কারণ কী? জানান, ‘ঈদকে উপলক্ষ করে টিভিতে একসঙ্গে তিনটি অনুষ্ঠান করেছি। দীর্ঘদিন ধরেই তো জাদুশিল্পের সঙ্গে জড়িত। এখন যেটি হয়েছে, ম্যাজিকের ক্ষেত্রে আমি ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড অনুসরণ করি। গত কয়েক বছর হলো বড় বড় ভেন্যু ছাড়া আমি শো করছি না। এটার কারণও সেই ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড বজায় রাখার চেষ্টা। এটি করতে গিয়ে শোর বাজেটও অনেক বড় হয়ে যায়; কিন্তু ম্যাজিককে একটি স্ট্যান্ডার্ড জায়গায় নিয়ে যাওয়ার পর তা থেকে তো নেমে আসা যায় না। তবে, দেশের বাইরে কিন্তু গত কয়েক বছরে অনেক পারফর্ম করেছি।
জুয়েল আইচকে জিজ্ঞেস করি বিপাশা আইচ আপনার কাজে কেমন সহায়ক। বললেন, দলের অধিকর্তা যেমন সহায়ক হন। আসলে সংসার সামলানো থেকে জাদু প্রদর্শন সবখানেই বিপাশা আইচ। জুয়েল আইচ করোনাকালে আক্রান্ত হয়েছিলেন, অসুস্থ ছিলেন অনেক দিন। তারপর থেকে তিনি নিয়মিত জাদু প্র্যাকটিস, লেখা, আঁকা, বাঁশি বাজানো নিয়েই থাকেন। জুয়েল আইচের প্রিয় জাদুশিল্পী ডেভিড কপারফিল্ড আর বিপাশা আইচের প্রিয় জাদুশিল্পী জুয়েল আইচ।
‘জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময়ে কাউকে পাশে পাওয়া যায় না। তখন শুধু পাশে থাকে নিজের পরিবার। সেই পরিবারের যত্ন নেওয়ার দায়িত্বটা কিন্তু পুরুষ হিসেবে আমাকেই প্রথম বহন করতে হবে। প্রতিটি নারী এবং সন্তান তার স্বামী আর বাবা-মাকে দায়িত্ববান এবং ত্যাগী হিসেবে দেখতে চায়’- এভাবেই পারিবারিক বন্ধনের ভিতকে মূল্যায়ন করলেন জাদুশিল্পী।
স্বামী হিসেবে জুয়েল আইচ কেমন জিজ্ঞেস করলে বিপাশা আইচ বলেন, স্বামী হিসেবে, মানুষ হিসেবে জুয়েল তুলনাহীন। আমার ভাবতে অনেকে ভালো লাগে যে জুয়েলের মতো একজন মানুষকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়েছি। একইভাবে বাবা হিসেবেও সে অসাধারণ। কারণ আমাদের মেয়ে খেয়ার সঙ্গে আমার চেয়ে ওর শেয়ারিংটা ভালো।
এবার বিপাশা আইচকে বলি, দাদা আপনার কাজে কেমন সহায়ক। তিনি আবার হাসি দিয়ে বলেন একদম না। বললাম মাসের টাকাতো হাতে তুলে দেন। এবারও হাসি দিয়ে বললেন তাও না।
দাম্পত্য জীবনে দ্বন্দ্ব, কলহ, বিয়ে বিচ্ছেদ এটিকে কীভাবে দেখেন জানতে চাইলে দুজনেই একমত হলেন, একজন আরেকজনের দায়িত্ব নিয়ে না জানলে এই সম্পর্কে না জড়ানোই ভালো। বিপাশা বললেন, শুধু আমরা দু’জনতো নই, আমাদের সন্তানের ভবিষ্যৎ, দু’জনের পরিবারের মানসম্মানও জড়িত এর সঙ্গে। পরিবার, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব কাউকে ছোট করার অধিকার আমাদের নেই বরং আমরা যদি তাদের কাছে আদর্শ হতে পারি; তাহলেই পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের উপকার আসবে। এই বোধটুকু প্রত্যেক দম্পতির থাকা উচিত। তাহলেই দেখবেন দাম্পত্যে কলহ ও বিয়ে বিচ্ছেদের মতো নেতিবাচক দিকগুলো দূর হয়ে যাবে।
দু’জনকে বলি জাদু তাহলে কি, আপনাদের মুখেই শুনতে চাই। বিপাশা আইচ বলেন, জাদু জীবন সংগ্রাম ও শিল্পের মিথস্ক্রিয়া। কথা শেষ হয়। উটের গ্রিবার মতো রাত গলা বাড়ায়। সোড়িয়াম বাতির নিচে আমি আর দশটা মানুষের ভিড়ে ভেতরে মাস্ক পরা এক অপরিচিত মানুষ হয়ে যাই।