Logo
×

Follow Us

বিনোদন

ন্যান্সি

এলেন দেখলেন জয় করলেন

Icon

রাফিউজ্জামান রাফি

প্রকাশ: ১৯ আগস্ট ২০২১, ০৯:৫৬

এলেন দেখলেন জয় করলেন

নাজমুন মুনিরা ন্যান্সি

গান অনেকেই গায়। তবে সবার গান কী আর মনকে ছুঁতে পারে? না, পারে না। আজকাল অধিকাংশ গানই কান পর্যন্ত পৌঁছে থেমে যায়। মন পর্যন্ত যাওয়ার সক্ষমতা তাদের হয় না। তবে কিছু কিছু কণ্ঠ আছে যেন পরশ পাথর। সে কণ্ঠের ছোঁয়া পেলে যে কোনো গান হয়ে যায় সোনা। এমন কণ্ঠের গান শুধু কান পেতে নয়, ভালো লাগে মন দিয়ে শুনতে। মূলত এরাই শিল্পী। ঠিক এমনই মন দিয়ে শোনার মতো গান করেন কণ্ঠশিল্পী ন্যান্সি। যার কণ্ঠে সৃষ্টিকর্তা যেমন দিয়েছেন সুরের সৌরভ, তেমনই দিয়েছেন সীমাহীন মুগ্ধতা ও মায়ার আঁচড়। আর সেই মুগ্ধতা ছড়িয়ে তিনি বাংলাদেশের সংগীত অঙ্গনে রানীর মতো করে রাজত্ব করে চলেছেন দেড় যুগ সময় ধরে। আর এই দীর্ঘ সময়ে সংগীতশিল্পী ন্যান্সির গান মায়াবী আবেশ ছড়িয়ে যেমন অনুরাগীদের বন্দি করে রেখেছে মুগ্ধতার মায়াজালে; তেমনই বাংলা সংগীতের ভাণ্ডারকেও করে তুলেছে সমৃদ্ধ। কোথায় নেই ন্যান্সির শ্রোতা? কোথায় বাজে না ন্যান্সির গান? শহরের বিলাসবহুল প্রাসাদের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষ যেমন দখল করে আছেন ন্যান্সি, তেমনই ধূলিমাখা মেঠো পথের দু’ধারে বিছিয়ে থাকা গ্রামবাংলার আনাচে-কানাচেও দখলদারিত্ব চালাচ্ছে তার গান। অর্থাৎ উঁচু থেকে নিচু সকল শ্রেণির শ্রোতাদেরই নিজের গান দিয়ে দোলা দিয়ে যান তিনি। আজকাল একজন কণ্ঠশিল্পীর কাছে একটি শ্রোতাপ্রিয় গান অর্জন যেখানে মহা তপস্যার বিষয়; সেখানে সংগীতের এই রানী নিয়মিত শ্রোতাপ্রিয় গান উপহার দিয়ে যাচ্ছেন। যার ধারাবাহিকতা এই দেড় যুগ পরে এসেও আগের মতোই চির সবুজ। 

পুরো নাম নাজমুন মুনিরা ন্যান্সি। জন্ম দাদা বাড়ি যশোরের নড়াইলে। তবে জন্ম নড়াইলে হলেও ন্যান্সির বেড়ে ওঠা নেত্রকোনায়। সরকারি চাকরিজীবী বাবা নঈমুল হকের ছিল বদলির চাকরি। বদলিজনিত কারণেই তাকে সপরিবারে একসময় নেত্রকোনায় চলে আসতে হয়। সেসময় পরিবারের সবার সঙ্গে ছোট্ট ন্যান্সিও চলে আসেন নেত্রকোনার সাতপাইতে। এখানেই কেটেছে তার শৈশব, পেরিয়েছে কৈশোরের দিনগুলো। গানের সঙ্গে ন্যান্সির সখ্য ছোটবেলা থেকেই। তার দিনের শুরুই হতো গান গেয়ে। তবে তার মতে সেই দিনগুলো ছিল ভীষণ যান্ত্রিক। রোজ তার দিনের শুরু হতো ভোর ৪টায়। বিছানা ছেড়েই বসতে হতো রেওয়াজে। একঘণ্টা রেওয়াজ শেষে শুরু হতো তার পড়াশোনা, স্কুল, হোম টিউটর, নাচের ক্লাস, ছবি আঁকা ও গানের ক্লাস। ঠিক এভাবেই কেটে যেত রাত ১০টা পর্যন্ত। তবে এত কঠোর নিয়মের মাঝেও ছোটবেলায় ন্যান্সির দুষ্টুমিও থেমে ছিল না। ছিলেন ভীষণ দুষ্ট। বড় ভাইয়ের সঙ্গে খুঁটিনাটি ঝগড়াঝাটি-মারপিট লেগেই থাকত তার। পেছন ফিরে সেই দিনগুলো এখন খুব মিস করেন ন্যান্সি।

সংগীতের সঙ্গে সখ্য ছোটবেলায় হলেও এদেশের সংগীত ভুবনে ন্যান্সির উত্থান ২০০৬ সালে। তখনো নেত্রকোনায় থাকেন। গান তার সবসময়ের সঙ্গী হলেও তিনি কখনো ভাবেননি যে তার উত্থানটা ঠিক এভাবে হবে। এভাবে এত দ্রুত মূলধারার শিল্পী হিসেবে কাজের সুযোগ পেয়ে যাবেন। এটি ছিল অনেকটা গল্পের মতো। নেত্রকোনায় থাকাকালীন একবার একটি ঘরোয়া পরিবেশে গান পরিবেশন করছিলেন ন্যান্সি। তার গান শুনতে অনেকের মতো সেখানে উপস্থিত ছিলেন ন্যান্সির মামাও। মামার সঙ্গে তার এক বন্ধুও উপস্থিত ছিল সেদিনের সেই গানের আসরে। মামার সেই বন্ধুটি আর কেউ নন। এদেশের সংগীত অঙ্গনের পরিচিত মুখ, বাংলাদেশের স্টাইলিশ পপ শিল্পী হিসেবে খ্যাত তুমুল জনপ্রিয় ফেরদৌস ওয়াহিদ। কথায় আছে অভিজ্ঞ জহুরী খাঁটি হীরা চিনতে কখনোই ভুল করেন না। সেদিনের সে আসরে গান শুনে ফেরদৌস ওয়াহিদও নেত্রকোনার সেই সাধারণ মেয়েটির মাঝে আগামী দিনের সংগীতের আকাশের এক দ্যুতিময় তারকাকে চিনতে ভুল করেননি। তিনি ন্যান্সির গানে এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে ন্যান্সির মাথায় হাত বুলিয়ে আশীর্বাদ করে এসেছিলেন। ঢাকায় ফিরে এসে ফেরদৌস ওয়াহিদ তার ছেলে সংগীত পরিচালক হাবিব ওয়াহিদকেও বলেছিলেন ন্যান্সির কথা।

হাবিব তখন সম্ভাবনাময় এক তরুণ সংগীত পরিচালক। কয়েকবছর হলো সংগীত পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন কেবল। এরই মধ্যে নিজের প্রতিভার সাক্ষর রাখতে শুরু করেছেন। তার হাবিব ফিচারিং কায়া অ্যালবামটি তখন সারাদেশের আনাচে কানাচে তুমুল জনপ্রিয়। রাস্তায়, গলির মোড়ে ও মানুষের মুখে মুখে তখন ফিরছে হাবিবের সংগীত পরিচালনায় কায়ার কণ্ঠে বাউল আব্দুল করিমের গান ‘কৃষ্ণ’। আস্তে আস্তে জমে উঠছে তার পসার। তারই ধারাবাহিতায় একদিন এক সিনেমার গানের সংগীত পরিচালনার কাজ আসে হাবিবের নিকট। সিনেমাটির পরিচালক এস এ হক অলীক। অলীক নাটকের পরিচালক হিসেবে পরিচিত। তিনি জীবনের প্রথম একটি সিনেমা বানাবেন। সিনেমাটির নাম হৃদয়ের কথা। এই সিনেমারই গান তৈরি করতে তিনি এলেন হাবিবের কাছে। এটি ছিল হাবিবেরও প্রথম সিনেমার কাজ। হৃদয়ের কথা চলচ্চিত্রের ‘ভালো বাসবো বাসবো রে’ শিরোনামের গানটির শেষের দুই লাইন পরিচালক অলীকের চাহিদা অনুযায়ী কোরাস কণ্ঠ দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। আর এই কোরাস ভয়েসের জন্যই হাবিব তার পিতাকে জানান তার দু-তিনজন কোরাস ভয়েস দরকার। এই কোরাস ভয়েস দিতেই হাবিবের স্টুডিওতে আগমন ঘটে ফেরদৌস ওয়াহিদের আশীর্বাদ করে আসা নেত্রকোনার সেই মেয়েটি- যার নাম ন্যান্সি। এই কোরাস ভয়েস নিতে গিয়েই হাবীবের নজরে আসে ন্যান্সির কণ্ঠ।

তার ভাষ্যমতে, সাধারণত যেভাবে কোরাস ভয়েস নেওয়া হয় তিনি সেভাবেই নিচ্ছিলেন; কিন্তু ন্যান্সি মাইক্রোফোনের সামনে কোরাস লাইন দুটি গাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাবিব যেন নড়ে বসেন। এমন অসাধারণ কণ্ঠ মন ছুঁয়ে যায় হাবিবের। তিনি মনে মনে বলতে থাকেন আরে এ তো সাংঘাতিক কণ্ঠ! কোথায় ছিল এতদিন এই প্রতিভা! সেদিনের সেই কোরাস ভয়েস দেওয়ার পালা শেষ হলেও হাবিব ঠিকই মনে রেখেছিলেন ন্যান্সির মুগ্ধতা ছড়ানো মায়া জড়ানো কণ্ঠটি। এর কিছুদিন পরেই একটি জিঙ্গেলে কণ্ঠ দেওয়ার জন্য আবার ন্যান্সিকে ডাকেন তিনি। জিঙ্গেলটিতে পর্দায় অপি করিম ঠোঁট মেলান ন্যান্সির কণ্ঠের সঙ্গে। ন্যান্সি যেন এসেছিলেনই নিজের কণ্ঠের মাধুর্য দিয়ে সবাইকে অবাক করে দিতে, চমকে দিতে। কোরাস ভয়েস দিতে গিয়ে তার কণ্ঠ যেমন অবাক করে দিয়েছিল হাবিবকে, তেমনই জিঙ্গেলে দেওয়া তার কণ্ঠ সেবার অবাক করে দিয়েছিল বিজ্ঞাপন সংশ্লিষ্টদের। তারা ন্যান্সির কণ্ঠের মিষ্টতায় এতটাই অবাক হয়েছিলেন যে, কৌতূহল সামলাতে না পেরে হাবিব ওয়াহিদের কাছে জানতে চেয়েছিলেন কণ্ঠটি কলকাতার কোনো কণ্ঠশিল্পীর কিনা। 

কথায় আছে স্রষ্টা যাকে দেন তাকে কেউই থামিয়ে রাখতে পারে না। স্রষ্টা যেন ভালোবেসেই ন্যান্সিকে এমন নিখুঁত একটি কণ্ঠ দিয়েছিলেন, যে কণ্ঠের যাদুতে সবাইকে মোহিত করে তিনি উন্মোচিত করে গেছেন একের পর এক সুযোগের দুয়ার। এমনই একটি সুযোগ ন্যান্সির হাতে এসে ধরা দেয় ২০০৮ সালে। হাবিব ওয়াহিদ আবার ডাকেন ন্যান্সিকে। তবে এবার আর কোনো কোরাস গানে কিংবা জিঙ্গেলে কণ্ঠ দিতে না। ন্যান্সি এবার ডাক পান গোটা একটি গানে কণ্ঠ দিতে। গানটি ছিল হৃদয়ের কথা খ্যাত পরিচালক এস এ হক অলীকের দ্বিতীয় সিনেমা ‘আকাশ ছোঁয়া ভালোবাসার একটি গান। হাবিবের সুর ও সংগীতায়োজনে এই গানটিতে তার সহশিল্পী হিসেবে কণ্ঠ দেন হাবিব নিজেই। যদিও কোরাস গানের মাধ্যমে ইতিপূর্বে ন্যান্সির চলচ্চিত্রে অভিষেক ঘটেছিল; কিন্তু এই গানের মাধ্যমেই চলচ্চিত্রে এবং সংগীত অঙ্গনে পরিপূর্ণ অভিষেক ঘটে ন্যান্সির। এই গানটি ছিল ন্যান্সির ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট। কেননা গানটি প্রকাশের পর যা হলো তা দেখে মনে পড়ে যায় জুলিয়াস সিজারের বিখ্যাত উক্তিটি। আজ থেকে দুই হাজার বছর আগে খ্রিষ্টপূর্ব ৪৭ সালে জুলিয়াস সিজার মাত্র চার ঘণ্টায় প্রায় বিনা বাধায় দখল করে নিয়েছিলেন পন্টুস রাজ্যটি। এত সহজে কম সময়ে এমন জয়ের পর সিজার মুখ দিয়ে মাত্র তিনটি শব্দ উচ্চারণ করেছিলেন। তা হলো, ভিনি, ভিডি, ভিসি। যার অর্থ এলাম, দেখলাম, জয় করলাম। চলচ্চিত্রটি মুক্তির আগেই চলচ্চিত্রের ‘পৃথিবীর যত সুখ’- গানটি এতটাই জনপ্রিয়তা অর্জন করে যে রাতারাতি তারকা বনে যাওয়া ন্যান্সির ক্ষেত্রেও বলা যায়, তিনি এলেন, দেখলেন, জয় করলেন। সবাই বুঝতে পারলেন বাংলা সংগীত অঙ্গনে নতুন এক সম্রাজ্ঞীর আবির্ভাব ঘটছে, যিনি এদেশের সংগীত অঙ্গন শাসন করবেন এক দীর্ঘ সময় ধরে। আকাশ ছোঁয়া ভালোবাসা চলচ্চিত্রে তার এমন ধুন্ধুমার সাফল্যর পরপর একই বছর ন্যান্সি আরও দুটি চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দেন। এই চলচ্চিত্র দুটির একটি হলো নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ পরিচালিত আমার আছে জল এবং মুরাদ পারভেজ পরিচালিত চন্দ্রগ্রহণ। এই চলচ্চিত্র দুটিতেও বরাবরের মতো নিজের সফলতা ধরে রাখেন ন্যান্সি। বিশেষ করে চন্দ্রগ্রহণ চলচ্চিত্রের গানটির কথা না বললেই নয়। এই গানটি তো ‘আকাশ ছোঁয়া ভালোবাসা’ চলচ্চিত্রের ন্যান্সির গাওয়া গানটির মতোই গ্রাস করে নেয় সারা বাংলা! বাংলা গানের শ্রোতারা আবারও দুলতে থাকে ন্যান্সির সুরের দোলায় ‘তোমারে দেখিলো পরানো ভরিয়া’। শ্রোতারা যখন ন্যান্সির এমন সুরের মায়াজালে বন্দি ঠিক তখনই ন্যান্সি নিয়ে আসেন তার প্রথম একক অডিও অ্যালবাম ‘ভালোবাসা অধরা’। ১০টি গান দিয়ে সাজানো প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সংগীতার ব্যানারে মুক্তিপ্রাপ্ত এই অ্যালবামটিও ছিল ন্যান্সির সফল একটি অ্যালবাম। অ্যালবামটির সব গানই শ্রোতাপ্রিয় হয় এবং মানুষের মুখে মুখে ফিরতে থাকে। এ বছরই ন্যান্সি দেখা পান তার ক্যারিয়ারের আরেকটি চির সবুজ গানের। এই গানটির নাম দ্বিধা, ‘বাহির বলে দূরে থাকুক, ভেতর বলে আসুক না’। গীতিকার মারজুক রাসেলের লেখা এই গানটি ব্যবহৃত হয় মোস্তফা সরোয়ার ফারুকী পরিচালিত চলচ্চিত্র থার্ড পার্সন সিঙ্গুলার নম্বরে। গানটিকে ন্যান্সির ক্যারিয়ারের আরেকটি সোনালি অর্জন বলে অভিহিত করা যেতে পারে। কেননা মুক্তির পরপরই থার্ড পার্সন সিঙ্গুলার নম্বর চলচ্চিত্রটি যেমন তুমুল দর্শকপ্রিয়তা অর্জন করে, তেমনই ন্যান্সির গাওয়া দ্বিধা গানটিও ভীষণ শ্রোতাপ্রিয় হয়। এই গানটি ন্যান্সির ক্যারিয়ারকেই শুধু শক্তিশালী করেনি, তাকে এনে দেয় প্রথমবারের মতো মেরিল প্রথম আলো সেরা নারী কণ্ঠশিল্পীর পুরস্কার। পুরস্কার সম্মাননা অনেক সময় শিল্পীর পরবর্তী অর্জনের আগ্রহকে ভোতা করে দিলেও ন্যান্সির বেলায় ঘটে তার উল্টো। পুরস্কার লাভের পর আরও ক্ষুরধার হয়ে ওঠেন ন্যান্সি। আর তার স্বাক্ষর রাখেন পরবর্তী গানগুলোতে। 

উদাহরণ স্বরূপ সেসময় ন্যান্সির গাওয়া খোঁজ : দ্য সার্চ সিনেমার ‘এতদিন কোথায় ছিলে’ এবং ভালোবাসলেই ঘর বাঁধা যায় না চলচ্চিত্রের ‘বুকের ভিতর গান’ দুটির কথা বলা যেতে পারে। দ্বিধা-পরবর্তী এই গান দুটিও ন্যান্সির রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে ওঠা গানগুলোর মাঝে অন্যতম। এই জনপ্রিয়তা অর্জনের মাধ্যমেই কেটে যায় ২০১০ তথা ন্যান্সির ক্যারিয়ারের সফল চারটি বছর। 

২০১১ সালে তিনি কণ্ঠ দেন মোস্তফা কামাল রাজ পরিচালিত প্রজাপতি চলচ্চিত্রের দুটি গানে। গান দুটির শিরোনাম ডুব এবং দুই দিকে বসবাস। এই গান দুটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে লুফে নেয় শ্রোতারা। এই গান দুটি ছিল ন্যান্সির ক্যারিয়ারের অনন্য কীর্তি। এই চলচ্চিত্রটি তার ক্যারিয়ারে আজীবন স্মরণীয়-বরণীয় হয়ে থাকবে। কেননা প্রজাপতি নামক এই সিনেমার গানই তাকে এনে দেয় একজন শিল্পীর সর্বোচ্চ কাঙ্ক্ষিত স্বীকৃতি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। পুরস্কার, অর্জন ও প্রাপ্তির পাশাপাশি সেবছর ন্যান্সি আরও একটি চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দেওয়ার মাধ্যমে বছরটি শেষ করেন। সেই চলচ্চিত্রটির নাম ‘কে আপন কে পর’। তবে ন্যান্সিকে কখনোই পর হতে হয়নি। বরং দিনে দিনে শ্রোতারা তার সুন্দর সুন্দর গানের জন্য তাকে আরও আপন করে নিয়েছেন। ন্যান্সিও তার প্রতিদান স্বরূপ প্রতিটি গানে ঢেলে দিয়েছেন তার কণ্ঠের সবটুকু সুধা। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১২ সালে ন্যান্সি তার কণ্ঠের মুগ্ধতা ঢেলে দেন নিজের দ্বিতীয় একক অ্যালবামটিতে। হাবিব ওয়াহিদের সুর ও সংগীতে নয়টি গান দিয়ে সাজানো রঙ নামের এই অ্যালবামটির ফলাফল ছিল বেশ সুখকর। কেননা ঝরা পাতা উড়ে যায়সহ এই অ্যলবামের বাকি সব গানই শ্রোতাদের বেশ সমাদর পায়। অ্যালবামের এই গানগুলো যখন আনাচে কানাচে রাজত্ব করছে, দখলদারি চালাচ্ছে শ্রোতাদের হৃদয়ে ঠিক তখন এর রেশ কাটতে না কাটতেই তিনি ভক্তবৃন্দদের রাঙিয়ে দেন ভালোবাসার রঙে। এবার তিনি কণ্ঠ দেন ভালোবাসার রঙ চলচ্চিত্রের দুটি গানে। গান দুটি হলো ‘গভীরে আরও গভীরে’ এবং ‘ভালোবাসার চেয়ে একটু বেশি’।

চলচ্চিত্রটি মুক্তির পরপরই পর্দায় মাহিয়া মাহির ঠোঁটে ন্যান্সির এই গান দুটি এতটাই জনপ্রিয়তা অর্জন করে যে, গভীরে আরও গভীরে গানটি যেন ন্যান্সিকে শ্রোতাদের হৃদয়ের আরও গভীরে স্থান করে দেয় আর ভালোবাসার চেয়ে একটু বেশি গানটি যেন ন্যান্সির সুরেলা কণ্ঠটিকে শ্রোতাদের ভালোবাসার চেয়েও আরও একটু বেশি ভালোবাসতে বাধ্য করে। শ্রোতারা যখন ন্যান্সির কণ্ঠের রঙে নিজেদের রাঙিয়ে গান দুটির মাঝে হাবুডুবু খাচ্ছেন, ঠিক সেসময়ই ন্যান্সিকে আবারও দেখা যায় অডিও অ্যালবামে। ন্যান্সি এবার তার তৃতীয় একক অ্যালবাম বাজারে নিয়ে আসেন। একই বছর আরও একটি অডিও অ্যালবামে ধরা দেন ন্যান্সি। এটি ছিল একটি দ্বৈত অ্যালবাম। ঝগড়ার গান শিরোনামের এই অ্যালবামটিতে ন্যান্সির সঙ্গে কণ্ঠ দিয়েছেন দেশের আরেক জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী আসিফ আকবর। বিগত বছরগুলোর মতো এই বছরটিও ছিল ন্যান্সির প্রাপ্তির বছর, এই বছরটি ছিল ন্যান্সির অর্জনের বছর। কেননা অ্যালবাম দুটির সাফল্যের পর এ বছরই ন্যান্সি পঞ্চমবারের মতো ঘরে তোলেন মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার। আর এটি সম্ভব হয় পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেমকাহিনী চলচ্চিত্রের ‘আকাশ হতে আমি চাই’ গানটির জন্য। পর্দায় জয়ার ঠোঁটে ন্যান্সির এই গানটি শুধু বিচারকদের মন জয় করে পুরস্কারই এনে দেয়নি, পাশাপাশি শ্রোতাদের মনও জয় করে নিয়েছিল। তবে এখানেই শেষ নয়।

সময়ের সঙ্গে গানের মানুষ ন্যান্সি হেঁটেছেন এবং হাঁটছেন গানের হাত ধরেই। গানও তাকে দিয়েছে দু’হাত ভরে। বাড়িয়েছে তার ক্যারিয়ারের সৌরভ, করেছে সৌন্দর্যমণ্ডিত ও সমৃদ্ধ। বানিয়েছে বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের ঘরের মানুষ। ন্যান্সিও বিন্দুমাত্র নিরাশ করেননি শ্রোতাদের। গানে গানে ভরিয়ে দিয়েছেন দেশসহ দেশের বাইরের বিভিন্ন প্রান্তে বসবাসকৃত বাংলা ভাষাভাষী মানুষের হৃদয়। গানে মুগ্ধ হয়ে তার গান কাছে থেকে শুনতে শ্রোতারাও তাকে ডেকে নিয়ে গিয়েছেন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এবং দেশের বাইরে আয়োজিত গানের অনুষ্ঠানগুলোতে। শ্রোতাদের ডাকে সাড়া দিয়ে ন্যান্সিও দেশে বিদেশে বিভিন্ন স্টেজ শোতে মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন নিজের কণ্ঠের কারুকার্যে। শ্রোতাদের বুঁদ করে রেখেছেন গানের মায়াবী জাদুতে। যার ধারা এখনো ঠিক আগের মতোই অব্যাহত আছে। 

স্টেজ শো, ফোনো লাইভ কনসার্ট, জিংগেল, অডিও এবং প্লেব্যাক সর্বত্রই আপন কণ্ঠশক্তির বলে সমানভাবে আধিপত্য বিস্তার করলেও চলচ্চিত্রের গানের মাধ্যমে উঠে আসা এই সংগীত শিল্পী সবচেয়ে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন চলচ্চিত্রের গানে। তার মতে, বড় পর্দায় সিনেমার পাত্র পাত্রীদের ঠোঁটে নিজের কণ্ঠ শুনতে পাওয়ার অনুভূতিই নাকি অন্যরকম। চলচ্চিত্রে প্লেব্যাককৃত ন্যান্সির গানের সংখ্যা দেড় থেকে দুই শতাধিক হবে। আর সবচেয়ে আশ্চর্যজনক কথা হচ্ছে তার গাওয়া এই গানগুলোর অধিকাংশই পেয়েছে শ্রোতাপ্রিয়তার তকমা যা সবার ক্ষেত্রে সচরাচর দেখা যায় না। আর এই প্রাপ্তি তাকে পৌঁছে দিয়েছে সাফল্যের সর্বোচ্চ শিখরে যেখানে শুধুই ন্যান্সি, যেখানে শুধুই ন্যান্সির আধিপত্য, যেখানে তাকে ধরাছোঁয়ার মতো আর কেউই নেই। ন্যান্সির প্লেব্যাক করা চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে উপরোল্লিখিত ছাড়াও উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রগুলো হলো দ্য স্পিড, জিরো ডিগ্রি, সুইট হার্ট, নিয়তি, এইতো প্রেম, ওয়ার্নিং প্রভৃতি। 

অডিও অ্যালবামেও ন্যান্সির রাজত্বটা রানির মতো। ক্যারিয়ারে ৫টি একক অ্যালবাম রয়েছে তার। এ ছাড়া অসংখ্য মিক্সড অ্যালবামে কণ্ঠ দিয়েছেন তিনি।। দ্বৈত গানে ন্যান্সির চাহিদা সর্বদাই সহশিল্পীদের কাছে আকাশচুম্বী। হালের জনপ্রিয় থেকে শুরু করে নবাগত সকল কণ্ঠশিল্পীই তার সঙ্গে দ্বৈত গান করতে ভীষণ আগ্রহী। ন্যান্সি বিমুখ করেন না কাউকেই। হালের আরেফিন রুমী, ইমরান, বেলাল খান, কাজী শুভদের সঙ্গেও যেমন তিনি গান করেন, তেমনই নতুনদেরও ফিরিয়ে দেন না। এক্ষেত্রে নতুন কণ্ঠশিল্পীদের আশ্রয়স্থলও বলা যেতে পারে তাকে। এ জন্য কথাও শুনতে হয় ন্যান্সিকে। অনেকে ন্যান্সির এই নতুনদের সঙ্গে গাওয়াটাকে খুব একটা সহজভাবে নেন না এমনকি নিষেধও করেন; কিন্তু মানবিক গুণসম্পন্ন কণ্ঠশিল্পী ন্যান্সি বিষয়টিকে দেখেন অন্যভাবে। তিনি জানেন আমাদের সংগীত অঙ্গনে একটি নেতিবাচক প্রবণতা রয়েছে। প্রবণতাটি হলো, নতুনদের অবজ্ঞা করা এবং পুরনোদের ছুঁড়ে ফেলা। ন্যান্সির নতুনদের সুযোগ দেওয়ার অন্যতম কারণ মানসিকতা দূর করার একটি প্রচেষ্টা। কেননা তিনি মনে করেন আজ নতুনদের সাদরে আমন্ত্রণ জানালে এই মানসিকতার বিস্তার রোধে তা অনন্য ভূমিকা পালন করবে। 

সংগীত শিল্পী হিসেবেও যেমন ন্যান্সি অনন্য তেমনি ব্যক্তিজীবনেও তার জুড়ি নেই। ন্যান্সির কাছে সবার আগে তার পরিবার। পরিবারের জন্য সবকিছু পাশে সরিয়ে রাখেন। উদার মনের কণ্ঠশিল্পী ন্যান্সি কিছুদিন আগে তার ছোটভাইকে নিজের দুটি বসতবাড়ি দান করে দিয়েছেন। তার এই উদারতা পরিবারের সদস্যদের প্রতি তার ভালোবাসা। 

ব্যক্তিজীবনে ন্যান্সির দুটি কন্যাসন্তান রয়েছে। তার বড় মেয়ে রোদেলা এরই মধ্যে মায়ের পদাংক অনুসরণ করেছেন। সম্প্রতি বাজারে তার একটি মৌলিক গান এসেছে। গানটির শিরোনাম ‘আমি উড়ে যেতে চাই’। এহসান রাহী ও মহসিন মেহেদীর লেখা এবং মীর মাসুমের সংগীতে ঈগল মিউজিকের ব্যানারে প্রকাশিত এই গানটি এর মধ্যেই বেশ সাড়া ফেলেছে। গানটি শুনে মুগ্ধ হয়ে হাবিব ওয়াহিদ, কিশোর দাসসহ সংগীত জগতের অনেকেই রোদেলার জন্য শুভকামনা জানিয়েছেন। 

কবি হেলাল হাফিজ দুঃখ চান এবং তার প্রত্যাশা হলো, তার জীবনে যেটুকু সুখস্মৃতি রয়েছে সেটুকুর বিনিময়েও তিনি দুঃখ কিনতে চান। কেননা একমাত্র শোক বা দুঃখই একজন শিল্পীর শিল্পমেধাকে আরও ক্ষুরধার করে তোলে, আরও পূর্ণতা দিতে পারে। সংগীত শিল্পী ন্যান্সির জীবনেও রয়েছে শোক বা দুঃখবোধ। মাকে হারিয়ে মানসিকভাবে খুব ভেঙে পড়েছিলেন তিনি। সেসময় নিজের রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রকাশের বিরূপ প্রতিক্রিয়াসহ আরও বেশকিছু প্রতিকূলতা তাড়া করছিল তাকে। এরই মাঝে মায়ের মৃত্যু যেন আরও ঘোরতরভাবে বিপর্যুস্ত করে দেয়। সবকিছু মিলিয়ে তিনি এতোটাই অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হন যে গানকে না বলে নিজেকে আড়ালে নিয়ে যান; কিন্তু যার হাতে রয়েছে এদেশের সংগীত অঙ্গনের আধিপত্যের অধিকার, তিনি কি আড়ালে থাকলে চলে। ন্যান্সিও তাই অভিমান ভেঙে ফিরে এসেছেন গানের ভুবনে। আবার হয়েছেন নিয়মিত। ন্যান্সির এই বিজয় রথ চলছে ঠিক আগের মতোই। প্রথমদিন তার কণ্ঠ শুনে যেমন নড়ে উঠেছিলেন হাবিব ওয়াহিদসহ অন্যরা, আজও তেমনি তার কণ্ঠ নিয়মিতভাবে নাড়িয়ে যাচ্ছে এদেশসহ বিশ্বের আনাচে কানাচে বসবাসরত গান অনুরাগী সকল বাংলা ভাষাভাষীদের। 

ন্যান্সির বিষয়ে জানতে চাইলে ফেরদৌস ওয়াহিদ জানান, আমার দৃষ্টিকোণ থেকে যদি বলি, ন্যান্সির মতো একজন কণ্ঠশিল্পী, অর্থাৎ ন্যান্সির মতো একটি কণ্ঠ বাংলাদেশের জন্য একটি গর্বের বিষয়। আরও যে কণ্ঠশিল্পী নেই তা না, কিন্তু কণ্ঠতো আল্লাহর দান। সেটি ন্যান্সিকে আল্লাহ দিয়েছেন। ও দেড়যুগ ধরে কাজ করছে একইভাবে। আমি এখন পর্যন্ত ওর পতনের, কণ্ঠগত পতনের কোনো কারণ বা আশঙ্কা দেখছি না। আমি দোয়া করি ও আরও বড় হোক, আরও অনেক দিন এভাবেই সুনামের সঙ্গে গান করে যাক। 

ন্যান্সির সম্বন্ধে আরও কথা হয় জনপ্রিয় গীতিকবি কবির বকুলের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমি বলবো রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমিন, শাহনাজ রহমতুল্লাহ, সামিনা চৌধুরী কনকচাঁপার পর একদমই ব্যতিক্রম যে কণ্ঠ আমরা পেয়েছি- সেটি ন্যান্সির। তার কণ্ঠটি অন্যদের চেয়ে একটু আলাদা। খুব সুন্দর, পরিশীলিত একটি কণ্ঠ। ওর কণ্ঠ ভালো বলেই ওর গাওয়া গানগুলো শুনতে ভালো লাগে। সেজন্যই তুলনামূলকভাবে অল্প গান করলেও ওর গানগুলো শ্রোতাপ্রিয়তা পেয়েছে অনেক বেশি। আর কম গানের কারণ হিসেবে আমি বলবো, ওর কণ্ঠের ইউটিলাইজেশন খুব বেশি হয়নি। ওর কণ্ঠে মেলোডিয়াস-সফট মেলোডিয়াস গানগুলো খুব ভালো লাগে। ও আমারও বেশকিছু ভালো ভালো গান করেছে। ওর জন্য শুভকামনা।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫