
আব্দুর রাজ্জাক
সত্তরের দশকে এদেশে যখন উর্দু ও হিন্দি সিনেমার দাপটে বাংলা সিনেমা মার খাচ্ছিল, তখন একটি হাত এসে এদেশের দুস্থ চলচ্চিত্র শিল্পের হাত ধরেছিল। সেই হাতটি ছিল একজন উদ্বাস্তুর হাত। দুস্থের হাত উদ্বাস্তু ধরবে এটাই স্বাভাবিক। তবে সেই উদ্বাস্তুর হাত যেন এদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ ছিল। কেননা ওই হাত ধরেই বাংলা চলচ্চিত্র স্থান করে নেয় বিশ্বের মধ্যে চতুর্থতম। বলছিলাম বাংলা চলচ্চিত্রের মুকুটহীন সম্রাট নায়করাজ রাজ্জাকের কথা, যিনি দীর্ঘ সময় ধরে দাপটের সঙ্গে শাসন করেছেন বাংলা চলচ্চিত্র।
কিংবদন্তি এই অভিনেতা জন্মগ্রহণ করেন কলকাতার টালিগঞ্জে। সপ্তম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় স্কুলে মঞ্চায়িত মঞ্চনাটকে অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি হাতেখড়ি নেন তার অভিনয় জীবনের। পরবর্তীতে কলকাতায় বাসরত অবস্থায় বেশকিছু টিভি নাটকে এবং দু-একটি সিনেমাতেও অভিনয় করেন তিনি। অতঃপর ১৯৬৪ সালে দেশভাগের সময় পরিবার-পরিজন নিয়ে তিনি চলে আসেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা বর্তমান বাংলাদেশে। রুটি-রোজগারের তাগিদে কলকাতার ছোটখাটো টিভি অভিনেতা আব্দুর রাজ্জাক এপাড়ে এসে কাজ শুরু করেন সহকারী পরিচালক হিসেবে। এর মাঝে ছোটখাটো চরিত্রে অভিনয়ও চালিয়ে যান তিনি। এর মাঝেই তার পরিচয় হয় সে সময়ের প্রতিভাবান চলচ্চিত্র পরিচালক জহির রায়হানের সঙ্গে। তিনি জহির রায়হানের সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করেন। জহির রায়হান তখন বাংলা লোককাহিনীর ওপর তার নির্মিতব্য বেহুলা চলচিত্রের জন্য নায়ক খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন; কিন্তু তিনি নায়ক খুঁজে পাচ্ছিলেন না। কারণ কেউই বেহুলা চলচ্চিত্রের নায়ক হতে রাজি ছিল না। কেননা নায়ককেতো সারা সিনেমায় মৃত লক্ষিন্দর হয়ে কলাগাছের ভেলায় শুয়ে থাকতে হবে। এমন মৃত ব্যক্তির চরিত্রে কেইবা অভিনয় করতে আগ্রহ দেখাবে?
কাউকে না পেয়ে জহির রায়হান তারই সহকারী পরিচালক আব্দুর রাজ্জাককে বললেন, ‘রাজু আপনিই আমার ছবির নায়ক। সেই সিনেমায় রাজ্জাকের বিপরীতে বেহুলার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন নায়িকা সুচন্দা। এর আগে কলকাতা বাংলাদেশ মিলিয়ে বেশিকিছু চলচ্চিত্রে কখনো ক্যামেরার সামনে আবার কখনো পিছনে কাজ করলেও, বেহুলা চলচ্চিত্রের মাধ্যমেই পর্দায় নায়ক হিসেবে আব্দুর রাজ্জাকের যে যাত্রাটি শুরু হয়, তা যেমন আর থেমে যায়নি, তেমনই নায়ক রাজ্জাককেও আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
৬০ দশক থেকে শুরু করে একের পর এক সিনেমায় অভিনয় করে ধাপে ধাপে ধারাবাহিকভাবে তিনি যেমন পেয়েছেন জনপ্রিয়তা, তেমনই নায়ক হিসেবে ৮০র দশক পর্যন্ত টানা দুই দশক ঢাকাই চলচ্চিত্রে করে গিয়েছেন একচেটিয়া রাজত্ব। ঢাকাই চলচ্চিত্রে সেসময় রাজ্জাকের সমসাময়িক চিত্রনায়কদের মধ্যে ফারুক, আলমগীর ছিলেন অন্যতম। এরা সবাই নিজেদের প্রখর অভিনয় দিয়ে সমৃদ্ধ করেছেন বাংলা চলচ্চিত্র; কিন্তু এত এত শক্তিশালী মেধা থাকতেও রাজ্জাক সব ছাপিয়ে হয়ে উঠেন নায়করাজ।
এই দীর্ঘ পথচলায় রাজ্জাক অভিনীত জননন্দিত চলচ্চিত্রগুলোর কথা বলতে হলে- নীল আকাশের নিচে, ময়নামতি, মধুমিলন, পিচঢালা পথ, যে আগুনে পুড়ি, জীবন থেকে নেয়া, কী যে করি, অবুঝ মন, রংবাজ, বেঈমান, আলোর মিছিল, অশিক্ষিত, অনন্ত প্রেম, বাদী থেকে বেগম চলচ্চিত্রের কথা উঠে আসে।
তার দীর্ঘ এই ক্যারিয়ারে তিনি শাবানা, ববিতা, নুতন, রোজিনাসহ অনেকের সঙ্গে জুটি বেঁধে অভিনয় করলেও রাজ্জাক-কবরী জুটির কথা না বললেই নয়। রাজ্জাক-কবরী জুটির পূর্বে যেমন ঢাকাই চলচ্চিত্রে কোনো উল্লেখযোগ্য জুটি তখনো গড়ে ওঠেনি, তেমনই পরবর্তীতে আরও অনেক জুটি এদেশের চলচ্চিত্রে এসে গেলেও এই জুটির মতো জনপ্রিয় ও সফল জুটি এখনো ঢাকাই চলচ্চিত্র পায়নি।
দর্শকনন্দিত নায়করাজ রাজ্জাক তার দীর্ঘ অভিনয় জীবনে এদেশের আপামর জনসাধারণের যেমন পেয়েছেন নিখাদ ভালোবাসা, তেমনই স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার।
একজন সফল অভিনেতার পাশাপাশি চলচ্চিত্র প্রযোজক ও পরিচালক হিসেবেও তিনি ছিলেন সফল। তার নিজস্ব প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান রাজলক্ষ্মী প্রোডাকশন হাউস থেকে নির্মিত বেশির ভাগ সিনেমাই তার পরিচালনায় পরিচালিত চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে অধিকাংশ চলচ্চিত্রই ছিল ব্যবসাসফল চলচ্চিত্র।
গত ২১ জুন ছিল বাংলা চলচ্চিত্রের এই সফল মানুষটির চলে যাওয়ার দিন। দীর্ঘ চার বছর হয়ে গেল এই কিংবদন্তির চলে যাওয়ার শূন্যস্থানটি কখনোই পূর্ণ হবার নয়।