
শানারেই দেবী শানু
শানারেই দেবী শানু। একাধারে নৃত্যশিল্পী, অভিনেত্রী ও লেখিকা। কবিতা দিয়ে লেখালেখি শুরু হলেও বর্তমানে উপন্যাসে মনোযোগ দিয়েছেন। কবি পরিচয়ের সঙ্গে যোগ করেছেন ঔপন্যাসিক উপাধি। একাধিকবার পুরস্কৃত হয়েছেন সাহিত্যকর্মের জন্য। অভিনয় ও লেখালেখি চলছে সমানতালে। প্রথম ‘লাক্স চ্যানেল আই সুপারস্টার’ বিজয়ী শানু বলেছেন, তার অভিনয় জীবনের কথা। আলোচনায় উঠে এসেছে সাহিত্যচর্চাসহ নানা প্রসঙ্গ। তাকে নিয়ে এবারের আয়োজন সাজিয়েছেন মোহাম্মদ তারেক
কেমন আছেন? কী নিয়ে ব্যস্ততা এখন?
ভালো আছি। এখন পূর্ণ মনোযোগ লেখাতেই দিচ্ছি। দুটি উপন্যাসের কাজ চলছে। দুটিই প্রেমের উপন্যাস। একটি ‘ইতি মেঘবালক’, অন্যটি ‘আমার একটা তুই চাই’। এর মধ্যে ‘আমার একটা তুই চাই’ বইটি ডিসেম্বরেই প্রকাশের ব্যবস্থা হচ্ছে।
আপনাদের সময়ের রিয়েলিটি শোর সঙ্গে এ সময়ের রিয়েলিটি শোর কি পার্থক্য চোখে পড়ে?
এখন বাণিজ্যিক চিন্তা-ভাবনা বেশি। আমরা শিল্পের কথা না ভেবে বিক্রির কথা ভাবছি। এজন্য শিল্পটাই হারিয়ে যাচ্ছে। আগের মতো শিল্পীও আর আসছে না। যারা আসছেন তারা নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে হিমশিম খাচ্ছেন।
এ সময়ের নাটক নিয়ে আপনার মতামত কী?
নাটকের মান নিয়ে আমি খুবই হতাশ। প্রচুর নিম্নমানের কাজ হচ্ছে। আমি কখনই এ ধরনের নিম্নমানের কাজ করতে চাই না। আমি মনে করি নির্মাতা ও প্রযোজক প্রত্যেকেরই দায়বদ্ধতার জায়গা আছে। যেমন আমি নতুন লিখছি। আমার অগ্রজ লেখকদের কাছে এক ধরনের শিক্ষা পাচ্ছি। আমি এমন কিছু লিখতে চাই না বা লিখব না, যা সমাজ বা পাঠকের ভাবনার জন্য ক্ষতিকারক। অর্থাৎ এ জায়গায় আমি দায়বদ্ধ। নির্মাতাদেরও সেরকম দায়বদ্ধতার জায়গাটা থাকা উচিত। ইদানীং বলা হচ্ছে দর্শক অমুক ধরনের নাটক খাবে না। শিল্পকে কেন খাওয়াব? নাটক একটা খাদ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন হতাশাজনক। শিল্পকে এ দৃষ্টিতে দেখা অনুচিত।
এখন তো বাজেটও কমে গেছে ...
একদম। বিষয়টা উদাহরণ দিয়ে বোঝানো যায়। রান্না করতে গেলে উপাদান ঠিকমতো থাকতে হবে। তা না থাকলে রান্না অপরিপূর্ণ থাকবে? নাটকের ক্ষেত্রেও অনেকটা তাই হচ্ছে। বাজেট কমে যাওয়ার কারণে যে শিল্পীকে নেওয়া দরকার তাকে নেওয়া যাচ্ছে না। যার ফলে নতুনদের নিয়ে কাজ করছেন নির্মাতারা। এতে করে নাটকের মান কমে যাচ্ছে। গাঁথুনি শক্ত হচ্ছে না। দর্শকেরও ভালো লাগছে না। আবার বাজেট সংকোচনের জন্য প্রয়োজনীয় অনেক চরিত্রও কমিয়ে ফেলছেন তারা। ফলে গল্প তার স্বকীয়তা হারাচ্ছে।
বছর দুয়েক আগে আপনি সিনেমায় নাম লিখিয়েছেন। আপনাকে ফের কবে বড়পর্দায় দেখা যাবে?
সিনেমার অবস্থাও সবকিছু মিলিয়ে বেশ নাজুক। টেলিভিশন নাটকেরও ধস নামছে। ওটিটি প্ল্যাটফর্মে নির্মাতা অভিনয়শিল্পীরা ঝুঁকছেন। ভবিষ্যৎ কোনদিকে যাবে বোঝা যাচ্ছে না। সিনেমা নিয়ে আমার তেমন উচ্চাকাক্সক্ষা ছিল না। সিনেমা নিয়ে সেভাবে ভাবিওনি কখনো। ভাবলে শুরু থেকেই ভাবতাম। সিনেমা নিয়ে প্রত্যাশাও ছিল না। যদিও ‘মিস্টার বাংলাদেশ’ করেছি। তবে ভবিষ্যতে ভালো চিত্রনাট্য পেলে কাজ করা হবে হয়তো।
আরেকটি বিষয় নিয়ে নাটকপাড়ায় আলোচনা হয়, সেটি হলো ‘সিন্ডিকেট’। এ নিয়ে কি বলবেন?
যারা ‘সিন্ডিকেট’ করছেন তাদের জন্য এটি লাভজনক হলেও অন্যরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আমাদের টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রির জন্য এটি খারাপ। অনেক ভালো অভিনয়শিল্পী আছেন, যারা এই সিন্ডিকেটের জন্য কাজের সুযোগ পাচ্ছেন না। কারণ গুটিকয়েক শিল্পীকে নিয়ে কাজ হচ্ছে। নাটক সংশ্লিষ্টরা অন্যদের সুযোগই দিচ্ছেন না। ফলে দর্শককে ঘুরেফিরে একই মুখ বারবার দেখতে বাধ্য করা হচ্ছে।
ইদানীং ‘ভিউ’ নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে। আপনার চোখে ‘ভিউ’ কেমন?
যদিও আমি ইউটিউবের ‘ভিউ’ দিয়ে কোনো শিল্পীকে যাচাই করতে চাই না। তবে অস্বীকার করা যাবে না, যাদের কাজের ‘ভিউ’ হচ্ছে তাদের যোগ্যতা আছে বলেই দর্শক তাদের কাজ দেখছেন। আর যাদের ‘ভিউ’ হচ্ছে না তারা হয়তো নিজেকে প্রমাণের পর্যাপ্ত সুযোগ পাচ্ছে না। অনেক বিষয়ই এখানে কাজ করছে। আমি বিষয়টি ইতিবাচকভাবেই দেখি। দর্শকের চাহিদার জন্যই তাদের নিয়ে কাজ হচ্ছে। যোগ্যতাবলেই তারা ‘ভিউসম্পন্ন’ শিল্পী।
জমে উঠেছে ওয়েব প্ল্যাটফর্ম। ওভার দ্য টপ বা ওটিটিতে মেতেছে দর্শক। এ প্ল্যাটফর্ম নিয়ে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কী?
টেলিভিশন পর্দা ছেড়ে আমরা ওয়েবে ঝুঁকছি। এ সময়ে এসে ওয়েবের মার্কেট বাড়বে এটাই স্বাভাবিক। আমরা নানা দেশের কনটেন্ট দেখছি। নিজেরাও ওয়েব কনটেন্ট বানাচ্ছি। এদেশের কোনো কোনো নির্মাতা ভাবছেন পার্শ্ববর্তী দেশের মতো রগরগে দৃশ্য জুড়ে দিলে ভিউ বাড়বে। অথচ পাশের দেশে গল্পের প্রয়োজনে এ জাতীয় দৃশ্য আনা হয়। তবে আশার দিক হলো ওয়েব সিরিজের নির্মাতারা গল্পকে প্রাধান্য দিচ্ছেন। আমি আশাবাদী ওয়েব প্ল্যাটফর্ম নিয়ে।
আপনি ওয়েব প্ল্যাটফর্মে কাজ করবেন কি?
অবশ্যই ভালো চিত্রনাট্য হলে কাজ করব। অভিনেত্রী হিসেবে শুরু থেকেই কোনো বাছ-বিচার ছিল না। নির্মাতারা যদি আমাকে নিয়ে কোনো চরিত্রের কথা ভাবেন, তাহলে কাজ করা হবে।
আপনি তো একজন কবি। কবিতার বই আসছে না এবার?
আসলে এবার কবিতাকে সময় দেওয়া হচ্ছে না। টুকটাক যা মাথায় আসছে লিখছি। সেগুলোকে সংরক্ষণের একটা বিষয় থাকে। উপন্যাসের ভূত ঢুকেছে মাথায়, তাই হয়তো আর কবিতার বইয়ের দিকে মনোযোগ দিচ্ছি না। উপন্যাস লিখতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম সেটা বড় কলেবরের; কিন্তু কবিতা এক বসাতেই লিখে ফেলা যায়। উপন্যাস লিখতে গেলে দীর্ঘ সময় নিয়ে প্লট ডেভেলপ করতে হয়। কবিতার চেয়ে উপন্যাসের ঘোর বেশি। ‘ইতি মেঘবালক’ করোনাকালেই শুরু করেছিলাম। মাঝে আর লিখতে ইচ্ছা করছিল না। বিরতি দিতে হয়েছে। তবে বইমেলার জন্য একটা চাপ আসায় কাজটি শেষ করলাম। এরপর ‘আমার একটা তুই চাই’ লেখা শুরু করি। টানা লিখেছি। উপন্যাস লিখতে গিয়ে কবিতাকে সময় দিতে পারলাম না।
গল্প কিংবা কবিতার বিষয় কী করে খুঁজে পান?
এটি কেউই বলতে পারে না। আমিও মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যাই। যেমন রাস্তায় হাঁটার সময় আমার চোখের সামনে কোনো ঘটনা ঘটল। সেখান থেকে একটা ভাবনা তৈরি হয়ে যেতে পারে। এক্ষেত্রে বলতে পারি ‘আমার একটা তুই চাই’ উপন্যাসে সিজোফ্রেনিক রোগীর কিছু বিষয় উঠে এসেছে। একটা মেয়ে ঘরবন্দি থাকতে থাকতে মানসিকভাবে এলোমেলো হয়ে পড়ে। সে দেয়ালে দেয়ালে ‘আমার একটা তুই চাই’ লিখতে থাকে। এই দৃশ্যটা আমার মাথায় এসেছিল। এই ভাবনার ডালপালা ছড়িয়ে উপন্যাসের একেকটি দৃশ্য দাঁড় করিয়েছি; কিন্তু কী করে এ ভাবনা তৈরি হলো আমি নিজেও বুঝতে পারছি না। এরকম আরও হয়। কিছুদিন আগে হুমায়ূন আহমেদ স্যারের একটি বই পড়ছিলাম। হঠাৎ করে একটা পয়েন্ট আমার মাথায় ঢুকে গেল। তা নিয়ে হয়তো আগামীতে লিখব। আস্তে আস্তে লেখক হয়ে উঠছি, টের পাচ্ছি বিষয়টি। কোন জায়গা থেকে যে গল্পগুলো নিয়ে নিচ্ছি নিজেও জানি না।
অভিনেত্রী নাকি লেখিকা কোন পরিচয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন?
দুটিই আমার আত্মার সত্তা। আমি অভিনেত্রী হতে চেয়েছি। এটিই আমার শৈশব থেকে লালিত স্বপ্ন। সে স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়েছে। শব্দ জগতে আমার পথচলা মাত্র শুরু। আমার লিখতে ভালো লাগে। গতবছর বইমেলায় বাচ্চাদের নিয়ে লিখেছি ‘শানারেই ও তার জাদুর লেইত্রেং’। সে বইয়ের জন্য ‘মীনা মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড’ পেয়ে অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করছিল। কারণ প্রথমবার বাচ্চাদের নিয়ে লিখেছি। মণিপুরী সম্প্রদায়কে এ গল্পের মাধ্যমে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। তাই এ অর্জন আমার জন্য বিশেষ কিছু। আগে জানানো হয়নি আমি পুরস্কার পাচ্ছি। তাই ঘোষণা হওয়ার আগে জানতামই না কিছু। রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতি ছিল আমার জন্য।
কাদের লেখা ভালো লাগে?
ওপার বাংলার সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়সহ অনেকের লেখাই ভালো লাগে। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ স্যারের লেখার মধ্যে অদ্ভূত এক ধরনের আনন্দ পাই। মুচকি একটা হাসি চলে আসে। সহজ সরল একটা আনন্দ। এ জন্যই হয়তো সাধারণ পাঠকদের কাছে তিনি এত জনপ্রিয়।
অভিনয় নাকি লেখালেখি কোনটি বেশি চ্যালেঞ্জিং?
দুটিই চ্যালেঞ্জিং এবং একইসূত্রে গাঁথা। অভিনয় যখন করি তখন চরিত্রটি নিজের মাঝে ধারণ করি। আবার উপন্যাস লেখার সময় পুরো গল্প থাকে নিজের মধ্যে। গল্পের ঘোরের মধ্যে থেকেই লেখার চেষ্টা করি। অভিনয়ে নানা চরিত্রের অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলতে হয়। তাই সেটা অবশ্যই চ্যালেঞ্জিং। অন্যদিকে উপন্যাসে শব্দ দিয়ে কল্পনার একেকটি ছবি আঁকতে হয়। লেখক জীবনের এ জায়গাটি বেশ উপভোগ করছি। ‘ইতি মেঘবালক’ লিখতে গিয়ে নানা কারণে ছন্দপতন হয়েছে। এটি যাতে না হয় সেজন্য পরিবার থেকে ছুটি নিয়ে ‘আমার একটা তুই চাই’ লিখেছি।
আপনি কাগজে লিখতেন। এখন ল্যাপটপ ব্যবহার করছেন লেখার কাজে। কেমন লাগছে?
‘আমার একটা তুই চাই’ পুরোটাই ল্যাপটপ ব্যবহার করে লিখেছি। মজা লাগছে। আগে ভাবতাম খাতা কলমে না লিখলে শব্দ বের হবে না। আবিষ্কার করলাম ল্যাপটপে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে লিখতে পারছি। কাজ দ্রুত এগোচ্ছে। খাতায় লিখলে সেটা আবার কম্পিউটারে কম্পোজ করতে হয়। প্রুফ দেখতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়। এখন আর সেটি করতে হচ্ছে না।
চিত্রনাট্য লিখবেন?
‘আমার একটা তুই চাই’ এর মূল ভাবনা জানার পর চিত্রনাট্য লিখতে বলেছেন কেউ কেউ। এটিকেই হয়তো চিত্রনাট্যে পরিণত করতে পারি খণ্ড নাটকের জন্য। উপন্যাস লিখছি বলে চিত্রনাট্য লেখার আত্মবিশ্বাস জন্মেছে। লিখছি না বলে হয়ে উঠছে না। যখন কবিতা লিখতাম না তখন কবিতা লেখার সাহস করতে পারতাম না। এখন তো লিখছি। উপন্যাস লেখারও দুঃসাহস করে ফেলেছি। তাই চিত্রনাট্যও লিখে ফেলতে পারি।
আপনি প্রথম ‘লাক্স চ্যানেল আই সুপারস্টার। ২০০৫ সালের সে আয়োজনে পরেছিলেন বিজয়ীর মুকুট। এ সময়ে এসে পেছন ফিরে তাকালে কী মনে হয়?
মানুষের জীবন একটি দীর্ঘ ভ্রমণ। আমরা সময়ের সঙ্গে ফেলে আসি অনেককিছু। আমি স্বপ্নবাজ মেয়ে। ছোটবেলায় স্বপ্ন দেখার কারণেই হয়তো এতদূর আসতে পেরেছি। ‘লাক্স চ্যানেল আই সুপারস্টার’ হবার আগে বাংলাদেশ টেলিভিশনে ‘বনফুল’ শিরোনামের একটি অনুষ্ঠানে নাচ করতাম। পুরো অনুষ্ঠানের ফোকাস আমার পারফরমেন্সের ওপর ছিল। একুশে টেলিভিশনের তানভির হোসেন প্রবাল দাদার একটা কাজও করেছি সে সময়। সে নাটকে সাবরিনা সাকা মিম ছিল। সে তখন সুপরিচিত। ‘লাক্স চ্যানেল আই সুপারস্টার’ আমার জন্য ছিল স্বপ্ন সোপান। আমি স্বপ্নের মাঝেই ছিলাম। এ সোপানই আমাকে সিলেট থেকে একদম মূলধারায় নিয়ে এসেছে।