‘প্রতিনিয়ত দু’জন দু’জনের যত্ন নেই’ আবিদা সুলতানা ও রফিকুল আলম

মাহমুদ সালেহীন খান
প্রকাশ: ০৬ অক্টোবর ২০২১, ১৪:০৩

আবিদা সুলতানা ও রফিকুল আলম
সত্তরের দশক থেকে গানের জগতের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন রফিকুল আলম। ১৯৬৭ সালের দিকে রাজশাহী বেতার কেন্দ্রে প্রথম গান করেন; পরবর্তীতে গানের জন্যই ঢাকায় চলে আসেন। কলেজে পড়ার সময় যুক্ত ছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে। আধুনিক গানের পাশাপাশি চলচ্চিত্রের জন্যও প্লে-ব্যাক করেছেন তিনি। গানের সূত্রেই শিল্পী আবিদা সুলতানার সঙ্গে পরিচয়। এরপর ১৯৭৫ সালে তারা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের একমাত্র পুত্র সাফদান আলম, একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে কর্মরত। গুণী এই শিল্পী দম্পতি তাদের দীর্ঘ দাম্পত্য এবং সংগীতজীবনের বিভিন্ন প্রসঙ্গে কথা বলেছেন মাহমুদ সালেহীন খানের সঙ্গে
কবে আমরা অভিমান করেছি মনেও নেই: আবিদা সুলতানা
বাংলাদেশের পঞ্চগড় জেলার একটি সংস্কৃতিমনা পরিবারে গানের পাখি আবিদা সুলতানার জন্ম। সংস্কৃতিমনা পরিবার হওয়ায় শৈশব থেকেই তিনি গান, নাটক, নাচসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ছোটবেলায় গানের চেয়েও নাচের প্রতি আবিদার বেশি ঝোঁক ছিল। তিনি বাবু রাম গোপাল মহন্ত, ওস্তাদ ফুল মোহাম্মদ, আক্তার সাদমানি, বারীন মজুমদার, ওস্তাদ নারু এবং ওস্তাদ সগীর উদ্দীন খানের কাছ থেকে গানের তালিম নিয়েছেন। আবিদার সংগীতজীবনে এই প্রখ্যাত ওস্তাদদের প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়।
আবিদা সুলতানার কাছে প্রথম প্রশ্ন রেখেছিলাম, যতটুকু জানি আপনার সংস্কৃতিচর্চার শুরু হয়েছিল নাচ দিয়ে। গানের ভুবনে এলেন কীভাবে? উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ, ছোটবেলায় নাচের প্রতি আমার অনেক আগ্রহ ছিল। ভালো নাচতেও পারতাম। একদিন মা আমাকে নাচতে বারণ করলেন। তারপর থেকে আর নাচ করিনি। নাচের সঙ্গে সঙ্গে গানও শিখতাম। নাচ ছেড়ে দেওয়ার পর গান শেখার প্রতি বেশি মনোযোগী হই। সেই থেকে আজও গান শিখছি’।
তিনি জানালেন, রবীন্দ্র এবং নজরুলসংগীত এই দুটির ওপর তালিম নিলেও আধুনিক গানই বেশি ভালো লাগত এবং স্বাচ্ছ্যন্দবোধ করতাম। পূর্ব পাকিস্তানের একটি সংগীত প্রতিযোগিতায় (পরবর্তীতে তা ফুলকুঁড়ি নামে বেশি পরিচিতি লাভ করে) বিজয়ী হই। ১৯৬৮ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশন এবং বাংলাদেশ বেতারের সংগীতশিল্পী হিসেবে তালিকাভুক্ত হলাম। তখন থেকেই এই দুই মাধ্যমে নিয়মিত গান পরিবেশন করে আসছি। ১৯৭৪ সালে প্রথম চলচ্চিত্রে প্লে-ব্যাক করি।
আবিদা সুলতানার বিখ্যাত গান ‘বিমূর্ত এই রাত্রি আমার’। এই গানের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় থেকে ভুপেন হাজারিকার গান শুনছি। তখন তার প্রচুর গান শোনা হতো। ১৯৭৫ সালের কথা। তখন আমি ইন্টারমিডিয়েটে পড়াশোনা করছি। আলমগীর কবির তখন ‘সীমানা পেরিয়ে’ ছবিটির নির্মাণ নিয়ে ব্যস্ত। একদিন জানতে পারি, ছবিটির ‘বিমূর্ত এই রাত্রি আমার’ গানে কণ্ঠ দিতে তিনি আমাকে নির্বাচন করেছেন। তারপর তিনি আমাদের বাসায় আসেন এবং আমার বাবাকে রাজি করান। আমার বড় বোন রেবেকা সুলতানা, দুলাভাই মোহাম্মদ শফিউল্লাহ, আলমগীর কবিরসহ কলকাতায় গেলাম। সেখানে গিয়ে দেখা হয় জয়শ্রী কবীরের সঙ্গে। আমাদের গানের রেকর্ডিং ছিল কলকাতার টেকনিশিয়ান্স স্টুডিওতে। ভুপেন হাজারিকা কিশোরী বয়সী আমাকে দেখে খানিকটা অবাক হয়েছিলেন। তিনি আলমগীর কবিরের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, আমি ঠিকভাবে গাইতে পারব কিনা। ভুপেনদা প্রথম দিন আমাকে বলেছিলেন, আজ আর তোমাকে গান শেখাব না। এই গানটা নিয়ে যাও। এটি পড় আর বোঝার চেষ্টা কর। গানটি অনেক বড় ছিল। অবশ্য এটি একটি কবিতা ছিল। গানটিতে সুর দিয়েছেন ভুপেন হাজারিকা। শিবদাস ব্যানার্জির লেখা অসমিয়া এই কবিতাটি বাংলায় রূপান্তর করা হয়েছিল। গানটির অর্থ বোঝার জন্য ভুপেনদা আমাকে উপদেশ দিয়েছিলেন; কিন্তু গানটি পড়ার পর সেদিন অনেক রাত পর্যন্ত কিছুই বুঝিনি। সত্যি বলতে, আমি তখন গানটির অর্থ না বুঝেই বলেছিলাম, গাইতে পারব। এরপর সেদিন হোটেলে বসে গানটি শিখি এবং অর্থ বোঝার চেষ্টা করি। পরদিন স্টুডিওতে প্রথমে দু’বার মহড়া করলাম, একবার মাইক্রোফোনে প্র্যাকটিস করলাম। এরপর অবশ্য দু’বারেই গানটি ঠিকভাবে রেকর্ডিং হয়। গানটি শোনার পর ভুপেনদা বেশ প্রশংসা করেছিলেন এবং আমার গলায় একটি ফুলের মালা পরিয়ে দিয়েছিলেন। এটিই ছিল ভুপেনদার সঙ্গে আমার শেষ কথা।’ তিনি আরও বললেন এভাবেই আস্তে আস্তে আধুনিক গানের দিকে ঝুঁকে গেলাম।
রফিকুল আলমের সঙ্গে পরিচয়ের গল্পটা জানতে চাইলে কণ্ঠশিল্পী আবিদা সুলতানা বলেন, ‘১৯৭৩ সালে পণ্ডিত বারীণ মজুমদার ও সাংবাদিক কামাল লোহানী পল্টনে একটি সংগীত সম্মেলন করেছিলেন। সেখানে রফিকুল আলম গান গাইলেন। সেই অনুষ্ঠানে কামাল লোহানীই আমার সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দেন; কিন্তু ঘনিষ্ঠভাবে পরিচয় করিয়ে দেন লাকী আখন্দ। এই পর্যন্ত বলে তিনি চুপ করলেন; কিন্তু নাছোড়বান্দা আমি তারপরের কথাও শুনতে চাই। বললেন, রফিকুল আলম খুব ভদ্র একজন মানুষ। উনি আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন পরিচয়ের অনেকটা দিন পরে। ১৯৭৪ সালে আমাদের মাঝে প্রেম হয়। ১৯৭৫-এ আমরা বিয়ে করি। তারপর থেকে তো আমরা একসঙ্গে এতটা জীবন পার করে দিলাম। স্বামী হিসেবে রফিকুল আলম কেমন জানতে চাইলে হেসে বললেন, ওই যে বললাম উনি খুবই ভদ্র একজন মানুষ। স্ত্রীকে সম্মান করতে জানেন। আমার ক্যারিয়ারে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো হস্তক্ষেপ করেনি। বিপরীত মানুষের মতামত সহ্য করার ক্ষমতা ওনার আছে। দাম্পত্য জীবনে এটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন? এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানলেন, একটা দীর্ঘ দাম্পত্যজীবন টিকে থাকার পেছনে স্বামী-স্ত্রীর পরস্পরকে সম্মান এবং একে-অপরের মতামত সহ্য ও গ্রহণ করার ক্ষমতা থাকতে হবে। তিনিই শ্রেষ্ঠ স্বামী যিনি তার স্ত্রীকে শতভাগ বুঝতে পারেন। আপনি তা হলে বলতে চাইছেন রফিকুল আলম স্বামী হিসেবে শতভাগ সফল? আবিদার অকপটে উত্তর, নিশ্চয়ই। তা না হলে আমরা একই প্রফেশনের হয়েও সুন্দরভাবে ঝগড়াঝাটি ছাড়া এতটা বছর পার করে দিলাম কীভাবে? জানতে চাই, আপনাদের দাম্পত্যজীবনে সত্যি কোনো মনোমালিন্য হয়নি? উত্তরে আবিদা বললেন, কোনো ইস্যু নিয়ে আমাদের মতের কখনো অমিল হয়নি। যখন প্রেম করেন তখনকার কোনো মজার স্মৃতি জানতে চাইলে বললেন, প্রেম মানেই তো মজার। তবে আমার আক্ষেপ ছিল। বেশ কিছুদিন যাওয়ার পর আমি রফিককে রাগ করে বলেছিলাম, এতদিন ধরে আমরা প্রেম করছি, অথচ আমাকে প্রেমের কোনো চিঠি দিলে না? তারপর ভাইয়া কি বললেন? এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বললেন, বাকিটা তোমার ভাইয়ার কাছ থেকে শুনে নিও।
করোনার এই সময়ে আপনার উপলব্ধি কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, এমন একটি বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হবে আমি কখনো ভাবিনি। যখন লকডাউন শুরু হলো তখন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ঘরবন্দি হয়ে আছি। নভেম্বর থেকে অবশ্য বের হচ্ছি, টুকটাক গান করছি চ্যানেলে এবং প্লে-ব্যাকের জন্য। তবে যা করছি স্বাস্থ্যবিধি মেনেই করছি। এই সময়ের বড় উপলব্ধিটা হচ্ছে জীবনের সবকিছুই আসলে তুচ্ছ। প্রচণ্ড ব্যস্ত সময়ের মধ্যে হঠাৎ ঘরবন্দি সময়টা কীভাবে কাটালেন তারা? জানালেন, প্রথম প্রথম বোরিং লাগেনি। কারণ পুরো পরিবারকে সময় দেওয়া হয়ে ওঠেনি অনেক দিন। যদিও আমি আর রফিকুল আলম দেশ-বিদেশের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে একই সঙ্গে গান করি; কিন্তু সেটাতো প্রফেশনাল লাইফ। আমি মজার মজার রান্না করতে পছন্দ করি। এই লকডাউনের সময়টিতে ছেলের বউকে নিয়ে ইউটিউব দেখে অনেক নতুন রান্না শিখেছি। রফিক খেতে খুব পছন্দ করে। এই সময়টায় সে অনেক নতুন সুস্বাদু খাবার খেয়েছে। তার কাছে প্রশ্ন রাখলাম, আপনি বললেন, ছেলের বউকে নিয়ে নতুন নতুন রান্না শিখেছেন। আজকাল বেশিরভাগ পরিবারে বউ-শাশুড়ির মধ্যে তিক্ত সম্পর্কের কথা শোনা যায়। বিষয়টিকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন? তিনি বললেন, আসলে এটা সম্পূর্ণ নির্ভর করবে আপনার মানসিকতার ওপর। আমার যেহেতু মেয়ে নেই, আমি ছেলের বউকে মেয়ের মতোই ভাবি। সেও খুব লক্ষ্মী একটি মেয়ে। আমি মজা করার জন্যই প্রশ্ন করি, তাহলে মেয়ে থাকলে আপনাদের বউ-শাশুড়ির সম্পর্কটা এরকম নাও থাকতে পারত? বললেন, ওই যে বললাম এটা নির্ভর করে সম্পূর্ণ মানসিকতার ওপর। তোমাকে আমি একটু আগেও বললাম বিপরীতমুখী মানুষের মতামত সহ্য করার ক্ষমতা থাকতে হয়। বউ-শাশুড়ির সম্পর্কের বেলাতেও এ কথা প্রযোজ্য। আমি মনে করি এই সম্পর্ক তিক্ত হবার কোনো কারণ নেই। যারা সম্পর্কটিকে তিক্ততার পর্যায়ে নিয়ে যায়, তারা খুব নিচু মনমানসিকতার মানুষ। সবকিছুকে ইতিবাচক দেখতে হবে। রফিকুল আলম বাবা হিসেবে কেমন? যথেষ্ট দায়িত্ববান। আমরা দু’জনেই বিভিন্ন শো নিয়ে ব্যস্ত থাকি। রফিক নিজেই একটু পরপর ছেলের খোঁজখবর রাখে। কোনো সমস্যা হলে নিজেই সমাধান করে দেয়। আর মা হিসেবে আবিদা সুলতানা কেমন? তিনি বলেন, একজন নারীর পরিপূর্ণতা হলো মাতৃত্বে। আমার ছেলেটা খুব লক্ষ্মী। ও যখন একটু একটু করে বড় হতে লাগল, আমরা দু’জনেই দেশের বাইরে গান গাইতে গেলে তেমন একটা বিরক্ত করত না। সেই সময় ও বেশিরভাগ খালা, ফুফুদের সঙ্গেই থাকত। আমি যেভাবে বলে দিতাম তারা সাফদানের ঠিক সেভাবেই টেককেয়ার করত। তবে যখন দেশে থাকতাম, আমি নিজ হাতে তার সবকিছু দেখাশোনা করেছি। ওর এখন নিজের সংসার হয়েছে। বাবা হিসেবেও সে খুব ভালো।
একজন কর্মজীবী মা হিসেবে সন্তান এবং সংসার দেখা শোনাটিকে কখনই চ্যালেঞ্জিং মনে করেন না আবিদা সুলতানা। তার মতে, কর্মজীবী স্ত্রী বা মা বলে কোনো কথা নেই, সংসারের দায়িত্ব সম্পূর্ণ নিজের। আমার সংসার আমাকেই দেখেশুনে রাখতে হবে। আর আমরা যারা গান করছি কিংবা ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত আছি, সবই কিন্তু নিজেদের একটু ভালো থাকার জন্যই। যতই ব্যস্ত থাকি না কেন দিন শেষে নিজের ঘরেই আসতে হবে।
গান এখন শোনার চেয়ে মিউজিক ভিডিওতে রূপান্তর হচ্ছে। এই বিষয়ে আবিদা সুলতানা বলেন, পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে সবই দিনের পর দিন বদলে যাচ্ছে। সে অনুযায়ী গানের জগতেও অনেক পরিবর্তন এসেছে। পরিবর্তনকে সাদরে গ্রহণ করতে হবে। তবে শিকড়কে ভুলে গেলে চলবে না। গান অবশ্যই দেখার বিষয়। এখন রেডিও থাকলেও মানুষ হয়তো তা তেমন শোনে না। প্রযুক্তির এমন অনেক মাধ্যম আছে যেখানে গান শোনার পাশাপাশি সুন্দর একটা ভিডিও দেখতে পছন্দ করেন অনেকেই। ভিডিও যদি গানের সঙ্গে মানানসই হয়, সেটা দেখতে ভালোই লাগে। তবে একটি ভিডিওতে খারাপ কিছু যেমন দেখানো যায়, আবার ভালো কিছুও দেখানো যায়। নির্মাতারা যেন মিউজিক ভিডিওতে গানের গল্প ধরে রেখে নির্মাণ করেন এটাই কামনা করি।
তিনি সংগীতের বর্তমান সময় নিয়ে বলেন, একটা সময় গানের যে রমরমা বাজার ছিল সেটা এখন আর নেই। ক্যাসেটের পর সিডিও উঠে গেছে। সবাই অনলাইনে ফ্রি গান শুনছেন। যেহেতু এখন ডিজিটালি গান প্রকাশ হয় তাই সবার সম্মতিক্রমে আমাদের গান প্রকাশের নিয়ম-নীতিতে পরিবর্তন প্রয়োজন। এখনকার গান আমার শোনা হয়। অনেকে ভালো করছেন। তবে বেশিরভাগ গানই রোবটিক মনে হয়। সার্বিক দিক বিচারে মনে হয়, এখন সাধনার কমতি রয়েছে। শিখতে চায় না অনেকেই। আজীবন শেখার মানসিকতা থাকতে হবে। গান সাধনার বিষয়। মনোযোগের বিষয়। সময় দেওয়ার বিষয়। এসব দিকে মনোযোগ দিতে হবে তরুণ প্রজন্মকে। তাহলেই সামনের দিকে এগিয়ে যাব আমরা।
দুই সংগীতশিল্পী রফিকুল আলম ও আবিদা সুলতানার সংসারজীবনে তো রাগ-অভিমান হয়ই। কীভাবে, কে অভিমান ভাঙায়? বললেন, বয়স যত বাড়ে স্বামী ও স্ত্রী উভয়ের প্রতি উভয়ের ভালোবাসাও তত বাড়ে, এটা আমি মনে করি। আমাদের বেলায়ও তাই। প্রতিনিয়ত আমরা দু’জন দু’জনের খুব যত্ন নেই। তাই রাগ-অভিমান হয় না। কবে আমরা অভিমান করেছি মনেও নেই। তবে যখন প্রেম করি তখন একদিন রাগ করেছিলাম প্রেমের চিঠির জন্য। এটা ঠিক। আমি তাকে রাগ করে বলেছিলাম, আমরা প্রেম করেছি কিন্তু কোনো চিঠি পেলাম না, এটা তো হতে পারে না। যখন আমাদের বিয়ের দিন ঠিক করা হলো, তার আগের দিন সে তাদের বাড়ি (রাজশাহী) যাচ্ছিল। আমি তখন তাকে বললাম, বাসায় গিয়ে আমাকে চিঠি লিখবে। তা না হলে বিয়ে আরও কিছুদিন পিছিয়ে দেব। পরে সে আমাকে চিঠি লিখে কিন্তু চিঠিটা বিয়ের পর আমি হাতে পাই। সে চিঠি এখনো আমার কাছে আছে।
তিনি আরও বলেন, আসলে আমরা দু’জনই একসঙ্গে স্টেজে গান করি। আমাদের দু’জনের প্রতি সবার ভালো আগ্রহ দেখছি। কার প্রতি কম বা বেশি ভালোবাসা বিচার করিনি কখনো। বরং বলব দর্শকরা আমাদের দু’জনকেই ভালোবাসেন।
আমরা কেউই আত্মসংকটে ভুগি না: রফিকুল আলম
সংগীতশিল্পী রফিকুল আলম চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার বিনোদপুরের লছমনপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা প্রয়াত ডা. গিয়াসউদ্দিন আহমেদ ও মা মমতাজ বেগম। চার ভাই ও দুই বোনের মধ্যে রফিকুল আলম চতুর্থ সন্তান। প্রথিতযশা সংগীতশিল্পী ও বঙ্কিম বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ড. সারোয়ার জাহান হলেন তার বড় ভাই। রফিকুল আলমের সহধর্মিণী দেশবরেণ্য সংগীতশিল্পী- আবিদা সুলতানা।
১৯৪৭ সালের দেশ-বিভাগ পরবর্তী সময়ে তার পিতা ডা. গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, দুই স্ত্রী এবং তাদের সন্তানসহ পরিবারের সবাই তৎকালীন মালদহ জেলার কৃষ্ণপুর থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুরের বোয়ালিয়া, রহনপুর এবং সবশেষে রফিকুল আলমদের মাতুলালয়/নানির বাড়ি অর্থাৎ চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের বিনোদপুরের লছমনপুর গ্রামে স্থানান্তর হয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। ডা. গিয়াস উদ্দিনের দ্বিতীয় স্ত্রী ছিলেন রহিমা খাতুন। রহিমা খাতুনের পাঁচ ছেলে পরিবারসহ স্থায়ীভাবে বিনোদপুরের লছমনপুর গ্রামে এখনো বসবাস করছেন। রফিকুল আলমের পিতা ডা. গিয়াস উদ্দিনের কবরও রয়েছে বিনোদপুরের লছমনপুর গ্রামে। উচ্চ শিক্ষার জন্য পরবর্তীতে রফিকুল আলম এবং তার বড় ভাই-প্রফেসর সারোয়ার জাহান রাজশাহীতে চলে যান।
সংগীতশিল্পী রফিকুল আলম ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ শিল্পী গোষ্ঠীর নেতৃত্বে এবং স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের বিশিষ্ট শিল্পী হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে অনবদ্য অবদান রাখেন। তৎকালীন বেতার-টেলিভিশনের সংগীতবিষয়ক নানা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ ও পরিচালনা করেন। বাংলা গানের ভুবনে দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর (পাঁচ দশক) ধরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন রফিকুল আলম।
কথা প্রসঙ্গে বলি, আবিদা সুলতানার সঙ্গে আপনার পরিচয়ের কথাটি জানলাম আপার কাছে। আপনার কাছে প্রশ্ন, তার প্রতি ভালো লাগা কিংবা ভালোবাসা কখন তৈরি হয়। রফিকুল আলম বলেন, “আবিদার প্রতি আকর্ষণ তৈরি হয় সত্তর দশকের মাঝামাঝি, ‘দূরের আকাশ’ শিরোনামের একটি গান রেকর্ড করতে গিয়ে। মোহাম্মদ রফিকুজ্জামানের লেখা ও ওস্তাদ মীর কাশেম খানের সুরে এই গানে দ্বৈত কণ্ঠ দিয়েছিলাম আমরা। ওই দিনই মুগ্ধ হয়েছিলাম আবিদার কণ্ঠমাধুর্যে। তার গায়কি ধরন একেবারেই আলাদা। এক সময় আবিষ্কার করি, কণ্ঠের মতো আবিদার মনটাও অসম্ভব সুন্দর।” ভালো লাগা ভালোবাসায় রূপান্তরিত হলো কীভাবে? রফিকুল আলম বলেন,‘ওদের পরিবারের সঙ্গে আমি কক্সবাজার গিয়েছিলাম ওর মামার আমন্ত্রণে। পরিবেশও মনের ওপর ছায়া ফেলে। একে তো আমরা শিল্পী। আবেগপ্রবণ। সমুদ্র, পাহাড় আর বনানীঘেরা কোনো পরিবেশে একে অপরকে কাছাকাছি পেয়েছি, তখন মনের আগল আপনা-আপনি খুলে গেছে। বলতে পারেন সেই ভ্রমণের পর থেকেই আমরা একে অপরের হয়ে গেছি।’
আপনি প্রেমের প্রথম পর্বে কোনো চিঠি লেখেননি বলে আবিদা আপা অভিযোগ করেছেন। রফিকুল আলম চিঠি লেখার কথা স্বীকার করে বিস্ময়টা আরও বাড়িয়ে দিলেন। জানালেন, ‘প্রেমপত্র একটাও লিখিনি বললে ভুল হবে। একদিন আবিদা আমাকে বলল, আজ বাদে কাল আমাদের বিয়ে। অথচ আজ পর্যন্ত একটা প্রেমপত্র পেলাম না, বিষয়টা কেমন হলো! এ কথা শুনে আমিও ভাবলাম, আসলেই তো। সে কথা ভেবে, আবিদার সঙ্গে যোগাযোগ করে, গায়ে হলুদের আগে রাজশাহী থেকে একটা চিঠি পাঠিয়েছিলাম। তবে দুঃখজনক হলো চিঠিটা তার কাছে পৌঁছেছিল গায়ে হলুদের দিন।
গানের ভুবনে দু’জনই ভালো গান করেন; কিন্তু তাদের মধ্যে কোনো প্রতিযোগিতা হয় কি-না। এমন প্রশ্নের উত্তরে রফিকুল আলম বলেন, ‘আমি একজন পুরুষ শিল্পী আর ও হচ্ছে (আবিদা সুলতানা) একজন মহিলা শিল্পী। এখানে প্রতিযোগিতা হওয়ার তেমন কথা নয়। সারাবিশ্বে মেয়েরা জনপ্রিয় হওয়ার একটি সুবিধা পায়। আমার মতো যুক্তিগ্রাহ্য একজন ব্যক্তি এটি মেনে নেয়। আবিদা যদি কোনো ভালো গান গায়, তখন মনে হয়, আমাকেও একটা ভালো গান গাইতে হবে। এ প্রতিদ্বন্দ্বিতা চললেও আমরা কেউই আত্মসংকটে ভুগি না।’ রফিকুল আলমের এ কথার রেশ ধরে আবিদা সুলতানা বলেন, ‘আমাদের মধ্যে কে বেশি ভালো গায়, কে বেশি জনপ্রিয় তা নিয়ে কখনো ভাবিনি। এ কারণে আমাদের মধ্যে কোনো অহমিকা কাজ করে না। ও যদি ভালো একটি গান করে আমি চেষ্টা করি তার চেয়ে ভালো একটি গান করতে; কিন্তু কখনো মনে আসে না ও যেন খারাপ গায়।’
আবিদা সুলতানা স্ত্রী হিসেবে কেমন জানতে চাইলে উচ্ছ্বসিত গলায় রফিকুল আলম বলেন, অসাধারণ! তার যে বিষয়টি আমাকে সবচেয়ে মুগ্ধ করে, তা হলো প্রচ-রকমের ভালোবাসে সে আমাকে। এটা প্রেমের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত একই রকমের রয়েছে। আর একটা দিক হলো খুব যত্নবান। আমরা প্রায় সময় একই সঙ্গে বিভিন্ন দেশ-বিদেশে ভ্রমণ করেছি, গান করেছি। ও যতই ক্লান্ত থাক না কেন, আমার প্রয়োজনীয় খুঁটিনাটি বিষয়গুলো আগে গুছিয়ে পরে নিজের কাজ করত। আর একটা দিক হলো ও খুব মজার রান্না করতে পারে। আমি খেতে খুব পছন্দ করি। যখনই সময় পায় নতুন নতুন রান্না করে সে। আপনার সন্তানের মা হিসেবে আবিদা কেমন জানতে চাইলে বলেন, এক কথায় খুবই দায়িত্ববান। সে তো বেশিরভাগ সময় দেশের বাইরে থাকত। তখনো দেখতাম প্রতিটি মুহূর্তে সাফদানের খবর নিতে। আর বাসায় থাকলে তো সাফদান ছাড়া কোনো কথাই নেই।
আবিদা সুলতানার আরও একটা দিক সম্পর্কে বলি সেটা হলো তার ছেলের বউয়ের সঙ্গে সম্পর্ক খুবই ভালো। এখনকার পরিবারগুলোতে দেখা যায় বউ-শাশুড়ির মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ চলে; কিন্তু আবিদার মধ্যে তা দেখিনি। সে তার ছেলের বউয়ের সঙ্গে সময় পেলে শপিংয়ে যাচ্ছে। এক সঙ্গে রান্না করছে। নতুন রান্না শিখছে। বিভিন্ন পার্টিতে যাচ্ছে। আসলে আমরা আমাদের পরিবারের জন্য কোনো বউ আনিনি। মেয়ে এনেছি। এই উপলব্ধিটা সবার মধ্যে থাকলেই আর সমস্যা থাকবে না।
ছেলে সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের ছেলে এখন ৭১ টিভিতে সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করছে। সে খুব মেধাবী এবং আমাদের মতো অগোছালো নয়। বরং অনেক বেশি গোছালো।
আমাদের সময় যে ধরনের ছবি হতো, যে ধরনের গল্পের ওপর নায়ক-নায়িকা অভিনয় করতেন, পুরো বিষয়টি এখন পরিবর্তন হয়ে গেছে। এর মানে যে ভালো কোনো গান হচ্ছে না, তা কিন্তু নয়। সারা পৃথিবীতে একটি পরিবর্তন এসেছে। আমরাও চেষ্টা করছি ওই পরিবর্তনের সঙ্গে এগিয়ে চলতে। রফিকুল আলম আরও বলেন, শুধু গানে নয়, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির সব শাখায় এই পরিবর্তন হচ্ছে। আর এই পরিবর্তনকে যারা মেনে নিতে পারবে না, তারা কিন্তু ছিটকে পড়বে। আর যারা ধারণ করতে পারবে তারাই টিকে থাকতে পারবে। আমি এখনো মঞ্চে অনেক তরুণ শিল্পীর সঙ্গে গান পরিবেশন করি। তারা যেভাবে গান করেন আমিও সেভাবে গান করি। তাদের সঙ্গে আমার পার্থক্য শুধু বয়সে।
বর্তমানে গান দেখার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন শিল্পীরা গান থেকে মিউজিক ভিডিওর দিকে বেশি নজর দিচ্ছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে রফিকুল আলম বলেন, ‘আমাদের আগে শিল্পী হতে হবে। আগে গানটি ভালো করে গাইতে জানতে হবে। এখন অনেক কণ্ঠশিল্পী গানের জগতে এসেছেন। তারা যদি গানটিকে ভালো করে শিখে মিউজিক ভিডিও নির্মাণ করে তাতে কোনো ক্ষতি আছে বলে আমি মনে করি না।’
তার কালজয়ী গানগুলোর সৃষ্টির কথা প্রসঙ্গে রফিকুল আলম বলেন, ‘এক হৃদয়হীনার কাছে’ গানের সৃষ্টির কথা অনেক মজার। আমি অত্যন্ত ভাগ্যবান শিল্পী, কারণ লাকী আখন্দের সুর করা ‘তোমাকে যেন ভুলে না যাই’ শিরোনামের গানটি করে বেশ জনপ্রিয়তা পাই। গানটি খুব অল্প সময়ে বেশ জনপ্রিয়তা পায়। এই গানটির জনপ্রিয়তার পর পর আমার ডাক আসে সিনেমার গানে। তারপর ‘অতিথি’ সিনেমায় একটি গান করি। গানটি শ্রদ্ধেয় গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লেখা, সত্য সাহার সুর। এই গানটি প্রচারের পর এফডিসিতে আমি আলোচনায় চলে আসি। তার দুদিন পরই আলাউদ্দিন আলী আমাকে ডাকেন রেডিওর জন্য একটি গান করাবেন বলে। আলাউদ্দিন আলী ওই সময় পূর্ণাঙ্গ মিউজিক ডিরেক্টর ছিলেন না। তিনি আমাকে বললেন, আমি তো ভালো কোনো শিল্পী পাচ্ছি না। তোমাকে দিয়ে একটি গান করাতে চাই। তারপর আলাউদ্দিন আলী নিজেই গানটির প্রথম একটি লাইন লিখেন। পরদিন আমাকে রেডিওতে আসতে বলেন। তারপর কিছুদিন তার আর কোনো খবর নেই। এর কিছুদিন পর আবার যোগাযোগ করলেন; কিন্তু রেকর্ডিংয়ে গিয়ে তিনি বললেন, গানটি আমার মনমতো হচ্ছে না। এরপর রেকর্ডিং বন্ধ করে অন্য আরেকটি স্টুডিওতে গানটি নিয়ে গেলেন। তখন এই গানটির জন্য ডাকা হয় লাকী আখন্দকে। দুটি স্টুডিও ঘুরে অনেক প্রচেষ্টার পর এই গানটি আমি গাই। অনেকটা সময় নিয়ে এই গান তৈরি হয়েছিল।’
এখনকার টিভি লাইভে শিল্পীদের পরিবেশনা নিয়েও অনেক বিতর্ক রয়েছে। আপনার কি মনে হয়? এ প্রসঙ্গে রফিকুল আলম বলেন, এতদিন ধরে গান গাইছি। যখন গাই সবাই বলেন যে, ‘একই রকম কণ্ঠ আপনার। এতটুকু বদলায়নি।’ রফিকুল আলমের একটি আক্ষেপ রয়েছে। এ প্রজন্মের বেশির ভাগ শিল্পীই গানের ভেতরে ঢুকছেন না। অথচ একটা সময় আমরা কত কষ্ট করেছি গান নিয়ে।
রফিকুল আলম বলেন, আমাদের দু’জনের মধ্যে কে বেশি ভালো গায়, কে বেশি জনপ্রিয় তা নিয়ে কখনও ভাবিনি। বরং অগণিত ভক্ত-শ্রোতার ভালোবাসার দাবি মেটাতেই ভালো কিছু গান করার বাসনা লালন করে আসছি। শ্রোতারাই আমাদের দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার প্রেরণা।
শিল্পী জীবন নিয়ে রফিকুল আলম আরও জানান, এ জীবনে আমার কোনো অপূর্ণতা নেই। শ্রোতাদের যা দিয়েছি, তার বিনিময়ে পেয়েছি অনেক বেশি। কিন্তু ভালো গানের জন্য একটা অতৃপ্তি আছেই। যদিও আমার অনেক গান মানুষের হৃদয়ে কেড়েছে, অনেক গানের জন্য প্রশংসাও পেয়েছি সংগীতবোদ্ধাদের। তারপরও মনে হয় আরও কিছু গান গাইতে হবে, যা আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে দীর্ঘকাল। আমার ধারণা, যারা সত্যিকারের সংগীত পূজারী তাদের মধ্যে একটা অতৃপ্তি চিরকাল থেকে যায়। আমারও আছে। হয়তো আমৃত্যু তা থেকেই যাবে।