Logo
×

Follow Us

বিনোদন

‘চোখ যে মনের কথা বলে’

গানের গীতিকার বিভ্রান্তি ও অন্যান্য

Icon

আহমেদ বাবলু

প্রকাশ: ২৬ অক্টোবর ২০২১, ১৫:৫৭

গানের গীতিকার বিভ্রান্তি ও অন্যান্য

ছবি: সংগৃহীত

সেদিন আমার কাছের বন্ধু পুরনো একটা বাংলা গান শুনতে চাইলে সঙ্গে সঙ্গেই ইউটিউবে সার্চ করে গানটি চালিয়ে দিলাম। গানটি ছিল- 

আমি চাঁদকে বলেছি আজ রাতে 

জোছনা লুকাতে

তুমি ভয় পেও না

গানের গীতিকার মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান, সুরকার ও শিল্পী খন্দকার নুরুল আলম।

ইউটিউব শুধু গানটি শোনাতেই সহযোগিতা করল না বরং আগ বাড়িয়ে এই শিল্পী ও সুরকারের আরও বেশ কিছু গান চোখের সামনে নিয়ে এলো, যা সে অহরহ করে থাকে। সেইসব গানের মধ্যে কালোত্তীর্ণ একটি গানও আছে

চোখ যে মনের কথা বলে

চোখে চোখ রাখা শুধু নয়

চোখের সে ভাষা বুঝতে হলে

চোখের মতো চোখ থাকা চাই

অনেকেই হয়তো খন্দকার নুরুল আলম নামটির সঙ্গে পরিচিত নাও হতে পারেন; কিন্তু এমন মানুষ এই বাংলায় খুব কমই পাওয়া যাবে, যারা এই গানটি একবার হলেও শোনেননি। অনেক সময় উত্তীর্ণ হয়ে বর্তমান প্রজন্মের কাছেও এই গান সমাদৃত এখনো। যে গানে কণ্ঠ দিয়েছিলেন খন্দকার নুরুল আলম নামের অসাধারণ এক সংগীতকার। 

আমি শুধু গানটি শুনেই ক্ষান্ত হই না, জানতে চাই এমন চমৎকার একটি গানের নির্মাতা কারা? অর্থাৎ গানটির গীতিকার এবং সুরকার কে কে ছিলেন? 

সুরকার হিসেবে অনুমেয় নামটিই সামনে আসে, প্রথম গানটির মতো এই গানেরও সুরকার একজনই- খন্দকার নুরুল আলম। বাংলা চলচ্চিত্রে অসংখ্য জনপ্রিয় গানের সুরকার তিনি। সমস্যা দেখা দেয় গীতিকার প্রসঙ্গে, কোথাও লেখা আছে গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার আবার কোথাও লেখা কাজী আজিজ আহমেদ। ধাঁধা তৈরি হয়! ভেতর থেকে প্রশ্ন আসে- গান তুমি কার? আসুন উত্তর খুঁজি।

অনলাইন দুনিয়ার তথ্য যাচাই বাছাই না করে খুব সহজেই বিশ্বাস করবেন না, এই পরামর্শ দিয়ে আমরা অনুসন্ধানে নামতে চাই। গানটি যে ছবিতে ব্যবহার হয়েছিল সেই ছবিটির নাম ‘যে আগুনে পুড়ি’ পরিচালক- আমির হোসেন, মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭০ সালে। অথচ তথ্য হিসেবে দু’একটা জায়গায় গীতিকার সুরকার হিসেবে কিন্তু আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের নামও আছে এবং শিল্পী হিসেবে পেয়ে যাবেন এন্ড্রু কিশোরকে। যদিও এই দু’জনের বাংলা চলচ্চিত্রে তখনো আবির্ভাবই হয়নি। অবশ্য এই বিভ্রান্তির একটা কারণ রয়ে গেছে।

‘যে আগুনে পুড়ি’ চলচ্চিত্রের ৩০ বছর পর শরৎ চন্দ্রের দত্তা উপন্যাসের ছায়া অবলম্বনে মোহাম্মদ হোসেনের পরিচালনায় ‘আজ গায়ে হলুদ’ নামে একটি ছবি মুক্তি পায়। সেই ছবিতে এই গানটি নতুন করে গাওয়ানো হয় এন্ড্রু কিশোরকে দিয়ে এবং শিল্পী হিসেবে এন্ড্রু কিশোর এই গানের জন্য জাতীয় পুরস্কারও পান। ইউটিউবে এই ছবিটির ভিডিও পরিবেশক অনুপম মুভিজ। তারা এই গানের নিচে মূল শিল্পী সুরকারের নাম দিয়ে গানটির সংগীতে রি-অর্গানাইজার হিসেবে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের নাম দিয়েছেন। সাধারণ কোনো শ্রোতা হয়তো এই ভেবে ভুল করেছেন যে, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল সাধারণত যেসব ছবিতে সংগীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেন, তার অধিকাংশ ছবির গীতিকারও তিনি। আমার বিভ্রান্তি দূর করতে ছবিটা খুঁজে ছবির ফুটেজে সেঁটে থাকা টাইটেল দেখতে থাকি। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো টাইটেলে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের নাম শুধু গীতিকার হিসেবেই আছে, সুরকার হিসেবে নয়। সংগীত পরিচালক হিসেবে দেওয়া আছে মোহাম্মদ হোসেনেরই নাম, যিনি ছবিটিও পরিচালনা করেছেন। মজার ব্যাপার হলো অনুপম মুভিজের আপলোড দেওয়া এই ছবির আরেকটা গানে আবার গীতিকার মুন্সি ওয়াদুদের নাম এবং সুরকার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল! যা ছবির মূল ফুটেজের সঙ্গে একেবারেই মিল নেই। যাই হোক আমরা মূল প্রসঙ্গে ফিরে যাই।

অনলাইনের এই যাচ্ছেতাই তথ্য বিভ্রান্তিতে আমি বরং যে কোনো মাধ্যমের সাক্ষাৎকার বা প্রকাশিত কোনো গ্রন্থ পেলে তার ওপর আস্থা রাখি বেশি। চলচ্চিত্রের গান নিয়ে প্রথমা প্রকাশন থেকে একটি বই প্রকাশিত হয়েছে ‘বাংলাদেশের সিনেমার স্মরণীয় গান ১৯৫৬-২০১৬’ বইটিতে গবেষক, সংকলক ও সম্পাদনায় মুদ্রিত আছে আসলাম আহসান এর নাম। এই বইটির ওপর আমার ভীষণ আস্থা। আস্থা থাকার কারণ এই বইয়ে যেসব তথ্য বা টীকা দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশের সংগীত সম্পর্কিত ইতিহাসের কথা মাথায় রাখলে তা রীতিমতো অবিশ্বাস্য! প্রতিটি গানের সঙ্গে ছবির নাম, মুক্তির তারিখ, পরিচালক, গীতিকার, সুরকার, শিল্পী, এমনকি কারা কারা অভিনয় করেছিল বা গানে ঠোঁট মিলিয়েছিল সেসব তথ্যও যতটুকু সম্ভব নির্ভুলভাবে দেওয়ার আন্তরিক চেষ্টা ছিল। এ ছাড়াও কোনো গান নিয়ে যদি কোনো তথ্য বিভ্রান্তি থাকে বা তর্ক থাকে সেটিরও ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। যেমন ‘অনেক সাধের ময়না আমার বাঁধন কেটে যায়’ গানটি সৈয়দ শামসুল হক এবং গাজী মাজহারুল আনোয়ার দু’জনেরই দাবি ছিল এটি তাদের লেখা, আসলাম আহসান বলা যায় গোয়েন্দা গল্পের মতো নানা তথ্যাদি হাজির করে প্রমাণ করেছেন সৈয়দ হকের দাবিটা ঠিক ছিল না! ওটা সত্যিই গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লেখা। সুতরাং সিনেমার গানের প্রয়োজনে আমি এই বইটিকে সব সময় অগ্রাধিকারে রাখি। 

আলমারি থেকে টেনে নিলাম বইটি। গানটির সঙ্গে যেসব তথ্য দেওয়া আছে তা তুলে দিচ্ছি-

ছবি- যে আগুনে পুড়ি

রিলিজ ২ জানুয়ারি ১৯৭০

কথা- কাজী আজিজ আহমেদ 

সুর- খন্দকার নুরুল আলম

কণ্ঠ- খন্দকার নুরুল আলম

অভিনয়- রাজ্জাক

চিত্রপরিচালক- আমীর হোসেন

আমার তবু ধন্দ কাটে না। যদি তাই হবে, তাহলে গাজী মাজহারুল আনোয়ারের নাম এলো কীভাবে? এবার আলমারি থেকে টেনে নিই সম্প্রতি প্রকাশিত গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লেখা একটি বই ‘বিখ্যাত গান সৃষ্টির নেপথ্য গল্প -অল্প কথার গল্প গান’ বইটি। বিস্ময়ের সঙ্গে দেখলাম শুরুর দিকেই আছে এই গানটি। বইটিতে গান রয়েছে ২০০টি সেই সঙ্গে ৫০টি গান সৃষ্টির নেপথ্য গল্প। দারুণ ব্যাপার হলো চোখ যে মনের কথা বলে গানটি কীভাবে লেখা হয়েছে, তা এখানে তুলে ধরা আছে। সেই গল্পটি আপনাদের একটু পরে শোনাই। তার আগে অনুসন্ধান করে আসি এখানে কাজী আজীজ আহমেদের নাম গীতিকার হিসেবে আসার উৎস কী?

গানটির গীতিকার সুরকারের নাম জানতে চেয়ে গুগলে সন্ধান চালালে বেশকিছু পত্রিকার সূত্র সামনে আসে, যার শিরোনামগুলো মূলত এমন-

‘চলে গেলেন চোখ যে মনের কথা বলে গানের গীতিকার’ কিংবা 

‘চোখ যে মনের কথা বলে গানের গীতিকার আর নেই’ 

বোঝা যায় আজীজ আহমেদের মৃত্যু সংবাদ সেগুলো। তিনি মারা যান ২০১৮ সালের ৩০ জানুয়ারি। সেখান থেকে আরও যা জানতে পারি, তার কিছুটা তুলে ধরছি- 

‘বাংলানিউজ টোয়েন্টিফোর.কম’ থেকে, যা প্রকাশিত হয়েছিল ৩০ জানুয়ারি ২০১৮ সালে। “পরিচালনার চেয়ে চলচ্চিত্রের কাহিনী, চিত্রনাট্য ও গান লেখায় বেশি আগ্রহী ছিলেন কাজী আজীজ। তার লেখা চিত্রনাট্যে নির্মিত হয়েছে ‘যে আগুনে পুড়ি’, ‘চোখের জলে’, ‘ক খ গ ঘ ঙ’, ‘এরাও মানুষ’, ‘ওরা ১১ জন’, ‘সংগ্রাম’, ‘অনন্ত প্রেম’, ‘বাজিমাত’সহ অসংখ্য নন্দিত চলচ্চিত্র”। 

এবার অনুসন্ধান চালাই ইউটিউবে। সেখানে নানান সূত্রের সঙ্গে চ্যানেল আইয়ে প্রচারিত ‘সোনালি সুরের স্মৃতিময় গান’ শিরোনামে একটা অনুষ্ঠানের সন্ধান পাই। অনুষ্ঠানটি পরিকল্পনা, উপস্থাপনা ও পরিচালনা করেন শাইখ সিরাজ। সে অনুষ্ঠানে আলোচিত গানটি পরিবেশন করেন তরুণ শিল্পী ইউসুফ। গান শুরুর আগে শাইখ সিরাজ গানটি সম্পর্কে যেসব কথা বলেন তা অনেকটা এরকম- 

‘গানটির গীতিকার আজীজ আহমেদ অবলিগ গাজী মাজহারুল আনোয়ার। আমার সঙ্গে গাজী ভাইয়ের কথা হয়েছে তিনি গানটি তাঁর বলে দাবি করেছেন, অন্যদিকে সুচন্দা আমাকে অন্য ধরনের তথ্য দিয়েছেন, গানটি লিখেছিলেন আজীজ আহমেদ সুচন্দার চোখ দেখেই কোনো এক স্যুটিং স্পটে’। 

এরপর তিনি জানান, গাজী মাজহারুল আনোয়ার বলেছিলেন- 

‘প্রথম দু’একটি লাইন নিয়ে হয়তো বিতর্ক আছে’- যাই হোক আমরা সেই বিতর্কে যাব না, আমরা একটা ভালো গান শুনব। 

এরপর যখন গান শুরু হয়ে যায়, তখন তথ্য হিসেবে আর কোনো অবলিগ রাখলেন না, গীতিকার হিসেবে আজীজ আহমেদের নাম ফুটেজে ভেসে ওঠে। 

শাইখ সিরাজের তথ্যের সম্পূরক হিসেবে আরেকটি অনুষ্ঠানেরও সন্ধান পেয়ে গেলাম। ব্যাকস্ক্রিন দেখে বুঝতে পারি এটির আয়োজক এইচএসবিসি ব্যাংক। অনুষ্ঠানের শিরোনাম ‘চোখ যে মনের কথা বলে- জীবনের বাঁকে, ডাকে সোনালি দিনের সুর’। 

এই অনুষ্ঠানে গানটি পরিবেশন করেন বাংলাদেশের স্বনামধন্য শিল্পী সুবীর নন্দী। পরিবেশনার আগে তার কথাতেও গীতিকার নিয়ে ধন্ধ ধরা পড়ে, তিনি বলেন, ‘যদ্দুর জানি- গানটির গীতিকার এম এ আজীজ’ 

(এখানে খুব সূক্ষ্মভাবে তথ্য বিকৃতি আরেকটু নতুন মাত্রা পেল, আজীজ আহমেদ বা কাজী আজীজ আহমেদ না, হয়ে গেলেন- এমএ আজীজ- দুঃখজনক) 

এরপর ঘটল আরও দারুণ ঘটনা, শিল্পীকে অপেক্ষায় রেখে অনুষ্ঠানের উপস্থাপক, অভিনেতা আফজাল হোসেন মঞ্চে ডেকে নিলেন আলোচিত গানটি যে সিনেমায় ব্যবহৃত হয়েছে সেই ছবির নায়িকা সুচন্দাকে। সুচন্দা তখন শাইখ সিরাজ যে কথার সূত্রপাত করেছিলেন সেই ঘটনাটি বিস্তারিতভাবে বললেন, তার বক্তব্যটি এরকম-

‘এই স্মৃতিচারণের মধ্য দিয়ে আমি ফিরে যাচ্ছি এই গানের সৃষ্টি মুহূর্তে। আমি (সুচন্দা) ও নায়ক রাজ্জাক, আমরা দু’জনে একটি ছবির স্যুটিং করছি। শর্ট রেডি। রোমান্টিক দৃশ্য চিত্রায়িত হবে। এর মধ্যে হঠাৎ আমি দেখছি, সেটের কোণায়, পাতলা লম্বা একজন লোক বসে পান চিবাচ্ছেন, আর আমার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। আমি একটু বিব্রত বোধ করছিলাম, ওই মুহূর্তে প্রয়াত চিত্রপরিচালক চাষী নজরুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন, আমি বললাম- চাষী ভাই, ওই ভদ্রলোক কে? অমন করে তাকিয়ে আছে! আমার খারাপ লাগছে। আমি এই রোমান্টিক শর্ট দিতে পারব না। আপনি একটু দয়া করে ওনাকে অনুরোধ করুন, উনি যেন একটু অন্য জায়গায় গিয়ে বসেন। তখন চাষী নজরুল ইসলাম সাহেব বললেন- ম্যাডাম আপনি ওই ভদ্রলোকের কথা ভুলে গিয়ে শর্টটা দিন, তারপরে আপনি বুঝতে পারবেন উনি কে, জানতে পারবেন তার পরিচয়-

সেই মোতাবেক আমি, রাজ্জাক, দু’জনেই রোমান্টিক দৃশ্যের সেই শর্টটা দিলাম। ... হঠাৎ দেখলাম চাষী ভাই একটি কাগজ হাতে করে নিয়ে আমার কাছে দিলেন, আমি কাগজটি পড়ে দেখলাম এই গানটি ‘চোখ যে মনের কথা বলে’। 

তার মানে এতক্ষণের তথ্য প্রমাণ এই কথাই বলে যে, ‘অনেক সাধের ময়না আমার বাঁধন খুলে যায়’ গানটির গবেষক আসলাম আহসান, গাজী মাজহারুল আনোয়ারের দাবিকে অসাধারণ ভাবে প্রমাণ করে দিলেও এই গানের বেলায় গাজী সাহেবের দাবি নিয়ে অন্ধকার বেশ গাঢ় হয়ে এসেছে। তবে এই অন্ধকারটুকু সরিয়ে প্রকৃত সত্যিটাকে বের করে আনা যায় কিনা সেই প্রচেষ্টা আমি আরও কিছুটা অব্যাহত রাখতে চাই। এবার সময় হয়েছে গাজী মাজহারুল আনোয়ার তার বয়ানে এই গান সৃষ্টির নেপথ্য গল্পটা কী বলেছেন তা শোনার। 

প্রত্যেক মানুষের কিছু শখ থাকে এবং বিশেষ বিশেষ ঘটনার দিকে তাঁদের দৃষ্টিপাত থাকে। এ দেশের অনেক গুণী সুরকারের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি তাদের একেকজনের বিশেষ বিশেষ কিছু গুণ এবং অভ্যাস আছে। এ দেশের একজন প্রখ্যাত সংগীত পরিচালক খন্দকার নুরুল আলম। খন্দকার সাহেবের ‘সুন্দর’ এবং ‘চোখ’ এই দুই শব্দের প্রতি বিশেষ দুর্বলতা ছিল। তখন আমার চলচ্চিত্রের গান লেখার ব্যস্ততা এতটাই বেশি ছিল যে, ভোর থেকে শুরু করে গভীর রাত পর্যন্ত বিভিন্ন সুরকারের সঙ্গে কাজ করে সময় পার হয়ে যেত।

খন্দকার সাহেব যখন আমার অপেক্ষায় বসে থাকতেন তখন তার কাছে যেতে যেতে ভাবতাম যে ‘চোখ’ শব্দ দিয়ে কোনো গান লিখলে হয়তো তিনি সন্তুষ্ট হবেন। জানি না কখন কোন সময় কার চোখে চোখ পড়ে তার দৃষ্টিবিনিময় হয়েছিল। সেই থেকেই হয়তো বা চোখের প্রতি তার এই বিশেষ দুর্বলতা। তিনি তখন আমীর হোসেন এর পরিচালনায় ‘যে আগুনে পুড়ি’ চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনা নিয়ে ব্যস্ত। সেই চলচ্চিত্রে গান লেখার জন্য তার বাসায় পৌঁছতেই তিনি বললেন, ‘তুই আসতে এত দেরি করলি কেন? আমি তো তোর অপেক্ষায় পথ চেয়ে বসে আছি।’

আমি দুষ্টুমি করে বললাম, ‘চোখ মনের কথা কীভাবে প্রকাশ করে তা নিয়ে ভাবতে ভাবতে দেরি হয়ে গেল।’

খন্দকার সাহেব তখন উৎফুল্ল হয়ে বললেন, ‘এই তো পেয়েছি! ছবির একটি সিচুয়েশন ঠিক এরকমই। মুখে প্রকাশ না করে চোখের ভাষায় ভালোলাগার কথা প্রকাশ করতে হবে। এক্ষুণি লেখাটি শেষ করো।’

আমি সেখানে বসেই গানটি লিখে ফেলি এবং খন্দকার সাহেব সুরারোপ করে নিজেই গানটি গাইলেন। পৃষ্ঠা-৪০

এবার গাজী সাহেবের পক্ষে তথ্য অনুসন্ধান করতে গিয়ে আশ্রয় নিই মূল ছবিটিকেই। এইসব বিষয়ে সবচে বড় এক নির্ভরতা সিনেমার ফুটেজে উল্লিখিত টাইটেল। যদিও ইতিহাস সংরক্ষণে আমাদের দৈন্যতার যে সংস্কৃতি তা অব্যাহত থাকায় পুরনো অনেক ছবির ফুটেজ হারিয়ে গেছে বা নষ্ট হয়ে গেছে। যে আগুনে পুড়ি ছবির যে ফুটেজটা পাই সেটা এনটিভির লোগো সংবলিত তাদের চ্যানেলে আপলোড দেওয়া এবং টাইটেলের শুরুতে ফুটেজ নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণেই হয়তোবা অভিনেতা অভিনেত্রীদের নাম পরে এডিট করে বসানো হয়েছে এবং কিছুক্ষণ পরে অন্যান্য কলাকুশলীদের নাম অবশ্য মূল ফুটেজেই প্রদর্শিত হয়েছে, আর এখানেই উল্লিখিত গান নিয়ে একটু একটু করে আমাদের সুধীজনদের নির্মিত করা যে গাঢ় অন্ধকার, তা কেটে গিয়ে সঠিক তথ্যটি স্পষ্ট হয়ে আসে। কারণ সিনেমার মূল ফুটেজে শুধু একজন গীতিকারের নামই লেখা আছে, আর সেটি হলো গাজী মাজহারুল আনোয়ার।

এমন কি খন্দকার নুরুল আলমের চোখ প্রীতি নিয়ে গাজী সাহেব যে মন্তব্য করেছেন তারও একটা নিদর্শন রয়ে গেছে এই ছবির আরেকটি শ্রোতা প্রিয় গানের কথায়, যেটি গেয়েছিলেন শিল্পী মাহমুদুন্নবী-

কে যেন আজ আমার চোখে

নতুন আলো দুলিয়ে দিলো

চলার পথের ক্লান্তিগুলো

কে যেন আজ ভুলিয়ে দিলো।

এবার উলটো প্রশ্ন আসাটা কিন্তু স্বাভাবিক, তা হলো এই গানটির গীতিকার হিসেবে যে কাজী আজীজ আহমেদের নাম ছড়িয়ে পড়ল এর ভিত্তি কী? ধারণা করি এই বিভ্রান্তির সূত্রপাত হয়েছিল চিত্রনায়িকা সুচন্দার সেই জবানিকে ধরেই, কিন্তু সুচন্দার মতো সিনিয়র একজন শিল্পী গল্পটি বানিয়ে বানিয়ে বলবেন নিশ্চয় তা খুব সহজেই আমরা বিশ্বাস করতে পারি না। সুতরাং এই গানটির রচয়িতা গাজী মাজহারুল আনোয়ার তা প্রমাণিত হয়ে গেলেও অনুসন্ধানটা আরেকটু টেনে নিতে চাই বাকি অন্ধকারটুকুও যদি দূর করা যায় সেই লক্ষ্যে।

এবার যে সূত্রটি আবিষ্কার করি তা বিশ্লেষণ করলে আমার মনে হয় বিষয়টির একটা মধুরেণ সমাপয়েৎ হতে পারে। ‘আমার ছবি’ নামে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে বিষয় করে চ্যানেল আই এ নিয়মিত একটা অনুষ্ঠান প্রচারিত হতো। গবেষণার দিক থেকে বিচার করলে এই অনুষ্ঠানটি হতে পারে বাংলা চলচ্চিত্রের এক দুর্লভ আর্কাইভ। এই অসামান্য অনুষ্ঠানটির উপস্থাপক ছিলেন প্রবীণ সাংবাদিক, চলচ্চিত্র সংসদের কর্মী শফিউজ্জামান খান লোদী। এই করোনা মহামারিতে আমরা যাদের হারিয়েছি তাদের মধ্যে তিনিও একজন। ১৮ এপ্রিল ২০২১ তারিখে মারা যান তিনি। ‘আমার ছবি’র ২৭২তম পর্বে অতিথি হিসেবে এসেছিলেন খন্দকার নুরুল আলম। চোখ যে মনের কথা বলে গানটি নিয়ে তিনি যে অভিজ্ঞতার বয়ান পেশ করেছিলেন, সে বয়ানটিই আমাদের চলমান তথ্য বিভ্রান্তির অবসান ঘটাতে সবচে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

খন্দকার নুরুল আলমের ভাষ্য মতে জানা যায়, ‘যে আগুনে পুড়ি’ ছবিটির কাহিনী ও চিত্রনাট্যকার ছিলেন কাজী আজীজ আহমেদ। তিনি একদিন চোখ যে মনের কথা বলে গানটির প্রথম কয়েকটি লাইন লিখে সুরকারের কাছে নিয়ে এলে খন্দকার নুরুল আলম পছন্দ করলেন এবং সে কয়টি লাইনেরই সুর করে বাকি গানের কথা আজীজ আহমেদের কাছে চাইলেন, কিন্তু আজীজ আহমেদ তখন অপারগতা স্বীকার করে বললেন- বাকিটা আর আসছে না, হবে না আমার দ্বারা’। ফলে নুরুল আলম তখন গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ারকে দিয়ে বাকি গানটা লিখিয়ে নিলেন। এই হলো ইতিহাস।

এবার আমরা মনে করার চেষ্টা করি শাইখ সিরাজ তার অনুষ্ঠানে গাজী মাজহারুল আনোয়ারকে উদ্ধৃতি করে যে মন্তব্যটি প্রকাশ করেছিলেন, বলেছিলেন ‘প্রথম দু’একটি লাইন নিয়ে হয়ত বিতর্ক আছে’- এখন বোধহয় আমরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছতেই পারি যে সুচন্দা যে গল্পটি প্রকাশ করেছিলেন সেই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই গানটির প্রথম দুই লাইন হোক বা চার লাইন হোক, তা লিখেছিলেন ছবিটির কাহিনী চিত্রনাট্যকার কাজী আজীজ আহমেদ, পরে যা সম্পূর্ণ করেছিলেন ছবির অন্যান্য গানের গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার। আশা করি এরপর থেকে এই গানটি নিয়ে চলতে থাকা বিতর্কের অবসান হবে বা হওয়া উচিত। 

পরিশেষে আর দু’একটি কথা বলা দরকার মনে করছি। প্রশ্ন উঠতে পারে গাজী মাজহারুল আনোয়ার তার বইয়ে এই গানটি সৃষ্টির নেপথ্য গল্পে আজীজ আহমেদের নাম উল্লেখ করলেন না কেন? তা করলে হয়ত খুব সহজেই এই বিতর্কের অবসানটা হয়ে যেতে পারত। কারণ নতুন গান তৈরি করার জন্য গীতিকারের কাছে সেই গান বিষয়ে আইডিয়া, সিচুয়েশনের ব্যাখ্যা এমন কি কখনো কখনো দুই একটা লাইনও সুরকার বা ছবির কাহিনীকার, পরিচালক হরহামেশাই দিয়ে থাকেন, যা বিরল নয়। বাংলা গানের প্রবাদ প্রতিম শিল্পী ও সুরকার হেমন্ত মুখোপাধ্যায় নিজেই এক সাক্ষাৎকারে প্রকাশ করেছিলেন তার জনপ্রিয় অনেক গানের মুখটুকু তিনিই গীতিকারদের বলে দিতেন। এ ছাড়া ‘আমার ছবি’ অনুষ্ঠানে দেওয়া খন্দকার নুরুল আলমের যে সাক্ষাৎকারটির উল্লেখ করেছি এর শুরুতেও এমন একটি অভিজ্ঞতার বয়ান আছে। ১৯৭০ সালেই খন্দকার নুরুল আলম বাংলা সিনেমার সংগীত পরিচালনায় আসেন। যে আগুনে পুড়ি সম্ভবত তার দ্বিতীয় ছবি। একই সালে তার সুরারোপিত প্রথম ছবিটিও মুক্তি পায়, নাম- ‘অন্তরঙ্গ’, ছবিটির পরিচালক ছিলেন চলচ্চিত্র সম্পাদক সৈয়দ আওয়াল, কাহিনীকার ওবায়দুল হক। নুরুল আলমের বরাতেই জানা যায় ওবায়দুল হক চিত্রনাট্যের সঙ্গে দুটি গানেরও খসড়া লিখে নিয়ে এসেছিলেন শুধু মাত্র সুরকারকে বোঝানোর জন্য যে, কী ধরনের গান ডিমান্ড করছেন। খন্দকার নুরুল আলম সেই খসড়া লিরিকেরই প্রশংসা করে সুরারোপ করলেন, বশীর আহমেদের কণ্ঠে সেই গান সুপারহিট হয়ে উঠল

‘ভুল যদি হয় মধুর এমন হোক না ভুল

ভুলের রঙে রাঙলো যে মন 

হোক না ভুল হোক না ভুল’ 

সুতরাং কাহিনীকার আজীজ আহমেদের একটা গানের দুই/চার লাইন লেখার গল্পটি স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবেই তুল্যমূল্য করা যেতে পারে। যদিও কাজী আজীজ আহমেদ এখন জীবিত নেই এবং বেঁচে থাকতেও তাকে এই গান নিয়ে কেউ কোনোদিন কোনো প্রশ্ন করেছিলেন কিনা বা এই বিতর্কটি সম্পর্কে তিনি ওয়াকিবহাল ছিলেন কিনা তা জানা যায়নি এবং আর যাবেও না। আর গাজী মাজহারুল হক কেন তার বইয়ে এই ঘটনার উল্লেখ করলেন না সেটার একটা ব্যাখ্যা আমার মনে হয় এমন হতে পারে যে, বাংলা গানের ইতিহাস নিয়ে কখনই সিরিয়াস কোনো কাজ সেই অর্থে হয়নি। আমি যে দুটি বইয়ের উল্লেখ করেছি তার একটি প্রকাশ হয়েছে মাত্র বছর চারেক আগে ২০১৭ সালে। গাজী মাজহারুল আনোয়ারের বইটি এসেছে এই বছর অর্থাৎ ২০২১ এর বই মেলায়। ইতিমধ্যে উল্লিখিত গানটির বয়েস ৫০ পেরিয়ে গেছে, গীতিকারের বয়স এখন ৭৮। এত বছর আগের সব গল্প তারা ঠিকঠাক স্মরণ করতে পারবেন সেটা আশা করাটা অন্যায়। অনেক সাধের ময়না আমার বাঁধন কেটে যায় গানের বেলায়ও সেটাই হয়েছে বলে ধারণা করি। নয়ত সৈয়দ শামসুল হকের মতো শিল্পসমৃদ্ধ ব্যক্তিত্বও ভুল দাবি করতে পারেন না। বাংলা সংগীতের ইতিহাস নির্মাণে সংগীত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ যদি এখনো এগিয়ে না আসেন, তাহলে আমাদের সংগীতের সমৃদ্ধ আকাশ এমন অনাকাক্সিক্ষত অন্ধকারেই ঢাকা পড়ে থাকবে। 

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫