
মনিকা আনা মারিয়া বেলুচ্চি। ছবি: সংগৃহীত
সিনেমা জগৎ শুনলে মাথায় ভেসে আসে চাকচিক্যময় বর্ণিল এক অদ্ভুত জগতের কথা। এই সময় অবধি কতই না তারকা এলেন, নিজেদের মেধার ঝলকানিতে জায়গা করে নিলেন এ জগতে। আবার অনেকেই ম্লান হয়ে গেলেন। জ্বলে উঠতে না পেরে ঝরে গেলেন অকালেই। ফিল্মের নেশা যখন একেবারে তুঙ্গে, সেই নব্বইয়ের দশকে সিনেমা জগতে পা পড়লো ইতালীয় এক উর্বশী রমণীর, আবেদনময়ী এই নারী নজর কেড়ে নিলেন অনেকের। তিনি হলেন মনিকা আনা মারিয়া বেলুচ্চি।
পেশাগত জীবনে যিনি আমাদের কাছে মনিকা বেলুচ্চি নামে অতি পরিচিত। ৫৪ বসন্ত পার করেছেন; কিন্তু তাকে দেখে অবশ্য তার বয়স বোঝার কোনো জো নেই। ইউরোপের এই সৌন্দর্যময়ীর চোখের রহস্য ভেদ করতে বেগ পেতে হবে যে কারও। তবে রূপের এই বাহুল্য ছাড়াও মনিকার আছে অসাধারণ বাচনভঙ্গি আর শরীরী এক ভাষা, যা তার অভিনয়কে পরিপূর্ণতা দান করেছে।
মনিকা তার বয়সী মেয়েদের তুলনায় ছিলেন বেশ আলাদা। ছোটবেলা থেকেই তার ছিল লাবণ্যময় চেহারা। একবার নিষ্পাপ মুখটি দেখলে দ্বিতীয়বার ফিরে তাকাতেই হতো। এখন যেমন মধ্যবিত্ত পরিবারের কাছে শিক্ষার মূল্য অনেক বেশি। মনিকার বাবা-মায়ের কাছেও শিক্ষার মর্ম তেমনই হয়ে দাঁড়িয়েছিল। নিজের দারিদ্র্যের ছায়া মেয়ের ওপর পড়তে না দেওয়ার জন্যই, যেন ঢাল হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন উচ্চশিক্ষাকে। সেজন্যই বোধহয় মনিকা তার মাতৃভাষা ছাড়াও সেই বয়সেই বিশুদ্ধ ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ আর স্প্যানিশ শিখে ফেলেছিলেন, যা তার বয়সের তেমন কোনো ছেলেমেয়েই পারতো না।
কিশোরীকাল থেকে বাবা-মাকে আর্থিক সহায়তা যোগাতে মনিকা তৎপর হয়ে ওঠেন। পড়াশোনার পাশাপাশি কাজ নেন এক রেস্তোরাঁয় ওয়েট্রেস হিসেবে। এ সময় তার এক বন্ধু আরো বেশি অর্থোপার্জনের জন্য তাকে দেখিয়ে দেয় মডেলিংয়ের রাস্তা। তা ইউরোপ আর ভূমধ্যবর্তী রক্তের মিশ্রণ মনিকাকে সেই বয়সেই দিয়েছিল এক অদ্ভুত কমনীয়তা। ১৩ বছরের মনিকার আবির্ভাব মডেল জগতের কারও চোখ এড়াতে পারেনি। সেই থেকে শুরু। জীবনের নতুন অধ্যায়ে আর কখনো তাকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
মাত্র ১৬ বছর বয়সে তার সৌন্দর্যে সম্মোহিত হয়ে পড়েন বাঘা বাঘা সব আলোকচিত্রী। আর মডেলিং জগৎ মনিকার কাছে হয়ে গেল হাতের নাগালের চাঁদ। তিনি পুরোদস্তুর পেশাদার মডেল হয়ে পড়েন; কিন্তু এতে করে একটা ক্ষতি হয়ে যায় তার। আশৈশব লালিত আইনজীবী হবার স্বপ্নকে ইস্তেফা দিতে হয় তার। হাল ছেড়ে দেবার পাত্রী মনিকা কখনো ছিলেন না?
তাই ১৯৮৩ সালে ইতালির পেরুজিয়া ইউনিভার্সিটিতে আইন বিভাগে নিজেকে তালিকাভুক্ত করে নেন তিনি। পরে অবশ্য মাত্রাতিরিক্ত কাজের চাপে পড়ার পাট চুকিয়েই ফেলেন। ১৯৮৮ সালে ২৪ বছর বয়সী মনিকা চলে আসেন মিলানে, সেখানে ‘এলিট মডেল ম্যানেজমেন্ট’ নামে একটি মডেলিং এজেন্সিতে তিনি কাজ শুরু করেন। এক বছরের মাথাতেই তিনি ইউরোপ আর আমেরিকার ফ্যাশন জগতের সম্ভাবনাময় এক নাম হয়ে ওঠেন।
মডেলিং জগতে সাড়া ফেলে দেওয়া তারকা মনিকা নিজেকে সেখানে সীমাবদ্ধ রাখতে চাননি। অভিনয়ের প্রতি বিশেষ দুর্বলতা ছিল তার। ১৯৯০ সালে ‘ভিটা কোই ফিজলি’ নামের একটি টিভি সিরিজের মাধ্যমে অভিনয়ের ক্যারিয়ারের সূচনা করেন। একই বছরে ‘ব্রিগান্তি’ সিনেমাতে অভিষেক হয় তার। আর প্রথম সিনেমাতেই নিজের জাতটা চিনিয়ে দিতে ভুল করেননি মনিকা। এরপর পুরোদস্তুর অভিনয়ে মনোনিবেশ করেন তিনি। ইতালির গণ্ডিপেরিয়ে সমস্ত সিনেমা জগৎ ঘুরে বেড়াতে খুব একটা সময় লাগেনি তার। আমেরিকার সিনেমায় পদচারণা শুরু হয় ব্রাম স্টোকারের ‘ড্রাকুলা’ সিনেমার মধ্য দিয়ে। রক্তপিপাসু ড্রাকুলার স্ত্রীর ভূমিকায় তিনি সেখানে অভিনয় করেন।
তবে মনিকার ক্যারিয়ারের মোড় ঘোরানো সিনেমার নাম বলতে গেলে নিঃসন্দেহে আসবে ‘এল এপার্টমেন্ট’ (১৯৯৬) এর নাম। রোমান্টিক এই সিনেমায় লিসা চরিত্রে অভিনয় করে অনেক নাম-ডাক কুড়ান এই অভিনেত্রী, ঝুলিতে জমা হয় বেশ কিছু পুরস্কার। সে সময়ে বিখ্যাত ফরাসি অভিনেতা ভিনসেন্ট ক্যাসেলের সান্নিধ্যে আসেন তিনি। পরবর্তীতে তার বিপরীতে ফরাসি অ্যাকশন ফিল্ম ‘ডোবারম্যান’ এ অভিনয় করেন। এখানে তার চরিত্র থাকে অপরাধ জগতের এক অধিপতির প্রেমিকা হিসেবে।
মনিকা বেলুচ্চি সবসময় একটা বিষয়ে খুব সজাগ ছিলেন। এমনকি এই বিষয়টি তিনি মুখেও বেশ কয়েকবার বলেছিলেন যে, সুন্দরি মাত্রই যে কেউ চাইলেই তাকে বুদ্ধিহীন ধরে নিতে পারে, এমনটি যেন না হয়। নিজের রূপের ওপর তিনি যে নির্ভরশীল নন, তার প্রমাণ তিনি দিয়ে গেছেন বারবার। বেশিরভাগ সময়ে অনিয়মিত আর বিতর্কিত সব চরিত্রে তিনি অভিনয় করতেন, যা ফুটিয়ে তুলতে সেই বিশেষ চরিত্রকেই। সৌন্দর্যের মাত্রা দিয়ে কোনো চরিত্রকে আধিক্য দিতে চাইতেন না। সে জন্যেই ‘আন্ডারসাসপিশন’, ‘ম্যালেনা’, ‘ইররিভার্সিবল’ জাতীয় সিনেমায় তার চরিত্র নিয়ে প্রশংসার পাশাপাশি ঝড় ওঠে সমালোচনার, যার বেশিরভাগই এ লাস্যময়ী অভিনেত্রী পাত্তা দেননি।
একের পর এক সিনেমা উপহার দিতে থাকেন মনিকা। তবে ২০১৫ সালে মুক্তি পাওয়া ‘জেমস বন্ড’ সিনেমায় তিনি দেখান এক অভাবনীয় চমক। ড্যানিয়েল ক্রেইগের বিপরীতে বয়স্কা নারী হিসেবে প্রথম তিনিই অভিনয় করেন ‘বন্ডগার্ল’ চরিত্রে। মনিকা অবশ্য নিজেকে বন্ডগার্ল বলতে একেবারেই নারাজ ছিলেন। নিজেকে তিনি দাবি করেন বন্ডওম্যান বলে। নারী হিসেবে এই চরিত্রে আবির্ভাব নিয়ে এতটুকু আক্ষেপ নেই। এই বয়সেও তিনি চাইলে যে কোনো চরিত্রে খাপ খাইয়ে নিতে পারেন- সেটাই প্রমাণ করে দিলেন তিনি।