
বাণিজ্যিক ছবি আর স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বড় পর্দার এই দুই মাধ্যম নিয়ে অনেক বেশি বিতর্ক হচ্ছে বোদ্ধামহলে। এই দুই মাধ্যমকেও আবার অনেকে দুইভাবে ভাগ করে রেখেছে। স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রকে মূল ধারার বাণিজ্যিক ছবি বলতে নারাজ অনে পরিচালক, শিল্পীরা।
শর্ট ফ্লিম বা স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র কেন নির্মাণ করেন পরিচালকরা? দর্শক কেন দেখেন? বাণিজ্যিক ছবিতে প্রযোজকরা লগ্নি করতে চান না, এই ঘরানায় কারা লগ্নি করেন? এরকম হাজারো প্রশ্ন আছে দর্শক ও বোদ্ধ মহলের। বাংলাদেশে শর্টফিল্ম চর্চা কিভাবে হচ্ছে, যারা এ মাধ্যমে কাজ করে কাজ করেন এবং শর্টফিল্ম নিয়ে ভাবেন এরকম বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে অনেক কিছু।
গুণী নির্মাতা তানভীর মোকাম্মেল তিনি বর্তমান সময়ে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের সামগ্রিক অবস্থা অভিযোগ করে বলেন, দেশের সিনেমায় শয়ে শয়ে চলচ্চিত্রকার দেখা যায়। তারা কেউ শখের বশে, কেউ ফেসবুকে দিতে, কেউ ইউটিউবে নিজের একটি চ্যানেল করে টাকা আয়ের ধান্দায় করছেন এসব।
আবার কেউ টেলিভিশন নাটকের মন্দা সময়ে প্রযোজক না পেয়ে স্বল্প টাকায় তৈরি করছেন এসব। আবার দেখা গেল, কোনো বহুজাতিক কোম্পানি তাদের প্রচারে আয়োজন করল স্বল্পদৈর্ঘ্য প্রতিযোগিতা। সেখানে মাথায় ভূত চাপা তরুণ চলচ্চিত্র কর্মী বানিয়ে ফেলছেন চলচ্চিত্র। আদতে সেটি চলচ্চিত্র নাকি তার পণ্যের প্রমোশন তৈরি করা হলো, তা বিবেচনা করার তাগিদটুকুও নেই। এমনই দশা আমাদের আজকের স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের।
তিনি আরো বলেন, স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো, এই চলচ্চিত্র নির্মাতাদের সিংহভাগ তরুণ। যাদের চলচ্চিত্র নিয়ে পঠন পাঠনের সময়। এই সময়টাতেই সে ভুল জিনিস তৈরি করে নিজেকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, ভুল পথে হাঁটছে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র।
স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের নামে বিভ্রান্ত করছে দর্শকদের। বেশির ভাগ চলচ্চিত্রের ভিডিও ছাড়া অন্য কিছুর কোনো মৌলিকতা নেই। বিশেষ করে আবহ সংগীত। চলচ্চিত্রের আবহ সংগীত নাটকের মতো কপি করে কারও সংগীত লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এতে চলচ্চিত্রের মান থাকছে না। তাছাড়া কপি রাইট আইনও নৈতিকভাবে একজন চলচ্চিত্রকার মানছেন না।
আমাদের দেশের স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নিমির্তি হচ্ছে দেশি বিদেশি ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের জন্য। এ ছাড়া আর কোথায় এ চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হচ্ছে, কারা তৈরি করছেন এ প্রসঙ্গে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির সিনে অ্যান্ড ড্রামা ক্লাবের প্রেসিডেন্ট দেবাংশু পল্লব বলেন, ‘দেশের এবং দেশের বাইরের বিভিন্ন ফেস্টিভ্যালে অংশগ্রহণের জন্য শর্টফিল্ম বানিয়ে থাকেন অনেক নির্মাতা।
আবার অনেক নির্মাতা আছেন নাটক এবং চলচ্চিত্র নির্মাণের পূর্বে হাতেখড়ি হিসেবে শর্টফিল্ম বানিয়ে থাকেন। বর্তমানে ইউটিউব চ্যানেল এবং অ্যাপসের কারণে শর্টফিল্ম নির্মাণে সংখ্যা বেশ বেড়েছে। অনেক ইউটিউব চ্যানেল আছে যারা সারাবছরই শর্টফিল্ম প্রকাশ করে থাকে। আবার অনেক অ্যাপসভিত্তিক ডিজিটাল মাধ্যম আছে, যারা বিশেষ দিবসে শর্টফিল্ম বানিয়ে থাকেন। এ ছাড়া অনেকে বিশ্বিবদ্যালয়ে পড়াশোনার অংশ হিসেবে শর্টফিল্ম বানিয়ে থাকেন। শর্টফিল্ম নির্মাণে তরুণ প্রজন্মের অংশগ্রহণটাই বেশি পরিলক্ষিত হয়ে থাকে।
বাংলাদেশে রেইনবো ফিল্ম সোসাইটি, মুভিয়ানা ফিল্ম সোসাইটি, চিলড্রেন ফিল্ম সোসাইটি শর্টফিল্মকে ফেস্টিভ্যালে দেখিয়ে থাকে। স্টামফোর্ড বিশ^বিদ্যালয়, গণবিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালইয়ে শর্টফিল্ম ফেস্টিভ্যালের আয়োজন করে থাকে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের চলচ্চিত্র সংসদগুলো।
এ ছাড়া ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেটসহ বিভিন্ন জেলা আর উপজেলায় স্থানীয় চলচ্চিত্র সংসদগুলো শর্টফিল্ম ফেস্টিভ্যালের আয়োজন করে থাকে।
দেশের বাইরে ভারতেই অনেক শর্টফিল্ম ফেস্টিভ্যাল হয়ে থাকে। এ ছাড়া নেপাল, শ্রীলঙ্কাসহ এশিয়ার অনেকদেশেই আমাদের দেশের নির্মাতাদের শর্টফিল্ম প্রদর্শিত হতে দেখা গেছে। ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রের বেশকিছু ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে আমাদের দেশের নির্মাতাদের শর্টফিল্ম প্রদর্শিত হতে দেখা যায়। অনেকক্ষেত্রে তারা সম্মানজনক পুরস্কারও অর্জন করে থাকেন। যেমন সম্প্রতি রাজস্থান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে বাংলাদেশি নির্মাতা মিজানুর রহমান লাবু পরিচালিত ‘মালা ভাবী’ শর্টফিল্মটি প্রদর্শিত হয়েছে। এটি কয়েকটি বিভাগে পুরস্কৃতও হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শর্টফিল্মের উদাহরণ হিসেবে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক একটি আয়োজনকে তুলে ধরা যেতে পারে।
নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির সিনে এন্ড ড্রামা ক্লাবের আয়োজনে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ‘এনএসইউ ইন্টারন্যাশনাল শর্ট ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’। ১০ দিন ব্যাপী আয়োজনটির পর্দা উঠবে ১৭ ফেব্রুয়ারি,২০২০ ইং তারিখে।
ক্লাবটির জয়েন্ট সেক্রেটারি হুমায়ুন আহমেদ শ্রাবণ বলেন, বাংলাদেশের তরুণদের চলচ্চিত্র ভাবনা অনেক অগ্রসর হচ্ছে, এই উৎসবের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা বিভিন্ন দেশের ছাত্র-ছাত্রীদের বানানো চলচ্চিত্র দেখার সুযোগ পাবে। আয়োজনজুড়ে থাকবে চলচ্চিত্রের ওপর বিভিন্ন ওয়ার্কশপ। যেখানে ওয়ার্কশপ পরিচালনা করবেন অমিতাভ রেজা চৌধুরী, রাশেদ জামান, সামির আহমেদ, জাহিদুর রাহিম অঞ্জনসহ অনেকেই।
এর পাশাপাশি থাকবে চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর ব্যবস্থা। এবারের এই উৎসবের অ্যাম্বাসাডরের ভূমিকায় থাকছেন অভিনেতা ফজলুর রহমান বাবু, তারেক আনাম খান, শতাব্দী ওয়াদুদ, আরেফিন শুভ, অভিনেত্রী আশনা হাবিব ভাবনা, শবনম ফারিয়া, অর্চিতা স্পর্শিয়াসহ অনেকেই।
দেশে যেসব ইউটিউব চ্যানেলে শর্টফিল্ম প্রচারিত হয়ে থাকে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে টাইগার মিডিয়া, সিলভার স্ক্রিন, সিক্স সিজনস মিডিয়া, ধ্রুব টিভি, বঙ্গ বিডি, জাগো এন্টারটেইনমেন্ট, গানবক্স, ডেডলাইন এন্টারটেইনমেন্ট, জি সিরিজ, সিমভি, মাই সাউন্ড, সিডি ভিশন, সিডি চয়েচ মিউজিক, সুরাঞ্জলী, জাগোবিডি, ইগল প্রিমিয়ার স্টেশন, আজব রেকর্ডস, ক্রোমোমিডিয়া, আন্ডার গ্রাউন্ড ক্রিয়েটিভ ফ্যাক্টরি, গাংচিল এন্টারটেইনমেন্ট, সিনেফায়ার রেকর্ডস, এমআর বেস্টমিডিয়া প্রভৃতি। ইউটিউবে শর্টফিল্ম নিয়ে কয়েকজন দর্শক কিছু গুরুত্বপূর্ণ মতামত দিলেন।
বেশকয়েকজন ইউটিউব মালিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেলো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শর্টফিল্মের দর্শক বাড়ছে। তবে ইউটিউবে প্রচারিত শর্টফিল্মগুলো যাতে অশ্লীলতা বিবর্জিত হয় সেদিকে নজর দেয়াটাও বিশেষ জরুরি।