
লাল মোরগের ঝুঁটি সিনেমার একটি দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত
ভারতভূমিকে ১৯০ বছর উপনিবেশ করে রেখেই ক্ষান্ত ছিল না ইংরেজরা, র্যাডক্লিফ লাইনের মাধ্যমে তারা এমনভাবে ভারতকে ভাগ করেছে যে, উপমহাদেশে অদ্যাবধি সংঘাত লেগেই রয়েছে। ভারতভূমি ভাগের রক্তাক্ত ইতিহাস মাড়ানোর পর তৎকালীন পূর্ববঙ্গের জন্য অবশ্য অপেক্ষা করেছিল আরও রক্তাক্ত ও বিভীষিকার ইতিহাস।
এই ভাগের ফলস্বরূপ ১২শ মাইল দূরের পাকিস্তানিরা অকস্মাৎ মালিকানা পেয়ে পূর্ববঙ্গের নাম পরিবর্তন করে শুধু পূর্ব পাকিস্তান করেনি, বাংলার ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, জীবনবোধকে ছিটকে ফেলে জোর করে অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছিল তাদের সংস্কৃতি।
নানান আন্দোলন, সংগ্রামের পর অবশেষে ১৯৭১ সালে রক্তপ্রবাহের মধ্য দিয়ে অর্জন করতে হয়েছে আমাদের মহান স্বাধীনতা। উল্লাসের রাজনীতি আর শোকের রাজনীতির তাৎপর্য যেমন আলাদা, তেমনি উল্লাসের বিজয় আর শোকের বিজয়ের তাৎপর্যও এক নয়। আমাদের মহান বিজয়ে উল্লাসের উদযাপন ব্যাপারটি ঠিক কতটা মানানসই- এটা অবশ্য প্রশ্নসাপেক্ষ।
যাই হোক, স্বাধীনতার পূর্ববর্তী সময়ে এদেশের মানুষকে উর্দু চলচ্চিত্র দেখতে হতো। মূলত স্বাধীনতার পর পরই অন্যরকম একটা আবহের সূচনা হয়েছিল বাংলাদেশে। বলা যায়- নব্যস্বাধীন দেশে চলচ্চিত্র নির্মাণের একটি জোয়ার এসেছিল আর চলচ্চিত্র নির্মাতারাও জাগরণ এবং স্বদেশচিন্তা ও চেতনা থেকে একের পর এক মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রই নির্মাণ করেছিলেন। মাঝে অবশ্য অনেকটা সময় মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে কোনো চলচ্চিত্রই নির্মাণ করা হয়নি।

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে যে কজন নির্মাতা বর্তমানে শক্তিশালী চলচ্চিত্রনির্মাতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন, নূরুল আলম আতিক তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য। গত ডিসেম্বরের ১০ তারিখে রাষ্ট্রীয় অনুদানে নির্মিত বিনা কর্তনে ছাড়পত্র পাওয়া বহুল প্রতীক্ষিত ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’ চলচ্চিত্রটি তিনি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি দিয়েছিলেন। পরিচালনার পাশাপাশি চলচ্চিত্রটির চিত্রনাট্য, কাহিনি, সংলাপ তারই লেখা। পাণ্ডুলিপি কারখানা প্রযোজিত এই চলচ্চিত্রের ব্যাপারে নির্মাতা নূরুল আলম আতিক বলেছিলেন, ‘আমাদের চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধ একরৈখিকভাবে উপস্থাপন হয়, এর বাইরেও অসংখ্য প্রেক্ষাপট রয়েছে, লাল মোরগের ঝুঁটি তেমন একটি প্রচেষ্টা।’
মূলত বিমানবন্দর রেনোভেটকে কেন্দ্র করে মুক্তিযুদ্ধের একটি চেনা অথচ অচেনা ও আলাদা চিত্রণ এই চলচ্চিত্র। বিহারি অধ্যুষিত মফস্বল শহরে ব্রিটিশদের গড়া বিমানবন্দর সচল করতে ’৭১-এর আগস্টে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আসা এবং সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে ওই জনপদে ঘটে যাওয়া নানান যুদ্ধকালীন ঘটনাসহ বন্দি, বিমানবন্দর প্রস্তুতকারী অভুক্ত শ্রমিকদের প্রতিবিম্বিত করে নির্মিত ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’।
মফস্বল শহরে বৃষ্টিপতনের দৃশ্যে সেনা অফিসারদের খোশমেজাজে উর্দু গান শোনার মধ্য দিয়ে শুরু হয় চলচ্চিত্রটি। চলচ্চিত্রটির শুরুতেই পদ্ম তথা ভাবনার বলা ‘খালি মাইরই খাচ্ছিস, ওমাক কামড়ে দিবার পারিস নাই’- কথাটির মধ্য দিয়ে বাঙালির তেজস্বী ও দ্রোহী মনোভাব প্রতিবিম্বিত করেছেন নির্মাতা।

জুবায়ের তথা ক্যাপ্টেন মনোয়ারের চোখে বাঙালি হলো বাস্টার্ড। পাকিস্তানি মিলিটারির শেকল পায়ে রেবা তথা দিলরুবা দোয়েলকে নাচানোর পাশবিক এবং বর্বরোচিত প্রহারের কালেও রেবার অগ্নিমূর্তি ধারণ করে ক্যাপ্টেন নকভির মুখে থু থু ছিটানোর দৃশ্য যথাযথভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন নির্মাতা। আশীষ খন্দকার তথা বুধা চরিত্রটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
সর্বোপরি, ৭ মার্চের ভাষণ দিয়ে শুরু হওয়া লাল মোরগের ডাক একইসঙ্গে বিনাশী এবং নূতন সূর্যোদয়ের ডাক- নির্মাতার জ্বলনোন্মুখ মগজচোখের চিত্রণ লাল মোরগের ঝুঁটিতে যেন তা যথাযথভাবে চিত্রিত হয়েছে। নূরুল আলম আতিক স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে দেশকে যেন একটি যথোপযুক্ত উপহার নিবেদন করেছেন।