Logo
×

Follow Us

জলবায়ু পরিবর্তন

দখল-দূষণে স্রোতহীন খড়িয়া নদী

Icon

ইলিয়াস আহমেদ

প্রকাশ: ০২ মে ২০২৫, ১০:৪৪

দখল-দূষণে স্রোতহীন খড়িয়া নদী

ফুলপুরের খড়িয়া নদী। ছবি: ময়মনসিং প্রতিনিধি

এক সময়কার উত্তাল ময়মনসিংহের ফুলপুরের খড়িয়া নদীটি বর্তমানে দখলদূষণে স্রোতহীন হয়ে পড়েছে। নদীর দুই পাশে ফসল এবং মাঝখানে সবুজ কচুরিপানায় ভরপুর। প্রতিনিয়ত ফেলা হচ্ছে ময়লা-আবর্জনা। নদীর জায়গায় গড়ে তোলা হচ্ছে দোকানপাট, ঘরবাড়িসহ বহুতল ভবন। বছরের পর বছর ধরে এমন অবস্থা চলায় নদী তার নিজস্ব প্রকৃতি হারাতে বসেছে।

৩৭ কিলোমিটার খড়িয়া নদীর শুরুটা ময়মনসিংহের সদর উপজেলার রাংসা থেকে ফুলপুর উপজেলা অতিবাহিত হয়ে হালুয়াঘাটের ভোগাই কংস নদীতে গিয়ে শেষ হয়। ফুলপুর উপজেলায় নদীটির অবস্থান বেশি হওয়ায় সেটি ফুলপুর খড়িয়া নদী হিসেবে পরিচিত। গত ১৫ বছর আগেও খড়িয়ায় স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ থাকলেও এখন দখলদূষণে তা মরতে বসেছে। ফুলপুর পৌরশহরের ব্রিজের দুই পাশে নদী দখল করে গড়ে উঠেছে বাসা-বাড়ি, ফসলের মাঠ। সিএস রেকর্ডে নদীর জায়গা থাকলেও আরওআর এবং বিআরএস খতিয়ান রেকর্ডে দখলসূত্রে নিজেদের নামে করে নেন অনেকে। আর নদীর জমি দেদার বিক্রি হচ্ছে অন্যত্র। যদিও পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, নদী খননের সময় তারা সিএস রেকর্ড অনুযায়ী খনন করবে।

প্রায় ৩০ বছর আগে ফুলপুর সরকারি কলেজ রোডে খড়িয়া নদীর পারে বহুতল ভবন নির্মাণ করেছেন ব্যবসায়ী মোফাজ্জল হোসেন। এ নিয়ে স্থানীয়রা প্রশাসনকে বারবার অবহিত করলেও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। সেখানকার বাসিন্দা আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘নির্মিত চারতলা বাসাটি যে কেউ দেখলে বলবে, সেটি নদীর মধ্যে পড়েছে, কিন্তু কোন ক্ষমতা বলে তা করেছেন সেটি আমাদের বোধগম্য নয়।’ আরো অনেকে নদীর জায়গা দখলসূত্রে কাগজপত্র করে নিজেদের নামে করে নিয়েছেন বলে তিনি জানান। 

এ বিষয়ে মোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘ক্রয়সূত্রে আড়াই শতাংশ জমি কিনে প্রায় ৩০ বছর আগে চারতলা বাসাটি নির্মাণ করেছি। নির্মাণের পর থেকেই মানুষ বলছে, সেটি নদীর মধ্যে পড়েছে, কিন্তু এ নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। জায়গাটির মালিক প্রকৃতপক্ষে আমিই।’ 

স্থানীয় বিল্লাল হোসেন বলেন, ‘ব্রিজের নিচে খড়িয়া নদীর অংশটুকু (মেন্দুমিয়ার চড়) নামে পরিচিত। এটি সরকারের কাছ থেকে ১০০ বছরের জন্য লিজ নিয়েছেন চৌকিদার কুদ্দুস। পরে তিনি বিআরএস খতিয়ানে নিজের নামে লিখে নেন। এখন প্লট করে বিক্রি করছেন। কিছুদিন আগেও শাহজাহান নামের এক ব্যবসায়ী এখানে জমি কিনেছেন। এই এলাকায় জোর যার মুল্লুক তার, কাউকে বলার কিছু নেই। আমরা চাই খড়িয়া নদীটি আগের অবস্থায় ফিরে আসুক।’

মাওলানা রফিকুল ইসলাম নামের একজন বলেন, ১৫ থেকে ২০ বছর আগেও নদীতে প্রবল স্রোত ছিল। অনেকে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করত। সময়ের পরিক্রমায় স্বার্থান্বেষী মহলের কারণে নদীটি যেমন দখল হয়ে সংকীর্ণ হচ্ছে, তেমনি বেশ কয়েক জায়গায় বেড়িবাঁধের কারণে পানির স্রোত না থাকায় সবুজ কচুরিপানায় ভরছে নদী। সেই সঙ্গে পৌরসভা ও আশপাশের মিল ফ্যাক্টরির বর্জ্যে দূষিত হচ্ছে পানি। একসময় জেলেরা মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করলেও এখন সব স্বপ্নের মতো। 

গোদারিয়া গ্রামের কৃষক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘প্রত্যেকে তার বাড়ির সামনের নদীর অংশটুকু দখল করে কৃষি আবাদ করার পাশাপাশি জমিও বিক্রি করছেন। তারা কীভাবে কাগজপত্র করে এসব করছেন তারাই ভালো জানেন। যার ফলে একটু বৃষ্টি হলেই নদীর পানি মানুষের বাসা-বাড়িতে প্রবেশ করে। নদী তো এখন সবুজ মাঠ, সেখানে বহুতল ভবনসহ নির্মাণ হচ্ছে দোকানপাট। আমরা চাই নদী তার প্রকৃতিতে ফিরে আসুক, দূর হোক দখলদারি।’  

জনৈক আব্দুল খালেক বলেন, কাগজপত্র দেখেই আমি জমি ক্রয় করে বাসা করেছি। আমার বাসার অনেক দূরে নদীর অবস্থান। এপারে নয় ওই পারে আমুয়াকান্দা মসজিদের আশপাশে খড়িয়া নদী দখল হচ্ছে। 

ব্রিজের পাশে নদীর ওপর কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে বেশ কয়েকটি চায়ের দোকান। সেখানকার দৈনন্দিন ময়লা-আবর্জনা পড়ছে নদীতে। দোকানি মো. রাজু বলেন, ‘ব্রিজের পাশে বাপ-দাদার ব্যবসার ধারাবাহিকতায় আমিও দোকান করছি। সম্প্রতি আমরাই কাঠ ব্যবহার করে কয়েকটি দোকান গড়ে তুলেছি। তবে কোনো ময়লা নদীতে ফেলা হচ্ছে না।’ 

ফুলপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাদিয়া ইসলাম সীমা বলেন, নদী সুরক্ষায় আইন রয়েছে। কেউ আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে দখলদূষণে জড়িত থাকলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 

ময়মনসিংহ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপসহকারী প্রকৌশলী আবু রায়হান বলেন, ‘আমরা নিয়মিত নদী খনন করছি। আর সব নদী সিএস রেকর্ড অনুযায়ী খনন করা হয়। সেখানে অনেকের জায়গাজমি থাকলেও আমাদের কিছু করার থাকে না। তাই নদীর জায়গা দখল করে অন্যত্র বিক্রি এবং বহুতল ভবন, দোকানপাট নির্মাণ কোনোভাবেই কাম্য নই। কারণ আইন সবার জন্য সমান।’ 

ময়মনসিংহ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আখলাক উল জামিল বলেন, জেলায় ৫৯টি নদ-নদী রয়েছে। এর মধ্যে এলাকার মানুষের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে খননকাজও অব্যাহত আছে। গত পাঁচ বছরে বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় জেলায় ছোট-বড় ২১টি নদী ও খাল খনন করা হয়েছে। বর্তমানে মুক্তাগাছার আয়মন নদীর খনন কাজ অব্যাহত রয়েছে এবং নান্দাইলের কাঁচামাটিয়া নদীর খননকাজ অচিরেই শুরু হবে। জনগণের দাবি বিবেচনা করে ফুলপুরের খড়িয়া নদী দখলমুক্ত করে খননের উদ্যোগ নেওয়া হবে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫