Logo
×

Follow Us

জলবায়ু পরিবর্তন

জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে

উপকূলীয় নদীগুলোতে মাত্রাতিরিক্ত লবণাক্ততা

Icon

কে এম ওবায়দুল্লাহ

প্রকাশ: ২৭ এপ্রিল ২০২১, ০৮:৪৫

উপকূলীয় নদীগুলোতে মাত্রাতিরিক্ত লবণাক্ততা

বরিশালের কীর্তনখোলা নদীর পানি লবণাক্ত হয়ে গেছে। ছবি: সংগৃহীত

লবণের পরিমাণ বাড়ছে দেশের মিঠাপানিতে। সাগরের মোহনা ছাড়িয়ে তা ঢুকে পড়ছে নদীপথের ভেতরের বেশ খানিকটা এলাকায়। এ বৃদ্ধির পরিমাণ যেমন মাত্রাগত, তেমনি সময়গতও। অর্থাৎ দিন দিন লবণাক্ততার তীব্রতার সঙ্গে বাড়ছে এর স্থায়িত্ব। 

আগে সাধারণত মার্চ থেকে মে পর্যন্ত উপকূলীয় নদীগুলোতে সর্বোচ্চ মাত্রার লবণাক্ততা থাকলেও, এখন সেই হিসাব বদলে ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। নদী অববাহিকায় এত দীর্ঘ সময় সহনীয় মাত্রার চেয়ে অতিরিক্ত লবণ পানি থাকার ফলে একদিকে মানুষের জীবন ও জীবিকায় পড়েছে মারাত্মক প্রভাব, অন্যদিকে হুমকির মুখে পড়েছে জলজ জীববৈচিত্র্য। 

গবেষণায় উঠে এসেছে, শুষ্ক মৌসুমে লবণাক্ত পানি প্রবেশ করায় একদিকে যেমন নদী ও নদী সংলগ্ন শত শত খাল-বিল থেকে স্বাদু পানির অনেক মাছ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে ও গেছে অন্যদিকে জন্মাতে শুরু করেছে লোনা পানির অনেক ঘাস ও হোগলা জাতীয় উদ্ভিদ। একইভাবে নদীগুলোর অন্যতম বাসিন্দা শুশুকের জীবনচক্রও হুমকির মুখে, যা আজ বিলুপ্তির পথে। 

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় দেখা যায়, বৃহত্তর বরিশালের পিরোজপুর, ঝালকাঠি, ভোলা, বরগুনা, পটুয়াখালী, খুলনার বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, চট্টগ্রামের নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুর অঞ্চল এখন লবণ পানিতে বিপর্যস্ত। অথচ দেশের মোট চাষযোগ্য জমির ৪০ ভাগ এই উপকূলীয় অঞ্চলে। এক সময় শস্যভা-ার বলে পরিচিত এ অঞ্চলের মাটি ও পানি দুই-ই লবণাক্ত হয়ে পড়ছে। বরিশাল বিভাগের লবণাক্ততার অতিঝুঁকিপূর্ণ জেলা বরগুনা। এ ছাড়া পটুয়াখালী, ভোলা, পিরোজপুর ও বরিশাল জেলার নদীগুলোতেও মাত্রাতিরিক্ত লবণাক্ততা বাড়ছে প্রতি বছর। দেশে লবণাক্ত জমির পরিমাণ জানতে ১৯৭৩ সালে প্রথম জরিপ চালায় মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট (এসআরডিআই)। তাতে দেখা যায়, উপকূলীয় ১৮টি জেলায় ২৮ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর জমির মধ্যে ৮ লাখ ৩৩ হাজার হেক্টরই লবণাক্ত। ওই জরিপের ২৭ বছর পর ২০০০ সালে দ্বিতীয় এবং ২০০৯ সালে তৃতীয় জরিপ পরিচালনা করে সংস্থাটি। বিদায়ী ২০২০ সালে চতুর্থ জরিপ হওয়ার কথা থাকলেও, করোনা সংক্রমণের কারণে তা হয়নি। এর মধ্যে দ্বিতীয় জরিপ থেকে জানা যায়, লবণাক্ত জমি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ ২০ হাজার ৭০০ হেক্টর। তৃতীয় জরিপে লবণাক্ত জমি বেড়ে দাঁড়ায় ১০ লাখ ৫৬ হাজার ২৬০ হেক্টরে। তার মানে, গত ৩৬ বছরে উপকূলীয় জেলাগুলোতে লবণাক্ত জমির পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ২৬ দশমিক ৭ ভাগ। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতি এক লিটার পানিতে দ্রবীভূত লবণের (পিপিটি) সহনীয় মান শূন্য দশমিক শূন্য ৫ গ্রাম; কিন্তু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নদীর পানিতে তা ২২ গ্রামেরও বেশি। আমাদের দেশে অবশ্য ডেসি সিমেন (ডিএস) কিংবা তড়িৎ পরিবাহিতার (ইলেকট্রিক্যাল কন্ডাক্টিভিটি বা ইসি) মাধ্যমে এটি পরিমাপ করা হয়। নদীতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি ভূগর্ভস্থ পানির স্তরও নিচে নামছে। কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উজানে ভারতের ফারাক্কা, তিস্তাসহ এককভাবে বেশ কিছু বাঁধ দেওয়ায় বাংলাদেশের নদীতে পানিপ্রবাহ মারাত্মকভাবে কমে যায়। এ ছাড়া সাগরপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ায় নোনা পানি নদীর ওপর দিকে উঠে আসছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবেই এ রকম হচ্ছে। এখন কপোতাক্ষ, শিবসা, পশুর, ভৈরব, রূপসা, বলেশ্বর, কচা, পায়রা, বিষখালী প্রভৃতি নদীতে লবণাক্ততার মাত্রা বাড়ে ডিসেম্বর-জানুয়ারি থেকেই। আর ভারি বৃষ্টি না হলে সে মাত্রা কমে না।

মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট প্রতি মাসে খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের ১৭টি পয়েন্ট থেকে মাটি এবং ১৩টি নদীর পানির লবণাক্ততা পরীক্ষা করে। ২০১০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত মাটি ও পানির লবণাক্ততা পরিমাপ প্রতিবেদন বিশ্নেষণ করে দেখা গেছে, খুলনার রূপসা নদীতে মে মাসে গড়ে লবণাক্ততা ছিল ১৮ দশমিক ৫৬ ডেসি সিমেন (ডিএস) মিটার, যেখানে সহনশীল মাত্রা শূন্য দশমিক ৭৫। একইভাবে শোলমারী নদীর কৈয়া বাজার পয়েন্টে গড়ে ১৮ দশমিক ৩৭, ডুমুরিয়ার ভদ্রা নদীতে ২১ দশমিক ৯৬, সাতক্ষীরার বেতনা নদীতে গড়ে ২০ দশমিক ৯৮, পাইকগাছার শিবসা নদীর পানিতে ২৬ দশমিক ৬৪ ডিএস মিটার লবণাক্ততা পাওয়া যায়। আর বটিয়াঘাটার কৃষ্ণনগরের মাটিতে এপ্রিল মাসে গড়ে লবণাক্ততা ছিল ৬ দশমিক ৪৮ ডিএস মিটার, যেখানে সহনশীল মাত্রা ২ ডিএস। মোংলা উপজেলার দিগরাজে গড়ে ২০ দশমিক ৭৩, পাইকগাছার শিববাড়ী এলাকার মাটিতে গড়ে ১৩ দশমিক ৯৬ মিটার। এতে আরও দেখা যায়, বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে নদীর পানিতে লবণ ঢোকা শুরু হয়, মে মাসে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। অন্যদিকে মাটিতে লবণাক্ততা সবচেয়ে বেশি থাকে এপ্রিলে। অর্থাৎ শুষ্ক মৌসুমে এসব অঞ্চলের নদীগুলোর পানি আর ব্যবহার উপযোগী থাকে না। অনেক সময় নষ্ট হয়ে যায় রবিশস্য ছাড়াও ধানের বীজ তলা ও বেড়ে ওঠা ধান।

দক্ষিণাঞ্চলের নদীর পানিতে লবণাক্ততার ওপর গবেষণা চালায় মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ও সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগের একদল গবেষক। এতে নেতৃত্ব দেওয়া ওই বিভাগের শিক্ষক মোহাম্মদ জসিমউদ্দিন বলেন, ‘দক্ষিণাঞ্চলের লবণাক্ততা ক্রমেই বৃদ্ধি পেয়ে পশ্চিমাঞ্চলের এলাকাগুলোয় ছড়িয়ে পড়ছে। এর বিরূপ প্রভাব দেখা যায় পুরো কৃষি ব্যবস্থাপনা বা শস্য বিন্যাসে। মূলত মাটিতে লবণাক্ততা ৪ ডিএস মিটারের বেশি থাকলে ফলন কমে যায়। আর লবণের মাত্রা ১২ ডিএস মিটারের ওপরে গেলে তো ওই মাটিতে ফসল ফলানোই অসম্ভব। আর পানিতে লবণাক্ততা ২ ডিএস মিটারের নিচে থাকলে তা দিয়ে সেচ দেওয়া যায়। ২ থেকে ৪ ডিএসের মধ্যে সব ফসলে সেচ দেওয়া যায় না। তবে চারের ওপরে গেলে সেচকাজে ব্যবহার করা যায় না ওই পানি। সাধারণত প্রতি মিটারে শূন্য দশমিক সাত পাঁচ পানির জন্য এবং দুই ডিএস মাটির লবণাক্ততার সহনশীল মাত্রা।’ তিনি আরও বলেন, ‘বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ায় নদ-নদীর পানিপ্রবাহ শুষ্ক মৌসুমে স্বাভাবিক মাত্রায় থাকে না। ফলে সমুদ্রের লোনা পানি উল্টো স্রোতের মাধ্যমে নদীর অনেক ভেতরে চলে আসে। লবণাক্ততা বেড়ে যায় দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের বিপুল এলাকায়। কখনো সেটা আরও উজানে চলে আসে।’ 

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন ও নদী বাঁচাও আন্দোলন বরিশাল বিভাগীয় সমন্বয়কারী রফিকুল আলম জানান, ২০১০ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত তারা একটি সার্ভে করেছিলেন। তাতে দেখা যায়, শুষ্ক মৌসুমে সাগরের লবণ পানি তেঁতুলিয়া নদী পর্যন্ত চলে আসছে। তখনই পরিবেশ অধিদপ্তরসহ দায়িত্বশীল সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে বিষয়টি জানানো হয়। সম্প্রতি মেঘনা ও কীর্তনখোলা নদীর পানিতেও লবণাক্ততা বেড়েছে। এ জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরকেই এসব নদীর পানি পরীক্ষা করে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। তা না হলে জলজ সম্পদেও বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। পাশাপাশি এই এলাকার মানুষের জীবন-জীবিকা এবং জীব-বৈচিত্র্যের ওপর পড়বে বিরূপ প্রভাব।

পরিবেশ অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয়ের সহকারী বায়োকেমিস্ট মো. মুনতাসীর রহমান বলছেন, ‘প্রতি মাসেই নদীর পানি পরীক্ষা করা হয়। তাতে দেখা যায়, গেল ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে মেঘনা, কীর্তনখোলা ও তেঁতুলিয়া নদীর পানির অনেকটাই পরিবর্তন এসেছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে কীর্তনখোলা নদীর ছয়টি স্পট থেকে পানি সংগ্রহ করা হয়। পরে পরীক্ষা করে পানিতে তড়িৎ পরিবাহিতা পাওয়া গেছে পার সেন্টিমিটারে ৩১৪ থেকে ৩৪০ মাইক্রোসিমেন্স। এর আগেও সেটা ৩০০ থেকে ৪০০-এর মধ্যেই ছিল; কিন্তু মার্চে পার সেন্টিমিটারে মাইক্রোসিমেন্স পাওয়া গেছে ১ হাজার ৩৩১ থেকে ১ হাজার ৩৬২ পর্যন্ত, যা মানদ-ের থেকেও অনেক বেশি। এটি অবশ্যই চিন্তার বিষয়। তাই নিয়মিত মনিটরিং রাখা হচ্ছে।’ 

পরিবেশ অধিদপ্তর বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) কামরুজ্জামান সরকার যদিও বলছেন, ‘প্রতি মাসেই মেঘনা, কীর্তনখোলা ও তেঁতুলিয়াসহ বরিশালের ১৫টি নদীর পানি পরীক্ষা করা হয়। আমরা বিষয়গুলো লক্ষ্য রাখছি। ঘন ঘন পানির স্যাম্পল সংগ্রহ ও পরীক্ষা করা হচ্ছে। তবে এখনই বলা যাবে না যে, অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ দক্ষিণাঞ্চলের নদীগুলোতে সে ধরনের বিশাল কিছু হয়ে গেছে।’ 

সরকারি এই কর্মকর্তার কথায় কিছুটা আশ^স্ত হলেও ভাবিয়ে তুলেছে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) এক গবেষণার ফল। তাতে বলা হয়, লবণাক্ততার কারণে উপকূলের ২০ শতাংশ নারী অকালগর্ভপাতের শিকার হন। গর্ভাবস্থায় এসব নারী লবণাক্ত পানি পান করেন বলে তাদের খিঁচুনি ও উচ্চ রক্তচাপও হয়, যা হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। কিডনিতেও এর প্রভাব পড়ে। শুধু তাই নয়, লবণাক্ত পানির প্রভাবে ৩ শতাংশ শিশুরও মৃত্যু হয়।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫