
রাজধানীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে তোলা। ছবি: সংগৃহীত
দেশের অধিকাংশ অঞ্চলে গত দুইদিন যাবত বৈরী আবহাওয়া বিরাজ করছে। এতে করে সারাদেশ যেমন স্থবির হয়ে পড়েছে তেমনি মানুষদের পোহাতে হচ্ছে ভোগান্তি। দৈনন্দিন কাজ করতে দেশের সবাইকে বেগ পেতে হচ্ছে।
নিম্নচাপের ফলে সৃষ্ট বৃষ্টিপাতে গতকাল মঙ্গলবার (১৩ সেপ্টেম্বর) যানজটে নাকাল হতে হয়েছে রাজধানীর বাসিন্দাদের। নদীর টেউয়ের মতো যানজটের টেউ লেগেছিল নগরজুড়ে। গতকালকের মতো যানজট ঢাকায় কখনো দেখা যায়নি বলে মন্তব্য করেছেন নগর গবেষকরা। আজ বুধবার (১৪ সেপ্টেম্বর) তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটেনি গতকালকের তুলনায়। আজও বৈরী আবহাওয়া বিরাজ করছে দেশজুড়ে।
তারা বলেন, সেই গাজীপুর থেকে শুরু করে এয়ারপোর্ট রোড, খিলক্ষেত, বনানী, মহাখালী, কুড়িল, নতুনবাজার, বাড্ডা, রামপুরা, মালিবাগ, মগবাজার, কাজীপাড়া, বিজয় সরণিসহ অনেক স্থানে অসহনীয় যানজট।
এদিকে, নিম্নচাপের কারণে রাজধানী ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে বেহাল অবস্থার সৃষ্টি হয়।
মোংলা সমুদ্রবন্দরে অবস্থানরত ১৪টি বিদেশি জাহাজে পণ্য খালাস মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়েছে খুলনার সুন্দরবনসংলগ্ন কয়রা উপজেলার বাগালি ইউনিয়নের শেওড়াপাড় গুচ্ছগ্রাম। তবে নিম্নচাপ যেন আশীর্বাদে পরিণত হয়েছে ভোলার মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদীর জেলেদের জন্য। পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় তাদের জালে ধরা পড়ছে ঝাঁকে ঝাঁকে রুপালি ইলিশ। পানি বাড়ায় ঝালকাঠির রাজাপুরের বিষখালী নদীতে ভাঙন দেখা দিয়েছে। ৬টি দোকান বিলীন হয়েছে নদীগর্ভে। ২৭টি গ্রাম ও শতাধিক আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর প্লাবিত হয়েছে। পটুয়াখালীতে বেড়িবাঁধ দিয়ে জোয়ারের পানি ঢুকে দুই ইউনিয়নের অন্তত ১০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
রাজধানী : নদীর টেউয়ের মতো যানজটের ঢেউ লেগেছিল নগরজুড়ে। সেই গাজীপুর থেকে শুরু করে এয়ারপোর্ট রোড, খিলক্ষেত, বনানী, মহাখালী, কুড়িল, নতুনবাজার, বাড্ডা, রামপুরা, মালিবাগ, মগবাজার, কাজীপাড়া, বিজয় সরণিসহ অনেক স্থানে অসহনীয় যানজট। এয়ারপোর্ট রোডের অসহনীয় যানজটে ট্রাফিক পুলিশ বড় অসহায়বোধ করে। কারণ এর আগে তারা এই কয়েক মাসে এই চিত্র দেখেননি। বনানীতে ব্যাংকে কর্মরত অফিসগামী এহসান মোটরসাইকেলে চড়ে অফিসে পৌঁছাতে সময় নিয়েছে এক ঘণ্টার বেশি। সে তার লালমাটিয়া বাসা থেকে বৃষ্টি ভেজা সকালেই রওনা দেন।
একইভাবে ধানমন্ডি থেকে মতিঝিল আসতে এক কর্মকর্তার ঘণ্টার বেশি সময় লেগেছে। সচিবালয়ে চাকরি করেন রমিজ। কাজীপাড়া থেকে তার অফিসে পৌঁছাতে অনেক সময় নিয়েছে। একে তো ঝুম বৃষ্টি তার ওপর তীব্র যানজট ফুরফুরে অনেকের মনকে বিরক্তিতে ভরিয়ে দিয়েছে। মালিবাগ থেকে পল্টন বেশি দূর নয়। কিন্তু বৃষ্টির মধ্যে এক ব্যবসায়ীকে তার দফতরে পৌঁছাতে লেগেছে এক ঘণ্টার কাছাকাছি। দুপুর ২টার দিকে একজন গণমাধ্যমকর্মী অনেক অলিগলি ঘুরে সিএনজিতে চড়ে আসার সময় দেখতে পান, কাকরাইল থেকে একেবারে শেরাটন পর্যন্ত গাড়ি স্থবির হয়ে আছে। অনেক সময় ধরে একটুও নড়াচড়া নেই।
আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, আজকালের মধ্যে পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হতে পারে। অর্থাৎ বৃষ্টির ধারা কমতে পারে। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপ আস্তে আস্তে দুর্বল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
মোংলা : মোংলায় গতকাল মঙ্গলবার ভোর থেকে শুরু হয়েছে টানা বৃষ্টিপাত। আজ বুধবারও বৃষ্টি বর্ষণ চলছে। গত কয়েক দিন ধরে চলা লঘু ও নিম্নচাপের প্রভাবে মোংলা সমুদ্রবন্দরে তিন নম্বর স্থানীয় সতর্কসংকেত বহাল রয়েছে।
বৈরী হাওয়া বাড়িঘর থেকে লোকজনও বের হচ্ছেন কম। আর এতে বেশি বিপাকে পড়েছে দৈনন্দিন খেটে খাওয়া দিনমজুররা। এদিকে বৃষ্টিপাতে বন্দরে অবস্থানরত ১৪টি বিদেশি বাণিজ্যিক জাহাজে পণ্য খালাস মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে বলে জানায় বন্দরের হারবার বিভাগ।
খুলনা : দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হচ্ছে খুলনার সুন্দরবনসংলগ্ন কয়রা উপজেলার বাগালি ইউনিয়নের শেওড়াপাড় (হোগলা) গুচ্ছগ্রাম। এর ফলে কপোতাক্ষ নদের পারের চরের জমিতে নির্মিত এই গুচ্ছগ্রামে বসবাসকারী পরিবারের সদস্যদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। প্রবল জোয়ারের প্লাবন ঠেকাতে চারদিকে রিং বাঁধ দেওয়ার দাবি উঠেছে ভুক্তভোগীদের পক্ষ থেকে। স্থানীয় বাগালি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুস সালাম গাজী বলছেন আগামী দেড় মাসের মধ্যেই সমস্যার সমাধান হবে।
খুলনার বিভিন্ন এলাকায় দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। কখনও হালকা আবার কখনো মাঝারি আকৃতির বৃষ্টি হচ্ছে। কিছুটা হলেও থমকে গেছে জনজীবন।
ভোলা: নিম্নচাপ শুরুর পর বৃদ্ধি পেয়েছে নদ-নদীর পানি। সাগরের নোনাপানি ছেড়ে ইলিশ চলে আসছে নদীর মিষ্টি পানিতে। মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদীতে ধরা পড়ছে ঝাঁকে ঝাঁকে রুপালি ইলিশ। যেভাবে ইলিশ ধরা পড়ছে তা অব্যাহত থাকলে ধারদেনা পরিশোধ করতে পারবেন বলে জানালেন মেঘনা নদীর জেলে মো. ইব্রাহিম। আড়তদার মো. বাচ্চু জানান নিম্নচাপ আমাদের জন্য আশীর্বাদ হয়েছে। আশা করছি মুক্ত হব মহাজনদের দাদন থেকে। এতদিন বৃষ্টি কম হওয়ায় নদীতে ইলিশ ছিল না। শুধু সাগরে ছিল।
ঝালকাঠি : ঝালকাঠির রাজাপুরের বিষখালী নদীতে আকস্মিকভাবে ভয়াবহ ভাঙন দেখা দিয়েছে। এতে ছয়টি দোকানঘর নদীর ভাঙনে বিলীন হয়েছে। সোমবার দুপুরে উপজেলার মঠবাড়ী ইউনিয়নের বিষখালী নদীসংলগ্ন বাদুড়তলা বাজারে ভাঙন শুরু হয়। ক্রমান্বয়ে এসব সম্পদ বিলীন হয়ে যায়। এ ঘটনায় ওই এলাকায় ভাঙন আতঙ্ক বিরাজ করছে।
বিষখালী ও হলতা নদীর জোয়ের পানি ৩-৪ ফুট বৃদ্ধি পাওয়ায় কাঁঠালিয়া উপজেলার অর্ধশত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ২৭টি গ্রাম ও শতাধিক আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর প্লাবিত হয়েছে। ভেঙে গেছে কাঁঠালিয়া গ্রামের বিষখালী নদীর তীরবর্তী রাস্তা ও চিংড়াখালী খালের বাঁধ।
জেলা মৎস্য বিভাগ জানিয়েছে, তাদের ৪০ শতাংশ মাছের ঘের ও পুকুর তলিয়ে গেছে। ফলে এ খামারিদের অর্ধকোটি টাকা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
পটুয়াখালী : গতকাল সকাল থেকে বিভিন্ন এলাকায় থেমে থেমে মাঝারি বৃষ্টিপাত হয়েছে। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন রয়েছে। আগুনমুখা, রাবনাবাদ, তেঁতুলিয়া, বুড়াগৌরাঙ্গসহ বিভিন্ন নদ-নদীর পানি স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে বেড়িবাঁধের বাইরে থাকা বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এ ছাড়া অরক্ষিত বেড়িবাঁধ দিয়ে জোয়ারের পানি ঢুকে কলাপাড়া উপজেলার লালুয়া ইউনিয়ন ও চম্পাপুর ইউনিয়নের অন্তত ১০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
সঞ্চারণশীল মেঘমালা সৃষ্টি অব্যাহত : উত্তর বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় গভীর সঞ্চারণশীল মেঘমালা সৃষ্টি অব্যাহত রয়েছে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর। আবহাওয়াবিদ মো. শাহীনুল ইসলাম স্বাক্ষরিত আবহাওয়ার পূর্বাভাসে গতকাল এই তথ্য জানানো হয়েছে।
মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার আবহাওয়ার এই পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, ভারতের দক্ষিণ মধ্যপ্রদেশ ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত সুস্পষ্ট লঘুচাপটি আরও পশ্চিম-উত্তরপশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়ে বর্তমানে এটি মধ্যপ্রদেশের মধ্যাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থান করছে। এটি আরও পশ্চিম-উত্তরপশ্চিম দিকে সরে গিয়ে ক্রমান্বয়ে দুর্বল হয়ে যেতে পারে। এর প্রভাবে উত্তর বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় গভীর সঞ্চারণশীল মেঘমালার সৃষ্টি অব্যাহত রয়েছে। মৌসুমি বায়ুর অক্ষ রাজস্থান, সুস্পষ্ট লঘুচাপের কেন্দ্রস্থল, ওড়িশা, বিহার, গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চল হয়ে আসাম পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। এর একটি বর্ধিতাংশ উত্তর বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত। মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশের ওপর সক্রিয় এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরে প্রবল অবস্থায় রয়েছে।
ভারী বর্ষণের সতর্ক বার্তায় বলা হয়েছে, সক্রিয় মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে বুধবার দুপুর ১২টার মধ্যে রংপুর, রাজশাহী, ঢাকা, ময়মনসিংহ, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের কোথাও ভারী থেকে অতিভারী বর্ষণ হতে পারে|