কাপ্তাই জাতীয় উদ্যান। নদীর তীরে রাম পাহাড় বিট অফিস। এখানে কর্ণফুলীর এক পাশ পাহারা দিচ্ছে রাম পাহাড়, অন্য পাশে সীতা পাহাড়। বন বিভাগের রাম পাহাড় বিট অফিসের কোয়ার্টারে থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল বার কয়েক। কর্ণফুলীর ওপারে সীতা পাহাড়ের এই অংশটায় যখনকার কথা বলছি, অর্থাৎ ২০০৭-০৮ সালেও বেশ ভালো বন ছিল। পুরোনো সব গাছপালা থেকে বেরিয়ে আসা লতাঝুড়ি মিলিয়ে যেন আদিম এক অরণ্য। সকালে ঘুম থেকে উঠে পাহাড়ের চূড়ায় গাছপালার মধ্যে নেচে বেড়ানো হনুমানদের দেখাত লিলিপুটের মতো।
রাম পাহাড় বিট অফিসে একটা শক্তিশালী সার্চলাইট আছে। রাতের বেলা এর আলো এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেয় কর্ণফুলীর বুক। নদীপথে পাচারের চেষ্টা করা চোরাই কাঠের চালান ধরাই উদ্দেশ্য। কখনো কখনো রাতে নদীর ওপাশে সীতা পাহাড়ের নিচে ফেলা হয় আলো। যদি পানি খেতে আসা কোনো বন্যপ্রাণীর দেখা মেলে! প্রতি রাতে সার্চলাইটের পাশে অধীর হয়ে বসে অপেক্ষায় থাকতাম। এমনই এক রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর সার্চলাইটের আলো এক জোড়া চোখের ওপর পড়তেই চমকে উঠলাম। জ্বলজ্বলে চোখের চারপাশে গোলাকার মুখের অবয়বটাও ধরা দিয়েছিল। পাহাড় থেকে মাছ শিকারের লোভে কিংবা পানি খেতে নেমে এসেছে একটি মেছো বিড়াল।
বাংলাদেশে যে আট জাতের বুনো বিড়ালের বাস, তার একটি মেছো বিড়াল। ইংরেজি নাম ফিশিং ক্যাট। মেছো বাঘ, বাঘুইলা বা বাঘরোল নামেও চেনেন অনেকে।
মেছো বাঘ নামে পরিচিতি পাওয়াই এই প্রাণীটির কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। নামের সঙ্গে বাঘ থাকার অপরাধে এদের পিটিয়ে মেরে ফেলে মানুষ। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভারতে চিতা বাঘ, কেনিয়ায় চিতা এমনকি নেপালে গন্ডারের মতো বড় আকারের প্রাণীর সঙ্গেও মানুষ যেভাবে মানিয়ে নেয়, বাংলাদেশে লোকালয়গুলোতে মেছো বিড়াল কিংবা বাঘডাশ বা শিয়ালের মতো প্রাণীর বেলায়ও ততটুকু সহনশীলতা দেখায় না মানুষ।
এবার জন্তুটা সম্পর্কে দু-চারটি তথ্য জেনে নেওয়া যাক। ধূসর শরীরে লম্বালম্বি কয়েক সারি হলুদ ডোরা এদের চেহারাটা ভারি আকর্ষণীয় করে তুলেছে। লেজসহ লম্বায় সাড়ে তিন ফুট। শরীরটা বেশ ভারী, তবে পা খাটো।
একসময় ঢাকার কামরাঙ্গীর চর ও ডেমরা এলাকায় এদের দেখা যেত। অবশ্য সেটা ১৯৮০ সালের আশপাশের ঘটনা। পার্বত্য চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের বনগুলোতে এরা বেশ আছে। সুন্দরবন এদের বড় ঘাঁটি। তেমনি আছে অনেক গ্রামীণ বনেই। তবে সবচেয়ে বেশি দেখা মেলে হাওর বা বিল এলাকায়। শ্রীমঙ্গলের হাইল হাওরের আশপাশে মাঝেমধ্যেই মানুষের হাতে মেছো বিড়াল ধরা পড়ার খবর পাওয়া যায়।
প্রথমবার যখন হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের কালেঙ্গার বনে গিয়েছিলাম, তখন বন বাংলোর পেছনের পাহাড়ে বিশাল একটি মেছো বিড়ালের আস্তানা ছিল। রাতে ওটা যখন শিকারে বের হয়, তখন এক পলক দেখার জন্য জঙ্গলে ঢুকেছিলাম। সিলেট বিভাগের কালেঙ্গা, সাতছড়ি, লাউয়াছড়া, লাঠিটিলার মতো বনগুলোতে এখনো বেশ ভালো সংখ্যায় আছে এই প্রাণীটি।
মেছো বিড়ালদের পছন্দের খাবার মেনুতে আছে মাছ থেকে শুরু করে খরগোশ, বন মোরগসহ ইঁদুরের মতো খুদে স্তন্যপায়ী প্রাণী। অবশ্য সুযোগ পেলে গ্রামের মানুষের হাঁস-মুরগিতেও অরুচি নেই।
মানুষ যে এদের শুধু নিজের গৃহপালিত প্রাণী খাওয়ার কারণে মারে তা নয়; নিছক আনন্দ পাওয়ার জন্যও মারে। এভাবে গ্রামীণ বনের বেশির ভাগ প্রাণীকেই আমরা মেরে, পিটিয়ে শেষ করেছি। এত কিছুর পরও কোনো কোনো গ্রামের আশপাশে কিংবা ভেতরের ছোটখাটো বনে মানিয়ে নিয়ে কীভাবে যেন এখনো টিকে আছে মেছো বিড়ালেরা। তবে আর কয়েক দিন থাকবে সন্দেহ। প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো মেছো বিড়ালের মৃত্যু সংবাদ পাই। এই ঘটনাগুলোর বেশি ভাগের জন্য দায়ী মানুষ।
ঝিনাইদহে গত ডিসেম্বরের ঘটনাটা সব কিছুকে ছাড়িয়ে গেছে। কালীগঞ্জ-নলডাঙ্গা সড়কের কাদিপুর এলাকায় পিটিয়ে মেছো বিড়ালটিকে মারা হয়েছিল। তারপর করা হয় বিকৃত রুচির একটি কাজ। ইজি বাইকে চাপিয়ে মৃতদেহটাকে বাজারে নিয়ে আসা হয়। তারপর মুখে সিগারেট আটকে, পাশে একটা চায়ের কাপ বেঁধে এবং শরীরের সঙ্গে ডাল-পাতা আটকে কুৎসিতভাবে প্রদর্শন করে স্থানীয় বাসিন্দারা।
এ ঘটনার পর এই মেছো বিড়ালটিকে হত্যার অপরাধে দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয় বন বিভাগের মামলায়। মেছো বিড়াল হত্যায় প্রথম এ ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া আশার আলো দেখায় একটু হলেও।
প্রশ্ন আসতে পারে, মেছো বিড়ালকে আমরা বাঁচাব কেন? যেখানে এদের হাঁস-মুরগি শিকারের অভ্যাসও আছে। প্রথম কথা, প্রতিটি প্রাণীই খাদ্যশৃঙ্খলের অংশ। আর গ্রামীণ বন কিংবা জলাভূমিগুলোতে মেছো বিড়ালের অবস্থান খাদ্যশৃঙ্খলের ওপরের দিকে। কাজেই এটা ঝুঁকিতে পড়া মানে গোটা পরিবেশ এবং জীববৈচিত্র্যই হুমকির মুখে পড়া। তেমনি এদের জন্য গ্রামীণ বন ও জলাভ‚মি রক্ষাও জরুরি। এ ছাড়া ইঁদুর দমনেও বড় ভূমিকা প্রাণীটির।
এদিকে মেছো বিড়াল রক্ষায় সচেতনতা তৈরি করতে বন অধিদপ্তর প্রথমবারের মতো আগামী ১ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব মেছো বিড়াল দিবসটি জাতীয়ভাবে উদযাপন করছে। এ উপলক্ষে শিক্ষার্থীদের জন্য পোস্টার ডিজাইন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে। এবার এই দিবসের প্রতিপাদ্য, ‘জনগণ যদি হয় সচেতন, মেছো বিড়াল হবে সংরক্ষণ।’
আশ্চর্যজনক হলেও এত বৈরী পরিস্থিতিতেও ঢাকা শহরের আশপাশের কোনো কোনো এলাকায়ও এখনো টিকে আছে মেছো বিড়াল। এমনই এক জায়গায় এই জানুয়ারিতেই দারুণ এক অভিজ্ঞতা হয়েছে প্রকৃতিপ্রেমী ও আলোকচিত্রী আলমাস জামানের। কয়েকজন সঙ্গীসহ গিয়েছিলেন পাখির ছবি তুলতে। এ সময় এক জলা জায়গার ধারে পেয়ে যান মেছো বিড়ালের পায়ের ছাপ। বিকেলে সঙ্গীরা চলে গেলেও রয়ে যান তিনি।
বেশ কয়েকটি পুকুরের মতো কেটে মাছ চাষ করেছে সেখানে স্থানীয়রা। পুকুরপারে আমগাছের সারি। তারও পরে ধান ও সরিষার ক্ষেত। কেবল এক দিকে একটু দূরে কিছু বসতবাড়ি। এর মধ্যে মাছের খাবার দেওয়ার জন্য এসেছিল দুটি ছেলে। সন্ধ্যা ঘনাতেই তড়িঘড়ি বিদায় নেওয়ার সময় আলমাস জামানকে বলে গেল, “জায়গাটা ভালো না। এখানে ‘তারা’ থাকে। রাতে কাউকে একা পেলে মাথা নিচের দিকে দিয়ে কাঁদার মধ্যে পুঁতে রাখে।” তবে তিনি তাতে থোরাই কেয়ার করলেন। অন্ধকার নামার বেশ কিছুক্ষণ পর প্রথম টর্চের আলোয় এক জোড়া চোখ ধরা দিল। তারপর অনেকটা সময় চোর-পুলিশ খেলার পর ক্যামেরাবন্দি করলেন মেছো বিড়ালের দুর্লভ এবং দুর্দান্ত কিছু ছবি।
সেখান থেকে এসে সুসংবাদও দিয়েছেন। ওই এলাকার মৎস্যজীবীদের কথা সত্যি হলে জায়গাটিতে মেছো বিড়ালের ভালো একটা বসতি আছে। মাঝে মাঝেই মাছের খোঁজে জাল কেটে ফেলায় স্থানীয়রা বেশ বিরক্ত প্রাণীটির ওপর।
দেশের আনাচকানাচে টিকে থাকুক মেছো বিড়াল। আমরা মানুষেরা তাদের বন্ধু যদি মনে নাও করি, অন্তত শত্রু না ভাবি। দেশের আলো-বাতাসে তাদেরও বেঁচে থাকার অধিকার আছে, সেটা মেনে নিই।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh