১৩ মার্চ, ২০২৫। কক্সবাজারের উখিয়া রেঞ্জের জুমছড়ির পাহাড়ি এলাকায় ৩৫ বছর বয়সী একটি পুরুষ বন্য হাতির মৃতদেহ খুঁজে পায় বন বিভাগ। হাতিটির মুখ দিয়ে রক্ত ঝরছিল। আর প্রাণীটির চলার পথে দেড় কিলোমিটারজুড়ে মেলে ছোপ ছোপ রক্ত। পরে জানা যায় গুলি করে হত্যা করা হয় প্রাণীটিকে।
এ ঘটনার দুই দিন আগে রাঙামাটির রাজস্থলীতে একটি গর্ভবতী হাতির মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। এদিকে ২১ মার্চ শেরপুরের নালিতাবাড়ী সীমান্তে বোরো ধানক্ষেতে সংযোগ দেওয়া জেনারেটরের তারে বিদ্যুতায়িত হয়ে মারা যায় একটি বুনো হাতি।
বেশ কয়েক বছর ধরেই বুনো হাতির মৃত্যু এ দেশে একটি স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। বিদ্যুতের ফাঁদের পাশাপাশি গুলি করে হাতি হত্যা করা হচ্ছে। তেমনি অনেক মৃত্যুর পেছনে পরোক্ষভাবে ভূমিকা রাখছে মানুষ।
কমছে এশীয় হাতি
বিশ্বে চার লাখের বেশি আফ্রিকান হাতি থাকলেও বর্তমানে এশীয় বুনো হাতি আছে ৪০ হাজারের আশপাশে। বিংশ শতকের গোড়ার দিকেই সংখ্যাটি ছিল এক লাখ।
যে ১৩ দেশে এশীয় হাতি আছে, সেগুলো হলো ভারত, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, লাওস, চীন, বাংলাদেশ, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা, ভুটান ও নেপাল। খুব সম্ভব, এই ১৩টি দেশের মধ্যে এই মুহূর্তে হাতি নিয়ে সবচেয়ে বিপর্যয়কর অবস্থায় আছি আমরাই।
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) ২০১৬ সালের জরিপ বলছে, এ দেশে স্থায়ী বুনো হাতি আছে ২৭০টির মতো। তবে এদের মধ্যে কতটি এখন টিকে আছে বলা মুশকিল। বন বিভাগের হিসাবেই ২০১০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত দেড় দশকে মানুষের আক্রমণসহ নানাভাবে মৃত্যু হয়েছে ১১৫টি হাতি। এদিকে এ বছরের গোড়া থেকেই মারা যাচ্ছে একের পর এক বুনো হাতি। সাম্প্রতিক সময়ে বুনো হাতির বাচ্চা হওয়ার কিছু খবর দেশের বিভিন্ন বনাঞ্চল থেকে পাওয়া গেলেও মোটের ওপর হাতির সংখ্যা অনেকটাই কমেছে সন্দেহ নেই। আমার ধারণা দেশে স্থায়ী বুনো হাতির সংখ্যাটা ২০০-এর কম বই, বেশি নয়।
ভালো নেই বুনো হাতিরা
আইইউসিএনের নয়, বছর আগের জরিপ বলছে, দেশের স্থায়ী বুনো হাতির অর্ধেকের বেশি, অর্থাৎ ১৪৭টির (গড়) আস্তানা কক্সবাজার-লামার বনাঞ্চলে। রোহিঙ্গা বসতি, বন-পাহাড় উজাড়, হাতি হত্যাসহ নানা কারণে এ এলাকাটি এখন হাতির জন্য একেবারেই অনিরাপদ।
বাস্তব কথা হলো, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, গারো পাহাড় অঞ্চল, দেশের কোথাও হাতিরা ভালো নেই। এদিকে চট্টগ্রামের আনোয়ারার কেইপিজেডের পাহাড়ি এলাকায় বিচরণ করা কয়েকটি হাতিও আছে বড় বিপদে। স্থানীয়রা চায় এদের এখান থেকে সরিয়ে দিতে। কিন্তু আমাদের যেমন নিজেদের ঘর-বাড়িতে থাকার অধিকার আছে, হাতিদেরও তাই, ঠিক না? নাকি বেঁচে থাকার অধিকার একচেটিয়া মানুষেরই?
পুরোনো দিনের কথা
অথচ একসময় এ দেশের বুনো হাতিদের বেশ আনন্দেই দিন কাটত। এনায়েত মাওলার ‘যখন শিকারি ছিলাম’ বইয়ে ১৯৫০-এর আশপাশে পার্বত্য চট্টগ্রামে বুনো হাতির অবস্থা সম্পর্কে কিছুটা আঁচ পাওয়া যায়। হাতির সংখ্যা এত বেশি ছিল যে তখন কাসালং রিজার্ভে ঘটা করে খেদার আয়োজন করার বর্ণনাও দিয়েছেন লেখক।
একসময় গোটা পাকিস্তান বন বিভাগের প্রধান ছিলেন ইউসুফ এস আহমেদ। তার বর্ণনায়ও কাসালং এবং কাপ্তাইয়ের অরণ্যে ঘটা করে হাতি খেদার আয়োজন করতে দেখা যায়। ওই সময়ের বুনো হাতিদের সম্পর্কে বিস্তর তথ্য পাবেন তার লেখা উইথ দ্য ওয়াইল্ড অ্যানিমেলস অব বেঙ্গল বইয়ে। যেটা এই বইমেলায় লেখকের নাতির অনুমতি নিয়ে নিজেই বাংলায় অনুবাদ করে প্রকাশ করেছি।
বান্দরবানের রেমাক্রির কাছে মধু নামের একটি জায়গায় হাতি শিকারের একটি বর্ণনাও দিয়েছেন এনায়েত মাওলা। এখন ওই এলাকায় আর হাতির ছিটেফোঁটাও নেই। এমনকি মোদক পর্যন্ত গেলেও হাতির দেখা পাবেন না। তবে মিয়ানমার বাংলাদেশের মধ্যে চলাচল করা কিছু হাতি সাঙ্গু রিজার্ভে ঢুকে লাগপাই এলাকা হয়ে। লিকরির পর এখন আর হাতি আসে না।
কাসালং সংরক্ষিত বনে গত শতকের মাঝামাঝি সময়ে ১০০ বুনো হাতির পাল থাকার কথাও শোনা যায়। আর এখন গোটা পার্বত্য চট্টগ্রামে (লামা-আলীকদম বাদ দিলে) সাকুল্যে স্থায়ী বুনো হাতির সংখ্যা ৫০-এর কিছু বেশি।
তেমনি সিলেটের লালাখালের আশপাশেও হাতির বড় বড় পালের মহাদর্পে ঘুরে বেড়াবার কাহিনি বর্ণনা করেছেন লেখক। এখন সিলেটে বন্য হাতির স্থায়ী কোনো বসতি নেই। কেবল লাঠিটিলার জঙ্গলে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত মিলিয়ে হাতির ছোট একটি পালের বিচরণ আছে।
মেঘালয়ের বিশাল অংশজুড়ে গারো পাহাড়। গারো পাহাড়ের মূল অংশ ভারতে, বাংলাদেশে পড়েছে ছোট কিছু টিলা। এই গারো পাহাড় সব সময়ই হাতির জন্য বিখ্যাত। পুরোনো দিনে গারো পাহাড় ছিল সুসঙ্গ রাজ্যের অধীনে। পরে সুসঙ্গের সঙ্গে দুর্গাপুর যোগ করে নাম হয় সুসঙ্গ দুর্গাপুর। সুসঙ্গের রাজারা খেদার মাধ্যমে গারো পাহাড় থেকে হাতি ধরতেন। ময়মনসিংহের মহারাজা সূর্যকান্ত আচার্যও গারো পাহাড়ে কয়েকবার খেদা পরিচালনা করেছেন।
এখনো গারো পাহাড়ের হাতিদের বিচরণ এলাকার মধ্যে ময়মনসিংহ, শেরপুর, জামালপুর, নেত্রকোনার পাহাড়ি গ্রামগুলো পড়ে ভালোভাবেই। তবে ভারত-বাংলাদেশ দুই দেশে আসা-যাওয়া করা এই হাতিদের খাবার জন্য সে অর্থে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই এখানকার বন-পাহাড়ে। তাই মানুষের সঙ্গে তাদের সংঘাত প্রকট।
হাতি-মানুষ লড়াই : দায় কার?
গত দেড় দশকে (২০১০-২০২৪) হাতির আক্রমণে মানুষের মৃত্যুও কম হয়নি। সংখ্যাটি ২৯২ জন। সর্বশেষ গত ২২ মার্চ আনোয়ারার কোরীয় রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল (কেইপিজেড) এলাকায় বন্য হাতির আক্রমণে এক শিশুর মৃত্যুর পর সড়ক অবরোধ করে বিক্ষুব্ধ লোকজন।
হাতির আক্রমণে মানুষের এ মৃত্যু দুর্ভাগ্যজনক। হাতি অধ্যুষিত এলাকাগুলোর মানুষেরাও যে আতঙ্কে থাকেন সন্দেহ নেই। তবে এটাও ঠিক, হাতিরা লোকালয়ে এসে মানুষের বাড়িঘরে হামলা চালানোর বড় দুটি কারণের একটি হলো হাতিদের বিচরণের জায়গায় গাছপালা কেটে সমান করে দিয়ে মানুষ হাতিদের খাবার সংকট সৃষ্টি করেছে। এ ছাড়া হাতি বিচরণের এলাকায় মানুষ যে শুধু ঘরবাড়ি, ক্ষেত-খামার, কলকারখানা বানিয়েছে তা নয়, তাদের চলাচলের পথ বা বিভিন্ন করিডর আটকে দিয়েছে। তাহলে শুধু হাতিদের ওপর দায় চাপানোটা কতটা উচিত?
নতুন বিপদ চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথ
বন বিভাগের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশে হাতির বিচরণ আছে, এমন তিনটি সংরক্ষিত অরণ্য চুনতি ও ফাঁসিয়াখালী বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য এবং মেধাকচ্ছপিয়া ন্যাশনাল পার্কের ২৭ কিলোমিটার বনাঞ্চল কেটে গেছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথ। ওই রেলপথ গেছে হাতি চলাচলের অন্তত ছয়টি করিডরের ওপর দিয়ে। ভারতে নীলগিরিসহ আরো বেশ কিছু এলাকায় হাতি চলাচলের রাস্তার ওপর দিয়ে রেললাইন গেছে। ওদের ব্যবস্থাপনা তুলনামূলক ভালো। তারপর সেখানেও রেলগাড়ির সঙ্গে সংঘর্ষে হাতি মারা পড়ার রেকর্ড আছে প্রচুর।
আমার এবং আরো অনেক হাতিপ্রেমীর আশঙ্কা সত্যি প্রমাণ করে এরই মধ্যে এ রুটে চলাচল করা একটি ট্রেনের ধাক্কায় কিশোর বয়সী এক হাতির মৃত্যু হয়েছে। অর্থাৎ এমনিতেই কোণঠাসা হয়ে পড়া হাতিদের জন্য আরেক মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে এই রেলপথ!
হাতিদেরও আছে বাঁচার অধিকার
তাহলে কি আমাদের হাতিদের বাঁচানোর আর কোনো উপায় নেই? আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কেবল বইয়েই পড়বে এ দেশে একসময় বুনো হাতি ছিল?
না, এখনো সব সুযোগ শেষ হয়ে যায়নি। একজন বন্যপ্রাণিপ্রেমী হিসেবে আমার মতে, হাতি বিচরণের এলাকাগুলোতে প্রচুর বৃক্ষরোপণ, সংরক্ষিত এলাকা দখলমুক্ত করা, হাতি চলাচলের করিডর রক্ষায় ব্যবস্থা নেওয়া হাতি বাঁচাতে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। তেমনি শিশু থেকে বৃদ্ধ সবার মধ্যে হাতি রক্ষায় সচেতনতা তৈরি, হাতি হত্যায় আইনের কঠোর প্রয়োগ, হাতি রক্ষায় বন বিভাগের এলিফেন্ট রেসপন্স টিমকে আরো সক্রিয় করা জরুরি।
তা ছাড়া চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথের হাতি বিচরণের এলাকাটিতে ট্রেনের গতি নিয়ন্ত্রণ ও ট্রেনচালকদের সতর্কতাও জরুরি। তেমনি হাতি এবং সব বন্যপ্রাণী রক্ষায় বন বিভাগকে পুরোপুরি উপযোগী করে তোলারও বিকল্প নেই।
সম্প্রতি ভারতের এক জঙ্গলে হাতির পালের একটি ছবি তোলেন এক আলোকচিত্রী। গভীর অরণ্যাবৃত একটি পাহাড়ঘেরা জায়গায় নদীতে বাচ্চাসহ মহানন্দে পানি খাচ্ছে বুনো হাতির ছোট্ট একটি পাল। ফেসবুকে ছবিটি শেয়ার দিয়ে লিখেছিলাম, আমাদের বুনো হাতিদের এমন শান্তিময় জীবন চাই। ঠিক সেই প্রত্যাশা নিয়েই শেষ করছি লেখাটি।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh