Logo
×

Follow Us

প্রবন্ধ

‘মানুষ জীবনানন্দ’ জরুরি পাঠ আজও

Icon

হাসান শাওন

প্রকাশ: ২২ অক্টোবর ২০২৪, ১৬:৪০

‘মানুষ জীবনানন্দ’ জরুরি পাঠ আজও

লাবণ্য দাশের ‘মানুষ জীবনানন্দ’

‘সকলেই কবি নয়, কবিস্বভাব বলে একটা জিনিস অবাস্তব নয়। কবিস্বভাব ক্রমেই শিক্ষিত ও শুদ্ধ হয়ে প্রতি পর্যায়ে কবিতার সারাৎসার রেখে যেতে পারে। এ রকম পর্যায় থেকে পর্যায়ে তার প্রাণতা চলতে পারে- কবির মৃত্যু পর্যন্ত।’ (কবিতার কথা, জীবনানন্দ দাশ) 

সন্দেহ নেই তার কবিস্বভাব নিভৃত আর নির্জন। প্রশ্ন অবান্তর নয় যে, মৃত্যুর এতকাল পরে পর্যন্ত কতটুকু জানা হয়েছে শুদ্ধতম কবি গ্রাহ্য জীবনানন্দ দাশের ৫৫ বছরের জীবন প্রাণতাসহ বিবিধ বিষয়? আজ তার ৭০ তম প্রয়াণ দিবসে শুধু স্ত্রী লাবণ্য দাশের লেখা ‘মানুষ জীবনানন্দ’ বইয়ের পাতায় বিচরণে চলবে এ প্রশ্নের উত্তর তল্লাশ।

১৯৩০ সালের ৯ মে জীবনানন্দ দাশের সঙ্গে বিবাহ সম্পর্কে যুক্ত হন লাবণ্য দাশ। বিবরবাসী কবির সামগ্রিক রচনার সিংহভাগ তার জীবনকালে অপ্রকাশিত ছিল। এই ‘মানুষ জীবনানন্দ’ বইটিও লাবণ্য লিখেছেন স্বামী জীবনানন্দের দেহান্তরের পরে। লেখিকা নিজে ইংরেজি সাহিত্যে সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী। বইটি শুধুমাত্র নিজের জীবনসঙ্গীর বিবরণে ভারাক্রান্ত হয়নি। লাবণ্যের নিজের পরিবার, বিয়ে পরবর্তী কবির সংসার যাপন, আর্থিক দৈন্য, দীর্ঘ বেকারত্ব, দম্পতির সন্তানদ্বয়ের বেড়ে ওঠা, তৎকালের বরিশালের জীবনযাত্রা, শহরের ব্রাহ্ম-সমাজের আচার, ল্যান্সডাউন রোডের বাড়ির স্মৃতিচারণ, ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতের দশা ও সর্বানন্দ ভবনের একেকটি চরিত্রের মতো কবি জননী কুসুমকুমারী দাশের প্রতি নিবদ্ধ আলোকপাতের শৈল্পিকতায় পূর্ণ হয়েছে এর মলাটবদ্ধ সমূহ পৃষ্ঠা।

জীবনচরাচরে কত ব্যক্তির সঙ্গের তো ঘটে যুক্ততা। সে অভিজ্ঞতা দাগ রাখে নিত্যযাপনে। বিয়ের মাধ্যমে সূচিত বন্ধনের জীবনসঙ্গী বধূ বিষয়ে কল্পনা কবির কাব্যে এসেছে ‘ঝরা পালক’ - এ এরূপে,

‘দুপুররাতে ও কার আওয়াজ!

        গান কে গাহে,- গান না!

কপোত-বধূ ঘুমিয়ে আছে

          নিঝুম ঝিঁঝির বুকের কাছে;

অস্তচাঁদের আলোর তলে

         এ কার তবে কান্না!

 গান কে গাহে,- গান না!’ (ছায়া-প্রিয়া, ঝরা পালক, জীবনানন্দ দাশ)

বাস্তবে বধূর সাথে ফুল শয্যার রাত নিয়ে ‘মানুষ জীবনানন্দ’ বইয়ে লাবণ্য দাশ লিখেছেন, তাঁর সর্বপ্রথম কথা হ’ল- ‘আমি শুনেছি তুমি গাইতে পারো। একটা গান শোনাবে?’ আমি আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কোনটা?’ ‘জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে, গানটা যদি জানো তবে সেটাই শোনাও। . . .’ কবিকে একবার নয় দুবার নববধূকে শোনাতে হয় এ গান।

লাবণ্য দাশ এ প্রসঙ্গে বেশ কিছু কাল পরে জীবনানন্দের ভাষ্য জানতে চান। কবি একটু হেসে উত্তরে বলেছিলেন, ‘জীবনের শুভ আরম্ভেই তো এ গান গাওয়া উচিত এবং শোনাও উচিত।’

কবি মানস, কবিতা- এর যে কোনো কিছুর মূল্যায়নে স্থান-কাল গুরুত্বপূর্ণ। ‘মানুষ জীবনানন্দ’ বইটিও এর ভিন্ন নয়। বিগত শতকের একটি পর্বে বরিশাল শহরে একটি একান্নবর্তী পরিবারের চরিত্রদের নিখুঁত বর্ণনা তুলে এনেছেন লাবণ্য দাশ। শুধুমাত্র জীবনানন্দের জন্মভূমি বরিশালের বগুড়া রোডের সর্বানন্দ ভবনে তার দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল না। পরিবারটির আদি ভিটা বিক্রমপুরের সঙ্গে এই ব্রাহ্ম পরিবারটির সম্পর্ক নিয়ে তিনি লিখেছেন। একইসঙ্গে পরিবারের সদস্যরা যখন এ স্থান ছেড়ে বিভিন্ন স্থানে তখনও প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকের যুক্ত আত্মীয়তার বন্ধনের কথাও তিনি লিখেছেন। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের উত্তাপে পূর্ববঙ্গের অবস্থা সংক্ষিপ্ত হলেও বাদ যায়নি লাবণ্যের লেখনির পরিসর থেকে।

কবি সম্পর্কে বর্ণনায় কবিতার খাতা অন্তপ্রাণ হিসেবে নিজের সহধর্মীকে চিহ্নিত করেছেন লাবণ্য দাশ। একইসঙ্গে জীবনানন্দ দাশ পরিবারের বয়োজ্যোষ্ঠদের প্রতি অনুগত ছিলেন সেটির উল্লেখ করেছেন নিজ বইয়ে। সন্তানদের প্রতি কবির অপত্য স্নেহের বিবরণ আছে বইয়ে। একই সঙ্গে এতে অত্যন্ত ছাত্রনিষ্ঠ শিক্ষক জীবনানন্দ দাশের অদেখা রূপ তুলে ধরা হয়েছে। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের সময় তার পুলিশ কর্তৃক আক্রান্ত হওয়া প্রসঙ্গ বইয়ে এসেছে। তখনও এক ছাত্রের কারণে সহজে নিষ্কৃতি পান কবি। এছাড়া কলকাতার পর্যায়ে জীবনানন্দের কাব্য আঙ্গিনার বন্ধুদের মধ্যে বুদ্ধদেব বসু, অচিন্ত্যকুমার ও প্রেমেন্দ্র মিত্রের কথা উল্লেখ আছে বইয়ে। ট্রাম দুর্ঘটনায় আহত হয়ে অসহনীয় ব্যথায় জীবনের অন্তিম দশা বাদ যায়নি লেখায়। 

কবির আরাধ্য শুধুমাত্র কবিতা। কিন্তু জীবনের বাস্তবতায় দরকার আর্থিক স্বচ্ছলতা। এর জন্য নির্দিষ্ট পেশায় ধারাবাহিক মগ্নতা জরুরি। এর অনুপস্থিতিতে মানুষে মানুষে, ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্কে টানাপোড়েন থাকে। দাম্পত্য সম্পর্ক এর বাইরে নয়। সরাসরি না হলেও প্রচ্ছন্নভাবে কবিপত্নী লাবণ্য দাশ নিজের বইয়ে বিষয়টি এড়িয়ে যেতে পারেননি। বইয়ের নাম ‘মানুষ জীবনানন্দ’ হলেও ‘মিলু’ ডাকনামের বর জীবনানন্দ দাশকে তিনি পুরো লেখনিজুড়ে ‘কবি’ ভিন্ন অন্য কোনো নামে চিত্রিত করেননি।

জীবনানন্দ দাশ নিজের আর্থিক দৈন্য সত্ত্বেও বিয়ের পণ প্রথায় বিশ্বাসী ছিলেন না তা বইতে জানা যায়। আবার লাবণ্য দাশ লিখেছেন যে, তার বিয়ের পরের লেখাপড়ায় কবির খুব উৎসাহ ছিল। কবি জীবনানন্দ দাশ যে পাঠক জীবনানন্দের চেয়ে কোনো অংশে কম নয় এরও নজির এ বই। কবিতায় শুদ্ধতা ছিল তার জীবন-সাধনার প্রকাশ্য পরিচয়। এ এক এমন মানুষের পরিচয় যিনি একটি মাত্র ধুতি পরিধানে সন্তুষ্ট কিন্তু বিশ্ববীক্ষণের হেন কোনো বিষয় নেই যা নিয়ে তার পড়াশোনা নেই।

 ‘অনেক মুহূর্ত আমি করেছি ক্ষয়

করে ফেলে বুঝছি সময়

যদিও অনন্ত, তবু প্রেম যেন অনন্ত নিয়ে নয়।

তবু তোমাকে ভালোবেসে

মুহূর্তের মধ্যে ফিরে এসে

বুঝেছি অকূলে জেগে রয়

ঘড়ির সময়ে আর মহাকালে যেখানেই রাখি এ হৃদয়।’

কবির এই কবিতার মতো ঘড়ির সময় আর মহাকালের যেখানেই তিনি থাকুন না কেন জীবনানন্দ চর্চা বাড়ছে ব্যাপকভাবে। বাংলা ভাষা ছাড়াও বিভিন্ন ভাষায় চলছে তার পাঠ। জীবনকালে অনাদৃত কবি এখন সমাদৃত। জীবনের যেসব বোধের কাব্যিক অনুরণ তার সৃষ্টিতে তা সমসময়ের দিনযাপনে ফিকে হয়নি মোটেও। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আর রোবোটিক যান্ত্রিক সভ্যতায় আরও যেন প্রাসঙ্গিক এই কালে জীবনানন্দের অবতারণা। কবি জীবনানন্দ দাশের সামগ্রিক কাব্যবোধ মূল্যায়নে তাই ‘মানুষ জীবনানন্দ’ বইটি এখনও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। সাধারণ পাঠকের কাছে যখন অজানা ‘বিপন্ন বিস্ময়’, তখন স্ত্রী লাবণ্যের খুব সরল গদ্যে কবির চিত্রায়নে কবিতার আঙ্গিকের অবয়ব উন্মুক্ত হয়।

বইটির পাতায় অক্ষরে অক্ষরে বাংলা কবিতার নক্ষত্র পুরুষ বোধগম্য হয়ে ওঠেন সাবলীলভাবে। জীবনে কবি, যাপনেও কবি- এমন বৈশিষ্ট্যে জীবনানন্দ দাশ স্বতন্ত্র। বইটিতে কবিপত্নীর লেখার অনবদ্য উপস্থাপন পুরোমাত্রায় আলোকিত করে এ সত্যকে।  

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫