আলাউদ্দিন আল আজাদ : জীবনঘনিষ্ঠ কথাকার

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ
প্রকাশ: ০৭ জুলাই ২০২৫, ১১:৫৩

অভিভাবকহীন জীবন সংগ্রামে অবিচল এক মানুষ ছিলেন আলাউদ্দিন আল আজাদ। সংগ্রামী চেতনাই তাকে প্রতিবাদী করেছে। তাই তো ১৯৫২ সালে প্রথম শহীদ মিনার ভাঙার প্রতিবাদে প্রথম কবিতাটি লিখেছিলেন তিনি। কারণ সংগ্রাম ছিল তার রক্তে। প্রতিবাদ ছিল তার মজ্জায়। সেই প্রতিবাদী সত্তা লালন করে গেছেন আমৃত্যু। সাহিত্যের প্রায় সব শাখায়ই স্বাক্ষর রেখেছেন নিষ্ঠার সঙ্গে।
‘স্মৃতিস্তম্ভ’ নামের কবিতা এবং ‘তেইশ নম্বর তৈলচিত্র’ নামের উপন্যাস তাকে অমর করে রেখেছে বাংলা সাহিত্যে। এ ছাড়া ছোটগল্প, প্রবন্ধ, নাটকসহ সাহিত্যের বিচিত্র শাখায় তার অবদান অনস্বীকার্য। কবিতায় তার প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর মুগ্ধ করেছে পাঠককে। উদ্বুদ্ধ করেছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে। কবিতায় তিনি বলেছেন, ‘স্মৃতির মিনার ভেঙেছে তোমার?/ভয় কি বন্ধু, আমরা এখনো চার কোটি পরিবার/খাড়া রয়েছি তো! যে-ভিত কখনো কোনো রাজন্য পারেনি ভাঙতে।’ (স্মৃতিস্তম্ভ)
তিনি প্রথম শহীদ মিনার ভাঙার প্রতিবাদে প্রথম কবিতা লিখেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র থাকা অবস্থায়। প্রখর মেধাবী ছাত্র আলাউদ্দিন আজাদের জীবন হাতে নিয়ে এমন প্রতিবাদী বক্তব্য সত্যিই ইতিহাস হয়ে থাকার মতো। একুশের রক্তাক্ত ঘটনার পর তারই উদ্যোগে সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় একুশের বুলেটিন। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা নিয়ে রচিত ‘ফেরারি ডায়েরি’ সমকালীন ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় দলিল হয়ে আছে। ‘তেইশ নম্বর তৈলচিত্র’ আলাউদ্দিন আল আজাদ রচিত প্রথম উপন্যাস। এটিকে তার শ্রেষ্ঠ উপন্যাস হিসেবেও বিবেচনা করা হয়। একজন চিত্রশিল্পীর মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ এবং তার জীবন ও প্রেমকে কেন্দ্র করে এই উপন্যাসের ঘটনা আবর্তিত হয়েছে। বাংলা সাহিত্যের মনস্তাত্ত্বিক ধারায় এটি একটি অন্যতম সংযোজন। একজন চিত্রশিল্পীর জীবনের অনুভব এবং তার দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রেম ও প্রাণের স্বরূপ এ উপন্যাসে নতুন রূপে বিশ্লেষিত হয়েছে।
১৯৬০ সালে ‘পদক্ষেপ’ পত্রিকার ঈদসংখ্যায় উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয়। কবিতার কোমলতা এ উপন্যাসের পাতায় পাতায় এসে ভর করেছে। একজন শিল্পীর দৃষ্টিতে জীবনবোধ, তার জীবনের বিচ্ছিন্নতা ও প্রেমের তীব্রতা এবং সত্যকে গ্রহণ করার সক্ষমতাকে তুলে ধরছে বাংলা সাহিত্যের এই অনন্য উপন্যাসটি। এক জীবনে তিনি ১১৮টি গল্প, ২৪টি উপন্যাস, ১২টি নাটক, ১১টি কাব্যগ্রন্থ, পাঁচটি প্রবন্ধ সংকলন, ত্রিশের বেশি সংকলিত গ্রন্থ, বিশের অধিক অনুবাদিত গ্রন্থ এবং অজস্র সাহিত্য সমালোচনা রেখে গেছেন। আশাবাদী সংগ্রামী মনোভাব তার রচনার বৈশিষ্ট্য। আলাউদ্দিন আল আজাদ একজন শাণিত ভাষার লেখক ছিলেন। তিনি ছিলেন বাস্তব জীবনের রূপকার। বাস্তবতার রূপ পরিগ্রহ করেছে তার ভাষা নির্মাণে। সংস্কৃতাশ্রয়ী শব্দ তিনি পরিহার করেছেন বলা চলে। তিনি প্রধানত মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্ত পরিবারের রূপকার।
আলাউদ্দিন আল আজাদের গল্প নাতিদীর্ঘ। তার উল্লেখযোগ্য গল্পগ্রন্থ-জেগে আছি (১৯৫০), ধানকন্যা (১৯৫১), জীবনজমিন (১৯৮৮) প্রভৃতি। উপন্যাস-তেইশ নম্বর তৈলচিত্র (১৯৬০), কর্ণফুলী (১৯৬২), ক্ষুধা ও আশা (১৯৬৪), জ্যোৎস্নার অজানা জীবন (১৯৮৬), পুরানো পল্টন (১৯৯২), কায়াহীন-ছায়াহীন (১৯৯৯) প্রভৃতি। কাব্যগ্রন্থÑমানচিত্র (১৯৬১), লেলিহান পাণ্ডুলিপি (১৯৭৫), সূর্য-জ্বালার সোপান (১৯৬৫), নিখোঁজ সনেটগুচ্ছ (১৯৮৩), সাজঘর (১৯৯০) প্রভৃতি। এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে তার সাহিত্যকর্মের দীর্ঘ তালিকা উপস্থাপন করা কার্যত কঠিন। তার সাহিত্যসম্ভার পাঠককে ঋদ্ধ করেছে বরাবরই। তাই তো আবদুল মান্নান সৈয়দ বলেছেন, ‘আলাউদ্দিন আল আজাদ প্রথম গল্পকার, যিনি অতি অল্প বয়সে খ্যাতি অর্জন করেন’। অধ্যাপনা থেকে শুরু করে সরকারের অনেক গুরত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। স্বদেশপ্রেম-সমাজসচেতনতা এবং সংগ্রামী চেতনা তার কাব্যচর্চার প্রধান কেন্দ্রভূমি হয়েছিল।
বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের যে ভিত্তি নির্মিত হয়ে আছে; সেই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে আলাউদ্দিন আল আজাদের শিল্প-চেতনার যে বিশেষত্ব পাঠকের চোখে পড়ে, তা হচ্ছে বর্ণনাময় শিল্পমাধুরী, বাক্য গঠনের অভিনবত্ব। সেই সঙ্গে গল্পে প্রতীকধর্মী চিত্রকল্প ব্যবহার পাঠকের নজর কেড়েছে। বাংলাদেশের মাটি ও মানুষ যেমন কথা বলে তার গল্পের আখ্যানে; তেমনই জীবনের বিভিন্ন দিক উপস্থাপিত হয় সাহিত্যের কাঠামোর ক্যানভাসে।
অত্যুজ্জ্বল এই নক্ষত্র আমাদের আলোকিত করেছেন। উল্লেখ্য, নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলায়। ১৯৩২ সালের ৬ মে জন্ম গ্রহণ করেন এবং ২০০৯ সালের ৩ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন। তাকে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি।