Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

শামসুর রাহমানের কবিতায় স্বদেশপ্রেম

Icon

কবীর আলমগীর

প্রকাশ: ২৫ আগস্ট ২০২৫, ১৫:২৪

শামসুর রাহমানের কবিতায় স্বদেশপ্রেম

কবি শামসুর রাহমান

আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি শামসুর রাহমান (২৩ অক্টোবর ১৯২৯ - ১৭ আগস্ট ২০০৬) তাঁর সৃষ্টির বিশাল ক্যানভাসে দেশ, কাল ও রাজনীতিকে এক অবিচ্ছেদ্য সত্তায় ধারণ করেছেন। তাঁর কবিতা কেবল ব্যক্তিগত অনুভূতির প্রকাশ নয়, বরং একটি জাতির বেড়ে ওঠার দলিল। গভীর দেশভাবনা, মমতা এবং সাধারণ মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা তাঁর লেখনীকে অনন্য উচ্চতায় আসীন করেছে। স্বদেশপ্রেম ছিল তাঁর কবিতার এক কেন্দ্রীয় সুর, যা সাম্প্রদায়িকতা ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের পাশাপাশি স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় জাতিকে করেছে উজ্জীবিত।

শামসুর রাহমান ছিলেন মূলত গণমানুষ ও সমাজ-রাজনীতি সচেতন এক কবি। তিনি কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের অন্ধ অনুসারী না হয়েও সমাজের অন্যায়, অবিচার ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সর্বদা সোচ্চার ছিলেন। তাঁর সমাজমনস্কতা সমকালের ঘটনাপ্রবাহকে চিরকালীনতার অনুভূতিতে রূপ দিত। একজন রোমান্টিক কবি হয়েও সমাজের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা ছিল প্রগাঢ়। এই দায়বদ্ধতা থেকেই তিনি অবক্ষয়িত সমাজ ও রাজনীতির কদর্য রূপকে কখনো ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের মাধ্যমে, আবার কখনো তীব্র ঘৃণার সঙ্গে কবিতায় তুলে ধরেছেন। তিনি এক সুন্দর, মঙ্গলময় ও কল্যাণকর সমাজের স্বপ্ন দেখতেন এবং সেই স্বপ্নের প্রতিচ্ছবিই তাঁর কবিতাকে বাংলাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাসের এক ক্ষুদ্র মহাফেজখানায় (Mini Archive) পরিণত করেছে।

শামসুর রাহমানের স্বদেশপ্রেমের ভিত্তি ছিল তাঁর ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি গভীর অনুরাগ। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় ঋদ্ধ এই কবির কাছে বাংলা বর্ণমালা ছিল তাঁর সত্তার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’ কবিতায় এই মমত্ববোধ অসাধারণভাবে ফুটে উঠেছে। তিনি লিখেছেন:

নক্ষত্রপুঞ্জের মতো জ্বলজ্বলে পতাকা উড়িয়ে আছো আমার সত্তায়।

তুমি আর আমি,

অবিচ্ছিন্ন, পরস্পর লীন।

এই পঙক্তিমালায় দেশের পতাকার মতোই বর্ণমালা তাঁর অস্তিত্বে মিশে আছে। আবার ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে রচিত ‘আসাদের শার্ট’ কবিতাটি বাংলা সাহিত্যে প্রতিবাদের এক অমর প্রতীকে পরিণত হয়েছে। শহীদ আসাদের রক্তমাখা শার্টকে তিনি জাতির প্রাণের পতাকার সঙ্গে তুলনা করে গণমানুষের চেতনায় নতুন করে আগুন জ্বেলে দিয়েছিলেন। তাঁর অসামান্য চিত্রকল্পে ফুটে ওঠে:

‘গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর মতো কিংবা সূর্যাস্তের

জ্বলন্ত মেঘের মতো আসাদের শার্ট

উড়ছে হাওয়ায় নীলিমায়।

... আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা।’

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিটি মুহূর্তে শামসুর রাহমানের কবিতা যুগিয়েছে প্রেরণা। মুক্তিযুদ্ধকালে তাঁর রচিত ‘স্বাধীনতা তুমি’ এবং ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য, হে স্বাধীনতা’ কবিতা দুটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। ‘বন্দী শিবির থেকে’ কাব্যগ্রন্থে তিনি স্বাধীনতার জন্য একটি জাতির অপরিসীম ত্যাগ ও সংগ্রামের এক মর্মস্পর্শী চিত্র এঁকেছেন। স্বাধীনতার জন্য কতটা রক্তগঙ্গা পাড়ি দিতে হয়েছে, তার এক তীব্র আর্তি ফুটে উঠেছে তাঁর কবিতায়:

‘তোমাকে পাওয়ার জন্য, হে স্বাধীনতা

তোমাকে পাওয়ার জন্যে

আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়?

আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন?’

এই প্রশ্ন শুধু কবির নয়, এটি ছিল সমগ্র মুক্তিকামী জাতির প্রশ্ন। এই আকুতিই তাঁর কবিতাকে সার্বজনীন করে তুলেছে।

শামসুর রাহমানের কবিতার দিগন্ত ছিল বহুমাত্রিক। দেশ, কাল, প্রেম, মানবিকতার মতো বিচিত্র বিষয়কে তিনি অনায়াসে কবিতায় ধারণ করেছেন। নাগরিক জীবনবোধের সঙ্গে গ্রামীণ জীবনের চিত্রকল্প এবং লোকজ শব্দের সার্থক সমন্বয় তাঁর কবিতাকে এক নতুন মাত্রা দিয়েছে। তাঁর প্রথম দিকের কবিতায় রোমান্টিকতার আবহ থাকলেও পরবর্তীকালে তিনি দৈনন্দিন জীবনের কথ্যভাষাকেই তাঁর সৃষ্টির প্রধান বাহন করে তোলেন। এই সহজবোধ্যতা ও গভীর জীবনবোধের কারণেই তাঁর কবিতা সাধারণ পাঠকের হৃদয়ে সহজেই স্থান করে নিতে পেরেছে। ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ থেকে শুরু করে ‘অন্ধকার থেকে আলোয়’ পর্যন্ত তাঁর প্রতিটি কাব্যেই এই মানবিক ও শুদ্ধতম চেতনার প্রকাশ ঘটেছে।

শামসুর রাহমানের কবিতা পাঠ করলে মনে হয়, তিনি আসলে স্বদেশকে খুঁজেছেন মানুষের চোখে, মানুষের রক্তে, মানুষের অনন্ত সংগ্রামে। তার কবিতার প্রতিটি শব্দ যেন এদেশের মাটিতে গড়ে ওঠা একেকটি বৃক্ষ, যার শেকড় গভীর এবং ফল মানবিকতার মধুরতায় ভরা।

শামসুর রাহমান তাঁর কবিতায় স্বদেশ ও সময়কে এক আশ্চর্য গ্রন্থিতে আবদ্ধ করেছেন। তিনি কেবল একজন কবি ছিলেন না, ছিলেন জাতির সংকটকালে এক মহান পথপ্রদর্শক। যখন তাঁর সমসাময়িক অনেক কবি আত্মমগ্নতায় নিমজ্জিত, তখন তিনি নির্জনতা ভেঙে দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর কবিতা জাতির ইতিহাস, আকাঙ্ক্ষা এবং সংগ্রামের এক অমিয় শক্তি, যা আজও প্রতিটি বাঙালিকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে। এভাবেই শামসুর রাহমান তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে বাংলা কবিতার এক কালজয়ী মহিমায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন।  

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫