
নারী মানসের জৈবিক সীমানা। ফাইল ছবি
নারীসুলভ হতে হলে হতে হবে দুর্বল, অপদার্থ, উদ্যোগহীন ও বশমানা। বালিকাকে... দমন করতে হবে তার স্বতঃস্ফূর্ততা এবং তার জায়গায় নিয়ে আসতে হবে গুরুজন শেখানো ছলাকলা ও আদবকায়দাকে। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার যে কোনো উদ্যোগই কমাবে তার নারীত্ব ও আবেদন। তরুণ পুরুষের ক্ষেত্রে নিজের অস্তিত্বের ভেতর বিচরণ অপেক্ষাকৃত সহজ, কেননা মানুষ হিসেবে তার বৃত্তি এবং পুরুষ হওয়ার মধ্যে কোনো বিরোধ নেই।
-সিমোন দ্য বুভোয়া ( The Second Sex )
“(জিম্মি আটকের ঘটনায়) আটককারীরা যেমন তাদের কাঙ্ক্ষিত জিনিস পাওয়ার জন্য কিছু জিম্মিকে হত্যা বা কমপক্ষে আহত করে, পুরুষেরা তেমনি নারীদেরকে আতঙ্কগ্রস্ত করে তাদের কাঙ্ক্ষিত জিনিস পাওয়ার জন্য: (তারা চায়) নারীদের কাছ থেকে যৌন, আবেগগত, গৃহস্থালি এবং প্রজননগত অব্যাহত সেবা। জিম্মিরা যেমন খুন হওয়া থেকে বাঁচার জন্য আটককারীদের সন্তুষ্ট করতে চায়, নারীরাও তেমনি পুরুষকে সন্তুষ্ট করার জন্য কাজ করে যায়, তাদের এই প্রচেষ্টা থেকেই উৎসারিত হয় নারীসুলভ মানসিকতা। নারীসুলভ মানসিকতা বলতে আমরা (নারীদের) সেই সব আচরণকেই বুঝি যা (কর্তৃত্বময়) পুরুষকে সন্তুষ্ট করে, কারণ এতে বোঝা যায় যে নারী তার অধস্তন অবস্থা মেনে নিয়েছে।”
-ডি এল আর গ্রাহাম
Loving to Survive: Sexual Terror Men’s Violence & Women’s Life
দুই পাখি কবিতায় রবীন্দ্রনাথ যে খাঁচার পাখির ছবি এঁকেছেন সে উড়তে ভয় পায়, মুক্তি চায় না, খাঁচাই তার কাছে পরিপাটি শান্তির আশ্রয় যেখানে নিরালায় থাকতেই তার ‘সুখ’। সীমাহীন আকাশ বা বনের মুক্ত- প্রান্তরে উড়ে বেড়ানোর আনন্দ তাকে টানে না। মুক্ত প্রান্তরের রোমাঞ্চ সে চায় না, নিরিবিলি ঘরের কোণে বসার ঠাঁই পেলেই সে ধন্য। বনের স্বতঃস্ফূর্ত সুর ও বাণীর বৈচিত্র্য তাকে স্পর্শ করে না, তাই সে শুধু শেখানো বুলি আওড়ে চলে।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর মনের যে প্রকাশিত রূপ আমরা দেখতে পাই, সেটা তার জন্মগত বা প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য নয়। পুরুষতান্ত্রিক বাস্তবতাও এক নির্মম খাঁচা, যেখানে আবদ্ধ নারীর মন ওই খাঁচার পাখির মতোই বদলে যায়। খাঁচার পাখির মতো নারীর মধ্যেও ভীতু, আপসকামী, আত্মবিশ্বাসহীন, সাবধানী, সুযোগ- সন্ধানী ও নতজানু এক সত্তা গড়ে ওঠে। এই বাস্তবতার মধ্যে একদিকে রয়েছে বন্দিত্ব, বৈষম্য, নিপীড়ন, বঞ্চনা ও কঠোর অনুশাসন, যার সঙ্গে মানিয়ে নিতে গিয়ে নারীর মন হয়ে ওঠে বাধ্য, অনুগত, আতঙ্কগ্রস্ত, নরম ও নতজানু। অন্যদিকে রয়েছে পুরুষতান্ত্রিক আদর্শ, মূল্যবোধ, মূল্যায়ন, স্বীকৃতি ইত্যাদি, যা নারীদের পুরুষতান্ত্রিক মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হতে উৎসাহিত করে।
ফলে তারা সচেতন বা অবচেতনভাবে এই মানদণ্ডে ‘নারীসুলভ’ হয়ে ওঠে। নারী যত কঠিন পুরুষতান্ত্রিক অনুশাসনের মধ্যে বড় হয়, তার মধ্যে কথিত ‘নারীসুলভ’ মানসিকতা ও আচরণের প্রবণতা তত গভীরভাবে প্রোথিত হয়। এ ধরনের একটি সমাজে অধিকাংশ নারীর মধ্যে এ ধরনের প্রবণতার উপস্থিতির ফলে আপাতদৃষ্টিতে একে সর্বজনীন বলেও মনে হয়। নারীর এ ধরনের আচরণ এ সমাজে ক্ষমতাবান লিঙ্গ হিসেবে পুরুষকে সন্তুষ্ট করে। কারণ এর মাধ্যমে প্রকাশিত হয় যে নারী তার অধস্তন অবস্থা মেনে নিয়েছে। অন্য দিকে নারী যখন অপেক্ষাকৃত মুক্ত পরিবেশে বড় হতে পারে; কিংবা পুরুষতান্ত্রিক ধারণার প্রভাব কাটিয়ে কিছুটা মুক্তভাবে ভাবতে পারে, তাদের মধ্যে ‘নারীসুলভ’ মানসিকতা ও আচরণ অপেক্ষাকৃত কম থাকে।
আমাদের সমাজে প্রচলিত ও আধিপত্যকারী ধারণা হলো প্রকৃতিগতভাবেই নারী ও পুরুষের মানসিকতা ও আচরণের ক্ষেত্রে বড় ধরনের পার্থক্য রয়েছে, যা তাদের জৈবিক পার্থক্যের কারণে গড়ে ওঠে। প্রকৃতপক্ষে ‘নারীসুলভ’ বা ‘পুরুষালি’ আচরণ ও মানসিকতা বলতে যা বোঝানো হয়, তা তাদের জৈবিক যৌনতাকে নির্দেশ করে না, এগুলো মূলত লিঙ্গীয় ধারণা-যা কেবল জৈবিক যৌনতার উপর নির্ভর করে না বরং সামাজিক আদর্শ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে স্বতন্ত্রভাবে বিকশিত হয়।
আচরণ, অনুভূতি, ভাবনা, ফ্যান্টাসি ইত্যাদির ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের মধ্যে ভিন্নতা আছে; কিন্তু তা গড়ে ওঠে জৈবিক ও সামাজিক বাস্তবতার মিথস্ক্রিয়ায়। পুরুষতান্ত্রিক আদর্শ ও দৃষ্টিভঙ্গির আদলেই গড়ে ওঠে ‘নারীসুলভ’ ও ‘পুরুষালি’ মনোভাব সম্পর্কে এ সমাজে প্রচলিত ধারণাগুলো। সমাজের অধিকাংশ নারী ও পুরুষের মানসিকতা, আচরণ এ ধরনেরই বা এর কাছাকাছি রূপে গড়ে ওঠে, যা সে এ সমাজে বেড়ে ওঠার সময়ই শেখে। এখানে ‘নারীসুলভ’ মানসিকতা বলতে যেমন-ভীতু, সংকীর্ণ, আপসকামী, আত্মবিশ্বাসহীন, সাবধানী, সুযোগ- সন্ধানী ও নতজানু মানসিকতাকে বোঝানো হয়, তেমনি পুরুষালি মানসিকতার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে কঠোরতা, নির্বিকারত্ব, স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাব-ভঙ্গি, আবেগ ও সংবেদনশীলতাবর্জিত মনোভাব সম্পর্কিত বা অন্তরঙ্গ হওয়ার প্রবণতার অভাব ইত্যাদি।
এই লিঙ্গ নির্দিষ্ট আচরণগুলো পুরুষতান্ত্রিক বাস্তবতার চাপে কিংবা এই বাস্তবতার সঙ্গে মানিয়ে চলার প্রচেষ্টা থেকেই নারীপুরুষের মধ্যে স্থায়ী হয়। নারীপুরুষের এই প্রকাশিত আচরণের আপাত পর্যবেক্ষণ থেকেই গড়ে ওঠে তাদের মানস সম্পর্কিত প্রচলিত ধারণাগুলো। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মূলধারা এই বৈশিষ্ট্যগুলোকে প্রকৃতিগত বা জৈবিক বলে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। কারণ লিঙ্গ বৈষম্যভিত্তিক এই সমাজ নারী ও পুরুষের কাছে যে মনোভাব ও আচরণ আশা করে, তাকে ‘জৈবিক’ প্রবণতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে, এগুলোকে ‘স্বাভাবিক’, ‘পরিবর্তনযোগ্য নয়’ কিংবা ‘গ্রহণযোগ্য’ বলে প্রতিষ্ঠা করা সহজ হয়।
লিঙ্গ বৈষম্যের কবলে নারী- মনস্তত্ত্বের অধ্যয়ন
মন আমাদের বোধের অংশ, যা গঠিত হয়- চেতনা, কল্পনা, উপলব্ধি, চিন্তা, বিচারশক্তি, ভাষা, স্মৃতি ইত্যাদির সমন্বয়ে। এগুলোকে ধারণ করে মস্তিষ্কের সেই অংশ, যেখানে চিন্তা ও চেতনা ক্রিয়াশীল থাকে এবং এটি আমাদের কল্পনাশক্তি, অভিরুচি, আবেগ ও অনুভূতিকেও ধারণ করে। মানসের প্রকাশিত রূপ
যেমন- প্রবৃত্তি, আচরণ, ব্যক্তিত্ব ইত্যাদি গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে জৈবিক (Nature) ও সামাজিক (Nature) উভয় মাত্রার প্রভাব রয়েছে। সাধারণভাবে আধুনিক মনোবিজ্ঞান ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে সামাজিক মাত্রাকে প্রধান নির্ণায়ক হিসেবে চিহ্নিত করেছে; কিন্তু ১৮৭৪ সালে বিজ্ঞানের পৃথক একটি ধারা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর থেকে গত শতাব্দীর আশির দশক পর্যন্ত নারীর মনস্তত্ত্ব অধ্যয়নের ক্ষেত্রে মূলধারার মনস্তত্ত্ববিদগণ সমাজে আধিপত্যকারী পুরুষতান্ত্রিক ধারণার প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে পারেননি।
এই দীর্ঘ সময়ের মনোবিজ্ঞানের গবেষণাগুলোকে পর্যালোচনা করলে মনে হবে, মনোবিজ্ঞান একান্তভাবে পুরুষের বা পুরুষ প্রাণীর আচরণের অধ্যয়নে কেন্দ্রীভূত আছে। কারণ ওই সময় পর্যন্ত নারী মানসকে পৃথক একটি পরিপ্রেক্ষিতে অর্থাৎ তার অবস্থান ও বাস্তবতার নিরিখে অধ্যয়ন করার কোনো উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ ছিল না। মনস্তত্ত্বের গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন মূলত পুরুষ মনস্তত্ত্ববিদরা। অধিকাংশ গবেষণায় বিষয়বস্তু হিসেবেও নারীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
যেখানে নারীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, সেখানেও তাদের যৌনতা ও লিঙ্গগত পার্থক্যের বিষয়টি যথাযথভাবে উল্লেখ না থাকায়, মানুষের মনের উপর এসব বিষয়ের (যৌনতা ও লিঙ্গ) প্রভাবকে অনুধাবন করা যায়নি। পুরুষাধিপত্যে আক্রান্ত মনোবিজ্ঞানের এই ধারায় পুরুষের আচরণ ও মনোভাবকে আদর্শ (Norm) বলে ধরে নেওয়া হয়েছে এবং সেই মানদণ্ডে বিশ্লেষিত হয়েছে নারী মানস।
নারীর মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে অনুসন্ধান প্রচলিত ভুল ধারণা দ্বারা যেমন আক্রান্ত হয়েছে, তেমনি আক্রান্ত হয়েছে এসব ধারণা দ্বারা প্রভাবিত বিজ্ঞানীদের পক্ষপাতদুষ্ট সিদ্ধান্ত দ্বারা। উনিশ শতকের যে দুজন বিজ্ঞানীর কাজ মনোবিজ্ঞানকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে তারা হলেন-চার্লস ডারউইন ও সিগমুন্ড ফ্রয়েড। এই দুই বিজ্ঞানীর তত্ত্ব এবং পরবর্তী পর্যায়ে সেই তত্ত্বের জৈব-নির্ধারণবাদী ব্যাখ্যার মাধ্যমে নারীকে ‘বিবর্তনের হীনতর ফসল’ এবং ‘দুর্বলতর মানস’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
নারী মনস্তত্ত্ববিদরাই মনোবিজ্ঞানের এই পুরুষ-কেন্দ্রিকতা এবং পুরুষতান্ত্রিক পক্ষপাত-দুষ্টতাকে প্রথম চিহ্নিত করেন। এর প্রতিক্রিয়ায় তাদের অনেকেই মনোবিজ্ঞানের গবেষণায় নিয়োজিত হন এবং নারীর মনস্তত্ত্বের অধ্যয়নে মনোবিজ্ঞানের মূলধারার বাইরে এক পৃথক ধারা তৈরি করেন। পরবর্তীকালে এরাই তাদের গবেষণালব্ধ জ্ঞান ও উপলব্ধি দিয়ে নারীর মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে অনেক ভুল ধারণার অবসান ঘটাতে পেরেছিলেন। শুরুর দিকে এ ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম উদ্যোগী হন মার্কিন নারী লিটা হলিংওয়ার্থ।
তিনিই প্রথম মনোবিজ্ঞানী যিনি মূলধারার মনোবিজ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত পুরুষতান্ত্রিক পক্ষপাতদুষ্ট ক্ষেত্রগুলোকে পরীক্ষা করে দেখার উদ্যোগ নেন। হলিংওয়ার্থ কিছুটা আশার আলো দেখালেও তার সময়ে নারীর মনস্তত্ত্ব অধ্যয়নের যৌক্তিক ও বৈজ্ঞানিক পথ তৈরির প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম সহজ ছিল না। বিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত মূলধারার মনোবিজ্ঞানে আধিপত্যকারী অবৈজ্ঞানিক ও পুরুষতান্ত্রিক চিন্তার প্রভাব এতটা ‘সর্বব্যাপী’ ছিল যে, এর প্রভাব কাটানো ছিল বেশ কঠিন।
এমনকি বিশ শতকের অনেক নারী গবেষকও এর দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত ছিলেন। বিশেষত যাদের উপর ফ্রয়েডের গভীর প্রভাব ছিল। তবে পরবর্তীকালে ক্যারেন হর্নাইসহ অন্যান্য নারী মনস্তত্ত্ববিদই নারীর মনস্তত্ত্ব অধ্যয়নে ফ্রয়েডীয় চিন্তার অবৈজ্ঞানিক প্রভাব কাটিয়ে উঠতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। গত শতাব্দীর ৫০ ও ৬০-এর দশকে সামাজিক ডারউইনবাদী, ফ্রয়েডীয় ও ইহুদি-খ্রিষ্টান ঐতিহ্যবাদীরা নারীপুরুষের মানস সম্পর্কে প্রচলিত (পুরুষতান্ত্রিক) লিঙ্গগত ধারণার ছাঁচকেই (stereotype) নতুন করে উপস্থিত করেন।
এরা সেই পুরনো জৈবনির্ধারণবাদী ‘যুক্তি’ দিয়ে নারীর অধস্তনতার ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা চালান। এ সময়ে নতুন ধারার নারী গবেষকরা বিজ্ঞানের সমসাময়িক জ্ঞান ও বোধের উপর ভিত্তি করে নতুনভাবে জৈবনির্ধারণবাদী যুক্তিকে মোকাবিলা করেছিলেন।
এ সব নারী মনস্তত্ত্ববিদ মনোবিজ্ঞানের অধ্যয়নে নারী মানসকে ভিন্ন সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে দেখার প্রয়োজনীয়তা এবং নারী মানসের উপর পৃথক গবেষণার উপর বিশেষ গুরুত্বকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। এরই ধারাবাহিকতায় পশ্চিমা দেশগুলোতে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। ১৯৭০-এর দশকে নারীর মনস্তত্ত্ব অধ্যয়ন ও গবেষণার ক্ষেত্রে মনোবিজ্ঞানের একটি পৃথক বিভাগ হিসেবে স্বীকৃতি পায় এবং ১৯৮০-এর দশকে নারীবাদী চিন্তাবিদরা এই ক্ষেত্রে তাদের অবদান রাখতে শুরু করেন।
নারীবাদী চিন্তকদের অবদান নারীর মন সম্পর্কে উপলব্ধিতে যুগান্তকারী পরিবর্তন নিয়ে আসে। তারাই প্রথম দেখালেন, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বাস্তবতা আসলে কেমন এবং এই বাস্তবতা কীভাবে নারী মানস গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখে। ৯০-এর দশকে নারীবাদী লেখকদের অনুসন্ধানে নারীর মনস্তত্ত্বের অধ্যয়ন নতুন মাত্রা পায়। কারণ তারা অন্যান্য গবেষকের চেয়ে গভীরভাবে নারীর জীবনের বহুমাত্রিক বাস্তবতাকে বিবেচনায় নিয়েছিলেন।
গত শতাব্দীতে আরেক ধারার মনস্তত্ত্ববিদরা নারীর মনস্তত্ত্বের বৈজ্ঞানিক অধ্যয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন, এটি ছিল সোভিয়েত মনোবিজ্ঞানীদের ধারা। এরাই প্রথম ফ্রয়েড ও তার অনুসারীদের পদ্ধতিগত ত্রুটি ও জৈবনির্ধারণবাদী বিচ্যুতিকে যৌক্তিকভাবে খণ্ডন করেছিলেন। যে দর্শনের উপর ভিত্তি করে তারা নর-নারীর মানসকে উপলব্ধির পথে এগিয়েছিলেন, সেটা বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মানুষের মনস্তত্ত্বকে অধ্যয়নের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি ধারা।
এই দর্শন অনুযায়ী, মানুষের মানসকে উপলব্ধি করতে হলে, তাকে প্রথমত সামাজিক জীব হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। এই ধারার মনোবিজ্ঞানীদের মতে, মানুষের জন্মগত মানসিক প্রবণতা ও বৈশিষ্ট্য থাকে; কিন্তু ওগুলো তার ব্যক্তিত্বের নির্ণায়ক নয়। ব্যক্তিত্বের (personality) বিকাশ তখনই শুরু হয়, যখন সে অন্য মানুষের সঙ্গে সামাজিক সম্পর্কে নিয়োজিত হয়। অতএব নর- নারীর ব্যক্তিত্বের পার্থক্য তৈরির ক্ষেত্রেও তাদের পৃথক সমাজ- বাস্তবতা গুরুত্বপূর্ণ। এভাবে নারীবাদী ও বস্তুবাদী ধারার বিকাশের ফলেই গত শতাব্দীতে নারীর মনস্তত্ত্বকে উপলব্ধি করার পরিণত বৈজ্ঞানিক ভিত্তি গড়ে ওঠে।
নারী মানসের জৈবিক সীমানা
পুরুষতান্ত্রিক সমাজ- বাস্তবতা নারী- পুরুষের মানসকে কতটা বদলে দেয়, তা বুঝতে হলে প্রকৃতিগতভাবে বা জন্মগতভাবে নারী- পুরুষের মানসিক প্রবণতার পার্থক্য কতটুকু ও কীভাবে থাকে, তার সঙ্গে সামাজিক ও অন্যান্য পরিবেশের মিথস্ক্রিয়া ঘটে। সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার। এ ক্ষেত্রে আধুনিক জীববিজ্ঞানের
তথ্য- উপাত্ত ও বিশ্লেষণের দিকেই আমাদের তাকাতে হবে। মনের অস্তিত্ব পুরোপুরিই মস্তিষ্কের ভেতরে। শরীরের অন্যান্য অংশে যেমন নারী- পুরুষের ক্ষেত্রে পার্থক্য রয়েছে, মস্তিষ্কের গঠন ও কার্যপ্রণালিতেও রয়েছে বেশ কিছু ভিন্নতা। জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক যেসব উন্নতি হয়েছে, তার ফলে আমরা মানসিক প্রবণতার জৈবিক- ভিত্তি সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য ও উপাত্ত পাচ্ছি। তবে এসব তথ্য ও উপাত্তকে ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। মাত্রাজ্ঞান ও বাস্তবতার নিরিখে বিচার না করার ফলে অতীতে অনেকেই এসব বিষয়ে জৈব- নির্ধারণবাদী ব্যাখ্যায় উপনীত হয়েছেন। সরলীকৃত ও পক্ষপাতদুষ্ট এসব ব্যাখ্যা ব্যবহৃত হয়েছে বর্ণ ও লিঙ্গ বৈষম্য, দাসপ্রথা ইত্যাদি নানা ধরনের প্রচলিত বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার পক্ষে।
জন্মের পর যে বয়স পর্যন্ত শিশুদের উপর সমাজের বিশেষ কোনো প্রভাব থাকে না, সে বয়সের মেয়ে ও ছেলে শিশুর উপর বিভিন্ন মনস্তাত্ত্বিক গবেষণার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, জন্মগতভাবে বা প্রকৃতিগতভাবে নারী-পুরুষের মানসিক প্রবণতায় কিছুটা ভিন্নতা থাকে। জৈবিক এই পার্থক্য নারী ও পুরুষের পৃথক মানসিক গঠনে উল্লেখযোগ্য প্রভাব রাখলেও শুধু জৈবিক ছাঁচে তাদের মানস গড়ে ওঠে না।
এর ভিত্তিতে বড়জোর আমরা বলতে পারি, জৈবিকভাবে তাদের (নারী-পুরুষের) প্রকৃতির তার এমনভাবে বাঁধা যে, তাদের মধ্যে মানসিকভাবে একটি নির্দিষ্ট প্রকারের হওয়ার প্রচ্ছন্ন সম্ভাবনা (potential) রয়েছে। যে কোনো জীব বা জৈবসত্তার (individual) ক্ষেত্রে এই প্রচ্ছন্ন সম্ভাবনাকে বলা হয় জৈবনিক সম্ভাবনা (Biological potential)। মস্তিষ্কের মানস-নিয়ন্ত্রণকারী অংশের জৈবনিক সম্ভাবনার সঙ্গে সামাজিক পরিবেশের মিথস্ক্রিয়ায় প্রতিটি নারীপুরুষের পৃথক মানসিক প্রবণতা, ব্যক্তিত্ব ও আচরণের নির্দিষ্ট ধরন গড়ে ওঠে।
জীবনবৃক্ষে মানুষ প্রাইমেট বর্গের অন্তর্গত। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রাইমেটদের মধ্যে যে প্রজাতির ক্ষেত্রে সামাজিক বন্ধন যত কম, তাদের মানসিক প্রবণতায় জৈবিক প্রবৃত্তির প্রভাব তত বেশি। মানুষের ক্ষেত্রে সামাজিক বন্ধন সবচেয়ে শক্তিশালী, জটিল ও স্থায়ী। সামাজিক প্রভাবের কারণে মানুষের যে কোনো বৈশিষ্ট্যের জৈবনিক- সম্ভাবনা বড় ধরনের রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যায় এবং পরিবর্তিত রূপে প্রকাশিত হয়।
মস্তিষ্কের গঠনের দিক থেকে নারীর মধ্যে যে মানসিক প্রবণতা থাকার জৈবনিক সম্ভাবনা রয়েছে, বাস্তবে দেখা যায় অনেক ক্ষেত্রে তার থেকে বেশ ভিন্ন চিত্র পাওয়া যায়। গত শতাব্দীতে বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সমাজে নৃতত্ত্ববিদদের অনুসন্ধান ও গবেষণা থেকে দেখা গেছে, সামাজিক অবস্থার ভিন্নতার কারণে ভৌগোলিকভাবে কাছাকাছি বসবাসকারী বিচ্ছিন্ন কয়েকটি জনগোষ্ঠীর নারী-পুরুষের মানসিক প্রবণতার মধ্যে বড় ধরনের ভিন্নতা রয়েছে। কেবল মস্তিষ্কের গঠনের জৈবনিক সম্ভাবনা অনুযায়ী, নারী-পুরুষের মানসিক প্রবণতা গঠিত হয়ে থাকলে, সব সমাজেই এর একটি সর্বজনীন রূপ থাকার কথা।
আমাদের সমাজে ব্যাপকভাবে প্রচলিত একটি ধারণা হলো, নারীর ক্ষেত্রে
সন্তান-বাৎসল্য পরিপূর্ণভাবে একটি জৈবিক ব্যাপার এবং এর প্রভাব অনেক শক্তিশালী। সে কারণে তার ক্ষেত্রে এর অন্যথা (বাৎসল্য-বিরোধী) হওয়া সম্ভব নয় বা ‘প্রাকৃতিক’ও নয়। এটি নারীর প্রকৃতিগত ‘গভীরতম প্রবণতা’- এমন ধারণা থেকে অনেক জীববিজ্ঞানীও মুক্ত নন। সন্তান ধারণ ও পালনের সময় নারীর শরীরে হরমোনগত পরিবর্তন ঘটে এবং এই হরমোনগুলো মস্তিষ্কের সেই অংশগুলোকে উদ্দীপ্ত করে, যেগুলোর সক্রিয়তা সন্তানের প্রতি মনোযোগ ও আগ্রহ বাড়ায়; কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে, সন্তানের প্রতি তীব্র মায়া বা টান সামাজিকভাবে তৈরি হওয়া একটি বিষয়। মানব প্রজাতির ক্ষেত্রে উন্নত সমাজে, যেখানে শিশুকে জন্ম দেওয়া, খাওয়ানো, প্রকৃতির প্রতিকূলতা থেকে রক্ষা করা ইত্যাদি সব ক্ষেত্রেই সামাজিক সহায়তা পাওয়া যায়, সে সমাজের নারীদের মাতৃ- মানসিকতা এবং প্রতিকূল
বন্য-অবস্থায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সমাজের নারীদের মাতৃমানসিকতা এক নয়। মা-কর্তৃক শিশু সন্তানকে পরিত্যাগ করা এবং হত্যা করার ঘটনা এখনো অনেক ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মধ্যে নিয়মিত একটি ব্যাপার। সন্তান জন্মের সময় উভয় সমাজের নারীদের একই ধরনের শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন ঘটে; কিন্তু মাতৃমানসিকতার ক্ষেত্রে বড় ধরনের পার্থক্যের কারণ হচ্ছে, এই মানসিকতা পরিপূর্ণভাবে জৈবিক নয় বরং জৈবিক ও সমাজিক বাস্তবতার মিথস্ক্রিয়ায় সৃষ্ট।
মস্তিষ্কের মানস নিয়ন্ত্রণকারী অংশ এবং এই অংশের উপর প্রভাব সৃষ্টিকারী শারীরতাত্ত্বিক জৈব-রসায়নের ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য আছে; কিন্তু তা অপরিবর্তনীয় ও স্থির কোনো বিষয় নয়। এই পার্থক্য সত্ত্বেও বেশিরভাগ নারী-পুরুষ যে কোনো মানসিক অবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। সামাজিক বাস্তবতা সম্পর্কে অসচেতনতার কারণেই নারী- পুরুষের মানসের পার্থক্যকে অনেক সময় ভুলভাবে জৈবিক পার্থক্য বলে চিহ্নিত করা হয়। অন্যদিকে জৈবিক পার্থক্যের একরৈখিক বিচার জন্ম দেয় জৈব-নির্ধারণবাদী বিভ্রান্তির। এসব বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত না হলে নারীর মন সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাওয়া সম্ভব নয়।
নারী-পুরুষের মানস সম্পর্কে প্রচলিত লিঙ্গীয় বিশ্বাস
নারীপুরুষের মানসের প্রকৃত রূপ যা-ই হোক আমাদের সমাজে এ সম্পর্কে যে বিশ্বাসগুলো প্রচলিত রয়েছে, তার ভিত্তিতেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের ব্যক্তিত্ব ও সক্ষমতাকে বিচার করা হয়। এই প্রচলিত ধারণা ও বিশ্বাসগুলো কেমন তার স্বরূপ দেখার গুরুত্বপূর্ণ আয়না হলো, ওই সমাজে প্রচলিত রূপকথা, পৌরাণিক কাহিনি, উপকথা, কিংবদন্তি ইত্যাদি। এগুলোর স্রষ্টা সমাজের অনেকে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সমাজের বহুসংখ্যক মানুষের অংশগ্রহণে তাদের চিন্তা, ধারণা ও উপলব্ধির ছায়া রয়েছে এই জনপ্রিয় কাহিনিগুলোর মধ্যে। এসব কাহিনিতে নারী ও পুরুষের মানসিকতার যে চিত্র আমরা পাই, তা নারী-পুরুষের মানস সম্পর্কে সামাজিক বিশ্বাসকে অনেকটাই প্রতিফলিত করে।
এসব কাহিনির মাধ্যমে নারীর মানস সম্পর্কে সমাজে আবহমান কাল থেকে যে বিশ্বাসের ছাঁচ (Stereotype) ছিল, সেখানে নারীর মানস সম্পর্কে বিশ্বাসের দুটি ধরন আমরা দেখতে পাই। একটা ধরন হলো ‘ভালো’ নারী, যার মানস দুর্বল ও নিষ্ক্রিয় (Passive)। এরা প্রতিবাদ করতে পারে না; কিংবা দুরবস্থা থেকে মুক্ত হওয়ার মনোবল বা আত্মশক্তি তাদের নেই। তাই তারা আক্রান্ত বা উপদ্রুত হয় বা মরে যায়। অন্য একটা ধরন হলো ‘খারাপ’ নারী।
মানসিকতার দিক থেকে এরা হিংসুটে, পরশ্রীকাতর, নিষ্ঠুর, অমানবিক, উচ্চাকাক্সক্ষী ও সক্রিয়। অন্যদিকে এসব কাহিনিতে প্রতিফলিত পুরুষের মানস সক্রিয়, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপরায়ণ, স্বনির্ভর ও আত্মশক্তিতে বলীয়ান। বর্তমান সময়ে সেই পুরাণ সমাজের ধারণা ও বিশ্বাস কিছুটা পাল্টে গেলেও, বহুলাংশে টিকে আছে। লাজুক, ভীরু, নির্ভরশীল, সংকীর্ণ, আপসকামী, ঈর্ষাকাতর, হুজুগে ইত্যাদি নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য এবং ভদ্র, কোমলমনা, আবেগপ্রবণ, মমতাময়ী, ‘নির্বিবাদী’ ইত্যাদি ইতিবাচক বৈশিষ্ট্য নারীর মানসের
প্রকৃতিগত (Innate) ধরন-এমন বিশ্বাস আমাদের সমাজে এখনো মোটামুটি সর্বজনীন। অন্যদিকে সাহসী, সক্রিয়, প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও সংঘাত-পরায়ণ, স্বনির্ভর, চিন্তাশীল ও আত্মশক্তিতে বলীয়ান ইত্যাদি ইতিবাচক বৈশিষ্ট্য এবং বেপরোয়া, আক্রমণাত্মক, নিষ্ঠুর ইত্যাদি নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য পুরুষের মানসের প্রকৃতিগত ধরন এমন বিশ্বাসও একইভাবে টিকে আছে। এই সমাজের মধ্যে বেড়ে ওঠা নারী-পুরুষ এই বিশ্বাসের ছাঁচেই কম-বেশি নারী ও পুরুষের মানসিকতাকে চিহ্নিত করে থাকে। এই বিশ্বাসগুলো সাধারণত সমাজের নারী-পুরুষের আচরণের অগভীর ও মোটাদাগের পর্যবেক্ষণ থেকে গড়ে ওঠে।
এ যুগের মনস্তত্ত্ববিদরা বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের উপর যে গবেষণা চালিয়েছেন, তাতেও দেখা গেছে নারী-পুরুষের মানস সম্পর্কে প্রচলিত বর্তমান সমাজে প্রচলিত ধারণাগুলো- রূপকথা, পৌরাণিক কাহিনি, উপকথা, কিংবদন্তিতে প্রকাশিত ধারণার কাছাকাছি। তারা দেখেন- নারীদের সম্পর্কে বিশ্বাস এমন যে, এরা অভিব্যক্তিপূর্ণ, স্বার্থপরায়ণ, আবেগপ্রবণ, মার্জিত, সহানুভূতিশীল ও নিবেদিতপ্রাণ। অন্যদিকে পুরুষকে অধিক দৃঢ়প্রত্যয়ী বলে বিশ্বাস করা হয় বলে তাদের চিহ্নিত করা হয় অধিক সক্রিয়, সক্ষম, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ, স্বাধীনচেতা ও আত্মপ্রত্যয়ী হিসেবে।
সমাজে নারী- পুরুষ ও বালক- বালিকাকে প্রতিদিন তারা যেভাবে জীবনযাপন করতে দেখে, মূলত তার উপর ভিত্তি করে এক ধরনের ভাসা ভাসা বোধ থেকেই এই বিশ্বাস গড়ে ওঠে। এ সব বিশ্বাসের পূর্বসূত্র বা সামাজিক ভিত্তি আমরা দেখতে পাই না। যেমন- অধিকাংশ নারী বা বালিকার মনের মাঝে ভীতি, সংকোচ বা লাজুকতা পুরুষের তুলনায় বেশি দৃশ্যমান হয়, তার পূর্বসূত্র হিসেবে নারীদের ক্ষেত্রে নানা রকম অবরোধ ও নিপীড়নের ভয় ও আশঙ্কা ইত্যাদি আমাদের বিবেচনায় থাকে না।
সামাজিক বিশ্বাসের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ মানসিকতা ও আচরণগুলো যখন প্রশ্রয় পায় বা পুরস্কৃত হয় এবং বিশ্বাসের বিপরীত মানসিকতা যখন ধিক্কৃত বা শাস্তিযোগ্য বিবেচিত হয়, তখন এই ধারণাগুলো আরও গভীরে প্রোথিত হওয়ার সুযোগ পায়। বিশ্বাসগুলো নানাভাবে সমাজে বেড়ে ওঠা নারী-পুরুষের মধ্যে ছড়িয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে আমাদের কথিত ও লিখিত ভাষা, পারিবারিক দৃষ্টিভঙ্গি, সমবয়সীদের কাছ থেকে পাওয়া ধারণা, মিডিয়া ইত্যাদি।
বেশিরভাগ মানুষ এই বিশ্বাসের ছাঁচেই নারী ও পুরুষের মানসকে বিচার করে। এর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব নারী-পুরুষ উভয়ের উপরেই পড়ে। তারা সচেতন বা অবচেতনভাবে এই ছাঁচের আদলে নিজেদের মানসিকতা ও আচরণকে পরিবর্তন করে; অন্যদের ক্ষেত্রে প্রশ্রয় দেয় এবং এর বিপরীত কিছু হলে তাকে প্রতিহত করতে সচেষ্ট হয়।
‘নারীসুলভ’ মনের ভিত্তিভূমি পুরুষশাসিত সমাজ
গত শতাব্দীতে আধুনিক মনোবিজ্ঞান সূত্রায়িত করে- মানুষের জন্মগত মানসিক প্রবণতা ও বৈশিষ্ট্যগুলো তার ব্যক্তিত্বের নির্ণায়ক নয়। ব্যক্তিত্বের বিকাশ তখনই শুরু হয়, যখন সে অন্য মানুষের সঙ্গে সামাজিক সম্পর্কে নিয়োজিত হয়। তাই বেশিরভাগ মেয়ের মধ্যে ‘মেয়েলি আচরণ’ বা ‘মেয়েলি স্বভাব’ ইত্যাদির উপস্থিতি দেখা গেলেও অনুমান করা যায়, সেগুলো তাদের জন্মগত বৈশিষ্ট্য নয় এবং নরনারীর ব্যক্তিত্বের পার্থক্য তৈরির ক্ষেত্রেও সমাজ- বাস্তবতাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
কারণ নারী ও পুরুষকে ভিন্ন রকমের সামাজিক বাস্তবতা ও সম্পর্কের মধ্যে যেতে হয়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের লিঙ্গ- নির্দিষ্ট ভূমিকার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য শৈশব থেকেই মেয়েরা নিজেদের প্রস্তুত করতে বাধ্য হয়। এভাবে প্রস্তুত না হলে, পুরুষতান্ত্রিক পরিবার ও সমাজের সম্পর্কগুলো তার জন্য সাংঘর্ষিক হয় এবং এর জন্য নারীকেই মূল্য দিতে হয়।
গবেষণায় দেখা গেছে যে, অনেক অল্প বয়সেই মেয়েরা নারীসুলভ আচরণ সম্পর্কে সামাজিক প্রত্যাশা ও নির্দেশনাগুলো অনুধাবন করতে পারে, যা তাদের মানসিক বিকাশের গতি- প্রকৃতিকে গভীরভাবে স্পর্শ করে। লিঙ্গ- নির্দিষ্ট ভূমিকা সম্পর্কিত ধারণাগুলো মেয়েরা পায় সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে। তবে এগুলোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি উৎস হলো পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। গুরুত্বের দিক থেকে এর পরেই রয়েছে সামাজিক কালচার ও মিডিয়ার ভূমিকা।
বেড়ে ওঠার সময় শিশু সবার আগে পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠদের মনোভঙ্গি ও আচরণ দ্বারা প্রভাবিত হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মা ও বাবা। এই প্রভাব প্রধানত দুই রকমের। প্রথমত মেয়ে সন্তান তার মায়ের আচরণ ও মনোভঙ্গিকে নিজের অজান্তেই অনেকটা অনুসরণ করে থাকে। অন্যদিকে মেয়ে সন্তান সম্পর্কে মা-বাবার ধারণা এবং তারা কন্যা সন্তানের কাছ থেকে কেমন আচরণ আশা করছেন, সেটাও বেড়ে-ওঠা মেয়েটির আচরণকে সুনির্দিষ্ট আকার দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
গবেষণায় দেখা গেছে, বেশিরভাগ বাবা- মায়ের বিশ্বাস কাক্সিক্ষত আচরণ ও জীবনধারার বাইরে গেলে মেয়েরা সমূহ বিপদে পড়তে পারে। এ কারণে মা- বাবা ছেলে- মেয়েদেরকে লিঙ্গ-নির্দিষ্ট আচরণ, কাজকর্ম, পোশাক ও খেলায় উৎসাহিত করেন এবং তাদের লিঙ্গ- নির্দিষ্ট বিশ্বাস সন্তানের মধ্যে সঞ্চারিত করেন। মা- বাবার কাছ থেকেই ধর্ম, লোকাচার এবং অন্যান্য সামাজিক- সাংস্কৃতিক বিশ্বাস আর আচরণের প্রভাব ছেলে- মেয়ের কাছে আসে।
ধর্মে মেয়েদেরকে অবদমিত ও গণ্ডিবদ্ধ রাখার যে বিধান বা আচার রয়েছে পারিবারিক বিশ্বাসের মধ্য দিয়েই তা মেয়েদের জীবনে আরোপিত হয়, যা তাদের জীবনকে আরও সীমাবদ্ধ করে এবং তাদের বাস্তবতাবোধ ও আত্মবিশ্বাসকে খর্ব করে। নারীর মনের উপর পরিবারের এই প্রভাব সাধারণত গভীর ও দীর্ঘমেয়াদি হয়।
বালিকাদের সামাজিকীকরণের গুরুত্বপূর্ণ স্থান শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। নারীর মানসিকতা গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে পরিবারের পরেই রয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা। তাদের ওপর শিক্ষক ও বিদ্যালয়ের সমবয়সী মেয়েদের মতো আচরণ ও পছন্দ- অপছন্দের গভীর প্রভাব থাকে। বালিকাদের লিঙ্গ- নির্দিষ্ট আচরণে প্ররোচনা দেয় প্রধানত সমবয়সীরা ও শিক্ষকরা। মা- বাবার মতো শিক্ষকেরাও বালিকাদের উপর অনেক লিঙ্গ- নির্দিষ্ট আচরণ ও কর্মকাণ্ড চাপিয়ে দেন।
কারিকুলামের বাইরেও স্কুলে একটা ‘অদৃশ্য কারিকুলাম’ থাকে, যা বালিকাদের লিঙ্গ- নির্দিষ্ট আচরণের সঙ্গে পরিচয় ঘটায়। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রচলিত সামাজিক ও ধর্মীয় রীতি-নীতিকে আরোপ করে শিক্ষার্থীদের আচরণের কোড নির্ধারণ করে, যা মেয়েদের উপর কঠোরভাবে চাপানো হয়। সহপাঠীদের সঙ্গে সম্পর্ক থেকে মেয়েদের মধ্যে সম ও বিপরীত লিঙ্গের সঙ্গে সম্পর্কের মানদণ্ড তৈরি হয়। এখানেই তাদের মধ্যে লিঙ্গের ভিত্তিতে সামাজিক কার্যক্রমে যুক্ত হওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়।
দেখা গেছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সমবয়সীদের মধ্যে নারী ও পুরুষ উভয়েই লিঙ্গ- নির্দিষ্ট আচরণকে পছন্দ করে এবং উৎসাহ দিয়ে থাকে। দেখা গেছে, লিঙ্গ- নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য বেশি থাকলেই নারীরা বেশি জনপ্রিয় হয়। অল্প বয়স থেকেই নারীর উপর চেপে বসা এই ‘নারীসুলভ’ আচরণ তার মধ্যে উদ্যোগহীনতা এবং বাধ্যতাকে আরোপ করে। এটা আরও শক্তিশালী হয় সমবয়সী পুরুষদের সঙ্গে মেশার ফলে। গবেষণায় দেখা গেছে, বেশি যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও অনেক ক্ষেত্রেই মেয়েরা পুরুষের অধীনস্থ পদ মেনে নিচ্ছে।
গণমাধ্যম এ যুগে লিঙ্গ- নির্দিষ্ট আচরণ ও কর্মকাণ্ডের শক্তিশালী প্ররোচক। মূলধারার চলচ্চিত্রের নায়িকা, ডিজনির কার্টুনের রাজকন্যা, টিভি শোর উপস্থাপক বা বিজ্ঞাপনের মডেল সবার কাছ থেকেই এই বালিকারা লিঙ্গ- নির্দিষ্ট ভূমিকা ও আচরণ সম্পর্কে ধারণা পেতে থাকে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, নারী চরিত্রগুলোর ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্যসমূহ, পারিবারিক আচরণ, নারীদের পেশা ও বৃত্তি এবং নারীপুরুষের শারীরিক অবয়ব সম্পর্কিত ধারণাগুলো। মিডিয়া যেভাবে
নারী- পুরুষের আচরণ ও কর্মকাণ্ডকে তুলে ধরে, তা বেশিরভাগ বালিকা ও তরুণীর মধ্যে আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি ও হীনম্মন্যতার জন্ম দেয়। তবে আশার কথা হলো, মেয়েরা যত পরিণত হয়, ততই তাদের উপর চেপে থাকা লিঙ্গ- নির্দিষ্ট আচরণের বন্ধন শিথিল হতে থাকে। ফলে লিঙ্গ- নির্দিষ্ট মানসিক প্রবণতা, যার অনেকটাই অল্প বয়সে সমবয়সীদের প্রভাবে নারীর মধ্যে আরোপিত হয়েছিল, সেগুলো কাটিয়ে ওঠা তার জন্য অপেক্ষাকৃত সহজ হয়।
সহিংসতা ও নিপীড়নের বাস্তবতায় গড়া নারী মানস
মানুষের সমাজে যে কোনো বৈষম্যমূলক ও অসম ক্ষমতা- সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখার জন্য শেষ পর্যন্ত সহিংসতা ও নিপীড়নের উপর নির্ভর করতে হয়। অধস্তন ও অবদমিত গোষ্ঠী হিসেবে নারীও এর ব্যতিক্রম নয়। নারীকে তার অধস্তন অবস্থান এবং অসম ক্ষমতা- সম্পর্কের মধ্যে রাখার ক্ষেত্রেও পুরুষতান্ত্রিক পরিবার এবং সমাজ সহিংসতা ও নিপীড়নকে ব্যবহার করে। এ সমাজে মোটের উপর প্রতি তিনজনে একজন নারী সহিংসতা ও নিপীড়নের শিকার হন এবং তাদের অধিকাংশই এগুলোর ভীতি ও হুমকির মধ্যে থাকেন। এই ভীতি ও হুমকি যে সামাজিক বাস্তবতা তৈরি করে, তা নারীর মানসিক প্রকৃতির গঠনে এবং এর গতিপ্রকৃতি নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
এ সমাজে নারীর ক্ষেত্রে সবচেয়ে নাজুক, দুর্বল ও গ্লানির জায়গা হচ্ছে, তার যৌনতা এবং যৌন অঙ্গ- প্রত্যঙ্গ। অতএব নারীকে সবচেয়ে নির্মমভাবে আঘাত করার উপায় হচ্ছে যৌন নিপীড়ন। যৌন- নিপীড়ন- যার দ্বারাই সংঘটিত হোক না কেন, সমাজের দৃষ্টিতে এর মুখ্য দায় আক্রমণকারীর নয়-আক্রান্ত নারীর এবং এই ‘কলঙ্ক’ এমন এক গ্লানি, যা কোনো কিছু দ্বারাই মোচনীয় নয়। যে সমাজ যত পশ্চাৎপদ, সে সমাজে এই মনোভাব তত গভীর। যৌন- নিপীড়নের নেতিবাচক প্রভাব নারীকে অত্যন্ত নির্মম ও গভীরভাবে অক্রান্ত করে। ফলে অনেক নারীই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন।
নারীর মধ্যে অন্তরমুখিতা, আক্রান্ত হওয়ার ভীতি, ঝামেলা এড়িয়ে চলার প্রবণতা, ‘রহস্যময়তা’ (নিজের মনোভাব আড়াল করার প্রবণতা), সংকোচ ও লাজুকতা ইত্যাদির অনেকটা আসে পুরুষতান্ত্রিক সহিংসতা ও নিপীড়নের পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে চলার প্রচেষ্টা থেকে এবং কিছুটা আসে বয়োজ্যেষ্ঠ নারীদের দিকনির্দেশনা থেকে। ছোটবেলা থেকে মেয়েদের অভিজ্ঞতা হয়- প্রতিবাদী, মেনে না- নেওয়া, বহির্মুখী নারীদেরকেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পুরুষদের সহিংস আচরণ এবং নিপীড়নের শিকার হতে হয়।
এর সঙ্গে মানিয়ে নিতে গিয়ে তাদের আচরণের মধ্যে নির্বিবাদী হওয়া, মানিয়ে নেওয়া, ছলনা বা কায়দা করে কথা বলা বা ভাব প্রকাশ করা, ‘সহজে’ গুটিয়ে যাওয়া, ঝুঁকি নিতে আগ্রহী না হওয়া ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। ক্রীতদাস, যুদ্ধবন্দি ও অন্যান্য বন্দি, নিচুজাতের মানুষরা যে ধরনের নির্মম নিষ্পেষণের শিকার হয়, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীও যে এ রকম বন্দিত্ব, নিষ্পেষণ ও দাসত্বের মধ্যে থাকে, তা প্রায়ই আমাদের চোখ এড়িয়ে যায়।
তুচ্ছ কারণে নারীকে হত্যা করা এবং তার দেহ ও মনের চরম নিগ্রহের এসব নিদর্শন আমাদের সামনে মূর্ত করে তোলে তাদের বন্দিত্ব ও দাসত্বের শেকড় কত গভীরে প্রোথিত। ইউরোপের ‘উইচ হান্ট’ অর্থাৎ অপয়া সন্দেহে নারীদের নির্মমভাবে নির্যাতন ও হত্যা, আমাদের দেশে হিন্দু সমাজের সহমরণ প্রথায় নারীদের জীবন্ত পুড়িয়ে মারা এবং পুরুষের মনোরঞ্জনের জন্য চীনের মেয়েদের চরম যন্ত্রণাদায়ক পায়ের পাতার বাঁধন মানব ইতিহাসে নারীর উপর ঘটে যাওয়া কিছু চরম নির্যাতনের ঘটনা।
গত শতাব্দীতে মনস্তাত্ত্বিক গবেষকরা লক্ষ করেন, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর প্রকাশিত মনোভাব, ব্যক্তিত্ব ও আচরণসমূহকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এর ধরন হচ্ছে দাসত্ব, অবদমন ও নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে বেড়ে ওঠা মানুষের মনোভাবের মতো। পঞ্চাশের দশকে মার্কিন মনস্তত্ত্ববিদ হেলেন মায়ার হ্যাকারের গবেষণায় উঠে আসে, গোষ্ঠীগতভাবে নারীদের সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রেই আফ্রিকান-আমেরিকানদের আচরণ ও মনোভঙ্গির মিল রয়েছে; যেমন- অধিক আবেগময় ও শিশুসুলভ ব্যবহার, নিজেকে হীনতর হিসেবে প্রকাশ করা, অসহায়ত্ব বা দুর্বলতা প্রকাশ করা, ছলনাময় ও দুর্বোধ্য আচরণ করা ইত্যাদি। তাঁর ব্যাখ্যায় স্পষ্ট হয় যে, এগুলো জন্মগত কোনো বৈশিষ্ট্য নয়। উভয় জনগোষ্ঠীর উপর একইভাবে বিদ্যমান বন্দিত্ব, অবদমন, (নিয়মিত) সহিংসতা ও নিপীড়নের সঙ্গে মানিয়ে চলার জন্য অভিযোজনমূলক প্রতিক্রিয়া থেকে গড়ে ওঠে এ ধরনের আচরণ।
সত্তর ও আশির দশকে মনস্তাত্ত্বিক জে বি মিলার ও জ্যাঁলিম্পেন- ব্লুমেনের লেখাতেও নিপীড়িত গোষ্ঠীর সঙ্গে নারী মানসের সাদৃশ্যের বিষয়টি উঠে এসেছে। তারা দেখান যে, ক্ষমতাহীন গোষ্ঠীর লোকরা ক্ষমতাসীনদের উপর প্রভাব বিস্তার করার জন্য তাদের বুদ্ধি, চালাকি, স্বজ্ঞা, ব্যক্তিগত সম্পর্ক, যৌনতা, ছলাকলা, এড়িয়ে চলা ইত্যাদি কৌশল ব্যবহার করে। তারা আরও দেখান যে, অধীনস্থ নারীরা আধিপত্যকারীদের (পুরুষ) স্বরগ্রামে এতটা গভীরভাবে বাঁধা পড়ে যে, কোনটা তাদের (আধিপত্যকারীদের) সন্তুষ্ট করবে এবং কোনটাতে তারা অসন্তুষ্ট হবে তা তাদের অন্তরাত্মার মধ্যে ঢুকে যায়। এ ধরনের আচরণের মধ্যে রয়েছে- অধিক আবেগময় ও শিশুসুলভ ব্যবহার, নিজেকে হীনতর হিসেবে প্রকাশ করা, অসহায়ত্ব বা দুর্বলতা প্রকাশ করা, ছলনাময় ও দুর্বোধ্য আচরণ করা ইত্যাদি।
শারীরিক সৌন্দর্যের চক্কর এবং নারীর মন
পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নিজের শরীর নিয়ে নারীকে দুই ধরনের জটিল চক্করে পড়তে হয়। একটি সাধারণ ধারণা হলো এই দুই চক্করের মূল উৎস। একটি হলো- নারীর দেহ পুরুষের ভোগের বস্তু এবং এ সমাজে এটিই নারীর অস্তিত্বের প্রধান পরিচয়। তাই পুরুষের ভোগের বস্তু হিসেবে নারীর উৎকর্ষই এ সমাজের দৃষ্টিতে তার ব্যক্তিগত উৎকর্ষের প্রধান নির্ণায়ক। শারীরিক সৌন্দর্য এবং যৌন আবেদনই এই সমাজে নারীর গ্রহণযোগ্যতার মুখ্য মাপকাঠি, আর সব গুণই গৌণ।
অতএব ছেলেবেলা থেকেই মেয়েরা শারীরিক সৌন্দর্য অর্জন ও রক্ষার এক চক্করে পড়ে, যা হয়ে যায় তার অস্তিত্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক। পুরুষের ভোগের বস্তু হিসেবে অন্য যে চক্করে সে পড়ে তা হলো, তার শরীর ভোগের বৈধ অধিকর্তা (স্বামী বা রক্ষক) ছাড়া অন্য সকল পুরুষের ‘ভোগ বা ভোগের লালসা’ থেকে নিজেকে ‘রক্ষা’ করার চক্কর। এর জন্য পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তার উপর আরোপ করে বাধ্যতামূলক অবরোধ।
শরীর ঢাকার কঠোর বাধ্যবাধকতা, চলাফেরা ও সামাজিক মেলামেশার উপর কঠোর শৃঙ্খল এই চক্করের মূল কারণ। তবে যাপিত জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে এর প্রয়োগ অত্যন্ত নিষ্ঠুর, অমানবিক ও নির্মম। এই উভয় চক্কর একদিকে যেমন মেয়েদের জীবনে নিয়ে আসে অমানবিক ও কষ্টদায়ক এক বাস্তবতা, অন্যদিকে তাকে বেঁধে ফেলে কঠিন এক মানসিক চাপের জালে। শরীর ও অস্তিত্বকে ঘিরে এই দ্বিবিধ চক্করের করুণ বাস্তবতা নারীর মানসিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে।
পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে নারীর সৌন্দর্য বলতে যা বোঝায়, তা সর্বজনীন নান্দনিক কিছু নয়। বরং নির্দিষ্ট একটি সমাজে সৌন্দর্যের নির্দিষ্ট কিছু মানদণ্ড থাকে, সেই মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হলেই তাকে সুন্দর বলা হয়। এই মানদণ্ড অনেকগুলো বিষয়ের সমন্বয়ে তৈরি হয়, তবে এর প্রধান দিক হলো যৌন আবেদন। পশ্চিমের উন্নত ধনতান্ত্রিক দেশগুলোর ক্ষেত্রে সৌন্দর্যের যে মাপকাঠি তার থেকে ভিন্ন আফ্রিকার গরিব দেশের সমাজের মাপকাঠি; কিন্তু যে ব্যাপারটি দুই সমাজেই এক তা হলো- উভয় সমাজেই নারীরাই নিজ নিজ সমাজের আদর্শ সৌন্দর্য ও যৌন আবেদনের অবাস্তব মানদণ্ডে উন্নীত হওয়ার জন্য এক কষ্টকর ও যন্ত্রণাবিদ্ধ যাত্রায় নিবেদিত হয়। ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে আমরা দেখেছি পুরুষের দৃষ্টিতে ‘সুন্দর’ ও যৌন আবেদনময়ী হওয়ার জন্য নারীকে অবর্ণনীয় শারীরিক যন্ত্রণার মধ্যে যেতে হচ্ছে। অনেক সময় মেয়েরা স্বেচ্ছায় এই যন্ত্রণার মধ্যে যায়; কিন্তু বল প্রয়োগে তাদেরকে এই যন্ত্রণায় যেতে বাধ্য করা হচ্ছে এমন নিদর্শনও কম নয়।
মানব ইতিহাসে সৌন্দর্যের জন্য জোরপূর্বক শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা চাপিয়ে দেওয়ার একটি চরম উদাহরণ হচ্ছে, ছোটবেলা থেকে চীনের মেয়েদের পায়ের পাতার যন্ত্রণাদায়ক বাঁধনের প্রথা। দশম শতক থেকে গত শতাব্দী পর্যন্ত প্রায় এক হাজার বছর টিকে ছিল এই নির্মম প্রথা। ছোটবেলায় এই নির্মম প্রথা চাপিয়ে দেওয়ায় তার মনের উপর কী প্রভাব পড়েছিল, সে সম্পর্কে এক বৃদ্ধ চীনা নারী বলেন, ‘আমি ছিলাম দুরন্ত এবং লাফ ঝাঁপ দিতে পছন্দ করা একটি বাচ্চা; কিন্তু ওই সময় থেকে আমার মুক্ত ও আশাবাদী মনটা মরে গেল।’
এই একুশ শতকেও বলপূর্বক কিশোরীদের সৌন্দর্য বড়ানোর যন্ত্রণাদায়ক প্রথা আফ্রিকার বেশ কটি অনগ্রসর দেশে রয়ে গেছে। ‘বিশেষ ক্যাম্প’ করে বালিকাদের একদিনে দৈনিক তার স্বাভাবিক চাহিদার সাত থেকে দশগুণ খাবার খাওয়ানো হয়। কয়েক মাসব্যাপী এই জোর করে খাওয়ানো মেয়েদের জন্য ভীষণ যন্ত্রণাদায়ক ও অস্বস্তিকর ব্যাপার। এতে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ে। পুরুষের ভোগের উপযোগী করার জন্য নারীর ব্যক্তি- সত্ত্বাকে অগ্রাহ্য করে, এভাবেই তাকে শারীরিকভাবে অনেকাংশে অক্ষম এবং মানসিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। যেন সে মানুষ নয় ভোগের বস্তু মাত্র, এর জন্য অধিক উপযোগী করতে তাকে যেমন ইচ্ছা, তেমনভাবে কেটে ছিঁড়ে তৈরি করে নেওয়া যাবে।
‘সভ্য’ ও ‘উন্নত’ বলে পরিচিত আধুনিক দেশগুলোতে সৌন্দর্যের জন্য নারীদের উপর পরিবার ও সমাজের প্রত্যক্ষ জবরদস্তি কমে গেছে; কিন্তু সৌন্দর্যের ভূত অন্যভাবে নারীর ঘাড়ে চেপেছে। ফ্যাশন ও কসমেটিক ইন্ডাস্ট্রির বাণিজ্য এবং ‘সর্বত্রগামী’ প্রচার মাধ্যমের উপর সওয়ার হয়ে সৌন্দর্য চর্চার পুরনো বৃক্ষ বহু শাখা- প্রশাখা মেলেছে। ‘নিখুঁত’ সৌন্দর্য পাওয়ার জন্য শরীরের এমন কোনো অঙ্গ নেই, যার পরিচর্যা এ যুগের নারীরা করে না।
বলাবাহুল্য তাদের এই সৌন্দর্য চর্চারও মুখ্য উদ্দেশ্য পুরুষতান্ত্রিক মানদণ্ড অধিক যৌন-অবেদনময়ী হওয়া। আধুনিক এই ‘চর্চা’ একদিকে গভীর ও বিস্তৃত, অন্যদিকে যন্ত্রণাদায়ক এবং ব্যয়বহুল।। শরীরকে সৌন্দর্যের মানদণ্ডে উত্তীর্ণ করার জন্য এ যুগে যে নারীদেহের কোনো অংশই বাদ পড়ে না। পরিবর্তন আনা হয়- চুল, ভুরু, চোখ, নাক, কান, ঘাড় ও কাঁধ, ঠোঁট, থুতনি, বগল, কব্জি, হাতের নখ, স্তন ও স্তনের বোঁটা, পেট, নাভি, যৌনাঙ্গ, নিতম্ব, উরু, পা (Leg) পয়ের পাতা (Foot) পায়ের নখ ইত্যাদিতে।
খুব ছোটবেলা থেকেই মেয়েরা সৌন্দর্য রক্ষা ও সৌন্দর্য বাড়ানোর নানা দক্ষযজ্ঞের সঙ্গে জড়িয়ে যায়। এগুলো তার মধ্যে আসে পরিবারের বয়োজেষ্ঠ নারী এবং অন্যান্য পারিপার্শ্বিকতা থেকে। কসমেটিক ও ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির প্ররোচনায় মিডিয়া ও বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে এই বাসনা আরও প্রবল হয়। নারীর বাহ্যিক অবয়ব কেমন হবে সৌন্দর্যের মানদণ্ডগুলো শুধু সে নির্দেশ দেয় তাই নয়, এগুলো নারীর চলাফেরা, দেহভঙ্গি, কথা বলা ও আচার-আচরণ ইত্যাদির মানদণ্ডও তৈরি করে দেয়।
এই মানদণ্ডই বলে দেয়, ব্যক্তি নারীর সঙ্গে তার শরীরের সম্পর্ক কেমন হবে। এসব নির্দেশনা নারীর শারীরিক স্বাধীনতার উপর এমন অনেক সীমাবদ্ধতা আরোপ করে, যা তার সমবয়সী পুরুষের ক্ষেত্রে থাকে না। শারীরিক স্বাধীনতার ঘাটতি তার মানসিক বিকাশ, বুদ্ধিবৃত্তিক সম্ভাবনা ও সৃজনশীল প্রতিভাকে মুক্তভাবে গড়ে উঠতে দেয় না। সাজ-পোশাকের এই চক্কর মেয়েদের বেশিরভাগ আগ্রহ ও পছন্দকে একটি ক্ষুদ্র গণ্ডিতে আবদ্ধ করে ফেলে। শিক্ষিত বা অশিক্ষিত সব মেয়ের জন্যেই ‘ভালো বিয়ে’ হওয়া পরিবারের জন্য সামাজিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
অতএব সামাজিক মানদণ্ডে ‘সুন্দর’ হওয়ার বা থাকার জন্য চেষ্টা চালানো এবং এর জন্য সময় দেওয়া থেকে বিরত থাকা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। বিয়ের পরও স্বামীর সঙ্গে ‘সুসম্পর্ক’ ধরে রাখতে শরীরের সৌন্দর্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী নারীও সন্তানের কারণে, সামাজিক কারণে বিয়ে টিকিয়ে রাখতে চায়। আর বেশিরভাগ বিবাহিত নারীই অর্থনৈতিকভাবে স্বামীর উপর নির্ভরশীল। অতএব শারীরিক সৌন্দর্যের চক্কর বৃদ্ধ হওয়ার আগে নারীকে ছাড়ে না। এর প্রভাবে তার শারীরিক ও মানসিক স্বাধীনতা খর্ব হয় এবং সৃজনশীল সম্ভাবনার অনেক পথ বন্ধ হয়ে যায়।
সৌন্দর্যের চক্করের গভীরে যে সত্য রয়েছে তা হলো, নারীর জীবন পুরুষকেন্দ্রিক এবং পুরুষের নিমিত্তেই তার অস্তিত্ব এবং সে তার ভোগের ও সাজিয়ে রাখার বস্তু। অতএব পুরুষের মনোরঞ্জনের অনুকূলে তার দেহকে পরিবর্তন করে ‘তৈরি’ করতে হবে তা যত কষ্টেরই হোক। কখনো বল প্রয়োগে তাকে তা করতে বাধ্য করা হয়, কখনো পারিপার্শ্বিক ও সামাজিক প্রণোদনা থেকে সে নিজেই এতে নিয়োজিত হয়। এই বাস্তবতা নারীর মনের গভীরে নিজের এক অধীন, আবদ্ধ ও দেহ- সর্বস্ব প্রতিচ্ছবি তৈরি করে, যা তার মনের মুক্ত বিকাশের বড় প্রতিবন্ধক। এই চক্কর নারীকে শরীর ও মনের পরিপূর্ণ বিকাশ থেকে বঞ্চিত করে এবং বেশিরভাগ নারীকে দুর্বল- চিত্ত, ভীরু, আত্মকেন্দ্রিক ও বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিতে পরিণত করে।
অবরোধের অন্ধকার এবং নারীর মন
পৃথিবীর অধিকাংশ সমাজে পুরুষতন্ত্রের উপস্থিতি থাকলেও অনেক সমাজেই এখন আর কঠোর অবরোধ প্রথা নেই। এই প্রথাকে বৈধ অধিকর্তা ছাড়া অন্য সকল পুরুষের ‘ভোগ বা ভোগের লালসা’ থেকে নারীর শরীরকে ‘রক্ষা’ করার ‘প্রয়োজনীয়’ ও ‘কার্যকর’ প্রথা বলে দাবি করা হয়। ‘পর্দা’ কেবল ড্রেস- কোড বা শরীর ঢাকার বিষয় নয়। পোশাক ছাড়াও পর্দার আরও গুরুত্বপূর্ণ দুটি অংশ রয়েছে।
একটি হলো, নারীকে পারিবারিক চৌহদ্দি বা নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে থাকতে বাধ্য করা। অন্যটি হলো পাবলিক প্লেসেও নারীদের পুরুষের থেকে আলাদা রাখা। অর্থাৎ ড্রেস কোড মেনেও গণ্ডির বাইরে যাওয়া কিংবা ‘পর- পুরুষ’ বা অপরিচিত পুরুষের সঙ্গে মেশা বা কথা বলা, কোনো পুরুষ সঙ্গী ছাড়া একা একা কোথাও যাওয়া ইত্যাদিরও অনুমোদন নেই এই প্রথায়। এই প্রথা যতটা না ধর্মীয় তার চেয়ে অনেক বেশি সাংস্কৃতিক ও পুরুষতান্ত্রিক। এর সঙ্গে জড়িত পুরুষতান্ত্রিক অহম এবং পারিবারিক ‘সম্মান’। তাই এই প্রথার প্রচলনের ক্ষেত্রে পুরুষতান্ত্রিক পরিবার অত্যন্ত কঠোর ও নির্মম। পর্দা খেলাপ করে ‘ইসলাম- বিরোধী’ জীবন যাপনের জন্য পারিবারিক সদস্য কর্তৃক বা অন্যদের দ্বারা নারীদের নিহত বা গুরুতরভাবে আহত হওয়ার ঘটনা অনেক ইসলামি দেশে প্রায়ই ঘটে থাকে।
যে সব সমাজে এই প্রথা প্রচলিত আছে, সেখানে পুরুষতান্ত্রিক অন্যান্য বিধিনিষেধের প্রয়োগের ক্ষেত্রেও এই প্রথাকে ব্যবহার করা হয়। পর্দার সীমানা কেবল চলাফেরা ও মেলামেশার বাধ্যবাধকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, মেয়েদের বিয়ে, শিক্ষা ও পেশাগতজীবনও পর্দার ‘রীতি’ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। মেয়েরা কত দূর পড়তে পারবে, কী বিষয়ে পড়তে পারবে এবং পেশায় যেতে পারবে কি-না, গেলেও কোন পেশায় যেতে পারবে, সে সিদ্ধান্ত পরিবার নেয় ‘পর্দার নীতি অনুযায়ী’। নারীকে শারীরিক ও মানসিকভাবে অবরুদ্ধ করে রাখার এই প্রথা এবং তা প্রয়োগের ক্ষেত্রে সমাজ ও পরিবারের কঠোর ও নির্মম অবস্থান নারীর মানসের উপর বহুমাত্রিক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
রোকেয়ার কালোত্তীর্ণ গ্রন্থ অবরোধবাসিনী- তে অবরোধের বাস্তব চিত্র উঠে এসেছে। তাতে আমরা দেখি অবরোধের মধ্যে থাকা নারীরা মৃত্যুযন্ত্রণার মধ্যেও মুখ খুলতে বা নড়াচড়ার সংকোচ কাটাতে পারছে না। কঠোর শৃঙ্খল ও অবদমনের মধ্যে থাকা নারী যে মানসিকভাবে কতটা শক্তিহীন হয়ে যায়, এগুলো তারই নিদর্শন। স্বাভাবিক অনেক কাজ করার মানসিক শক্তি এবং নিজের পরিচিত চৌহদ্দির বাইরে সাবলীলভাবে চলাফেরা ও কাজকর্ম করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে তারা। বাইরের জগৎ এবং পরিবারের বাইরে সমাজের অন্য সব বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন এসব নারী একরকম ‘শিশুর মতো অন্তকরণহীন’ হয়েই গড়ে উঠত। তাদের মন এতটাই আত্মবিশ্বাসহীন হয়ে গড়ে উঠত যে, পূর্ণবয়স্ক হয়েও তারা বিশ্বাস করত নিজেদের দায়িত্ব নেওয়ার ক্ষমতা তাদের নেই।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, আত্ম- নিয়ন্ত্রণ অধিকার এবং স্বাধীনতার অভাব নারীর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ইসলামি বিপ্লবের পর কঠোর অবরোধ ইরানের নারীদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর গভীর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। ইরানে আত্মহত্যার হার বৈশ্বিক গড়ের পাঁচগুণ এবং অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, এর শতকরা ৮৩ জন হলো নারী। কঠোর অবরোধ প্রথা চালু রয়েছে এমন অন্যান্য দেশেও নারীদের মধ্যে মানসিক রোগের প্রকোপ অবরোধমুক্ত দেশগুলোর চেয়ে অনেক বেশি।
একদিকে ছেলেবেলা থেকে কঠোরভাবে আদ্যোপান্ত শরীর ঢাকার বাধ্যবাধকতা এবং অন্যদিকে চলাফেরা ও কর্মকাণ্ডের উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ নারীর মনে বহির্জগৎ সম্পর্কে গভীর সংবেদনশীলতা, ভীতি ও অদ্ভুত এক ধরনের ট্যাবু তৈরি করে। ফলে বহির্জগৎ সম্পর্কে মেয়েদের মধ্যে উপযুক্ত ধারণা গড়ে উঠতে পারে না এবং তাদের সামাজিকীকরণও ব্যাহত হয়। এভাবে বেড়ে ওঠা মানুষের মধ্যে আত্মবিশ্বাসেরও বড় ধরনের ঘাটতি থাকে। পূর্ণ বয়স্ক হলেও তারা আর নিজের দায়িত্ব নিতে সক্ষম হয়ে ওঠে না।
আধুনিক জীববিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞানের বোধ থেকে আমরা উপলব্ধি করি, প্রকৃতিগতভাবে নারী ও পুরুষের মানসিকতার বড় ধরনের পার্থক্য নেই।
নারী-পুরুষের মানসের যে পার্থক্য আমরা বিভিন্ন মাত্রায় দেখতে পাই, তার প্রধান ও নির্ণায়ক কারণ হলো, তাদের ভিন্ন সামাজিক বাস্তবতা। নারী-পুরুষ কেউই লিঙ্গ-নির্দিষ্ট মনোভাব ও আচরণ নিয়ে জন্মায় না। জন্মের পর সমাজ ও সভ্যতার প্রভাবই তাদের মধ্যে লিঙ্গ- নির্দিষ্ট মানসিকতার জন্ম দেয়। এই ক্ষেত্রে জৈবিক পার্থক্যের চেয়ে সমাজিক মাত্রা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ঐতিহাসিকভাবে সমাজে নারীর অধস্তন অবস্থা, বৈষম্য ও নিপীড়নমূলক অবস্থানে থাকা এবং পুরুষের ভোগের বস্তু হিসেবে যে শরীরী চক্করে তাকে পড়তে হয়, এই সবগুলো ব্যাপারই মূলত এ সমাজে নারীর মধ্যে নারী মানসের জন্ম দেয় । বনের পাখির মতোই মুক্ত অবস্থায়ই জন্ম নেয় নারীর মন।
এর পর পুরুষতন্ত্রের খাঁচায় বন্দি থেকে তার পারণতি হয়, সেই খাঁচার পাখির মতো ভীরু ও নতজানু মানসিকতার। যে সামাজিক প্রেক্ষাপটে নারীর মনস্তত্ত্বের এই রূপান্তর ঘটে, তাকে ঐতিহাসিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটেই দেখতে হবে। তা হলেই আমরা এর সঠিক রূপ এবং ভেতরের বাস্তবতাকে অনুধাবন করতে পারব এবং এর নেতিবাচক প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসার পথও আমাদের সামনে উন্মুক্ত হবে।
নারীর মন ও মুক্তি
‘নারীসুলভ’ মন নিয়ে নারী জন্মায় না। সমাজে নারীর মনকে আমরা যেভাবে আবিষ্কার করি, তা গড়ে ওঠে একদিকে নারীর মনের উপর পুরুষতান্ত্রিক অনুশাসন ও আদর্শের চাপ থেকে, অন্যদিকে পুরুষশাসিত সমাজের সহিংসতা, নিপীড়ন ও নিষ্পেষণ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে চলার প্রচেষ্টা থেকে। আমাদের এতক্ষণের দীর্ঘ আলোচনায় এ বিষয়গুলো অনেক বিস্তৃতভাবেই উঠে এসেছে। বাধ্য, অনুগত, আতঙ্কগ্রস্ত, আপসকামী, নরম, নতজানু এই মন নিয়ে ‘সুখে-শান্তিতে’ থাকা যায়; কিন্তু অধিকার, মানবিক মর্যাদা ও স্বাধীনতা পাওয়া যায় না। মেনে নিয়ে ‘সুখে-শান্তিতে’ থাকার চেষ্টা করা এবং পুরুষের অধীন হতে বাধ্য হয়ে মানসিক সংকটে পড়া, উপরে উল্লিখিত এই দুই ধরনের বাস্তবতাই এ সমাজে নারীর মনকে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধার দুই ধরনের শেকল। এসব শেকলে বাঁধা নারী কী করে মুক্তভাবে বাঁচতে শিখবে? পদে পদে পরিবার ও সমাজে নিপীড়ন, সহিংসতা ও নিষ্পেষণের নির্মম বাস্তবতাকে তারা কী করে ছিন্ন করবেন?
জীবনের পথ চলতে যে শক্তি, বুদ্ধি, কৌশল ও দক্ষতা দরকার, তার জন্য নারীরা এত দিন অন্যের উপর নির্ভর করেছে বা করতে বাধ্য হয়েছে। নির্ভরতার এই ভারসাম্যের কেন্দ্রে নিজেকে আনতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন নিজের জীবনকে নিজের পায়ের উপর নিয়ে চলার লক্ষ্য নির্ধারণ করা। নিপীড়ন, সহিংসতা এবং অন্যান্য নিষ্পেষণ থেকে বাঁচার জন্য অন্যের পাহারার চেয়ে নিজেকে শক্ত করা বেশি প্রয়োজনীয়। বাস্তবতা যেমন নারীর মনের নির্দিষ্ট একটি ধরন তৈরি করে, তেমনি বাস্তবতাকে পাল্টাতে হলেও মনের তারকে আরও কঠোর এক গ্রামে বাঁধতে হবে। পুরুষশাসিত সমাজে পরিবার ও সমাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেই এই কাজটি করতে হয়। তাই এটা খুব সহজ কাজ নয়, বিশেষ করে পশ্চাৎপদ সমাজগুলোতে। শক্তি, বুদ্ধি, কৌশল ও উদ্যমের সমন্বয় করেই এ যুদ্ধে জয়ী হতে হবে।
লেখক: চিকিৎসক এবং প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক, বাঙলাদেশ লেখক শিবির