
প্রবন্ধ। প্রতীকী ছবি
যুগ যুগ ধরে ভারতবর্ষে রাধা ও কৃষ্ণের প্রেমকাহিনি বৈষ্ণব ধর্ম ও সাহিত্যের অন্যতম প্রধান উপজীব্য। কিন্তু কৃষ্ণের দয়িতা রাধার প্রেমকে কেন্দ্র করে যে ভাবরসের সৃষ্টি হয়েছে, তার আবেদন ও প্রভাব বৈষ্ণব সাহিত্যের আঙিনা ছাড়িয়ে প্রায় সমগ্র ভারতের সাহিত্য ভাণ্ডারের উপরেই পড়েছে।
ধর্মীয় বলয়ে ধর্মবেত্তাদের মনে যেমনি, সাহিত্যাঙ্গনে ও আধ্যাত্মিক বলয়ে বৈষ্ণবশাস্ত্রীদের মনে তেমনি, আবার নৃবিজ্ঞানের ও ইতিহাসের পাঠকদের মনেও স্বভাবতই এই প্রশ্ন উদিত হয়েছে, কে এই রাধা?
তিনি কি সাহিত্যের উপজীব্য মাত্র? তাহলে বৈষ্ণব ধর্মে তার এই চ‚ড়ান্ত অধিষ্ঠানের পেছনের কারণগুলো কী কী? পুরাণোক্ত রাধার কি কোনো ঐতিহাসিক অস্তিত্ব ছিল? আর শ্রীকৃষ্ণের সাথেইবা রাধা যুক্ত হলেন কীভাবে? রাধা কি শুধুই কৃষ্ণের দয়িতা, নাকি তিনি আরও বেশি কিছু? এই প্রবন্ধে লেখক এই প্রশ্নগুলোর উত্তর বিস্তৃত আকারে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
আর ধর্মীয় অঙ্গন থেকে রাধা সাহিত্যে প্রবেশ করেছেন, নাকি আগেই তার ঐতিহাসিক অস্তিত্ব ছিল ও পরে তিনি ধর্মীয় পরিসরে প্রবেশ করেছেন-সে বিষয়ে লিখতে গিয়ে কিছু যৌক্তিক অনুমানের দ্বারস্থ হয়েছেন লেখক। রাধা বৈষ্ণব শাস্ত্রের আঙিনা পেরিয়ে তান্ত্রিক এবং শাক্তদেরও আরাধ্যাতে পরিণত হয়েছেন। সেখানে তার বিবর্তিত রূপ কী রকম-লেখক এই প্রবন্ধে সেই ধারণা দেওয়ারও চেষ্টা করেছেন।
আর এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে গিয়ে লেখক শ্রীরাধাকে মূলত ধর্ম, দর্শন, সমাজবিজ্ঞান ও নৃবিজ্ঞানের সমন্বয়ে সৃষ্ট একটি সামগ্রিক অবস্থান থেকে পাঠ করার চেষ্টা করেছেন।
ব্রহ্মের পরমকলা যে পদ্মিনী তা থেকে কোটি কোটি ব্রহ্মাণ্ড উৎপন্ন হয় এবং তার প্রসাদগুণেই রুদ্র, বিষ্ণু ও ব্রহ্মা সংহার, পালন ও সৃষ্টি কার্যে নিয়ত আছেন। পদ্মিনীর দেহকান্তিই প্রকৃতি এবং তার কোটি কোটি অংশ কোটি কোটি চন্দ্রমা। (রাধাতন্ত্রম, দেব্যুবাচ: ১২-১৪) (মুখোপাধ্যায়: ১৪১২ বাংলা নবভারত সংস্করণ: ১৭৭)
এক
আমরা যারা হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে কিছু জানতে চাই তারা অবগত যে, কংসের অত্যাচারে ও অনাচারে যখন পৃথিবীর অবস্থা করুণ, তখন বৈকুণ্ঠধামবাসী বিষ্ণু কৃষ্ণ নাম নিয়ে কংসের আপন ভগ্নীর পুত্র রূপে ধরাধামে অবতরণ করলেন অর্থাৎ কংস বধের অভিপ্রায়ে তিনি অবতারত্ব গ্রহণ করলেন এবং নিজের মৃত্যুর বিষয়ে কংস যেহেতু গণক ও ধর্মীয় পণ্ডিতদের মাধ্যমে আগে থেকেই জ্ঞাত ছিলেন, তিনি তাই নিজের মৃত্যু ঠেকাতে তার বোনের সদ্যোজাত সন্তানদেরকে একের পর এক হত্যা শুরু করলেন।
কৃষ্ণ ছিলেন তার পিতা-মাতা অর্থাৎ বসুদেব ও দেবকীর অষ্টম সন্তান, যিনি ছিলেন তাদের একমাত্র পুত্রসন্তান এবং বৈকণ্ঠধামবাসী বিষ্ণুর অবতার। তাই কৃষ্ণ অলৌকিকভাবে প্রাণে বেঁচে যান এবং গোকুলে পালক পিতা-মাতা নন্দগোপ ও যশোধার গৃহে প্রতিপালিত হন। এই গোকুলেই তার সাক্ষাৎ হয় তার ভবিষ্যৎ প্রেয়সী গোপকন্যা শ্রীরাধিকার সঙ্গে, যাকে বৈষ্ণবকুল ও তার ভক্তেরা বিশেষত বঙ্গে রাধারানী নামেই ডাকতে বিশেষ ভালোবাসেন। এই হলো রাধাকে জানবার প্রথম পাঠ।
কিন্তু বৈষ্ণব শাস্ত্রে রাধার ব্যাখ্যা আরও ব্যাপক। তিনি ব্রহ্মের পরম প্রকৃতি। তিনিই জগজ্জননী ও সৃষ্টির আদি কারণ, অর্থাৎ জগৎকারণ। তবে তিনি আদিতে কীভাবে এই জগজ্জননী ও কৃষ্ণের সমবায়িনী শক্তি অর্থাৎ কৃষ্ণের সামগ্রিক সৃষ্টিশক্তির মূলপ্রবাহ হয়ে উঠলেন তার ব্যাখ্যা প্রথমে আমরা যে জায়গাগুলো থেকে আলোচনা করব সেগুলো বৈষ্ণব ও গৌড়ীয় বৈষ্ণবশাস্ত্রের ধারামতে, শাক্ত ও তান্ত্রিকদের চিন্তার আলোকে এবং রামকৃষ্ণ মিশনের প্রাজ্ঞজনদের চিন্তানুসারে। শশীভূষণ দাশগুপ্তের ব্যাখ্যার জায়গা থেকেও আমরা রাধাকে কিছুটা বুঝবার চেষ্টা করব।
কারণ রাধাপাঠকে বিশেষত বঙ্গাঞ্চলে একাডেমিক ডিসকোর্স আকারে হাজির করার পেছনে তার অবদান অনস্বীকার্য। তবে শুরুতেই বলে নেওয়া ভালো যে, রাধাকে বৃহৎব্যাপ্তিতে বোঝার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধারাগুলোর মধ্যে মিলও আছে; বিশেষত-ধর্মীয় ব্যাখ্যার জায়গা থেকে রাধার উপস্থাপনে প্রায়শই বিবিধ ধারার শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যাগুলো প্রায় সমান্তরাল। এর কারণ এই ব্যাখ্যাগুলোর জন্য ধর্মীয় নানান ধারা ও উপধারাসমূহ অনেক ক্ষেত্রেই একই উৎসসমূহ ব্যবহার করেছে।
দুই
হিন্দু বা সনাতন ধর্মের সব ধারাই এই বিষয়ে একমত যে, হিন্দু ধর্মের যে ত্রিত্ববাদ (Hindu Trinity) তিন প্রধান দেবতাকে নিয়ে গড়ে উঠেছে, অর্থাৎ জগতের সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা, পালনকর্তা বিষ্ণু এবং তার সংহারক শিব-এদের প্রত্যেকের জন্য নারী সমবায়িনী শক্তি রয়েছেন; যেমন-ব্রহ্মার জন্য সরস্বতী, বিষ্ণুর জন্য লক্ষ্নী। তবে শিবের জন্য এই সমবায়িনী শক্তি কখনো উমা, কখনো শ্যামা, কখনো গৌরী, কখনো সতী, কখনো ভৈরবী, কখনো কালী, কখনো দুর্গা, কখনো চণ্ডী। অবশ্য বিজ্ঞজনদের ও শাস্ত্রীয় পণ্ডিতদের মত-এরা একই দেবীশক্তির বিবিধ রূপভেদ মাত্র। এই সমবায়িনী শক্তি হিন্দু শাস্ত্রে বর্ণিত ‘শক্তিতত্ত্বের’ মূল আধার। তবে বলে রাখা ভালো যে, এই নারী শক্তি যাকে হিন্দুশাস্ত্র বলছে প্রকৃতি, তা মূলত দুটি রূপে হিন্দু আখ্যানগুলোতে চিত্রিত হয়েছে এবং শাস্ত্রীয় বচনে বিবৃত হয়েছে। যথা-অসুর বিনাশিনী শক্তি ও হ্লাদিনী শক্তি।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, শ্যামা, কালী, দুর্গা, ভৈরবী, চণ্ডী-এরা অসুর বিনাশিনী; অর্থাৎ অসুর, পিশাচ, রাক্ষস ও দানবদের বধের নিমিত্তে তাদের আগমন ঘটেছে। এ ধারার আরও দেবী আমরা ভারতের সর্বত্র পেতে পারি। যেমন-জম্মু ও কাশ্মীরে ত্রিকুটা পর্বতমালার কাটরাতে আমরা পাই দেবীমাতা (Mother Goddess) বেইষ্ণু দেবীর মন্দির, যাকে পার্বতী (অনেকের মতে কালী), লক্ষ্নী ও সরস্বতীর মিলিত শক্তির প্রকাশিকা হিসেবে জ্ঞান করা হয়।
ত্রেতাযুগে অসুরদের বিনাশ করতে তার আগমন ঘটেছিল। (Singh: 2011) অন্যদিকে দেবগণের প্রেমদায়িনী বা হ্লাদিনী শক্তিরূপে পাই আমরা লক্ষ্নী, সরস্বতী, উমা, গৌরী, সতী, পার্বতী, শ্রীরাধিকা ইত্যাদি দেবীদের। এই ধারারও আরও দেবী আছেন ভারতের সর্বত্র, যেমন-তামিল অঞ্চলে দেবী মিনাক্ষী। তাকে তামিলনাড়ুর মাদুরাই জেলার মঙ্গলকর্ত্রী ও রক্ষাদেবী (tutelary deity) হিসেবে আরাধনা করা হয়। তিনি দেবী পার্বতীর আরেক রূপ। ((Howes: 2003: 27) শিবের আরেক রূপ ‘সুন্দরেশ্বরে’র তিনি সহগামিনী ও সমবায়িনী শক্তি, অর্থাৎ তিনি মূলত তার হ্লাদিনী শক্তি। (Meenakshi Pancharatnam Lyrics – Meenatchi Pancha Ratnam. Hindu Devotional Blog. https://www.hindudevotionalblog.com/2008/09/meenakshi-pancharatnam-lyrics-meenatchi.html)
তবে মিনাক্ষীর হ্লাদিনী শক্তি হয়ে ওঠার আগে তার একটি বিধ্বংসী ও চণ্ডীরূপ আছে। একদা তিনি মানব ও দেবগণের সংহারিকাও হয়ে উঠেছিলেন এবং সেই সঙ্গে তিনি সমগ্র জগৎ জয় করতে উন্মত্ত হয়ে উঠেছিলেন। তবে শিবের কারণে সেই হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসযজ্ঞ বেশিদূর এগোয়নি। তিনি শিবের সুন্দরেশ্বর রূপকে পতি হিসেবে গ্রহণ করেন। তাদের দুই পুত্র হয়, সুবরামানিয়া বা কার্তিক এবং বিনায়ক বা গণেশ। (Kinsley: 1988: 202; see also: https://www.daiwikhotels.com/about-madurai/meenakshi-sundareswarar/) বোঝাই যাচ্ছে এই মিনাক্ষীও পার্বতী ও দুর্গার আরেক রূপ। এছাড়াও তামিলনাড়–তে পার্বতীর আরও দুটি রূপভেদ আমরা পাই, কামাক্ষী ও বিশালাক্ষী-এরাও শিবের প্রেমদায়িনী বা হ্লাদিনী শক্তি। (Nelson: 2006: 121)
তিন
আমরা দেবী দুর্গার হাতে মহিষাসুর বধের কাহিনি জানি; যে কারণে তার আরেক নাম মহিষমর্দিনী। এ আখ্যানটি শ্রীশ্রীচণ্ডীর অংশ, আর মূলত এটি মার্কেন্ডেয় পুরাণের অন্তর্গত। অন্যদিকে মহাকালী, পরাশক্তিসহ বিবিধ রূপে তিনি বধ করেছেন মধু, কৈটভ, শুম্ভ, নিশুম্ভ, তারকাসুর, ভণ্ডাসুর, ভস্মাসুর, অরুণাসুর, নরকাসুর, ভীমাসুর, দুর্গমাসুর, রক্তবীজ, ধূম্রলোচন, মেঘলোচন, সুগ্রীব, শুম্ভ ও নিশুম্ভের অধস্তন চণ্ড ও মুণ্ডসহ আরও বহু অসুরকে, যে কাহিনিগুলো সমগ্র ভারতবর্ষ জুড়েই নানা লোকগাথা, আখ্যান, লোকায়ত চিন্তা, নাটক ও পুরাণাদিতে ব্যাপ্ত রয়েছে।
সেই অসুর বধের নিমিত্তে একই দেবী বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নামে পরিচিত হয়েছেন। একই কাহিনি অনেক সময় বহু উৎস থেকে বর্ণিত হয়েছে, ফলে আখ্যানগুলোতে কাহিনির নানাবিধ চিত্রায়ণ ঘটেছে। তাতে অবশ্য মূল কাহিনির কোনো পরিবর্তন হয়নি। আর বহু বর্ণিল আকারে তার উপস্থাপন মানসলোকে বহু ব্যঞ্জনাময় বয়ানের দ্বার অবারিত করেছে। যেমন-মধু-কৈটভের বধ।
কোনো কোনো পুরাণমতে এই প্রবল পরাক্রান্ত দুই অসুরের মৃত্যু হয়েছে দেবী মহামায়া, অর্থাৎ দেবী চণ্ডী বা কালীর হাতে, যারা দেবী গৌড়ী, পার্বতী বা দুর্গারই রূপভেদ। কিন্তু শ্রীশ্রীচণ্ডীতে আমরা বিষ্ণুকেই তাদের সংহারক রূপে পাই। সেখানে যোগনিদ্রায় শায়িত বিষ্ণুর কর্ণমল (বধৎধিী ড়ৎ পবৎঁসবহ) থেকে মধু ও কৈটভ নামের দুই মহাশক্তিশালী অসুরের আগমন ঘটলে তারা সৃষ্টির প্রধান কারণ প্রজাপতি ব্রহ্মাকে হত্যা করতে উদ্যত হয়। ব্রহ্মা তখন জগজ্জননী ভগবতী মহামায়া বা মহাদেবী দুর্গার দ্বারস্থ হন।
এখানে আমরা জানতে পারি যে, ভগবতী দুর্গা শুধু শিবের সমবায়িনী শক্তি নন, তিনি সমগ্র দেবশক্তি তথা শুভশক্তির কেন্দ্র এবং জগতের সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়ের মূল চালিকা শক্তি। শ্রীশ্রীচণ্ডীতে আমরা পাই, তার স্তবগান করতে গিয়ে ব্রহ্মা এক জায়গায় বলছেন, “যেই ভগবান এই জগতের সৃষ্টি, স্থিতি ও পালন করেন, সেই ভগবানকেও যখন তুমি নিদ্রাবিষ্ট করে রেখেছে, তখন কে তোমার স্তব করতে সমর্থ? আমাকে, ভগবান বিষ্ণুকে ও ভগবান রুদ্রকেও১ তুমিই শরীর গ্রহণ করিয়েছ; কাজেই তোমার স্তুতি করার মতো শক্তি কার আছে?” (শ্রীশ্রীচণ্ডী: ২০১২ সংস্করণ: ৬২-৬৩)
এরপর তিনি দেবীকে অসুর সংহারের প্রয়োজনে বিষ্ণুদেবকে জাগ্রত করতে অনুরোধ করলে দেবী বিষ্ণুকে তার যোগনিদ্রা থেকে জাগালেন এবং অসুরদ্বয়কে মোহাচ্ছন করে রাখলেন। বিষ্ণু পাঁচ হাজার বছর অসুরদ্বয়ের সঙ্গে যুদ্ধ করলেন। বিষ্ণুর যুদ্ধকৌশলের নিপুণতায় অসুরদ্বয় প্রীত হয়ে তাকে বর দিতে চাইলে বিষ্ণু তাদের তার হাতে বধ্য হওয়ার বর চাইলেন এবং তাদের এই কৌশলে বধ করলেন।
(শ্রীশ্রীচণ্ডী: ২০১২ সংস্করণ: ৬৫-৬৬) তার মানে অসুর বিনাশে দেবী সরাসরি অংশগ্রহণ না করলেও তার পরোক্ষ ভূমিকা ছিল। আবার ভাগবত পুরাণে আমরা পাই যে, বিষ্ণুর কর্ণমল থেকে সৃষ্ট মধু ও কৈটভ নামের দুই মহাশক্তিশালী অসুর ব্রহ্মার কাছ থেকে বেদ লুণ্ঠন করে মহাসমুদ্রে আত্মগোপন করে।
বিষ্ণু তখন অশ্বমুখ অবতার বা অশ্বাবতার ‘হয়গ্রীবে’র আদলে বেদ উদ্ধার করেন এবং অসুরদ্বয়কে বধ করেন। (Parmeshwaranand: 2001: 632) আবার ‘দেবী মাহাত্ম্যের’ পঞ্চম অধ্যায়ে আমরা পাই, শুম্ভ ও নিশুম্ভ নামক দুই মহাপরাক্রমশালী অসুরভ্রাতা স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতাল-এই ত্রিলোক জয় করে দেবতাদের নিজেদের অধীনস্থ করে এবং ত্রিলোকের সব নিয়ম-কানুনের বিনাশের কারণ হয়ে ওঠে।
আর তা তারা করতে সমর্থ হয় তপস্যার দ্বারা ব্রহ্মাকে তুষ্ট করে, কারণ তারা এই বর চেয়েছিল যে, তারা হবে মানব ও দানবদের সামনে অপরাজেয়, কাজেই তাদের অবধ্য। কিন্তু তারা ভ্রমবশত দেবতাদের বা দেবীদের কথা বলেনি। ফলে দেবী পার্বতী তাদের বধ করতে চাইলে তারা প্রথমে তাদের দুই অধস্তন অসুর চণ্ড ও মুণ্ডকে প্রেরণ করে। তারা দেবীর রূপে মুগ্ধ হয়ে সে বিষয়ে শুম্ভকে অবহিত করলে শুম্ভ দেবীকে অধিকার করতে আগ্রহী হয়।
দেবী পার্বতী মহাকালীর রূপ ধারণ করে চণ্ড ও মুণ্ডকে বিনাশ করেন এবং গ্রহণ করেন চামুণ্ডা উপাধি। একই কারণে তাকে চামুণ্ডী, চামুণ্ডেশ্বরী, চর্চিকা, রক্তান্দিকা ইত্যাদি উপাধিতেও ভূষিত করা হয়েছে। (Gopal: 1990: 81) এরপর দেবী সমগ্র অসুরবাহিনীকে বিনাশ করেন। ফলে শুম্ভ ও নিশুম্ভ নিজেরাই এবার দেবীর মুখোমুখি হয়। নিশুম্ভকে বধ করে দেবীর সিংহ। তার মৃতদেহ থেকে এক ভয়ানক দানব আবির্ভূত হলে দেবী তার বিনাশ ঘটান। এরপর দেবী তার ত্রিশূল দিয়ে শুম্ভকে বধ করেন। যা হোক হিন্দুশাস্ত্রের বক্তব্য হচ্ছে, আমরা এই যে দেবীকে পাই, তিনি শুধু পুরাণোক্ত দেবী নন, তিনি বেদে বর্ণিত মহাদেবীও একাধারে।
ঋকবেদের দেবীসূক্তে দেবী ভক্তকে বলছেন, “আমার দ্বারাই লোকসকল বেঁচে আছে, অন্ন গ্রহণ ও শ্রবণাদি করছে। আমাকে যে অবহেলা করে সে বিনষ্ট হয়। তুমি শ্রদ্ধাবান, সে কারণে আমি তোমাকে এসব বলছি। ব্রহ্মশক্তির প্রতি হিংসাত্মক অসুরদের বধের অভিপ্রায়ে ধনুর্ধর রুদ্রের বাহুতে আমিই শক্তিরূপে অবস্থিতা ছিলাম। আমিই লোকরক্ষার জন্য যুদ্ধকার্যে নিযুক্তা হই। আমিই আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যে প্রবিষ্টা হয়ে রয়েছি।” (সারদানন্দ : ২০১১ : ৬)
দেবী এখানে আরও বলছেন, ‘আমিই সমগ্র জগতের রাজ্ঞী, আমার উপাসকেরাই বিভ‚তিসম্পন্ন হয়; আমিই ব্রহ্মা ও ব্রহ্মজ্ঞানসম্পন্না, সকল যজ্ঞে আমারই প্রথম পূজাধিকার; দর্শন, শ্রবণ, অন্নগ্রহণ ও শ্বাসপ্রশ্বাসাদি প্রাণিজগতের সমগ্র ব্যাপার আমার শক্তিতেই সম্পন্ন হয়; সংসারে যে কোনো ব্যক্তি শুদ্ধভাবে আমার উপাসনা না করে আমার অবজ্ঞা করে, সে দিন দিন ক্ষীণ ও কালে বিনষ্ট হয়; হে সখা, যা বলছি তা অবহিত হয়ে শ্রবণ করো-শ্রদ্ধার দ্বারা যে ব্রহ্মবস্তুর সন্দর্শন লাভ হয়, আমিই তা; আমার কৃপাতেই লোক শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করে: আমার কৃপাকটাক্ষেই পুরুষ-স্রষ্টা, ঋষি ও সূক্ষ্নবুদ্ধিসম্পন্ন হয়।’ (সারদানন্দ: ২০১১: ৭০-৭১) যে কারণে এই দেবীশক্তিকে পূজা করতে এবং তাকে আবাহন করতে স্তব করা হয়,
যা দেবী২ সর্বভ‚তেষু শক্তিরূপেণ সংস্তিতা।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ /
অর্থাৎ যে দেবী সর্বভূতে শক্তিরূপে বিরাজমান,
তাকে প্রণাম, তাকে প্রণাম, তাকে প্রণাম, তাকে নমস্কার, নমস্কার /
এই সব দেবী যে একজনই তার আরেকটি প্রমাণ হচ্ছে পদ্মপুরাণের সৃষ্টিখণ্ড। যেখানে বিষ্ণু সাবিত্রী দেবীকে পরম ভক্তিসহকারে স্তব করে বলছেন, ‘তুমি সর্বগা, সর্বভ‚তে দ্রষ্টব্যা, সর্বরকমে অদ্ভুতা; সৎ-অসৎ যাহা কিছু দৃশ্য তোমা বিনা কিছুই নয়। তথাপি যে সব স্থানে সিদ্ধিকামী ব্যক্তিগণ-কর্তৃক তুমি দ্রষ্টব্য, অথবা ভূতিকামী ব্যক্তিগণ-কর্তৃক স্মরণীয়া সেই-সব তোমার অগ্রে বলিতেছি।’ (দাশগুপ্ত : বাংলা ১৪১৬ সংস্করণ: ৩-৪) এরপর সব দেবী যে একজনই তার একটি দীর্ঘ তালিকা উপস্থাপন করেন বিষ্ণু।
তিনি বলেন, ‘দেবী তুমি পুষ্করে সাবিত্রী, বারাণসীতে বিশালাক্ষী, নৈমিষারণ্যে লিঙ্গধারিণী, প্রয়াগে ললিতা দেবী, গন্ধমাদনে কামুকা, মানসে কুমুদা, অম্বরে বিশ্বকায়া, গোমন্তে গোমতী...’। এই ধারায় তিনি শতাধিক দেবীর নাম উপস্থাপন করেছেন। (দাশগুপ্ত: বাংলা ১৪১৬ সংস্করণ: ৪-৫) আর এখানেই তিনি লিখেছেন যে, ঐ মহাদেবীই দেবিকাতটে নন্দিনী, দ্বারবতীতে রুক্মিণী, বৃন্দাবনে রাধা... ইত্যাদি।
হিন্দু বা সনাতন ধর্ম ও তার শাস্ত্র সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আগেভাগেই বলে রাখি। এই শাস্ত্রে শক্তি ও শক্তির আধার একই বা অভেদ। আরও ভেঙ্গে বললে, যে কোনো শক্তি আর তার সঙ্গে সম্পর্কিত দেব বা দেবী আদতে অভিন্ন। যেমন-আগুন মানে অগ্নি, আবার আগুনের দেবতাও অগ্নি। বাতাসের আরেক নাম পবন, আবার তার দেবতাও পবন। ফলে হিন্দুশাস্ত্রে শক্তি জড় বা অচেতন নয়, বরং তা সচেতন। ফলে এই পরমা দেবীশক্তির বেলায় সেই সত্য আরও প্রবল। তিনি নিজে শুধু সচেতন নন, তিনি সর্বভূতে চেতনার কারণ। যে কারণে এই দেবীর স্তবে এও বলা হয় যে,
যা দেবী সর্বভূতেষু চেতনেত্যভিধীয়তে।
(সারদানন্দ : ২০১১ : ১৪)
অর্থাৎ যে দেবী সর্বভূতে চেতনা রূপে বিরাজমান,
এই একই পরমা দেবী যে সকল দেবগণের ত্রাণকর্ত্রী তার আরেকটি প্রমাণ হচ্ছে বিষ্ণুপুরাণ। কাহিনিটি এই যে, দুর্বাশা মুনি দেবরাজ ইন্দ্রকে একটি মালা উপহার হিসেবে দিলে দেবরাজ ইন্দ্র সেই মালা অবহেলা করেন। এতে ক্রুদ্ধ দুর্বাশার অভিশাপে দেবগণ শ্রী বা লক্ষ্নী হারান, যা ক্ষীরোদ সমুদ্রের গহিনে বিলীন হয় এবং দেবগণের সমস্ত গৌরব ও ঐশ্বর্য লুপ্ত হয়। এই সংকট উত্তরণের জন্য দেবতারা পিতামহ ব্রহ্মাকে নিয়ে বিষ্ণুর শরণাপন্ন হন।
আর বিষ্ণু অসুর ও দেবগণকে সঙ্গে নিয়ে তারা একত্রে মিলে সমুদ্র মন্থন করতে পরামর্শ দেন। এই মন্থনে সমুদ্রের অতল থেকে জগতের শ্রী ও সমৃদ্ধির প্রকাশ রূপে ‘শ্রীদেবী’ অর্থাৎ ‘লক্ষ্নীদেবী’ আবিভর্‚ত হন। এই সমুদ্র মন্থনে দেবী লক্ষ্নী দেবগণের সমস্ত মঙ্গল ও সৌকর্যের আকর হিসেবে প্রমাণ হয়ে আবার দেব জগতের কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠিত হন।
দেবীকে গ্রহণ করতে গিয়ে স্বর্গরাজ্যের গন্ধর্বগণ গান গাওয়া শুরু করল, অপ্সরাগণ নৃত্য পরিবেশন করতে লাগল, স্বর্গলোকের হাতিরা হেমপাত্র নিয়ে সর্বলোকমহেশ্বরী দেবীর উপর পানি বর্ষণ করে তাকে স্নানে সহায়তা করতে লাগল। আর ক্ষীরোদ সাগর নিজে রূপ ধারণ করে দেবীকে অমলিন পদ্মফুলের মালা প্রদান করল। স্বর্গলোকের কারিগর দেব বিশ্বকর্মা দেবীর অঙ্গবিভূষণ করলেন। এই কাহিনিগুলো কম-বেশি আমাদের জানা।
যা হোক পুরাণাদিতে এত কিছু বয়ানের অর্থ সম্ভবত দেবীর গুরুত্ব উপস্থাপন করা। আর আমাদের জন্য স্মর্তব্য হচ্ছে এই দেবী লক্ষ্নীই শ্রীরাধিকা। বিষয়টি শশীভূষণ দাশগুপ্তও গুরুত্ব সহকারে বর্ণনা করেছেন। (দাশগুপ্ত : বাংলা ১৩৯৬ সংস্করণ : ৫৩-৫৪)
পুরাণে এই বিবরণ আরও বিস্তৃত আকারে আছে। সব দেবী মূলত একজনই, স্থান-কাল-কর্ম ভেদে তার বহু রূপ। শক্তির উপাসক তান্ত্রিকদের কাছে এই দেবীই সব, কারণ তিনিই শক্তি ও তার কারণ এবং তিনিই সর্বজগতের অধীশ্বরী। ‘রাধাতন্ত্রম’ বলছে, ব্রহ্মের পরমকলা যে পদ্মিনী তা থেকে কোটি কোটি ব্রহ্মাণ্ড উৎপন্ন হয় এবং তার প্রসাদগুণেই রুদ্র, বিষ্ণু ও ব্রহ্মা সংহার, পালন ও সৃষ্টি কার্যে নিয়ত আছেন। পদ্মিনীর দেহকান্তিই প্রকৃতি এবং তার কোটি কোটি অংশ কোটি কোটি চন্দ্রমা। (রাধাতন্ত্রম, দেব্যুবাচ: ১২-১৪) (মুখোপাধ্যায়: ১৪১২ বাংলা নবভারত সংস্করণ: ১৭৭)
এই পদ্মিনী শ্রীরাধারই রূপভেদ মাত্র। আবার অন্যত্র আমরা দেখতে পাই, বাসুদেব-কৃষ্ণ স্বয়ং দেবী ত্রিপুরাসুন্দরীর আরাধনা করছেন নিম্নোক্ত বাক্যে,
‘হে ত্রিপুরাসুন্দরী! তুমি জীবের দুঃখনাশ কর হে মাতঃ! তোমাকে নমস্কার করি! তুমি শঙ্করের (শিবের) আরাধ্যা ও নারায়ণের (বিষ্ণুর) চিন্তনীয়া তোমাকে নমস্কার করি। তুমি ত্রিভুবন প্রসব করিয়াছ এবং এইক্ষণ অমৃতসেক করিয়া আমার চেতনা প্রদান করিয়াছ হে মাতঃ! তোমাকে নমস্কার করি। তুমি বিষ্ণুর হৃদয়বাসিনী আমাকে প্রত্যক্ষ দেখা দিয়াছ হে মাতঃ! তোমাকে নমস্কার করি \ (মুখোপাধ্যায় : ১৪১২ বাংলা নবভারত সংস্করণ : ১২)
বলা বাহুল্য যে, রাধাতন্ত্রে দেবী ত্রিপুরাসুন্দরী শ্রীরাধারই এক বিশ্বমাত্রিক রূপ। আর এই আদি পরাশক্তি যে রাধা তা আরও প্রকটিত করেছে নারদ পাঞ্চরাত্রম; সেখানে বলা হচ্ছে, হে রাধারানী! হে জগন্মাতা! হে সর্বেশ্বরী
আদ্যাপ্রকৃতি কৃষ্ণ প্রাণাধিকা দেবী, মহাবিষ্ণু-প্রসূরপি (অর্থাৎ তুমি সেই জগন্মাতা, যে মহাবিষ্ণুকেও প্রসব করেছো)। (ভট্টাচার্য: ২০১৩: ৯৫)
চার
রাধাকে বৈষ্ণব ও তান্ত্রিকদের সমগ্র জগতের অধীশ্বরীরূপে গ্রহণের প্রেক্ষাপট এক অর্থে বেদসমূহ এবং পুরাণাদির কারণে আগেই তৈরি ছিল। আর শাক্ত ও তান্ত্রিকদের কাছে শক্তিই যখন মূল, তখন রাধাকে তাদের বাস্তবতায় শক্তিরূপিণী আদিদেবী বা আদ্যাশক্তির বহুমাত্রিক প্রকাশের একটি হিসাবে গণ্য করেই তাকে তাদেরও আরাধ্যা দেবী রূপে গ্রহণ করাটাই স্বাভাবিক। এই জায়গায় তান্ত্রিক ও শাক্তধারা বিষয়ে শশীভূষণ দাশগুপ্ত যা বিবৃত করেছেন তা নিয়ে কিছুটা আলোকপাত করা যাক। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের মানুষ বৈষ্ণব ধর্ম বলতে শ্রীচৈতন্য প্রবর্তিত বৈষ্ণব ধারাকেই বোঝে।
কিন্তু বৈষ্ণব ধর্মের বীজ অত্যন্ত প্রাচীন। বৌদ্ধ সহজিয়া ধারাও এতে কোনো কোনো সময় প্রভাব রেখেছে। তান্ত্রিকদের প্রভাব যে সেখানে আছে, তা বলা বাহুল্য। তবে এসব ধারায় শক্তি অর্জনের পথ কতকগুলো গুহ্য সাধনার উপর গড়ে উঠেছে, সেখানে দর্শনের তেমন কোনো প্রভাব নেই বলেই তার অভিমত।
এগুলো বামাচারী তান্ত্রিক সাধনা, বৌদ্ধ তান্ত্রিক সাধনা, বৌদ্ধ সহজিয়া সাধনা, বৈষ্ণব সহজিয়া সাধনা প্রভৃতির উদ্রেক ঘটিয়েছে বলে শশীভ‚ষণ দাশগুপ্ত মন্তব্য করেছেন। এদের বহিরঙ্গ বিবিধ রূপ ও নামে পরিচিত হলেও ভেতরে তাদের মধ্যে গভীর ঐক্য আছে বলে তিনি তার মত ব্যক্ত করেছেন, আর তা হচ্ছে এক উপলব্ধির ঐক্য-‘চরম সত্য অদ্বয় পরমানন্দ স্বরূপ’।
এই অদ্বয় আনন্দ তত্ত্বই (সংক্ষেপে অদ্বয়তত্ত¡) হলো ‘পরম সামরস্য’। (দাশগুপ্ত: বাংলা ১৩৯৬ সংস্করণ: ২৭৬-২৭৭) অদ্বয়তত্ত্বের দুটি ধারা-একটি শিব, অপরটি শক্তি। এরাই সৃষ্টির আদিতে অবস্থানকারী ‘পুরুষ’ ও ‘প্রকৃতি’। এই দুই ধারা নিজেদের সম্মেলনে যে তত্ত্বের জন্ম দিয়েছে তার নাম ‘মিথুনতত্ত্ব’, যাকে ‘যামলতত্ত্ব’ বা ‘যুগলতত্ত্ব’ নামেও অভিহিত করা হয়।
এটিই তান্ত্রিক বৌদ্ধদের কাছে ‘যুগনদ্ধ তত্ত্ব’ নামে পরিচিত। তান্ত্রিক বৌদ্ধমত যে হিন্দু শাক্ত ও তান্ত্রিক ধারার সংস্পর্শে উদ্ভূত তা এখান থেকে অনুমান করা সহজ। তান্ত্রিক সাধনার ক্ষেত্রে এই অখণ্ড যুগলতত্ত্বই ‘কেবলানন্দ তত্ত্ব’। অদ্বয়তত্ত্ব যে শিবতত্ত্ব ও শক্তিতত্ত্বের জন্ম দিয়েছে সেখানে সূক্ষ্ন ও স্থূল উভয় অর্থে পুরুষ শিবতত্তে¡র ও নারী শক্তিতত্ত্বের প্রতীক। ফলে এই দুইয়ের সম্মেলনে দুই তত্ত্বই নিজেকে পূর্ণ করতে চায়।
নারী-পুরুষের মিলনের মাধ্যমে এটি পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয়, যা সাধক-সাধিকাকে পূর্ণ সামরস্যে পৌঁছে দেয়। তান্ত্রিক ভাষায় এটিই ‘সামরস্য-সুখ’, বৌদ্ধদের (আমার মতে তান্ত্রিক বৌদ্ধদের- লেখক) ভাষায় ‘মহাসুখ’, আর বৈষ্ণবদের ভাষায় ‘মহাভাব’ স্বরূপ। (দাশগুপ্ত: বাংলা ১৩৯৬ সংস্করণ: ২৭৮) যুগলতত্ত্ব ও তার যুগল সাধনা যখন বৈষ্ণব সমাজে প্রবেশ করে তখন সহজিয়া বৌদ্ধদের যোগ-সাধনা প্রেম-সাধনায় রূপান্তরিত হয়, বৈষ্ণব ধর্ম পরিণত হয় প্রেমধর্মে-যেখানে চরমাবস্থায় প্রেমই আনন্দ স্বরূপ। (দাশগুপ্ত: বাংলা ১৩৯৬ সংস্করণ: ২৭৯) বলে রাখা ভালো যে, এইসব সাধনায় যৌনতাকে কোনোভাবেই নেতিবাচক রূপে দেখা হয় না।
বরং তা সাধনার একটি অন্যতম ধাপ, যার মধ্যে সৃজনশীলতা, আধ্যাত্মিকতা ও প্রকৃতির সঙ্গে সাধক বা সাধিকার ঐকান্তিকতা তৈরি করে। তবে শশীভূষণের আলোচনায় দুটি সমস্যা দেখা যায়। তিনি অনেক তান্ত্রিক ও সহজিয়া বৌদ্ধ-সাধনাকে স্রেফ বৌদ্ধ-সাধনা বলে মন্তব্য করে গিয়েছেন। অন্যদিকে বৈষ্ণবধর্ম মাত্রই যে রাধাতত্ত্ব নয়, তা তিনি বলেননি। চৈতন্যের কারণে রাধাবাদের জনপ্রিয়তা বঙ্গাঞ্চলে ও উড়িষ্যায় বেশি।
কিন্তু বৈষ্ণবদের এমন শাখাও আছে বা ইতিহাসে ছিল যেখানে রাধা অনুপস্থিত। যেমন-চৈতন্য যখন পুরীতে ছিলেন তখন ‘পঞ্চশাখার’ বৈষ্ণবদের সাথে তার পরিচয় হয়। তারা চৈতন্যকে অবতার জ্ঞানে সম্মান করতেন। তাদের মধ্যে অন্যতম ঈশ্বর দাস ‘চৈতন্য ভাগবত’ লেখেন এবং সেখানে চৈতন্যকে স্বয়ং ঈশ্বর রূপে উপস্থাপন করেছেন।
অথচ পঞ্চশাখার বৈষ্ণবদের মধ্যে রাধা অনুপস্থিত। (চক্রবর্তী: ২০১৫ মুদ্রণ: ৪৭) তার মানে চৈতন্যের কারণে জনপ্রিয় রাধাবাদ একটি বিশেষ রাধাতত্ত্ব, যার সঙ্গে শাক্ত, বামাচারী ও তান্ত্রিকদের ততটুকু মিল যতটুকু শক্তির কেন্দ্ররূপে নারীকে উপস্থাপন করা যায়। কারণ এদের কাছে প্রকৃতি নারী রূপিণী ও জগতে শক্তির ভরকেন্দ্রও নারী।
পাঁচ
বৈষ্ণব ও অনেক তান্ত্রিক মতে প্রবল পরাক্রান্তা দেবীই ধ্বংসযজ্ঞের শেষে সৃষ্টির ধারা অব্যাহত রাখতে এবং প্রধান দেবগণের সৃজনীশক্তির মূলপ্রবাহ রূপে হ্লাদিনী শক্তি হিসাবে আবির্ভূতা। দেবীর এই হ্লাদিনী রূপ হলো প্রেমদায়িনী রূপ। এই বর্গে ‘মহামায়া’ বা ‘আদি পরাশক্তি’ যেসব রূপ ধারণ করেছেন তারা হলেন বৈকুণ্ঠবাসিনী নারায়ণের অর্ধাঙ্গিনী লক্ষ্নী, পিতামহ ব্রহ্মার সঙ্গিনী সরস্বতী, আর মহাদেব শিবের পার্শ্বচারিণী উমা, গৌরী, পার্বতী, সতী ইত্যাদি।
সেই সঙ্গে আরও অনেক নামে; কিন্তু এদেরকে যে নামেই ডাকা হোক না কেন, তারা আদতে একজনই। অন্যদিকে এই ধারাতেই শ্রীমতী রাধা নামে মহাদেবী পৃথিবীতে শ্রীকৃষ্ণের লীলাসঙ্গিনী বা লীলাবিলাসিনী-এক কথায় তিনি কৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তি, যিনি প্রেমঘন কৃষ্ণের প্রেমপরিণাম। তিনি মানুষ রূপে লীলাবাসনায় বৃন্দাবনে গোপীশ্রেষ্ঠা।
এ হলো গৌড়ীয় বৈষ্ণব শাস্ত্রের মীমাংসা। (দাস: ২০০৯: ১৪১-১৫৫) শ্রীগোপাল গোবিন্দ ভট্টাচার্য লিখেছেন, বৈষ্ণব দর্শন এই দেবী রূপী পরাশক্তিকে আহ্লাদিনী নামে অভিহিত করেছে এবং শাক্ত দর্শন একই পরাশক্তিকে জগন্মাতা আদ্যাশক্তিরূপে অভিহিত করেছে এবং শাক্ত দর্শন এই পরব্রহ্মের গুণময়ী শক্তিকে
মাতৃভাবে ভজনা করে। (ভট্টাচার্য: ২০১৩: ৯৫) বৈষ্ণব দর্শনের এই আহ্লাদিনী শক্তিই বৈষ্ণবগণের কাছে রাধা। রাধার আরও নাম আছে-রাধিকা, রাধে, মাধবী (যেহেতু তার সখা মাধব অর্থাৎ কৃষ্ণ), কেশবী (যেহেতু তার সখা কেশব অর্থাৎ কৃষ্ণ), রাসেশ্বরী (যেহেতু তিনি রাস উৎসবের ঈশ্বরী ও প্রধান নায়িকা), কিশোরী (কারণ অনেকে মনে করেন তিনি কৃষ্ণের সঙ্গে লীলাকালে কিশোরী ছিলেন), শ্যামা (যেহেতু তিনি শ্যাম অর্থাৎ কৃষ্ণের সহচরী) ইত্যাদি। এই ধারায় বৈষ্ণবদের মাঝে তাকে রাইকিশোরী অর্থাৎ কিশোরী রাধিকা (রাই রাধার আরেক নাম), রাইবিনোদিনী অর্থাৎ কিশোরী বিনোদিনী ইত্যাদি নামেও ডাকা হয়।
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে আমরা পাই যে, কৃষ্ণ নামে ধরাধামে বিষ্ণুর অবতার অবতরণ করলে বৈকুণ্ঠধামে তার সঙ্গিনী দেবী লক্ষ্নী গোকুলে রাধা নামে জন্মগ্রহণ করেন। আর বড়– চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনেও কিন্তু রাধা তাই। সনাতন ধর্ম বলে যে, এই দেব ও দেবী শক্তি আদিতে এক ও অভেদ শক্তি রূপে বিরাজিত ছিলেন। পরে তার দ্বিভাজন হয়েছে।
“সৃষ্টির পূর্বে ঈশ্বর আপনাকে দুই ভাগে বিভক্ত করে এক অংশে পুরুষ এবং অপরাংশে নারীমূর্তি পরিগ্রহ করলেন ও সঙ্গত হলেন।” (মনুসংহিতা: ১:৩২)
(সারদানন্দ: ২০১১:৭১-৭২)
‘দেবী ভাগবতে’ দেবী নিজেই তা পরিষ্কার করে ব্যক্ত করেছেন, “আমি ও ব্রহ্ম এক। উভয়ের মধ্যে ভেদ নেই। যিনি ব্রহ্ম তিনিই আমি। আমি যা তিনিও তা, এই ভেদ ভ্রমকল্পিত, বাস্তব নয়।” (অমৃতত্বানন্দ: ২০০৭: ৩৬)
তার মানে পরমশক্তির নারী অংশ বা ‘প্রকৃতি’ এক অর্থে সামগ্রিক শক্তিরই প্রকাশক এবং এই জায়গায় বৈষ্ণব, শাক্ত ও তান্ত্রিকদের মধ্যেকার চিন্তায় সমতা রয়েছে।
শশীভ‚ষণ দাশগুপ্ত পুরো বিষয়টিকে বৈষ্ণব শাস্ত্র থেকে সার আকারে লিখেছেন যে, শ্রীরাধা ভগবানের এই হ্লাদিনী শক্তির বিকাশ-সুতরাং তিনি মূলপ্রকৃতি, ঈশ্বরী এবং শ্রীকৃষ্ণের অর্ধাংশস্বরূপা। ভগবান একাধারে ভোক্তা ও ভোগ্য, কিন্তু ‘তস্মাৎ একাকী ন রমতে’-তিনি একাকী রমণ করেন না-সেজন্য ‘দুই’ হওয়ার ইচ্ছা করে আপনাকে দ্বিধাবিভক্ত করে ‘লীলারস’ আস্বাদন করেছেন, যা তার নিজেরই অন্তর্নিহিত প্রেম রসের আস্বাদন। নিত্য বৃন্দাবনে আদতে শ্রীকৃষ্ণ অনন্তকাল ধরে নিজেই নিজেকে আস্বাদন করে যাচ্ছেন। (দাশগুপ্ত: বাংলা ১৩৯৬ সংস্করণ: ৫৯-৬০)
আর গৌরী সেন শ্রীরাধাকে বৈষ্ণব আচার্যরা কীভাবে দেখেন তার সার বর্ণনা করেছেন নিম্নোক্তভাবে,
[...] ঈশ্বর ও ভক্তের সম্পর্ক হবে রাধা-কৃষ্ণের সম্পর্কের মতো। এই সম্পর্কের স্বরূপ বিশ্লেষণ করে বলা যায় যে, রাধা সর্বশক্তির আধার কৃষ্ণের হ্লাদিনী বা আনন্দদায়িনী শক্তি। শক্তি ও শক্তিধর অভিন্ন, রাধা ও কৃষ্ণ তাই অভিন্ন। কিন্তু দুই ভিন্নরূপ গ্রহণ না করলে ঈশ্বরের লীলা প্রকট হয় না।
সেই জন্য রাধা-কৃষ্ণের ভক্ত-ভগবানের পৃথক অস্তিত্ব অনুভব করা প্রয়োজন। সুতরাং পরমাত্মার সঙ্গে জীবাত্মার ভেদ ও অভেদ দুই-ই আছে। এর প্রয়োজন এবং ভেদ ও অভেদ কল্পনা অচিন্ত্য বা অজ্ঞাত। গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের এই হলো দার্শনিক ভিত্তি অচিন্ত্য ভেদাভেদ নামে যা পরিচিত। ( সেন: ১৯৮৪: ১১)
উপরোক্ত বয়ান থেকে শ্রীচৈতন্যদেব প্রবর্তিত ʻঅচিন্ত্য ভেদাভেদ তত্ত্বের’ সারও বোঝা গেল। স্বামী অমৃতানন্দ তার বই ‘শক্তি’তে দেবী তথা মাতৃশক্তিকে বুঝবার নিমিত্তে দেবী পুরাণ থেকে উদ্ধৃত করেছেন, তিনি ব্রহ্মাদি দেবগণের ভুক্তিমুক্তি প্রদায়িনী, তিনি তাদের মা। (দেবী পুরাণম: ২৯:২০) (অমৃতত্বানন্দ: ২০০৭: ১২)
যখন দেবগণ একত্রে মহাদেবী সন্দর্শনে গেলেন, তারা তাকে বিনীতভাবে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কে? ‘তিনি বললেন-আমি ব্রহ্মস্বরূপ। আমার থেকেই
প্রকৃতি-পুরুষাত্মক সৎরূপ ও অসৎরূপ জগৎ উৎপন্ন হয়েছে। আমি আনন্দ ও নিরানন্দরূপা। আমি বিজ্ঞান ও অবিজ্ঞানরূপা। অবশ্য জ্ঞাতব্য ব্রহ্ম এবং আমিই অব্রহ্ম। পঞ্চীকৃত ও অপঞ্চীকৃত মহাভূতও আমিই। এই সমগ্র দৃশ্যজগৎ আমিই। বেদ ও অবেদ আমি। বিদ্যা ও অবিদ্যাও আমি, অজা আর অনজাও (প্রকৃতি ও তার থেকে ভিন্ন) আমি, ঊর্ধ্ব, অধঃ, চারিদিকও আমিই’। (শ্রীশ্রীচণ্ডী: ২০১২ সংস্করণ: ৩৭-৩৮)
এই আলোচনা উপনিষদেও প্রবলভাবে আলোচিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পরম সত্তার দ্বিভাজন উপনিষদে যেভাবে এসেছে তার সারাংশকে কাব্যিকভাবে এভাবে এঁকেছেন,
যে ভাবে পরম-এক আনন্দে উৎসুক
আপনারে দুই করি লভিছেন সুখ,
দুয়ের মিলন-ঘাতে বিচিত্র বেদনা
নিত্য বর্ণ, গন্ধ, গীত করিছে রচনা। (বন্দ্যোপাধ্যায়: ২০০০: ২৭)
কিন্তু শাস্ত্রীয় ও ভাবগত উভয় বিচারেই এই বিভাজন একজন থেকে অপরজনকে বিযুক্ত করতে নয়, একে অপরকে আরও পরিপূর্ণ, আরও সামগ্রিক করতে করা হয়েছে। বৈষ্ণবদের বেশ কিছু প্রধান ধারার, সেই সঙ্গে শাক্ত ও তান্ত্রিকদের মতে এই সামগ্রিক রূপটিও নারী রূপিণী। শাক্ত ও তান্ত্রিকদের চোখে তিনি শ্যামা, কালী, দুর্গা, ভৈরবী, চণ্ডী। আর বৈষ্ণবকুলে তিনিই শ্রীমতী রাধিকা বা শ্রীমতী রাধারানী। তবে শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ বলছে, সৃষ্টির সেই মহালগ্নে পরমশক্তি নারীও নন, পুরুষও নন, নৈব স্ত্রী ন পুমানেব নৈব চায়ং নপুংসকঃ। (শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ, ৫:১০) অর্থাৎ তিনি স্ত্রী নন, পুরুষ নন, নপুংসকও নন। (অমৃত্বানন্দ: ২০০৭: ৩৬)
তার মানে বিভাজনের পরে তিনি হলেন নারী ও পুরুষ। তাহলে শাক্ত ও তান্ত্রিকদের কাছে তিনি জগদম্বা বা জগজ্জননী কেন, কেন তিনি দেবী রূপে অর্থাৎ নারীরূপে আরাধ্যা? উত্তর দ্বিমুখী। প্রকৃতিকে কল্পনা করা হয় নারী রূপে, কারণ তিনি সৃষ্টি করেন, উৎপাদন করেন, শুষ্কতম ভূমিতেও তিনি জীবনের প্রবাহ তৈরি করেন। এই জগৎকেও তিনি সৃষ্টি করেছেন তার মাতৃবৈশিষ্ট্য দিয়ে।
ফলে প্রকৃতি জননী, অর্থাৎ নারী। প্রশ্ন উঠতে পারে, সে ক্ষেত্রে সারা দুনিয়ায় কেন পরমশক্তিকে নারী রূপে ভজনা করা হচ্ছে না? আর ভারতেও সর্বত্র দেবীরা বঙ্গ বা উড়িষ্যার মতো প্রধান শক্তি রূপে বন্দিতা নন। সেসব অঞ্চলে রাম ও কৃষ্ণের সঙ্গে সঙ্গে বিনায়ক, অর্থাৎ গণপতি বা গণেশের পূজার চল বেশি।
অঞ্চলভেদে আরও অনেক দেবতারও পূজা হয়। যেমন-দক্ষিণ ভারতে ও শ্রীলংকায় কার্তিকের পূজা হয়, সেখানে তার নাম মুরুগান। উত্তরে বলতে হয়, এর কারণ সম্ভবত বঙ্গসহ ও ভারতের কোনো কোনো অঞ্চলে দীর্ঘ সময় ধরে মাতৃতান্ত্রিকতার প্রভাব। পুরুষতান্ত্রিকতা এই অঞ্চলগুলোতে তার প্রভাব বিস্তারের পরেও আজও গারো ও সাঁওতালদের মধ্যে মাতৃতান্ত্রিকতা টিকে আছে। ফলে এটি অনুমেয় যে, একদা এখানে মাতৃতান্ত্রিক সমাজ প্রবলভাবেই রাজত্ব করেছে।
ছয়
বর্তমানকালের প্রত্নতত্ত্ববিদ ও ঐতিহাসিকদের অনেকে বলছেন, দক্ষিণ এশিয়ার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত ৩,৩০০ খ্রিষ্টপূর্ব সাল থেকে ১,৩০০ খ্রিষ্টপূর্ব সাল পর্যন্ত টিকে থাকা হরপ্পা সভ্যতা মাতৃতান্ত্রিক ছিল। সেখানে শক্তির পূজা হতো এবং শক্তিকে নারী রূপেই আরাধনা করা হতো দেবীমাতা হিসেবে। জন মার্শাল ( John Marshall, 1876-1958) এই সিদ্ধান্তের উদ্গাতা। (Marshall ed. 1931: 48-78) ওই সভ্যতার বিভিন্ন আইকন (Icon), প্রতিমা বা বিগ্রহ (Idol) ইত্যাদি থেকে অনুমান করা হয়েছে যে এটির বৈশিষ্ট্য ছিল
মাতৃতান্ত্রিক, সেই সাথে সমাজ ছিল মেট্রিলোকাল (matrilocal), অর্থাৎ সমাজে যে হাইয়ারআর্কি (hierarchy) বিদ্যমান ছিল, সেখানে গুরুত্বপূর্ণ পদে নারীরা সমাসীন ছিলেন।৩ ফলে এখান থেকে প্রতীতি হয় যে, বঙ্গ বা উড়িষ্যায় একদা মাতৃতান্ত্রিকতার প্রবল জোয়ার থাকাটা অসম্ভব কিছু নয়। তারই রেশ ধরে এইসব অঞ্চলে দেবীদের আধিপত্য প্রবল। দেবীদের এই প্রাধান্য শুধু হরপ্পাতেই ছিল তা মানতে নারাজ দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়। বিভিন্ন পুরাতত্ত্ববিদের গবেষণা ও খনন কার্যের (excavation) উপর ভিত্তি করে তিনি লিখেছেন, মহেঞ্জো-দারো, হরপ্পা,
চানহু-দারো এবং সিন্ধু-প্রদেশ ও বেলুচিস্তানের নানা জায়গা থেকে এ-জাতীয় মূর্তি বহুল সংখ্যায় পাওয়া গিয়েছে। অঙ্গসৌষ্ঠব ও নির্মাণভঙ্গির দিক থেকে সিন্ধু-উপত্যকা ও বেলুচিস্তানে পাওয়া মূর্তিগুলোর মধ্যে কিছু কিছু পার্থক্য থাকলেও প্রত্নতত্ত্ববিদেরা এগুলোকে প্রাচীন শক্তি-সাধনার নির্দেশক মাতৃকা বা মহামাতৃকা বা বসুমাতা মূর্তি বলেই শনাক্ত করেছেন। (চট্টোপাধ্যায়: ২০১২ মুদ্রণ: ৬২)
তার মানে অনেক অঞ্চলে মাতৃশক্তির প্রভাব হারিয়ে গেলেও বঙ্গে ও ভারতের আরও কিছু অঞ্চলে তার রেশ অন্য অঞ্চলের চেয়ে বেশিদিন টিকে ছিল বলে অনুমিত হয়।
সাত
উপরে আমরা ধর্মতাত্ত্বিক ও নৃতাত্ত্বিক জায়গা থেকে রাধা, রাধাবাদ ও রাধাতত্ত্বের কিছু তত্ত্ব-তালাশ করলাম। এবার আমরা রাধার ঐতিহাসিক বাস্তবতা নিয়ে কিছু প্রাসঙ্গিক অনুমান হাজির করার চেষ্টা করব, যেখানে নৃতত্ত্ব আবারও আমাদের কাজে লাগবে। আর স্বাভাবিকভাবে তাতে রাধার দয়িত বা প্রেমিক কৃষ্ণের ঐতিহাসিকতা নিয়েও আমরা কিছু আলোচনায় প্রবৃত্ত হব।
আমরা জানি যে, শ্রীচৈতন্যদেব দাক্ষিণাত্য থেকে বৈষ্ণব শাস্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ পাঠ নিয়েছিলেন। এই দাক্ষিণাত্য ছিল প্রাচীন বৈষ্ণবদের একটি শাখা আলবারদের বাসস্থান। বৈষ্ণব ভজন-সঙ্গীত নিয়ে তাদের আবির্ভাবকাল খ্রিষ্টীয় পঞ্চম থেকে নবম শতাব্দীর মধ্যে বলে ঐতিহাসিকরা অনুমান করেন।
শশীভূষণ দাশগুপ্ত তাই জানিয়েছেন। (দাশগুপ্ত: বাংলা ১৩৯৬ সংস্করণ: ১২১) আর ক্ষুদিরাম দাস তাদের আবির্ভাব কাল দাক্ষিণাত্যে খ্রিষ্টীয় পঞ্চম-ষষ্ঠ শতাব্দীতে বলে উল্লেখ করেছেন। আলবারদের যে চার হাজার ভজন-সঙ্গীত রয়েছে তা ‘দিব্য-প্রবন্ধম’ নামে প্রসিদ্ধ। অশ্বঘোষের বুদ্ধ চরিতেও কৃষ্ণের গোপীদের সঙ্গে লীলার বিবরণ আছে। (দাস: ২০০৯: ১৫)
বলে রাখা ভালো যে, রাধা নাম ‘ভাগবত’ পুরাণে অনুপস্থিত। অনেকের মতে, রাধা গোপীগণের মধ্যে কৃষ্ণের বিশেষ প্রণয়িনী এবং প্রধানা গোপী হিসাবে জনপ্রিয় হয়েছেন মূলত জয়দেবের সংস্কৃত ভাষায় লিখিত ‘গীত-গোবিন্দের’ কল্যাণে। আলবারদের ভজন-সঙ্গীতেও রাধার নাম নেই। এখানে আমরা তামিল গানগুলোতে রাধার স্থলে যাকে পাই তার নাম ‘নাপ্পিন্নাই’, যা একটি ফুলের নাম। রাধা যেমন কৃষ্ণের নিকটাত্মীয়া, নাপ্পিন্নাইও তাই।
আর নাপ্পিন্নাইও রাধার মতন সৌন্দর্যের প্রতিমা। তিনিও রাধার মতোই লক্ষ্নীর অবতার এবং এক গোপী, আর রাধাও তো গোপীই ছিলেন। জে.এস.এম. হুপারের J.S.M. Hooper) Hymns of the Alvars থেকে কবি অন্ডালের একটি কবিতা নিম্নে উদ্ধৃত করলাম, যেখানে এই বক্তব্যগুলোর প্রতিফলন পাওয়া যাবে;
Daughter of Nandagopal’ who is like
A lusty elephant, who fleeth not
With shoulders strong: Nappinnai, thou with hair
Diffusing fragrance, open thou the door!
Come see how everywhere the cocks are crowing
And in the mathavi bower the Kuil sweet
Repeats its song.-Thou with a bell in hand,
Come, gaily open, with the lotus hands
And tinkling bangles fair, that we may sing
Thy cousin’s name! Ah, Elorembavay!
Thou who art strong to make them brave in fight,
Going before the three and thirty gods;
Awake from out thy sleep!Thou who art just,
Thou who art mighty, thou, O faultless one
O Lady Nappinnai, with tender breasts
Like unto little cups, with lips of red
And slender waist, Lakshmi, awake from sleep!
Proffer thy bridegroom fans and mirrors now,
And let us bathe! Ah, Elorembavay! (দাশগুপ্ত: বাংলা ১৩৯৬ সংস্করণ : ১২১-১২২)
গোকুলের মতোই সমাজে নারীরা অনেক স্বাধীনতা ভোগ করতেন। নারীরা নিজেদের বর নিজেরাই পছন্দ করতেন। ‘বৃষ-বশীকরণ’ উৎসবে বীর পুরুষেরা ক্ষিপ্ত বৃষকে স্বহস্তে বশ করতেন, তাদের মধ্যে যে কন্যা যাকে পছন্দ করতেন তাকে নিজের বিয়ের মাল্য দান করতেন। আর গোপবালা নাপ্পিন্নাইও তার প্রেমিককে একই কায়দায় বরণ করেছিলেন। (দাশগুপ্ত: বাংলা ১৩৯৬ সংস্করণ: ১২২-১২৩)
প্রশ্ন হলো নাপ্পিন্নাইয়ের নাম রাধা হলো কী করে? আমার মতে, বঙ্গাঞ্চলে বা উড়িষ্যায় নাপ্পিন্নাই নামটি শুনতে কিছুটা খটোমটো। তাই হয়তো তাকে ডাকা হতো কৃষ্ণের প্রধান আরাধ্যা রূপে। পরে সেখান থেকে আ উহ্য হয়ে গেছে, ধ-এর পরে উচ্চারণের সুবিধার্থে য-ফলা বাদ গেছে। কোনো এক ভাষার শব্দ অন্য ভাষায় অনুপ্রবেশ করলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্বরবর্ণ উহ্য হওয়া বিচিত্র নয়।
যেমন, ইব্রাহীম নামটি আফ্রিকায় তিউনিসিয়াসহ অনেক জায়গায় ‘ই’ বিয়োগে উচ্চারিত হয় ব্রাহীম। প্রাচীনকালের পারস্য সম্রাট আনুশিরভানকে ভারতবর্ষের অনেক অঞ্চলে ডাকা হয় নুশিরভান নামে। ভারতবর্ষের আগরওয়াল অনেক জায়গায় গারেওয়াল নামে পরিচিত; যেমন: ভারতীয় অভিনেত্রী সিমি গারেওয়াল ইত্যাদি। যিশুর এক নাম ‘ইমানুয়েল’ যার অর্থ ঈশ্বর আমাদের সঙ্গে। এই নাম আইবেরিয়ান উপদ্বীপে (Iberian Peninsula) অর্থাৎ স্পেন ও পর্তুগালে উচ্চারিত হয় ‘মানুয়েল’।
একইভাবেই কিন্তু আমরা কৃষ্ণের আহ্লাদিনী শক্তিকে বলছি হ্লাদিনী শক্তি। আর ওই একইভাবে কৃষ্ণের প্রধান দয়িতা ও আরাধিকা (যিনি স্বয়ং কৃষ্ণ কর্তৃক ভজিতা ও আরাধিতা) ‘আ’ বিয়োজনে হয়েছেন রাধিকা।
এ অবশ্য আমার অনুমান। রাধার নাম যে, ‘রা’ ও ‘ধা’ এই দুই ধাতুর সন্ধি (রা+ধা) থেকে এসেছে, যেখানে ‘রা’ মানে ভক্তের ভক্তি বা মুক্তিপ্রাপ্তি আর ‘ধা’ মানে হরির দিকে ধাবিত হওয়া ইত্যাকার ব্যাখ্যা দেওয়া হয়, (দাশগুপ্ত : বাংলা ১৩৯৬ সংস্করণ: ১১৪)। এগুলো আমার মতে পরবর্তীকালের করা কষ্টকল্পিত অনুমান এবং ভক্তিবিলাসীদের কর্ম। আমার সঙ্গে এই ব্যাপারে ক্ষুদিরাম দাসও একমত। (দাস: ২০০৯: ৫২) অন্যত্র শশীভ‚ষণ দাশগুপ্ত বলছেন যে, ‘রাধ্’ ধাতু পরিচরণ বা সেবন অর্থে গৃহীত।
আর আমরা মনে করি শ্রীরাধা শ্রীকৃষ্ণের দেহ-আত্মার সর্বশ্রেষ্ঠ সেবন। ‘রাধিত’ বা ‘আরাধিত’ বলতে বোঝায় পুষ্পের দ্বারা অলঙ্কৃত বা অভ্যর্চিত। সেই একই অর্থে কৃষ্ণ রাধারূপ পুষ্পের দ্বারা সর্বশ্রেষ্ঠ রূপে অভ্যর্চিত (দাশগুপ্ত: বাংলা ১৩৯৬ সংস্করণ: ১০৮-৯)। রাধা নামের এই ব্যাখ্যাও বলা চলে স্বপ্নবিলাসীদের অতিবুদ্ধির ফল, এটিও কষ্ট করে ধর্মীয় সাযুজ্য বজায় রেখে একটি নামকে অর্থপ্রদ করার চেষ্টা।
অন্যদিকে নাপ্পিন্নাইয়ের প্রেমিকের (পরে স্বামী) নাম ওই তামিল অঞ্চলে ছিল ‘মাল’ (Pattanaik: 2007: https://devdutt.com/articles/a-milkmaid-called-radha/) বা ‘মায়োন’ বা ‘মায়বন’ (ভাদুড়ী: বাংলা ১৪২২ সংস্করণ: ৪৬), যে নাম ও সেই সাথে নাপ্পিন্নাইয়ের নাম খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দীর তামিল মহাকাব্য শিলপ্পড়িকারমে (Shilapadikaram) বিবৃত আছে। (Pattanaik: 2007: https://devdutt.com/articles/a-milkmaid-called-radha/)
আর এই মায়োন বা মায়বনও নাপ্পিন্নাইয়ের কাপড় আর গয়না চুরি করে নগ্না নাপ্পিন্নাইকে লজ্জিত করেছিলেন। (ভাদুড়ী: বাংলা ১৪২২ সংস্করণ: ৪৬)। এর সঙ্গে কৃষ্ণের গোপীদের বস্ত্রহরণের কাহিনির সাদৃশ্য আছে। ফলে দাক্ষিণাত্য থেকেই রাধা-কৃষ্ণের প্রণয়লীলার কাহিনিটি এসেছে এ কথাটি হয়তো বলা অমূলক হবে না।
দেবদূত পাটনায়েক লিখেছেন, In the 5th century, the Tamil epic, Shilapadikaram, refers to one Nal-Pinnai who was the beloved of Mal (the local name for Krishna). Scholars believe that she represents an early form of Radha. This idea of a favorite milkmaid gradually spread to the North and reached its climax with the composition of the Gita Govinda, a Sanskrit song written by Jayadeva in the 12th century AD where the passion of the cowherd god and his milkmaid beloved was celebrated in a language and style that took all of India by storm. (Pattanaik: 2007: https://devdutt.com/articles/a-milkmaid-called-radha/)
আর ক্ষুদিরাম দাস লিখেছেন, বৈষ্ণবশাস্ত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ যে ‘ভাগবত পুরাণ’ তার জন্মও দাক্ষিণাত্যেই। (দাস : ২০০৯: ১৫) ফলে দাক্ষিণাত্য থেকেই কৃষ্ণ ও গোপীগণের প্রেমলীলা ও প্রণয়োপাখ্যানের আমদানি হয়েছিল এই অনুমানের শক্ত ভিত্তি তৈরি হয় এবং সেখান থেকেই পরে উত্তরে এই প্রেমকাহিনি বিস্তৃতি লাভ করে বলে অনুমিত হয়। রাধা নামটি প্রাচীন সাহিত্যে প্রথম আমরা পাই খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকের প্রতিষ্ঠানপুরের রাজা হাল সাতবাহনের
‘গাহা-সত্তসঈতে’ (দাশগুপ্ত : বাংলা ১৩৯৬ সংস্করণ: ১২৩)। এই গাহা-সত্তসঈকে সংস্কৃতে ডাকা হয় ‘গাথা সপ্তশতী’ নামে। যদিও Peter Khoroche ও Herman Tieken-এর ইংরেজি অনুবাদ Poems on Life and Love in Ancient India: Hāla’s Sattasaī (Khoroche, Tieken.2009ed.)-তে আমি রাধা নাম খুঁেজ পাইনি।
আট
শশীভূষণ দাশগুপ্ত প্রাচীন আভীর জাতির মধ্যে রাখাল-কৃষ্ণের প্রণয়োপাখ্যান যে চালু ছিল বলেছেন, (দাশগুপ্ত: বাংলা ১৩৯৬ সংস্করণ: ১২৯) আমার মনে হয় তার আদি উৎসও দাক্ষিণাত্য। কারণ আভীর জাতির বাসস্থানও ছিল দক্ষিণ ভারতে। (ভট্টাচার্য: ২০১৫ সংস্করণ: ২৯৪), এই আভীররা শূদ্র ছিলেন বলে আর পি চন্দের বরাতে নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী লিখেছেন। (ভাদুড়ী: বাংলা ১৪২২ সংস্করণ: ৪৩) আর অন্ধক-বৃষ্ণিকুল অর্থাৎ যে কুলে কৃষ্ণ জন্মেছিলেন বলে অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, এরা ছিলেন যাদবদের অধস্তন।
ফলে আভীরদের সঙ্গে তাদের যোগসূত্র থাকা স্বাভাবিক। আমার মনে হয় একদা এরা আভীরদের মতোই শূদ্রগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। আমার প্রতীতি এই যে, দাক্ষিণাত্যের মাল বা মায়োন বা মায়বন তামিল অঞ্চলের হওয়াতে তিনি ছিলেন অশ্বেতকায় ও দ্রাবিড়। তিনি তার নানা সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণে তার অঞ্চলে প্রভূত খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা লাভ করেন।
গোপ সমাজে জন্ম বলে তিনি ছিলেন প্রান্তিক সমাজের প্রতিনিধি। পরে তার উপর দেবত্ব আরোপ করা হয়েছে। যেমন, হয়তো কালীয় নাগ ছিল নেহায়েত একটি বড় সাপ, যেটিকে তিনি হত্যা করেন। পরে মানুষের মুখে মুখে তা হয়ে উঠেছে এক সর্প-দানব। তিনি দ্রাবিড় ও অশ্বেতকায় হওয়ার পরেও আর্যদের উপর তার প্রাধান্য বিস্তার করতে পেরেছিলেন তার বুদ্ধি, স্বজাতি প্রেম ও নেতৃত্বের গুণে। তিনি গোকুলে নিম্নবর্গের মানুষের ত্রাতা ছিলেন। অত্যাচারী রাজা কংস, চেদীরাজ শিশুপাল ও ভীমের সহায়তায় (যদি বৃন্দাবনের রাধার কৃষ্ণ ও মহাভারতের কৃষ্ণ একজনই হন) কংসের শ্বশুর জরাসন্ধকে তিনি বধ করেন।
গৌরী সেন লিখেছেন যে, দেবকীর পুত্র কৃষ্ণের প্রথম হদিস পাওয়া যায় ছান্দোগ্য উপনিষদে, যেখানে তিনি ঋষি আঙ্গিরসের শিষ্য এবং আঙ্গিরস কৃষ্ণের সঙ্গে যেসব আলোচনা করেছেন তার সঙ্গে গীতায় বর্ণিত অর্জুনকে প্রদত্ত কৃষ্ণের উপদেশের মিল দেখা যায়। তাই অনুমান করা যায় যে, ছান্দোগ্য উপনিষদের এবং গীতায় বর্ণিত কৃষ্ণ অভিন্ন। (সেন: ১৯৮৪: ৩) দেবকীপুত্র কৃষ্ণের অস্তিত্ব যে ছান্দোগ্য উপনিষদে আছে তা গৌরী ভট্টাচার্যও লিখেছেন।
(ভট্টাচার্য: ১৯৮৯: ৪) কিন্তু বৃন্দাবনের রাধার কৃষ্ণ ও মহাভারতের কৃষ্ণ যে একজনই, তা প্রমাণ করা দুরূহ। সেই সঙ্গে এও প্রমাণ করা দুরূহ, কবে প্রথম কৃষ্ণ বিষ্ণুর অবতার হয়ে উঠলেন। কেউ কেউ মনে করেন, বৃষ্ণি, অন্ধক ও অন্য জাতিরা মিলে একটি সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠিত করেন এবং কৃষ্ণ ছিলেন তাদের প্রধান। (ভট্টাচার্য: ২০১৫ সংস্করণ: ২৮২) কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রেও বৃষ্ণিসঙ্ঘের কথা আছে।
কংস ছিলেন সেখানে সঙ্ঘমুখ্য। (ভাদুড়ী, নৃসিংহপ্রসাদ. বাংলা ১৪২২ সংস্করণ: ৬১) এই সঙ্ঘেরই কোনো এক সময় কর্ণধার ছিলেন সম্ভবত বাসুদেব-কৃষ্ণ। দ্বারকাতে তিনি গণপ্রতিনিধিত্বশীল এক শাসন ব্যবস্থা কায়েম করেছিলেন বলে অনেকে বলেন, তা আধুনিক গণতন্ত্রের বিচারে পূর্ণাঙ্গ গণতন্ত্র না হলেও বিভিন্ন কৌমের প্রতিনিধিত্ব সেখানে ছিল।
তার ব্যাপক জনপ্রিয়তা ও নেতৃত্বের কারণে তার উপর পরে দেবত্ব আরোপ করা সহজ হয়েছে। তিনি অশ্বেতকায় হওয়ার পরেও তার গাত্রবর্ণ নিয়ে কেউ কথা বলেনি। আমরা মহাভারত, ভাগবত পুরাণ কিংবা হরিবংশে তার কোনো প্রমাণ দেখি না। এর কারণ দুটি হতে পারে। প্রথমত মহাভারতের কৃষ্ণ ও ভাগবত পুরাণের গোপীগণের নাগর কৃষ্ণ একজন নন। গোপীগণের নাগর কৃষ্ণের নামও হয়তো কৃষ্ণ ছিল না। যেমন-কোনো
পিতা-মাতা তাদের পুত্রদের নাম দুর্যোধন, দুঃশাসন ইত্যাদি রাখবেন না যেমনটি আমরা মহাভারতে দেখতে পাই, তেমনি কোনো পিতা-মাতার তাদের পুত্রের নাম কালো বা কৃষ্ণ রাখার কথা নয়, তার গাত্রবর্ণ কালো হলেও। এখন অনেকে তা রাখেন কারণ ভগবান হিসাবে কৃষ্ণ এখন স্বীকৃত পুরুষ। ৎ
তার মানে তার নাম অনেকের কাছে বিস্মৃত হওয়ার কারণে তাকে পরে তার গাত্রবর্ণ দিয়ে হয়তো শনাক্ত করার প্রচলন শুরু হয়। পরবর্তীতে তার প্রবল প্রভাবের কারণে মহাভারতের কৃষ্ণ তার সঙ্গে মিশে যায়। অথবা দ্বিতীয়ত তিনি অশ্বেতকায় হওয়া সত্ত্বেও তার প্রবল ব্যক্তিত্বের কারণে কেউ তার গাত্রবর্ণ নিয়ে প্রশ্ন তোলেননি। তবে আমার মতে প্রথম কারণটিই বেশি যুক্তিযুক্ত।
তার শত্রু তো কম ছিল না। তাদের কেউ না কেউ তো তার গাত্রবর্ণ ও তার আর্যত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলতোই, কারণ বেশিরভাগ ভারতীয় ও ইউরোপীয় আর্যরা শ্বেতকায় ছিল বলে আজও মনে করেন। আর হিন্দুদের অর্থাৎ সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে বাসুদেব-কৃষ্ণ আর্যশ্রেষ্ঠ। হয়তো মহাভারতের কৃষ্ণের আদিতে অন্য নাম ছিল।
আর তামিল অঞ্চলের ‘মাল’ বা ‘মায়োন’ বা ‘মায়বন’ বাংলা, উড়িষ্যাসহ আরও অন্যান্য অঞ্চলে কৃষ্ণ নামে সর্বত্র প্রতিষ্ঠিত হন। এই জায়গায় আরও যে কথাটা বলা আবশ্যক, আর তা হলো নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুড়ী অভিযোগ করেছেন, গোয়ালাদের ঘরে বড় হয়েও কৃষ্ণের উঠাবসা ছিল আর্য-নৃপতিদের সঙ্গে, বরং অনার্যদেরই তিনি হয়ে উঠলেন যম হয়ে।(ভাদুড়ী, নৃসিংহপ্রসাদ. বাংলা ১৪২২ সংস্করণ : ৪১) আমার মতে এই কৃষ্ণ হচ্ছে আর্য কৃষ্ণ, যার সঙ্গে তখনো দাক্ষিণাত্যের কৃষ্ণকে একাকার করা হয়নি।
অবশ্য কেউ যদি বলেন, বাসুদেব-কৃষ্ণ স্বয়ং ভগবান, তার গাত্রবর্ণ সাদাই কী আর কালোই কী? তবে তা নিয়ে আর কোনো তর্ক চলে না। আমরা চাচ্ছি ঐতিহাসিক কৃষ্ণকে আবিষ্কার করতে। এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠতে পারে- কৃষ্ণ যদি অশ্বেতকায় হন, তবে তার পিতা বসুদেব ও মা দেবকীর এবং সেই সঙ্গে তার মামা কংসকে নিয়ে রচিত কাহিনিটির জন্ম কীভাবে হলো?
এ বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উপস্থাপন করেছেন ড. হংসনারায়ণ ভট্টাচার্য, যেটির কথা নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ীও লিখেছেন বিভিন্ন সূত্রে। আমরা আভীর জাতির কথা বলেছি। কোনো কোনো ঐতিহাসিক মনে করেন যে, যাযাবর এই আভীর জাতি প্রথম ভারতবর্ষে অনুপ্রবেশ করে খ্রিষ্টীয় প্রথম শতাব্দীতে সিরিয়া কিংবা এশিয়া মাইনর থেকে। তারা তাদের সঙ্গে এনেছিল যিশু খ্রিষ্টের নাম।
খ্রিষ্ট পরে কৃষ্টতে ও আরও পরে কৃষ্ণতে রূপান্তরিত হয়ে হিন্দুদের কৃষ্ণের সঙ্গে মিশে যায়। (ভাদুড়ী, নৃসিংহপ্রসাদ. বাংলা ১৪২২ সংস্করণ: ২৭) এখান থেকেই আমার অনুমান যে, বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্টে বর্ণিত জুডিয়ার রাজা হেরোদ নিয়েছেন ভারতে কংসের রূপ, যে হেরোদও গণকদের মুখে ভবিষ্যদ্বাণী শুনে বেথেলহেম ও তার আশপাশের অঞ্চলের দুই বছর বা তার কম বয়সী সব ছেলেশিশু হত্যা শুরু করেন এই ভয়ে যে, তিনি জেনেছিলেন কোনো ইহুদি শিশু তার মৃত্যুর কারণ হবেন, যে কিনা হবেন ইহুদিদের ভবিষ্যৎ রাজা। (Matthew: 2:13-18, New Testament, King James Version. See: https://www.biblestudytools.com/matthew/passage/?q=matthew+2:13-18) কংসও ভবিষ্যদ্বাণী শুনেছিলেন যে, দেবকীর অষ্টম পুত্র তার মৃত্যুর কারণ হবেন।
কৃষ্ণের পিতা বসুদেব যেমন কৃষ্ণকে নিয়ে গোকুলে দিয়ে আসেন, আর নিউ টেস্টামেন্টে বর্ণিত জোসেফ ও মরিয়ম (মেরী) যিশুকে নিয়ে পালিয়ে মিশরে চলে যান। ফলে যোসেফ ও মরিয়ম হয়েছেন এখানে বসুদেব ও দেবকী। আরও একটি অদ্ভুত মিল পাওয়া যায় কৃষ্ণ ও যিশুর মধ্যে। কৃষ্ণ তার বাল্যবন্ধু ব্রাহ্মণ সুদামার (দক্ষিণ ভারতে তার নাম কুচেলা) পা নিজে ধুইয়ে দিয়েছিলেন বলে ভাগবত পুরাণে উল্লেখ আছে।
সত্বর যাইয়া বিপ্রে করি আলিঙ্গন।
হাতে ধরি আনে হরি করিয়া যতন /
রতন আসনে কৃষ্ণ বসায় ব্রাহ্মণে।
পুলকিত বিপ্রতনু কৃষ্ণের স্পর্শনে /
একচিত্তে কৃষ্ণরুপ করে দরশন।
যতনে পালঙ্কে প্রভু বসায় তখন /
আপনি শ্রীহরি করে তাহার সেবন।
আপন হস্তেতে ধোয় ব্রাহ্মণ-চরণ / (মজুমদার: ২০০৯ সংস্করণ: ৯৯০)
অন্যদিকে যিশুও তার শিষ্যদের পা ধুইয়ে দিয়েছিলেন। If I then, your Lord and Teacher, have washed your feet, you also ought to wash one another’s feet. For I have given you an example, that you should do as I have done to you. Most assuredly, I say to you, a servant is not greater than his master; nor is he who is sent greater than he who sent him. If you know these things, blessed are you if you do them.
(John 13:14–17; New King James Version)
যা হোক গোকুলের এই কৃষ্ণই হয়তো পরে তার প্রেমিকাদের ত্যাগ করেন তার কর্তব্য-কাজ সারতে। ফলে রাধার সঙ্গে তার বিচ্ছেদ ঘটে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন, বৃন্দাবনে সে আর আসেনি। এতদিন যেমন সে তার জন্ম-পরিচয় বিস্তৃত ছিল, এখন সে যেন তার বাল্য-কৈশোরের এই অধ্যায়টিও সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়েছে। (গঙ্গোপাধ্যায়: ২০০৮: ১৪৬)
এই বিচ্ছেদের কারণে সৃষ্ট দুঃখানুভ‚তি যা রাধাকে পীড়িত করেছে, তাই পরে বৈষ্ণব সাহিত্যের প্রধান উপজীব্য হয়ে ওঠে। বৈষ্ণব কবি ও সাধকরা সেসব নানা বর্ণিল রূপে প্রকাশ করেছেন তাদের সাহিত্যে।
অনেকে আমাকে প্রশ্ন করেন, রাধা-কৃষ্ণের এই প্রেম কাহিনির পুনরুদ্ঘাটনে আজকের দিনে কোনো প্রয়োজন আছে? আমি বলি আছে, অন্তত প্রতীকী অর্থে তো আছেই। সেটা কেমন? এখানে ধরা যাক ভারতবর্ষই স্বয়ং রাধা। আর তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকা ব্রাহ্মণ্যবাদ হচ্ছে আয়ান ঘোষ, রাধার স্বামী।
আয়ান ঘোষ যেমন নপুংসক, ব্রাহ্মণ্যবাদও নপুংসক, অপ্রয়োজনীয় ও সমাজের নিচের তলার ও বঞ্চিত মানুষের জন্য এক আপদ। তাকে ভারতের আর কোনো প্রয়োজন নেই। এবার এই বৃন্দাবনে এসেছে ভারতীর (তার রূপ সরস্বতী বা রাধা যা-ই হোক) নতুন প্রেমিক। সে কৃষ্ণরূপী ইসলাম, বিশেষত সুফি ইসলাম।
তার প্রেমে মুক্তি পেয়েছে সমাজের দুর্বল, বঞ্চিত, অসহায়, ব্রাত্যজন ও অচ্ছুত। তার কারণে জন্ম নিলো চৈতন্য, নিত্যানন্দ প্রমুখ। সংমিশ্রিত ইসলামে (Syncretic Islam) জন্ম নিলো কবীর, দাদূর, লালন, হাসন ইত্যাদি। আর প্রধান ইসলামী বর্গগুলোতে অবস্থান করেই ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়ল হাজী শরিয়তুল্লাহ, তিতুমীরসহ আরও বহু। ভারতে নানাভাবে বিকশিত হলো বঞ্চিত ও শোষিত মানুষের মুক্তির পথ।
রাধা কৃষ্ণের দয়িতা। তিনি শুধু কৃষ্ণের প্রধান প্রেমিকা নন, মানবী রূপেও তিনি সুসম্পন্না। কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামীর চৈতন্য চরিতামৃতে আমরা পাই, তিনি মানবী রূপেও
নৃত্য-গীতে পটীয়সী এবং কবিত্ব শক্তির অধিকারী। তিনি তার ক্রোধ, ভালোবাসা, বাম্যতা এবং অন্য সব আবেগ শতধারায় প্রকাশ করেছেন। (কবিরাজ গোস্বামী : গোবিন্দ লীলামৃত: ১৩: ৩০) কিন্ত শক্তিনাথ ঝার ভাষায়, গৌড়ীয় ধারায় রাধা হয়ে উঠলেন শুধুই কৃষ্ণের শক্তি মাত্র। (ঝা: ২০০৭: ৯) বেশিরভাগ ধারায় তা শুধুই হ্লাদিনী শক্তি।
কিন্তু রাধার প্রেম যা কৃষ্ণকে আহ্লাদিত করতো তা বৃন্দাবন নামক এক বনের বাতাবরণে তাকে কৃষ্ণের শুধু হ্লাদিনী শক্তি রূপে নয়, তার সামগ্রিক শক্তি রূপেই হয়তো গড়ে তুলেছিল। তাই পরে কালে কালে বৈষ্ণব, শাক্ত ও তান্ত্রিক ধারা রাধাকে করে তুলেছে দেবী মহামায়া বা আদ্যাশক্তির শক্তি, একই সঙ্গে জগতের প্রেমশক্তির ভরকেন্দ্র রূপে।
লেখক : গবেষক ও রাজনীতি বিশ্লেষক