
ইতিহাস সচেতনতার মধ্য দিয়ে শওকত আলী বাংলা সাহিত্যের অনন্য এক কথাকার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সমাজের খেটে খাওয়া তথাকথিত ছোট লোকদের নিয়ে কত বড় মাপের সাহিত্য রচনা করা যায়, তিনি সেটা প্রমাণ করেছেন। একই সঙ্গে মধ্যবিত্তের টানাপড়েন চিত্রিত করেছেন নিজের প্রাতস্বিক ধারায়। বিশ্বাসের সঙ্গে কখনও দ্বৈরথ রচনা করেননি। সাহিত্যের এই সততা নিয়েই লেখা তাঁর গল্প, উপন্যাস।
এক.
পিঙ্গল আকাশ থেকে মাদারডাঙ্গার কথা (২০১১) তার শুরু এবং সম্ভবত শেষ রচনা। পিঙ্গল আকাশ-এর মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর অস্তিত্ব ও পথরেখা জানান দিয়েছিলেন। সবাই বুঝেছিল সাহিত্যের এ বন্ধুর পথে তিনি সিন্ধু তীরে বালু নিয়ে খেলতে আসেননি। এ উপন্যাসে মঞ্জুর আত্মহননে ফুটে ওঠে ক্ষয়িষ্ণু ও মূল্যবোধহীন বিকৃত একটি নগরসংস্কৃতি বিকাশের চিত্র। এ প্রসঙ্গে মনে রাখা ভালো, শওকত আলীর উপন্যাসের সব চরিত্রই কম-বেশি আত্মোন্নয়নকামী।
এর পেছনে যে লেখকের ব্যক্তিজীবনের সংগ্রাম-সংকটের ছায়াপাত ঘটেছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশের ষাটের দশকের গল্প-উপন্যাসে গ্রাম ও শহরকেন্দ্রিক নাগরিক জীবনের যে আশা-আকাঙ্খা-স্বপ্ন ও সংগ্রাম কিংবা সামষ্টিক জীবনে সামাজিক-রাজনৈতিক যে প্রভাব পড়েছে, তা উপন্যাসে তুলে ধরার ক্ষেত্রে শওকত আলীর দক্ষতা অসামান্য। একই সময় তিনি উপন্যাস-গল্প রচনার একটি স্বাতন্ত্র্য ভাষা গড়ে তুলেছেন সফলভাবে; যে ভাষা সহজেই সাধারণ পাঠককে আকর্ষণ করে।
‘কিষানের একটা জীবনই কি কম, কহ?...কিষানের জীবনে কত কথা থাকে’ এবং ‘একটি-দুটি করে লোক দেখা গেল একসময় বড় সড়কের ওপর। কৌতূহল না সমবেদনার কারণে তারা একে একে এসে পৌঁছাচ্ছিল বোঝা মুশকিল। তবে লোকগুলো ঈষৎ আন্দোলিত হচ্ছিল। আন্দোলিত হচ্ছিল তার প্রমাণ তারা ক্রমেই কাছাকাছি জড়ো হচ্ছিল এবং জড়ো হয়ে কাছে এগিয়ে আসছিল’- (গল্প : ‘নয়নতারা কোথায় রে’)।
মেহনতি ক্ষেতের মজুর-কিষান জীবনের অন্তর্গত ভাষা চিত্রের মধ্য দিয়ে বর্ণনা করা হয়েছে। কিষান জীবনের কথকতা, তাদের আগমন, আন্দোলন-সংগ্রামকে ঐক্যবদ্ধ করার যে প্রাণান্তকর চেষ্টা এটাই শওকত আলীর গল্পের বিষয়। তার গল্প হাড় খুলির বৃত্তান্তে আমরা যে রাজাকারকে দেখি, বিত্তবেসাতির জোর তার যুদ্ধাপরাধী পরিচয় ভুলিয়ে দিয়েছে। সে তার দখল করা জমি খুঁড়তে খুঁড়তে একসময় দেখা পায় অজস্র হাড় খুলি বেরিয়ে আসছে। এই বেরিয়ে আসা আর শেষ হয় না। মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে লেখা এ গল্পের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সমাজবাস্তবতা উঠে এসেছে।
তবে তার গল্পে রাত, শীত, বৃষ্টি এবং কান্দরের বর্ণনা ঘুরে ফিরে আসে। ‘অন্ধকার চারদিকে থই থই করে। মনে হয় বাতাসে অন্ধকার পাক খাচ্ছে, ফুলছে আর চারদিকে কেমন ছড়িয়ে যাচ্ছে। উত্তর দেখো, দক্ষিণ দেখো, আসমানে তাকাও শুধু কালো। থেকে থেকে কালো মেঘের পিন্ডগুলো একদিক থেকে গড়িয়ে যাচ্ছে আরেক দিকে। ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটা এসে শরীর কাঁপিয়ে দিচ্ছে’ (‘আর মা কান্দে না’)। এপিক ধর্মী রচনায় সিদ্ধহস্ত শওকত আলীর বর্ণনার মধ্য দিয়ে প্রকৃতি, সমাজ বাস্তবতাকে অবলোকন করা যায়।
আরেকটি গল্পেও এই বর্ণনা রীতির প্রভাব লক্ষ করা যায়। ‘খোলা কান্দরে হাওয়ার ঝাপটা ভীষণ আছাড় খাচ্ছে। উত্তর থেকে বাতাস শব্দ করে ছুটে আসছে। দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে উথাল-পাতাল অন্ধকারটা দেখে নিল দুজনে। তারপর পা বাড়াল।
কিন্তু কোথায়? তখনই শুরু হলো বেদম বৃষ্টি। ‘নয়নতারা কোথায় রে’ গল্পেরও আকাশ-বাতাস-বৃষ্টির বর্ণনা এ রকমই : ‘আসমানের লীলা বোঝা ভার। এই বাতাস বন্ধ, গুমোট ভাব, যেন চেপে আসছে বুকের ওপর ভারী বোঝার মতো- তারপর এই আবার দেখ, দেখতে দেখতে কোন দিক থেকে বাতাস বইতে শুরু করে দিল, গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ফুটে উঠল বাতাসের গায়ে। শেষে মেঘ ডাক ছেড়ে বৃষ্টি ঢালতে শুরু করে দিল।’ (লেলিহানসাধ)। তার গল্পের বর্ণনায় কাব্যময়তা আছে, ভাঙাচোরা জীবনের মানুষের স্বপ্ন আছে, আছে শ্রেণি-শোষণের চিত্র ও শ্রেণিসংগ্রামের ইঙ্গিত।
দুই.
তিনি জন্মভূমি ত্যাগ করে বাংলাদেশে এসে প্রত্যক্ষ করেছেন পাকিস্তানের নব্য ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ-নির্যাতন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের পর আগে যারা সামন্ত ছিল, সেখানে নতুন সামন্ত এল। শ্রেণি চরিত্র রয়েই গেল। ফলে স্বপ্ন ভাঙার নতুন কষ্ট জমা হলো। এই স্বপ্নভঙ্গের বেদনা তার ট্রিলজিতে (দক্ষিণায়নের দিন, কুলায় কালগ্রোত, পূর্বরাত্রি পূর্বদিন) লিখেছেন তিনি। এখানে বাংলাদেশের যাত্রালগ্ন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা-উত্তর অস্থির রাজনৈতিক বাস্তবতা। সামরিক শাসনের অবরুদ্ধ কালের চিত্রসহ সচেতন নাগরিক শ্রেণির ভেতর-বাহির অসাধারণ দক্ষতায় অঙ্কন করেছেন।
প্রদোষে প্রাকৃতজন উপন্যাসটি শওকত আলীকে রাতারাতি খ্যাতির শীর্ষ পর্যায়ে পৌঁছে দেয়। এই উপন্যাসে তিনি বিশ শতকের প্রায় শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণের শিল্পভাষ্য রচনা করেছেন। লক্ষণ সেন ২৮ বছরের রাজত্বকালের শেষ বছরগুলোতে বার্ধক্যে এবং ক্ষমতা প্রয়োগে খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। শাসনকার্য পরিচালনা কষ্টসাধ্য হয়ে উঠেছিল। এই দুর্বলতার সুযোগে সাম্রাজ্যের ভেতরে ঐক্য ও সংহতিতে ফাটল ধরে এবং কিছু স্বাধীন শক্তির উত্থান ঘটে।
এ ছাড়া শক্তিমান ও ক্ষমতাধরদের অরাজকতা দেশময় ছড়িয়ে পড়ে। এ পরিস্থিতিতে তুরস্কের অভিযানকারী বখতিয়ার খিলজি অনায়াসেই বাংলা দখল করে নেন। এই বিশৃঙ্খল পটভূমিতে গ্রামবাংলা কীভাবে অস্থির হয়ে ওঠে, ক্ষমতাধরদের তাণ্ডব ও লুটপাটে কীভাবে মানুষ গ্রামছাড়া হয় এবং কিছু নর-নারী বিচিত্র সম্পর্কের টানাপোড়নে কীভাবে রক্তাক্ত হয়ে উঠেছিল, সেসবের নানামাত্রিক বুনন-বিন্যাসে গড়ে উঠেছে প্রদোষে প্রাকৃতজন উপন্যাসটি।
উল্লিখিত উপন্যাসের সবচেয়ে বড় শক্তি এর ভাষা; প্রতিটি পদে, পদবন্ধনে। সাধু ভাষার শব্দভান্ডার বিস্ময়কর নৈপুণ্যে তিনি ব্যবহার করেছেন চলিত ভাষার গড়ন-সৌষ্ঠবে। সম্ভবত ষোড়শ শতকের ভাষিক জগতের ধ্রুপদি আবহের স্বাদ পাইয়ে দেওয়ার জন্য তিনি এই অসাধারণ ভাষাপ্রপঞ্চ বেছে নিয়েছেন। কমলকুমার মজুমদারের ভাষা ব্যবহারের সঙ্গে আমাদের পরিচয় আছে, বাক্যগড়নের রীতির সঙ্গে পরিচয় আছে। সেখানে কাঠিন্য নির্ধারণই যেন কর্তব্য।
কিন্তু সে অন্য অভিধা। শওকত আলী ভাষার মধ্যে পুরে দিতে চেয়েছেন জীবনের প্রতি গভীর মমত্ববোধের আলো, আনন্দ আর অফুরন্ত প্রবাহ। পথ চলতে চলতে ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত শ্যামাঙ্গ সম্মুখে যে প্রহেলিকা দেখতে পায়, তার বর্ণনা দিতে গিয়ে শওকত আলী লিখেছেন: ‘সে বড় বিচিত্র অবস্থা। এখন স্মরণ হলে কৌতুক বোধ হয়। অবশ্য তখনো তার কৌতুক বোধ হচ্ছিল। কৌতুক বোধ হবারই কথা। কারণ প্রথমে তুমি দেখলে বংশবীথিকার বিনত শাখায় একটি বনকপোত।
পরক্ষণে সেই ক্ষুদ্রাকার পাখিটি হয়ে গেল একটি ঊর্ধ্বলম্ফী মর্কট মুহূর্তেক পরে সেই মর্কটও আর থাকল না, নিমেষে হয়ে গেল একটি বিশুদ্ধ বৃক্ষশাখা। চক্ষু কচালিত করলে অতঃপর তুমি আর কিছুই দেখলে না। বংশবীথিকা না, বনকপোত না, মর্কট না, বিশুদ্ধ শাখাও না।’
এই রচনার মধ্যে প্রায় প্রতিটি শব্দই তৎসম। কিন্তু কোথাও দুর্বোধ্যতার লেশ নেই। অধিকন্তু এমন একটি সহজতা বিরাজমান, যা পাঠকের বোধের জগৎ তৃপ্ত করে। নগরকেন্দ্রিক মধ্যবিত্ত সমাজ মূলত তাঁর উপন্যাসে ঘুরেফিরে এসেছে। একই সময় তার রচনায় সমকালীন রাজনৈতিক বাস্তবতা, ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং মহান মুক্তিযুদ্ধও স্থান করে নিয়েছে।
তিন.
শওকত আলীর রচিত উপন্যাসের তালিকা দীর্ঘ না হলেও একেবারে সংক্ষিপ্ত নয়। জীবনভর সাহিত্যসেবায় নিয়োজিত থেকে গুণী এই কথাশিল্পী বাংলা একাডেমি, একুশে পদকসহ বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। বামঘেঁষা রাজনৈতিক চেতনা দ্বারা উত্তাল যৌবনে প্রভাবিত হলেও তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাস ও ধারণা স্বচ্ছ।
শওকত আলীর জন্ম পশ্চিমবঙ্গের দিনাজপুর জেলায়। ১৯৪৭ সালের দেশভাগ তাঁর অন্তর-বাহির কুরে কুরে খায়। নিজ ভূমি হারানোর বেদনা থেকে তিনি আর মুক্ত হননি। বাড়ির পাশে মেলা হতো, কীর্তন, যাত্রা, সার্কাস- মোদ্দাকথা তিনি সংস্কৃতিসমৃদ্ধ এলাকায় বড় হয়ে উঠেছিলেন। কাছ থেকে সেসব দেখেছেন।
তারপর একদিন সকালে শোনা গেল, এ দেশ আর তাদের নেই! সেই কষ্ট তিনি লালন করেছেন আমৃত্যু। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তিনি জানান দিয়ে গেছেন যে সমাজের তথাকথিত ছোটলোকেরাই সাহিত্যের প্রকৃত চরিত্র। যাদের জীবনে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম আছে। শ্রেণিসংগ্রামের সম্ভাবনা আছে। আর যারা সেই সংগ্রামের নেতৃত্ব দেবেন, তাদের জন্য তিনি জীবনের স্লেটে খড়িমাটি দিয়ে নাম লিখে গেছেন।
তথ্যঋণ:
শওকত আলীর গল্প উত্তরের চালচিত্র, সুশান্ত মজুমদার
শওকত আলীর উপন্যাসে জীবনবোধ, সুজন হালদার
ঔপন্যাসিক শওকত আলী প্রসঙ্গে, অনুপম হাসান