Logo
×

Follow Us

ফিচার

রাইড শেয়ারিংয়ের দিনকাল

Icon

দীপংকর গৌতম

প্রকাশ: ১৮ মে ২০২৫, ১৬:০০

রাইড শেয়ারিংয়ের দিনকাল

ট্যাক্সি সার্ভিসের রেন্ট কার ব্যবস্থা অনেক আগে থেকেই দেশে প্রচলিত। রেন্ট কারের সার্ভিসও যে এক ধরনের রাইড শেয়ারিংএটা নতুন করে বলার কিছু নেই। রাইড শেয়ারিংয়ের আগের কথা যদি বলি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন বিশ্বজুড়ে জ্বালানিসংকট প্রকট আকার ধারণ করে। এই সময় বিভিন্ন দেশে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে রাইড শেয়ারিং সেবা। অনেক দেশেই এটি কারপুলিং, কস্ট শেয়ারিং নামেও পরিচিত। জ্বালানি, সময়, অর্থ সাশ্রয়ের পাশাপাশি পরিবেশের ক্ষতি কম হওয়ায় দ্রুত বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা পায় মাধ্যমটি।

রাইড শেয়ারিংয়ের বেশ আগে ইউরোপ আমেরিকায় লিফট দেওয়ার একটা প্রথা চালু ছিল। তবে আক্ষরিক অর্থে যদি রাইড শেয়ারিং কোম্পানি সার্ভিসের কথা চিন্তা করি, সে ক্ষেত্রে রাইড শেয়ারিংয়ের যাত্রা শুরু হয় ২০০৯ সালে উবারের মাধ্যমে। আমেরিকান এই কোম্পানিটি বর্তমানে বিশ্বের ৭৮৫টির বেশি শহরে রাইড শেয়ারিং সার্ভিস প্রদান করে আসছে। বাংলাদেশে মধ্য আয়ের মানুষের চলাফেরার জন্য পাবলিক পরিবহনের সংকট মেটাতে সিএনজি ছাড়া গতি নেই। মিটার ছাড়া ইচ্ছামতো ভাড়া চাওয়া, নির্দিষ্ট গন্তব্যে যাওয়ার ব্যাপারে অনিহা ইত্যাদি কারণে যাত্রীরা ছিল মহাবিরক্ত। এসব বিষয়কে ধরেই যাত্রীকে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছে দিতে নির্ধারিত ভাড়ায় চলতে শুরু করেপাঠাও ২০১৫ সাল থেকে মোটরসাইকেল দিয়ে যাত্রা শুরু করে পাঠাও। যোগাযোগে যেন নতুনত্বের ছোঁয়া মিলল। এর পরে পাঠাওয়ের দেখাদেখি ওভাই, পিকমি, সহজ নামে বিভিন্ন রাইড শেয়ারিং কোম্পানি কাজ করতে শুরু করে। রাইড শেয়ারিং জনপ্রিয় হয়ে ওঠে বিভিন্ন শহরে।

শুরুটা হয়েছিল কিন্তু গাড়ির মালিকের পার্শ্বব্যবসা (সাইড বিজনেস) হিসেবে, অনেকটা ফ্রিল্যান্স কাজের মতো। কিন্তু রাইড শেয়ারিং অ্যাপ ছাড়াই চুক্তিতে চলা শুরু হয় করোনার সময় থেকে। সময় প্রচুর মানুষ চাকরি হারায়, বেকার মানুষের সংখ্যা বাড়ে ব্যাপক হারে। তারা বিকল্প কাজ হিসেবে রাইড শেয়ারিংয়ের কাজ নিয়ে নেয়। ফলে অ্যাপের বাইরে দরাদরি করার একটা সুযোগ এসে যায়। এতে দেখা যায় অ্যাপের নির্ধারিত টাকার থেকে অপেক্ষাকৃত কম টাকায় শুরু হয় রাইডের যাত্রা। ফলে এটা কোম্পানি ছাড়াই পরবর্তী সময়ে অনেকের পূর্ণকালীন কাজে পরিণত হয়েছে। ব্যবসা ভালো হওয়ায় অনেকে এখন নিজে রাইড না চালিয়ে চালক রেখে একাধিক গাড়ি রাস্তায় নামিয়ে এই পরিষেবা দিচ্ছেন।

রাইড শেয়ারিংয়ের উপকারিতা যাত্রীরা যেমন পাচ্ছেন, তেমনিভাবে প্রচুর তরুণ উদ্যোক্তার জন্যও উপার্জনের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। অনেক শিক্ষিত বেকার ব্যাংকঋণ নিয়ে মোটরসাইকেল বা গাড়ি কিনে এই রাইড শেয়ারিং কোম্পানিগুলোর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন এবং মাসে ভালো টাকা রোজগার করছেন। সরকার প্রথম দিকে কিছুটা দ্বিধায় থাকলেও পরে নীতিমালা তৈরি করে এই নতুন শিল্পকে উৎসাহিত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে।

তবে রাইড শেয়ারিংকে যে যানজটের প্রধান কারণগুলোর একটা বলা হয়, এটাও সত্য। রাস্তার চেয়ে যানবাহনের সংখ্যাধিক্য যানজটের একটি প্রধান কারণ। বাস, মেট্রোরেল ইত্যাদি অধিক যাত্রী বহনসম্পন্ন গণপরিবহন ছাড়া যানজট কমানো সম্ভব নয়। যেহেতু যানজট এড়িয়ে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্যই বেশির ভাগ যাত্রী এই পরিষেবাটি নেন, সেহেতু ভিড়ের মধ্যে পাশ কাটিয়ে, কখনো বা ফুটপাতের ওপর উঠে মোটরসাইকেলচালকরা যাত্রীকে খুব তাড়াতাড়ি নিয়ে যেতে চান। তাই অনেক সময়ই ট্রাফিক আইন ভাঙতে হয় এবং প্রায়ই দুর্ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়ান। বিষয়ে সচেতনতা থাকতে হবে।

মিজানের বয়স ২২-২৩ বছর। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। খিলক্ষেত ওভার ব্রিজের নিচে দাঁড়িয়ে যাত্রী ডাকছিলেন। তার সঙ্গে আসার সময় তার রাইড শেয়ারিংয়ের ইতিবৃত্ত শোনা গেল। চাকরিজীবী বাবা সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলে মা চেয়েছিলেন তাদের ফ্ল্যাট বিক্রি করে টাকা ব্যাংকে রেখে ভাড়া বাসায় উঠতে। ব্যাংকের সুদে চলত তাদের মা-ছেলের পরিবার মিজানের লেখাপড়া। মিজান মাকে কাজে নিষেধ করেন। মিজানের বাইক ছিল আগে থেকেই। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে ক্লাসের বাইরে তিনি বাইক চালান। তাতে তার পড়ার খরচ বাসার খরচ দুইই চলে। তবে বর্তমানে ইজি বাইক মূল সড়কে চলতে দেওয়ার কারণে বাইকের আয় কমেছে। তবুও রাইড শেয়ারিংয়ের জন্য তার মতো অজস্র ছাত্রের পড়াশোনা চলছে বলে মিজান জানান।

মিরপুর-১০-এর গোল চক্কর হলো বাইক রাইডিংয়ের রাজধানী। অজস্র রাইডার এখানে বসে থাকেন যাত্রীর আশায়। এখানে কথা হয় আমীর হোসেনের সঙ্গে। মিরপুরে একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে কাজ করতেন। করোনায় ব্যবসায় ধস নামলে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে যায়। দোকান বন্ধ হলে আমীর হোসেন বাইক নিয়ে রাইড শেয়ারিং শুরু করেন। শুরুতে ভাড়া ঠিকঠাক মতো বুঝতেন না। এখন তিনি দক্ষ বাইকার। দিনে -১০ ঘণ্টা বাইক চালান। যে আয় হয় তাতে খুব ভালো আছেন। তবে ঢাকার রাস্তা এত সরু আর যানজট না থাকলে আয় আরো বেশি হতো। তার অভিযোগ হলো, অযথা মাঝেমধ্যেই তাদের বিরুদ্ধে ২০০০ টাকার মামলা দেওয়া হয়। ছাড়া মূল সড়কে ইজি বাইক চলতে দেওয়ায় যানজট দুর্ঘটনা বাড়ছে, বাড়ছে তাদের আয়ও। করোনার পর থেকে বাইক চালিয়ে হাজার হাজার পরিবার আজ সচ্ছল। দেশের অর্থনীতির এটা একটা ইতিবাচক বিষয়।

কিন্তু বাইকচালকদের ওপর যথাযথ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি না থাকলে এই পেশায় টেকা কষ্টকর হয়ে যাবে।করোনায় পেশা হারিয়ে, কেউ বাবাকে হারিয়ে, কেউবা দ্রব্যমূল্য বাড়ায় হিমশিম খেয়ে রাইড শেয়ারিংয়ে এসেছে বাধ্য হয়ে।আমাদের সঙ্গে ব্যবহারটা ভালো না করলে মাঝেমধ্যে খুব কষ্ট হয়। আমরা যে লেখাপড়া শিখে-কাজ হারিয়ে এই কাজ করছি, এটা বেশির ভাগ লোক ভাবতেই চায় না।দুঃখের সঙ্গে কথাগুলো বলেন বাইকার মোখলেসুর রহমান। তিনি জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়ে পড়ে এনজিওতে ঢুকেছিলেন। এনজিওর এখন ফান্ড নেই। তাই রাইড শেয়ারিং করে সংসার চালান। রাইড শেয়ারিংয়ের ব্যবসাটি নতুন হলেও প্রসার বেড়েছে। বেকার সংকট নিরসনে এর যত্ন-আত্তি করা প্রয়োজন।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫