
চেঙ্গিস খানের আবক্ষ মূর্তি।
আজ থেকে ৮০০ বছর আগে, মঙ্গোলিয়ার বিশাল তৃণভূমি এক কিংবদন্তীর সাক্ষী হয়েছিল। সেই কিংবদন্তীর নাম- চেঙ্গিস খান। সম্রাট চেঙ্গিস খান গড়ে তুলেছিলেন এক সুবিশাল সাম্রাজ্য। জয় করেছিলেন এশিয়া এবং ইউরোপের বিস্তৃত অঞ্চল। কিন্তু এই অভূতপূর্ব বিজয়ের মাঝে একটি রহস্য আজও অমীমাংসিতই রয়ে গেছে। আর তা হলো চেঙ্গিস খানের সমাধি।
চেঙ্গিস খানের সমাধি কি পিরামিডের মতো সুবিশাল কোনো কাঠামো? নাকি দিগন্ত বিস্তৃত তৃণভূমির মাঝে সুনিপুণ টেরাকোটায় খচিত কোন কবর।
সত্যিটা হলো, এই খবর আজও কেউ জানে না। খুব সম্ভবত চেঙ্গিস খানও তাই চেয়েছিলেন।
মৃত্যুর পর রহস্যের জাল
তাংগুতদের বিরুদ্ধে লড়বার সময় মারা যান চেঙ্গিস খান। চেঙ্গিসের বয়স তখন ৬৭ বছর। আর সাল ১২২৭ খ্রীষ্টাব্দ। কিংবদন্তি আছে, সম্রাটের শেষ ইচ্ছা পূরণ করতেই নাকি সৈন্যরা গোপনে তার মৃতদেহ প্রাসাদে নিয়ে যায়। আর এ সময় পথে যারাই তার মৃতদেহ দেখে ফেলেছে, তাদেরই হত্যা করেছে সেনারা!
বিখ্যাত ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ জন মান তার “চেঙ্গিস খান: লাইফ, ডেথ অ্যান্ড রেজারেকশন” বইয়ে উল্লেখ করেছেন, সমাধিস্থ করার পর, হাজারটা ঘোড়া চেঙ্গিস খানের কবরের ওপর দিয়ে চালিয়ে নিয়ে সমাধির চিহ্ন মুছে ফেলা হয়। আর এভাবেই নাকি দুনিয়ার প্রায় অর্ধেক জয় করা মানুষটির চিহ্ন মাটির নিচে হারিয়ে গেছে।
প্রাচীন মঙ্গোল বিশ্বাস অনুযায়ী, সম্রাটদের কবর খোঁড়া ছিল চরম অপরাধ। অনেকের ধারণা, চেঙ্গিস খানের কবরে তাই কোনো চিহ্ন বা স্মৃতিস্তম্ভ রাখা হয়নি। কারণ মঙ্গোলরা বিশ্বাস করতো, চেঙ্গিস খানের আত্মা কেবল তখনই রাজ্যকে রক্ষা করবে, যখন কেউ তাকে বিরক্ত করবে না।
অদৃশ্য সমাধির সন্ধানে
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই সমাধি খুঁজে বেড়াচ্ছেন ইতিহাসবিদ, অভিযাত্রিক আর গবেষকরা। কিন্তু কেউ-ই আজও সফল হতে পারেননি।
ভেনিসিয়ান পর্যটক মার্কো পোলো একবার দাবি করেছিলেন, চেঙ্গিস খানের সমাধির খবর জানতো এমন ২০,০০০ মানুষকে নাকি হত্যা করা হয়েছিল। যদিও আধুনিক ঐতিহাসিকরা মার্কো পলোর এই দাবিকে স্রেফ ‘গল্প’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন।
২০১৪ সালে স্যাটেলাইট ইমেজ ব্যবহার করে একদল গবেষক সম্ভাব্য স্থান খুঁজে বের করার জোর চেষ্টা চালিয়েছিলেন। তবে তাতে সাফল্য ধরা দেয়নি। এমন কত গবেষক আজও খুঁজে চলেছেন, কিন্তু সেই সমাধি যেন ধরা দেওয়ার নয়।
মরি ক্র্যাভিজ নামে এক শৌখিন মার্কিন প্রত্নতত্ত্ববিদের মাথায় চেপে বসলো ভূত। চেঙ্গিস খানের সমাধি তাকে খুঁজে বের করতেই হবে!
৪ কিংবা ৫ বছর নয়, গুণে গুণে ৪০ বছর ধরে বুরখান খালদুন পর্বতের কাছে চষে বেড়ান তিনি। কিন্তু বার বার সাপের কামড় আর রহস্যময় দুর্ঘটনায় পড়ে ক্র্যাভিজের গবেষণা দল। অনেকেই মনে করেন এটি ছিল সমাধির অভিশাপ।
এমনও সময় গেছে, একদিকে মার্কিন বিজ্ঞানী আলবার্ট লিন ইউ-মিন আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে তন্ন তন্ন করে ফেলছেন মঙ্গোলিয়া। এতে তিনি সহায়তা নিচ্ছিলেন স্যাটেলাইট ছবি আর গ্রাউন্ড-পেনিট্রেটিং রাডারের। আর অন্যদিকে নিকলস নামে এক অনুসন্ধানকারী খুঁজে চলেছেন এক রহস্যময় স্থান। নাম তার "মাউন্টেন এক্স"।
নিকলস বলেছিলেন, “আমি জানি কিছু একটা তো আছেই ওই মাটির (মাউন্টেন এক্স) নিচে। আর ওটা স্বাভাবিক কিছু নয়।”সাত বছর ধরে গবেষণা চালিয়ে ওই স্থানটিকে তিনি চেঙ্গিস খানের সম্ভাব্য সমাধিস্থ জায়গা বলে ধরে নিয়েছিলেন।
তারা জানার চেষ্টা করছেন, চেঙ্গিস খানের মরদেহ প্রাসাদ থেকে ঠিক কোন পথে কবরস্থ করতে নিয়ে যাওয়া হয়।
কোন কোন ঐতিহাসিক মনে করেন, চেঙ্গিস খানের সমাধি আছে চীনের কোন অজানা স্থানে। কিন্তু লিন ইউ-মিন এর মতে চেঙ্গিস খান নিংজিয়ার লিউপান পর্বতে মারা যান। পরে তাকে মঙ্গোলিয়াতেই সমাধিস্থ করা হয়, চীনে নয়। যদিও নিংজিয়ান অঞ্চলটি বর্তমানে চীনে অবস্থিত।
মঙ্গোলিয়ানরা চায় না সমাধির খোঁজ!
কিন্তু মঙ্গোলিয়ার অনেকেই এই অনুসন্ধানের ঘোর বিরোধী। কারণ চেঙ্গিস খান শুধু মাত্র ইতিহাসের একটি চরিত্র নন, তিনি তাদের জাতীয় বীর এবং মঙ্গোলিয়ার বীরত্বের প্রতীক। পশ্চিমা বিশ্ব তাকে বিজেতা হিসেবে জানে। একজন বিজেতার শায়িত অবস্থার কোন চিহ্ন পৃথিবী জানুক এটি হয়ত তারা চায় না। চেঙ্গিস খানকে চিরকাল তারা এক অকুতোভয় পরাক্রমশালী বীর হিসেবেই মনে রাখতে চায়। তাই সমাধিস্থ চেঙ্গিসের চেয়ে সমাধিহীন চেঙ্গিস অনেক বেশি শক্তিশালী।
মঙ্গোলদের কাছে চেঙ্গিস খান শুধু মাত্র একজন রাজ্য বিজেতা নন। তিনি সেই ব্যক্তি যিনি বাণিজ্যের স্বার্থে সিল্ক রুট উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন, নিশ্চিত করেছিলেন ধর্মীয় স্বাধীনতা আর প্রচলন করেছিলেন কাগজের মুদ্রা। মঙ্গোলদের কাছে তিনি একজন সভ্যতা নির্মাণকারী। মঙ্গোলিয়ায় চালু আছে এমন কথা- “যদি তারা চাইতেন আমরা খুঁজে বের করি, তাহলে কোনো চিহ্ন রেখে যেতেন।" আর এটাই তাদের শেষ কথা।
কী আছে ওই আশ্চর্য সমাধির নিচে?
অনেকে মনে করেন, সমাধি যদি কখনো পাওয়াও যায়, তবে সেখানে থাকবে সম্রাটের আমলে জয় করা সম্পদ, গহনা, অস্ত্র, সোনা, রত্ন আর শিল্পকর্ম।
তবে প্রত্নতত্ত্ববিদদের ধারণা, চেঙ্গিস খানকে যদি সত্যিই কবর দেওয়া হয়ে থাকে তবে সেটা হয়ত মাটির ২০ মিটার নিচে চাপা পড়ে আছে। আর মুছে ফেলা হয়েছে কবরের চিহ্ন।
বিশাল মঙ্গোলিয়ার নির্জন তৃণভূমিতে এ ধরনের সমাধি খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ‘অভিশাপ’ আর ‘অশরীরী’ পাহারার গল্প। এগুলো যদি সত্যিই থেকে থাকে, তবে হয়ত এটাই চেঙ্গিস খানের ইচ্ছা। তিনি নিজেও হয়ত চাননি কেউ খুঁজে পাক তার সমাধি।
অমীমাংসিত রহস্য
আজও চেঙ্গিস খানের সমাধি ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এক অমীমাংসিত রহস্য হিসেবেই রয়ে গেছে। তৃণভূমির বাতাসে ভেসে বেড়ানো এই রহস্য, ইতিহাস আর কিংবদন্তির মাঝে মিলেমিশে গেছে।
মঙ্গোলদের কাছে সমাধি কেবল ইতিহাসের বিষয় নয়, আধ্যাতিকতারও বিষয়। অনেক প্রবীণ মঙ্গোল বিশ্বাস করেন, সমাধি কেউ খুঁজে পেলে, সম্রাটের আত্মা অশান্ত হয়ে উঠতে পারে। তাই অসংখ্য মঙ্গল মনে করেন, এই রহস্যের উন্মোচন না হওয়াই ভালো।
তবে ঐতিহাসিকরা অন্তত এ বিষয়ে একমত হয়েছেন যে, সমাধিস্থল পাহাড়ি অরণ্যের ভেতর এমনভাবে লুকানো হয়েছে, যেন প্রকৃতি নিজেই সেটিকে রক্ষা করে।
প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক বিজ্ঞানীরা আজ স্যাটেলাইট ইমেজিং, ম্যাগনেটোমিটার ও গ্রাউন্ড–পেনিট্রেটিং রাডার ব্যবহার করে অনুসন্ধান চালাচ্ছেন। তবে এখনো নিশ্চিত করে বলা যায়নি ঠিক কোথায় রয়েছে ইতিহাসের এই মহান সম্রাটের চিরনিদ্রার স্থান।
এই রহস্যের টানই যেন ইতিহাসপ্রেমী আর গবেষকদের বারবার মঙ্গোলিয়ার উঁচু পাহাড় আর বিস্তৃত তৃণভূমির দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কেউ বলছেন "মাউন্টেন এক্স" কেউ বলছেন বুরখান খালদুন। যেখানেই থাকুক, প্রকৃতি তার বুকে লুকিয়ে রেখেছে চেঙ্গিস খানের শেষ শয্যা।
মঙ্গোলরা এখনো মনে করে, যদি প্রকৃতি বা পূর্বপুরুষেরা চায়, তবে ঠিক ঠিক একদিন প্রকাশ পাবে চেঙ্গিস খানের নিখোঁজ সমাধি। আর সেদিন হয়ত নতুন করে লেখা হবে ইতিহাসের এক বিস্ময়কর অধ্যায়।