
আটলান্টিক মহাসাগরে কোনো এক উপকূল ঘেঁসে সাঁতরে বেড়াচ্ছেন, হঠাৎ লক্ষ্য করলেন আপনার পাশেই অগভীর পানিতে ভেসে আছে একদল ধূসর সবুজ প্রাণী। তাদের পাখনার মতো দেহে সূর্যের আলো এসে পড়তেই ঝিকমিক করে উঠছে শরীর—যেন একগুচ্ছ জলজ জোনাকি! এই সুনীল জগতে এক অপার বিস্ময় হয়ে বেঁচে থাকা ওই ছোট্ট প্রাণীগুলোই—এলিসিয়া ক্লোরোটিকা, অনেকে বাংলায় আদর করে ডাকে ‘সৌরশামুক’। কিন্তু নামেই শুধু শামুক, আদতে এ যেন প্রকৃতির এক অলৌকিক শিল্পকর্ম—সূর্যের আলোয় বাঁধা এদের জীবন।
সৌরশামুকের প্রধান খোরাক কিন্তু সূর্যের আলো! হ্যাঁ, ঠিকই পড়ছেন—এরা এমন জলজ প্রাণী, যারা গাছের মতো ফটোসিন্থেসিস করে বেঁচে থাকে! ফ্লোরিডার বুড়ো জেলেরা বলত— “ওইসব সোনাঝরা আলোর শামুকগুলো আসলে একেকটা জলজ নক্ষত্র।”
হয়তবা সেটা নিছক কল্পকথা, তবে বিজ্ঞানের চশমায় দেখলেও এই সৌরশামুক যে সাধারণ কোনো প্রাণী নয়, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
এদের জন্ম কিন্তু একদম সাধারণভাবে, ডিম থেকে ফোটে—যেমন অন্য সামুদ্রিক শামুকেরা। আমাদের সেই আলো-খাওয়া ছোট্ট ‘সৌরশামুক’—সেও কিন্তু ডিম পাড়ে। এরা হলো হার্মাফ্রোডাইট, মানে একই দেহে পুরুষ ও নারী উভয় প্রজনন অঙ্গ থাকে। এই শব্দটার মূল এসেছে গ্রিক পুরাণ থেকে। একবার দেবদূত হার্মিস আর প্রেমের দেবী অ্যাফ্রোদেইতির মিলনের ফলে জন্ম নেয় এক শিশু। যার নাম রাখা হয় হার্মাফ্রোডাইট। হার্মাফ্রোডাইটের দেহে দুই লিঙ্গেরই বৈশিষ্ট্য ছিল। সেই থেকে এসেছে শব্দটা। যার বাংলা মানে করণে দাঁড়ায় উভলিঙ্গ প্রাণী। মানে যাদের দেহে নারী ও পুরুষ—দু’ধরনের প্রজনন অঙ্গই থাকে।
কেমন অদ্ভুত, তাই না? এদের মধ্যে যখন দুটি শামুক মিলিত হয়, তখন তারা একে অপরকে উর্বর করতে পারে, এবং দুজনই ডিম পাড়ার ক্ষমতা রাখে। ডিমগুলো সাধারণত একধরনের স্পাইরাল বা সর্পিল আকৃতিতে থাকে, দেখতে অনেকটা সূক্ষ্ম ফিতা বা ঝিকিমিকি লেইসের মতো। এই ডিমগুলো থাকে এক রকম জেলির মতো আবরণে ঘেরা, যাতে সাগরের ক্ষারতা আর শিকারিদের হাত থেকে কিছুটা রক্ষা মেলে। ডিমগুলো জলজ গাছের ওপর কিংবা সমুদ্রের নিচের নরম জমিতে আটকানো থাকে।
আর সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, যখন এই ডিম থেকে ছোট ছোট সৌরশামুকের বাচ্চা জন্মায়, তখন তারা মায়ের মতো ফটোসিন্থেসিস করতে পারে না। শুরুতে শৈবাল খেতে শেখে, এসময় তারা অদ্ভুত কাণ্ড ঘটায়—ডুবে যায় সবুজ শৈবালের ভেতর, এবং তারপর সেই শৈবালের কোষ থেকে টেনে নেয় ক্লোরোপ্লাস্ট। এইসব ক্লোরোপ্লাস্ট তার নিজের শরীরে এমনভাবে বসিয়ে নেয় যে সে নিজেই একটা জীবন্ত সৌরকোষে পরিণত হয়। সূর্যের আলো পেলেই সে নিজের খাবার নিজেই বানিয়ে নেয়—গাছের মতো! অদ্ভুত না ব্যাপারটা?
এই বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করেছেন যারা, তাদের মধ্যে অন্যতম অধ্যাপক মেরি ই. রাম্পো। তিনি জানান, একটি ফটোসিন্থেসিস-সম্পর্কিত জিন সৌরশামুকের শরীরেই কাজ করে।
তবে সৌরশামুকের শরীরে থাকা বাইরের ক্লোরোপ্লাস্টগুলোকে কীভাবে সে সহ্য করে—এ প্রশ্ন এখনো এক রহস্য। সাধারণত প্রাণীদেহে বাইরের কোনো বস্তু ঢুকলে ইমিউন সিস্টেম তা আক্রমণ করে ধ্বংস করে দেয়। কিন্তু সৌরশামুক যেন এই নিয়মও ভেঙে দিয়েছে। বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, হয়তো কিছু নির্দিষ্ট ইমিউনোলজিক্যাল পরিবর্তন বা শৈবালের পাঠানো অণু-সংকেত তাকে এই সহনশীলতা দেয়। এছাড়া, ফটোসিন্থেসিস চলাকালীন উৎপন্ন ‘ফ্রি র্যাডিক্যাল’ নামের বিষাক্ত উপাদানগুলো থেকেও শরীরকে সে রক্ষা করতে পারে—যা অন্য প্রাণীদের পক্ষে সাধারণত সম্ভব নয়।
জিনগত গবেষণায় দেখা গেছে, এই শামুকটির ডিএনএতে প্রায় চব্বিশ হাজার প্রোটিন-কোডিং জিন রয়েছে। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, এই সংখ্যা অনেক বেশি এবং এর মানে হতে পারে— শামুকটি শৈবালের আরও কিছু জিন নিজের শরীরে স্থায়ীভাবে নিয়ে ফেলেছে। এই প্রাণীর জিনগত সংমিশ্রণ বা হরাইজন্টাল জিন ট্রান্সফার যদি ডিকোড করা যায়, তাহলে ভবিষ্যতে উদ্ভিদ-প্রাণীর সীমা পেরিয়ে নতুন জৈবপ্রযুক্তির দিগন্ত খুলে যেতে পারে বলে মনে করছেন গবেষকরা।
যদিও গবেষকরা এই শামুকের দৈহিক গঠনতন্ত্র নিয়ে বিস্মিত, বাস্তবে এর দেখা পাওয়া এখন কঠিন। উপকূল বদলে যাচ্ছে, বালুমাটি ক্ষয়ে যাচ্ছে, শৈবালের প্রাকৃতিক আবাসে হস্তক্ষেপ বাড়ছে। ফলে সৌরশামুকের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ছে।
একসময় উত্তর আমেরিকার জলাভূমি, বিশেষ করে ফ্লোরিডা ও মেরিল্যান্ড উপকূল এই প্রাণীর আদর্শ বাসস্থান ছিল। এখন নগরায়ন ও দূষণের কারণে স্বাভাবিক প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট হওয়ায় এ অঞ্চলগুলোতেও এদের দেখা পাওয়া কঠিন।
শুধু পরিবেশ নয়, গবেষণাতেও বাধা আসছে। অনেক প্রবীণ গবেষক অবসরে চলে গেছেন, নতুন প্রজন্ম এই দুর্লভ প্রাণীর দিকে আগ্রহ কম দেখাচ্ছে। ফলে গবেষণার ধারাবাহিকতা হারিয়ে যাচ্ছে। আর গবেষণাগারে এই শামুক পালন করা খুবই কঠিন—অল্প আয়ুষ্কাল, জটিল প্রজনন ব্যবস্থা ও খাদ্যের অভাব বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। সিডনি পিয়ার্স নামে এক গবেষক বলেন, “সৌরশামুক এত দ্রুত শৈবাল খায়—যে আমরা যতটা উৎপাদন করি, ততটা দিয়ে ওদের রাখা যায় না।”
গবেষকরা মনে করছেন, এর আবাসস্থল চিহ্নিত করে সংরক্ষণের উদ্যোগ নিতে হবে। স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণে করা যেতে পারে সিটিজেন সায়েন্স প্রকল্প, যাতে তারা সৌরশামুকের উপস্থিতি নথিভুক্ত করে। একই সঙ্গে জলের গুণমান পরীক্ষা, উপকূলের মানচিত্র তৈরি এবং বিজ্ঞানীদের নতুন প্রজন্মকে এই গবেষণায় আগ্রহী করে তোলা দরকার। কারণ যদি গবেষণা থেমে যায়, তাহলে সৌরশামুকের এই বিস্ময়কর কার্যক্ষমতার অনেক তথ্য হয়তো অজানাই থেকে যাবে মানুষের কাছে।
তথ্যসূত্র
* রাম্পো, মেরি ই. (২০০৮)। Elysia chlorotica-তে psbO জিনের প্রকাশ সংক্রান্ত গবেষণাপত্র।
* ক্রুগ, প্যাট্রিক (ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি, লস অ্যাঞ্জেলেস) – সাক্ষাৎকার, গবেষণাবিবরণ।
* পিয়ার্স, সিডনি – বহু দশক ধরে সৌরশামুক গবেষণায় নিয়োজিত গবেষকের মতামত।
* ‘সায়েন্স ম্যাগাজিন’ এবং ‘ন্যাচার রিভিউস মলিকিউলার সেল বায়োলজি’-র নির্বাচিত প্রতিবেদন ও বিশ্লেষণ।