
জর্জ মনকের হাতে আঁকা চিত্র
সামরিক ইতিহাসে ‘ফিল্ড মার্শাল’ শব্দটি শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক অনড় নেতৃত্ব, শৃঙ্খলা ও কৌশলের প্রতিচ্ছবি। বিশ্বজুড়ে এই পদটি সর্বোচ্চ সামরিক সম্মান হিসেবে বিবেচিত।
কিন্তু কখন, কোথায় এবং কে প্রথম এই পদটি লাভ করেছিলেন—এই প্রশ্নের উত্তর অনেকের কাছেই অজানা।
ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, পৃথিবীর প্রথম ফিল্ড মার্শাল হিসেবে যাঁর নাম স্বীকৃত, তিনি হলেন জর্জ মনক। সময়টা ছিল ১৭শ শতকের ইংল্যান্ড, আর পটভূমি ব্রিটিশ ইতিহাসের এক নাটকীয় অধ্যায়।
জর্জ মনক জন্মগ্রহণ করেন ১৬০৮ সালের ৬ ডিসেম্বর, ডেভনের মোতেহ্যাম গ্রামে। তিনি ছিলেন একটি মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা সামরিক প্রতিভা।
তরুণ বয়সেই তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং দ্রুতই নিজেকে একজন দক্ষ ও সাহসী সৈনিক হিসেবে প্রমাণ করতে সক্ষম হন। তাঁর সামরিক ক্যারিয়ার শুরু হয় ব্রিটিশ বাহিনীতে, পরে তিনি অংশ নেন নেদারল্যান্ডসের স্বাধীনতা যুদ্ধেও।
কিন্তু তাঁর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় শুরু হয় ইংল্যান্ডের গৃহযুদ্ধ চলাকালে।
এই গৃহযুদ্ধে রাজতন্ত্রবাদী (রয়্যালিস্ট) ও পার্লামেন্টারিয়ানদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। মনক শুরুতে রাজতন্ত্রের পক্ষে থাকলেও পরে ক্রমে পার্লামেন্টের অধীনে যান এবং ওলিভার ক্রমওয়েলের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন।
ক্রমওয়েলের মৃত্যুর পর যখন ইংল্যান্ড রাজনৈতিক অস্থিরতায় নিমজ্জিত, তখন জর্জ মনক ছিলেন একমাত্র স্থিতিশীল ও বিশ্বস্ত সামরিক নেতা। পার্লামেন্টারিয়ান পক্ষ ছেড়ে আবার যুক্তরাজ্যে পুনরায় রাজতন্ত্র ফিরে যায়।
ফিল্ড মার্শাল উপাধি এবং এর তাৎপর্য
১৬৬০ সালে ইংল্যান্ডে রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় এবং দ্বিতীয় চার্লস দ্বিতীয় সিংহাসনে বসেন। এই ঐতিহাসিক রিস্টোরেশনের নেতৃত্ব দেন জর্জ মনক। তাঁর অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ, দ্বিতীয় চার্লস তাঁকে ‘ফিল্ড মার্শাল’ উপাধিতে ভূষিত করেন এবং ডিউক অব অ্যালবেমার্লে পদমর্যাদা দেন।
ইতিহাসবিদদের মতে, এটিই আধুনিক অর্থে পৃথিবীর প্রথম ফিল্ড মার্শাল পদপ্রাপ্তির ঘটনা।
যদিও ইউরোপের অন্য কিছু দেশে ‘মার্শাল’ বা ‘ফেল্ডমার্শাল’ জাতীয় পদ আগে থেকেই প্রচলিত ছিল, তবে ব্রিটিশ সামরিক কাঠামোতে এই পদটি প্রতিষ্ঠিত হয় জর্জ মনকের মাধ্যমেই।
পরবর্তী সময়ে জার্মানি, রাশিয়া, অস্ট্রিয়া ও ফ্রান্স সহ নানা দেশে ফিল্ড মার্শাল উপাধি সামরিক নেতৃত্বের চূড়ান্ত স্বীকৃতি হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে।
মনক: কেবল সেনাপতি নয়, একজন রাষ্ট্রনায়কও
মনক শুধুমাত্র একজন সামরিক কমান্ডারই ছিলেন না, তিনি ছিলেন দূরদর্শী রাজনৈতিক কৌশলীও।
ব্রিটিশ ইতিহাসে তাঁর গুরুত্ব এতটাই বেশি যে, অনেকে তাঁকে “দ্য আর্কিটেক্ট অব রিস্টোরেশন” বলেও আখ্যা দেন।
তাঁর বিচক্ষণতা ও ভারসাম্যপূর্ণ নেতৃত্বের কারণেই ইংল্যান্ড রাজতন্ত্রে ফিরতে পেরেছিল।
তবে ইতিহাসের আয়নায় জর্জ মনক-এর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে সেই কারণে যে, তিনি কেবল একজন যোদ্ধা ছিলেন না, ছিলেন শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের পথপ্রদর্শকও। তাঁর নেতৃত্বে সামরিক ক্ষমতা রূপান্তরিত হয় রাজনৈতিক সমঝোতায়—এ এক অনন্য নজির।
উত্তরাধিকার ও প্রাসঙ্গিকতা
বর্তমানে বিশ্বে অনেক দেশেই ফিল্ড মার্শাল পদটি আছে, তবে এটি সাধারণত শুধুমাত্র বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রদান করা হয়।
গত মঙ্গলবার পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আসিম মুনির দ্বিতীয় পাকিস্তানি হিসেবে পদটি পেয়েছেন। এ ছাড়া ভারতের দুইজন সমরনেতা- স্যাম মানেকশ ও কে এম কারিয়াপ্পা এই পদে ভূষিত হয়েছেন।
বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত এ ধরনের পদে কেউ অধিষ্ঠিত হননি। সেনাপ্রধানরা জেনারেল পদে থাকেন।