
২০২০ সালে পোল্যান্ডে বজ্রপাতের সময় বিদ্যুতের ঝলক। ছবি: উইকিপিডিয়া
ঝুম বৃষ্টি মাথায় নিয়েই বাসা থেকে অফিসের উদ্দেশে বের হলাম। রিকশার নানা জায়গার ছিদ্র দিয়ে শরীর ভিজছে, এদিকে একটু পর পরই বজ্রপাতের শব্দে কেঁপে উঠছি। আর এটাই আমাকে মনে করিয়ে দিল পুরোনো এক স্মৃতি।
বছর কয়েক আগের কথা। কমলগঞ্জের শমসেরনগরের রিসোর্ট থেকে বের হতেই হালকা বৃষ্টি রূপ নিল মুষলধারেতে। আমরা দলেবলে বাচ্চা-কাচ্চাসহ ১৫-১৬ জন। দুটি নোয়া গাড়িতে চলেছি, গন্তব্য মাধবপুর চা বাগান। রাস্তার দু-পাশেও চা বাগান। একটু পর পরই বাজ পড়ছে। প্রচণ্ড বৃষ্টি আর বাজের শব্দে ছোটরা চিৎকার জুড়েছে ভয়ে। বড়দের চেহারা ফ্যাকাশে।
তারপরই ঘটল ঘটনাটা। আমরা ছিলাম পেছনের গাড়িতে। সামনের গাড়িটা রাস্তার পাশের একটা গাছকে অতিক্রম করে গেল। আমাদের গাড়িটি তখন গাছটি থেকে বড়জোর ফুট দশেক দূরে। এমন সময় চোখ ধাঁধানো আলোর খেলা। গোল একটা আলোর বৃত্ত আঘাত হানল গাছটির গায়ে। সেই সঙ্গে কান ফাটানো শব্দ। বল বজ্রপাত। এই প্রথম প্রকৃতির বিস্ময় আশ্চর্য এ বজ্রপাত সরাসরি চোখের সামনে দেখার সৌভাগ্য হলো। অবশ্য সময়ের একটু এদিক-সেদিক হলে এটা আমাদের জন্য বড় দুর্ভোগেরও কারণ হতে পারত।
মৌসুমি মৃত্যুদূত!
আকাশে বাজ পড়ছে—শব্দটা এখন শুধু প্রকৃতির নয়, পরিসংখ্যানেরও! প্রতি বছরই বাংলাদেশের আকাশে কোটি কোটি ভোল্টের বিদ্যুৎ চমকে ওঠে। সেই বিদ্যুৎ কেবল আলোর খেলা দেখাচ্ছে না, কেড়ে নিচ্ছে শত শত প্রাণ। বিজ্ঞান বলে, বজ্রপাত এক ধরনের বৈদ্যুতিক স্ফুলিঙ্গ। কিন্তু আমাদের জন্য এটি এক ধরণের ‘মৌসুমি মৃত্যুদূত’। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে বজ্রপাতে মৃত্যুর হার আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে।
বজ্রপাত হয় কীভাবে?
মেঘের ভেতরে বরফকণা, জলকণা এবং বায়ু প্রবাহের ঘর্ষণে তৈরি হয় বৈদ্যুতিক চার্জ। এক পর্যায়ে দুই ধরনের চার্জ একে-অপরকে আকর্ষণ করে—ফলাফল: প্রচণ্ড গতি ও উত্তাপসহ বজ্রপাত।
একেকটি বজ্রপাতের বিদ্যুৎ শক্তি এতটাই বেশি যে তা একটি গৃহস্থালির ১০০ ওয়াটের বাল্ব ৩ মাস জ্বালিয়ে রাখতে পারে!
আরও পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করা যাক
তাপ ও জলীয় বাষ্প উঠে যায়
গরম বাতাস আর জলীয় বাষ্প মাটির কাছ থেকে উঠে যায় আকাশে। এটা মূলত ঘটে গরম দিনে বা ঘন কালো মেঘ জমলে।
মেঘের ভেতর ঠাণ্ডা ও গরম বায়ুর সংঘর্ষ
উপরে ঠান্ডা বাতাস ও বরফের কণা থাকে, নিচে থাকে গরম বাতাস। এই দুইয়ের সংঘর্ষে মেঘের ভেতরে ছোট ছোট বরফকণা ও পানি একে অপরের সঙ্গে ঘষা খেতে থাকে।
ঘর্ষণে চার্জ তৈরি হয়
এই ঘষা-ঘষিতে মেঘের একদিকে (সাধারণত নিচের দিকে) ঋণাত্মক (–) চার্জ এবং ওপরের দিকে ধনাত্মক (+) চার্জ জমা হয়।চার্জ ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে
চার্জ যখন খুব বেশি জমে যায়, তখন সেটা ভারসাম্য রাখতে চায়। তখন হঠাৎ করে এক চার্জ থেকে আরেক চার্জে বিদ্যুৎ লাফিয়ে পড়ে—এটাই বজ্রপাত।
বজ্রপাতের সঙ্গে শব্দ হয় কেন?
বিদ্যুৎ খুব দ্রুত বাতাসের মধ্যে দিয়ে যায়, এতে বাতাস হঠাৎ গরম হয়ে বিস্ফোরণের মতো শব্দ করে। এটাকে বলে গর্জন বা বজ্রধ্বনি।
বছরের কোন সময় বজ্রপাত বেশি হয়?
বাংলাদেশে মার্চ থেকে মে এবং জুন-জুলাইতে বজ্রপাতের প্রবণতা থাকে সবচেয়ে বেশি। বিশেষ করে এপ্রিল-মে মাসে গরম ও জলীয় বাষ্পের আধিক্য বজ্রঘন মেঘ তৈরি করে। এসময় বিকেল বা সন্ধ্যায় আকাশে দেখা যায় ‘বিদ্যুৎরেখা’ আর শোনা যায় কান ফাটানো গর্জন।
বজ্রপাতপ্রবণ এলাকা কোথায়?
বাংলাদেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চল সবচেয়ে বেশি বজ্রপাতপ্রবণ। বিশেষ করে: ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা, সুনামগঞ্জ, সিলেট, কিশোরগঞ্জ ও জামালপুর এলাকা।
এই অঞ্চলগুলোতে খোলা মাঠ, ধানক্ষেত ও জলাভূমির আধিক্য বজ্রপাতের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। তা ছাড়া এসব অঞ্চলে গরু-ছাগল চড়ানো, কৃষিকাজ, নৌকাযোগে চলাচল বেশি হওয়ায় মানুষ বজ্রপাতের মুখোমুখি হন প্রায়ই।
বাল্টিক সাগরের আকাশে মেঘ থেকে মেঘে বজ্রপাত। ছবি: উইকিপিডিয়া
পরিসংখ্যানে বজ্রপাতে মৃত্যু
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত ১৪ বছরে বজ্রপাতে শুধু তিন হাজার ৮ শর বেশি মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ২০২৪ সালেই মারা গিয়েছে ২৭১ জন।
বেশিরভাগ মৃত্যু ঘটে কৃষক, রাখাল ও স্কুলফেরত শিশুদের মধ্যে।
নানা ধরনের বজ্রপাত
বজ্রপাত নানা ধরনের হয়। এমন কয়েকটির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব এখন।
সবচেয়ে পরিচিত বজ্রপাত হলো মেঘ থেকে মাটিতে বজ্রপাত। মেঘ থেকে সোজা মাটিতে আঘাত করে। মানুষ, গাছ, ঘরবাড়ি—সবকিছু এতে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
আবার মেঘ থেকে মেঘে বজ্রপাতও ঘটে। এতে একটি মেঘ থেকে আরেকটি মেঘে বিদ্যুৎ ছুটে যায়। এটি সাধারণত আকাশেই ঘটে, মাটিতে না নেমে।
কখনো একই মেঘের ভেতরেই বিদ্যুৎ খেলে যায়। আকাশে ঝলক দেখা যায়, কিন্তু মাটিতে আঘাত করে না।
মাটি থেকে মেঘে বজ্রপাত বিরল ধরনের। মাটি থেকে বিদ্যুৎ উঠে গিয়ে মেঘে গিয়ে লাগে। অনেক সময় উঁচু ভবন বা টাওয়ার থেকে শুরু হয়।
শুষ্ক বজ্রপাতের সময় বৃষ্টি হয় না, শুধু বিদ্যুৎ ঝলক দেখা যায়।
বল বজ্রপাত
এ ছাড়া শুরুতে যে বলেছিলাম সেই বল বজ্রপাত নামের একধরনের বিরল এবং রহস্যময় বজ্রপাত আছে। এটা সাধারণ বজ্রপাতের মতো নয়। দেখতে গোল বা আগুনের বলের মতো হয়, যেটা কয়েক সেকেন্ড থেকে কয়েক মিনিট পর্যন্ত বাতাসে ভেসে থাকতে পারে। আকার সাধারণত লেবুর মতো বা ফুটবলের মতো হয়।
এটা কোনো ঘরের ভেতর দিয়েও ঢুকে যেতে পারে, এমনকি দেয়াল ভেদ করেও!
অনেকে মনে করেন এটা চোখের ভুল, একে ভৌতিক বা অলৌকিক বলেও মনে করেন কেউ কেউ। তবে বিজ্ঞানীরা এটিকে প্রাকৃতিক বৈদ্যুতিক ঘটনা হিসেবে ব্যাখ্যা করেন।
বিশ্বে কোথায় বেশি বজ্রপাত হয়?
দক্ষিণ আমেরিকার লেক মারাকাইবো এলাকায় বছরে ৩০০ দিনের কাছাকাছি বজ্রপাত হওয়া এই হ্রদকে অনেকেই বিবেচনা করেন পৃথিবীর বজ্রপাতের রাজধানী বলে। ভারতের চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টির মতো বজ্রপাতও নিয়মিত ঘটনা। যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা পরিচিত ‘লাইটনিং ক্যাপিটাল অব ইউএসএ’।
বজ্রঝড়ের সময় গাছের নিচে দাঁড়ানো মোটেই নিরাপদ নয়। ছবি: পিক্সাবে
আর দক্ষিণ এশিয়ায় এখন বাংলাদেশ অন্যতম শীর্ষে!
কেন বাড়ছে বজ্রপাত ও মৃত্যু?
তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা বাড়লে বজ্রঘন মেঘ তৈরির সম্ভাবনা বাড়ে। উঁচু গাছের অভাবে বজ্রপাত সরাসরি মানুষের গায়ে পড়ছে। খোলা মাঠে কাজ করা কৃষক, জেলে ও রাখালেরা ঝুঁকির মুখে পড়েন বেশি। মোবাইল-ধাতব বস্তু ব্যবহারও বজ্রপাতের সময় বিপজ্জনক।
বজ্রঝড় ও বজ্রপাতের মৃত্যুর বিষয়ে, আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ বলেন, শুকনো আবহাওয়ার সময় ভূমি শুকনো থাকে। এ সময় দক্ষিণ দিক থেকে বেশ গতিতে গরম ও আর্দ্র বাতাস আসে। এটি ওপরে উঠে ঠান্ডা-শীতল বাতাসের সঙ্গে একসঙ্গে মিশে যায়, তখন তৈরি হয় ঘন কালো মেঘ-বজ্রসহ ঝড়।
তিনি বলেন, এখন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝড়-বৃষ্টির সময়গুলে পরিবর্তিত হচ্ছে। আগে যেমন এপ্রিলে কালবৈশাখি বেশি হতো এখন মে মাসে বেশি হচ্ছে। কখনো কখনো গোটা দেশজুড়েই এমন বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে, কখনো আবার পাঁচ-ছয়টি জেলা নিয়ে হয়। আর এ সময় মানুষ বিশেষ করে মাঠে যারা কাজ করেন তারা বজ্রপাতে আক্রান্ত হন বেশি। জলবায়ু পরিবর্তন একই সঙ্গে তাই বজ্রপাত বৃদ্ধি ও এতে মৃত্যু বাড়ায় ভূমিকা রাখছে।
রক্ষা পাওয়ার উপায় কী?
বজ্রপাত ঠেকানো যায় না, তবে সতর্ক থাকলে প্রাণ বাঁচানো যায়। কী কী ধরনের সতর্কতা? তাই জানাচ্ছি এখন,
বজ্রপাতের সময় খোলা মাঠ, গাছের নীচ, পুকুর বা জলাশয় এড়িয়ে চলুন।
ধাতব বস্তু (মোবাইল, ছাতা, কোদাল) ব্যবহার করবেন না।
ঘরের ভেতর নিরাপদ থাকুন। দরজা-জানালা বন্ধ রাখুন।
বজ্রপাতের আশঙ্কা থাকলে ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি বন্ধ রাখুন।
আবহাওয়া অফিসের মোবাইল অ্যাপ বা রেডিও-টিভি থেকে সতর্কতা শুনে চলুন।
বজ্রপাতে প্রাণহানি কমানোর বিষয়ে আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ বলেন, বিশেষ করে বিল বা খোলা এলাকায় ছোট ছোট ঘর তৈরি করে সেখানে আর্থিংয়ের ব্যবস্থা করে দেওয়া যেতে পারে। এ সব জায়গায় বজ্রঝড়ের আভাস পেলে মানুষ এসে আশ্রয় নেবেন। আর্থিং করা থাকায় আশ্রয় নেওয়া মানুষেরা নিরাপদে থাকবেন। তেমনি খোলা জায়গায় তাল গাছসহ উঁচু গাছের চারা লাগালে এর ওপর বজ্রপাতের সম্ভাবনা বেশি থাকবে। আর ভুল করেও বড় গাছের নিচে ঝড়-বৃষ্টির সময় আশ্রয় নেওয়া যাবে না।
বজ্রপাত প্রকৃতির এক চরম রূপ, যার নিয়ন্ত্রণ নেই আমাদের হাতে। কিন্তু সচেতনতা, শিক্ষা এবং প্রযুক্তির সহায়তায় আমরা এর ভয়াবহতা কমাতে পারি। আকাশে বিদ্যুৎ চমকালে এখন আমাদের শুধু চমকাবার নয়, সজাগ হওয়ার সময়।