Logo
×

Follow Us

ফিচার

‘তোমাদের দেশে নাকি সব মানুষই বাঁশি শেখে’

Icon

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৪ মে ২০২৫, ১৭:৪৬

‘তোমাদের দেশে নাকি সব মানুষই বাঁশি শেখে’

ছবি: সাম্প্রতিক দেশকাল

বাঙালির খুব আপন বাদ্যের নাম বাঁশি। তার মোহনীয় সুরে প্রাণ জুড়ায় না এমন মানুষ পাওয়া কঠিন। বাংলার কবি, গীতিকার ছাড়িয়ে পারস্যের কবির কবিতায়ও ঠাঁই করে নিয়েছে বাঁশি। নজরুলের গানের ‘মধুর বাঁশরি’ শচীন দেব বর্মনের গানে এসেছে ‘ডাকাতিয়া বাঁশি’ রূপে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাঁশি নিয়ে লিখেছেন কবিতা বাঁশির করুণ ডাক  বেয়ে/ ছেঁড়াছাতা রাজছত্র/ মিলে চলে গেছে/এক বৈকুণ্ঠের দিকে।’

পারস্যের কবি সুফি সাধক মওলানা জালালউদ্দিন রুমি লিখে গেছেন বাঁশি বলে আমি বাঁশ ঝাড়ের মধ্যে আপনজনের সাথে সুখে শান্তিতে বসবাস করতেছিলাম। সেখান থেকে আমাকে কাটিয়া পৃথক করিয়া আনা হইয়াছে।

সে জুদাইর (আলাদার) কারণে আমি ব্যথিত হইয়া বিরহ-যাতনায় কান্না করিতেছি। আমার বিরহ যাতনায় মানবজাতি সহানুভূতির ক্রন্দন করিতেছে।’

উচ্চ সংস্কৃতি থেকে লোক সংস্কৃতিÑসর্বত্রই বাঁশির সুরের উপস্থিতি। বাংলায় বাঁশিকে মুরালি, মোহন বাঁশি, বংশী অথবা বাঁশরিও বলা হয়। বাঁশির পাশ্চাত্য সংস্করণও সমধিক জনপ্রিয়।

ভারতীয় উপমহাদেশে বাঁশি তৈরিতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তরলা বাঁশ ব্যবহার করা হয়। কেউ কেউ শখের বশে স্টিলের, তামার, পিতলের, রুপার এমনকি সোনার পাইপ দিয়েও বাঁশি তৈরি করে থাকেন।

প্রাচীন ও মনোহরা এই বাদ্যযন্ত্রে থাকে সাতটি ছিদ্র (মাঝে মাঝে আটটিও ছিদ্র দেখা যায়)। বাঁশের তৈরি বাঁশিতে একপাশে গিট রেখে বায়ুরোধী করা হয়। বন্ধ ও খোলা প্রান্তের মাঝামাঝিতে ছিদ্রগুলো থাকে। যে ছিদ্রটি বন্ধ প্রান্তের ঠিক কাছাকাছি থাকে, সে ছিদ্রে কৌশলে ফুঁ দিয়ে হয় এবং বাকি ছয়টি ছিদ্রে ডান হাতের এবং বাম হাতের মধ্যবর্তী তিনটি আঙুলের সাহায্যে সুর তুলতে হয়। প্রযুক্তি এগিয়ে যাচ্ছে দিন দিন।

গাছের সবুজ পাতা আঁকছে কম্পিটার। বাঁশিও বাজানো যায় কী বোর্ডে! কিন্তু হিন্দু মিথলজিতে যে বাঁশির সুরে রাধা চলে আসে গোকুলের মন্দিরে, সে বাঁশির স্বাদ তো আর প্রযুক্তি দিতে পারে না!

কুমিল্লার হোমনা উপজেলার  শ্রীমদ্দি গ্রাম। এই গ্রামটির মানুষের চার বা পাঁচ প্রজন্ম ধরে প্রধান পেশা হচ্ছে বাঁশি। শ্রীমদ্দির কাঁচা-পাকা পথ ধরে হাঁটতে গেলে পাগল হতে হয়। চারদিক ঘিরে ধরে বানের মতো বাঁশির সুর। অজস্র ঘরের ভেতর তৈরি হচ্ছে বাঁশি। সে বাঁশির সুর  এসে ধাক্কা দেয় নাগরিক কর্ন-কুহরে।

শ্রীমদ্দির বাতাসে ভেসে বেড়ায় বাঁশির মধুর সুর। আলাপ করলে বাঁশির কারিগর সুমন মিয়া জানান, এই গ্রামের বাঁশির কারিগররা ১৬ থেকে ২০ ধরনের বাঁশি তৈরি করতে পারেন। এসব বাঁশির প্রকারভেদ রয়েছে।

যেমন : ক্লাসিক্যাল বাঁশি, আড় বাঁশি, মোহন বাঁশি, বীণ বাঁশি, ক্যালেনর বাঁশি, পাখি বাঁশি, নাগিন বাঁশি, বেলুন বাঁশি, মুখ বাঁশি, ফেন্সি বাঁশি ও খানদানি বাঁশি। প্রতিটি বাঁশিই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বহন করে। সারা দেশের বংশীবাদক বা বাদ্যযন্ত্র বিক্রেতাদের কাছে শ্রীমদ্দি গ্রামের একটি বিশেষত্ব রয়েছে।

তারা এ গ্রাম থেকে বিশেষভাবে বাঁশি সংগ্রহ করেন। দেশের প্রায় সব পেশাদার বংশীবাদক শ্রীমদ্দির তৈরি বাঁশি ব্যবহার করেন। গ্রামটিতে তৈরি এই বাঁশি দেশের পাঁচিল ডিঙিয়ে রপ্তানি হয়Ñইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, আমেরিকা, ইতালি, কানাডাসহ প্রতিবেশী দেশ ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও ভুটানেও।

শ্রীমদ্দি যেভাবে বাঁশির গ্রাম

অনেক দিন আগের কথা। শ্রীমদ্দি গ্রামে কোকিল দাস বৈরাগী ও দীনবন্ধু নামের দুজন বাঁশি পাগল মানুষ ছিলেন। তারা তৎকালীন অবিভক্ত ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে বাঁশি বাজাতেন এবং ওই সব অঞ্চলের সুর এবং বাঁশি তৈরির কৌশল শিখতেন।

যেসব প-িত বাঁশি বাজান তারা নিজেদের বাঁশি নিজেরাই তৈরি করেন। শ্রীমদ্দি গ্রামের কোকিল দাস বৈরাগী ও দীনবন্ধু বাঁশি তৈরির কলাকৌশল শিখে গ্রামে চলে আসেন। তারপর উভয়ে বাঁশি বানানো শুরু করেন। নিজেদের তৈরি বাঁশি বাজানো এবং ফেরি করে বিক্রি হয়ে ওঠে তাদের জীবিকা।

ধীরে ধীরে তাদের হাত ধরে বাঁশি তৈরির এই শিল্প ছড়িয়ে পড়ে গ্রামে। দেশভাগের সময় কোকিল বৈরাগী ও দীনবন্ধু পরিবারসহ ভারতে চলে যান। কিন্তু নিজের গ্রাম শ্রীমদ্দিতে রেখে যান বাঁশি তৈরির এই অমূল্য শিল্প। সময়ের সঙ্গে নানা চ্যালেঞ্জের মধ্যেও এই শিল্প এখনো টিকে আছে।

বর্তমানে গ্রামের ৩০ থেকে ৪০টি পরিবার বাঁশি তৈরির কাজে নিয়োজিত। প্রবীণ কারিগর গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘স্বাধীনতার আগে বাঁশির চাহিদা অনেক বেশি ছিল। বাপ-দাদাদের দেখতাম দুই মাস খেটে বাকি সময়টা আরামে কাটাতেন। এখন তো আমাদের সারা বছরই কষ্ট করতে হয়।’

বাঁশি তৈরির প্রক্রিয়া

বাঁশি তৈরির প্রধান উপকরণ মুলি বাঁশ, যা চট্টগ্রাম, মিরসরাই, সীতাকু- ও রাঙামাটি থেকে সংগ্রহ করা হয়। বাঁশগুলো কেনার পর ভালো মানের বাঁশ আলাদা করে পরিষ্কার করা হয়। এরপর চাহিদামতো আকারে কাটা হয়। বাঁশ কাটার পর ধুয়ে রোদে শুকানো হয় কয়েক দিন।

একটি ছোট বাঁশি তৈরিতেও ১৩-১৪টি ধাপ অতিক্রম করতে হয়। পুরো প্রক্রিয়ায় প্রায় ২০-২২ জন লোকের পরিশ্রম লাগে। কেউ বাঁশ পরিষ্কার করেন, কেউ কাটেন, কেউ শুকানোর দায়িত্বে থাকেন। বাঁশ শুকানোর পর আড় বাঁশি, ক্লাসিক্যাল বাঁশি এবং অর্ডারের বিশেষ বাঁশির জন্য বাঁশকে একটি ঘরে রেখে শুকানো হয়।

কয়েক মাস থেকে বছর খানেক পর্যন্ত বাঁশ কিউরিং করা হয়। এতে বাঁশের মান বৃদ্ধি পায়। বাঁশির শরীরে আকৃতিভেদে ছয় থেকে আটটি ছিদ্র থাকে। এই ছিদ্র করার জন্য এক মাথায় চোখা লোহার শিক ব্যবহার করা হয়। লোহার শিকে আগুনে তাপ দিয়ে বাঁশির শরীরে ফুটো করা হয়।

এই ফুটো করার আবার মাপ আছে। অনেকে স্কেল দিয়ে দাগ কেটে মাপ অনুযায়ী ফুটো করেন। তবে আজফার হোসেনের  মতো দক্ষ কারিগরদের দাগ কাটা লাগে না। শিক গরম করে চোখের আন্দাজে নিমিষেই ফুটো করে ফেলেন বাঁশির শরীরে। তবে এই আন্দাজের ফুটো সাধারণ বাঁশি, মেলায় বিক্রির বাঁশির জন্য।

ক্লাসিক্যাল বাঁশি, আড় বাঁশি, অর্থাৎ পেশাদার বংশীবাদকদের বাঁশি ফুটো করা হয় যতœ ও সাবধানতার সঙ্গে। হারমোনিয়াম বাজিয়ে, সুর মিলিয়ে বাঁশির স্কেল তৈরি করেন মুজিবর মিয়া।

কোনোটা এফ শার্প, কোনোটা সি মাইনর আবার কোনোটি ডি শার্প। পেশাদার বংশীবাদকদের চাহিদা অনুযায়ী সব স্কেলের বাঁশিই তৈরি করা হয় শ্রীমদ্দি গ্রামে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পাইকাররা শ্রীমদ্দি গ্রামে এসে বাঁশি কিনে নিয়ে যান।

মান, নকশা ও গুণাগুণভেদে বাঁশির দাম ভিন্ন হয়। পাঁচ টাকা থেকে পাঁচ থেকে দশ হাজার টাকা পর্যন্ত দামে বিক্রি হয় বাঁশি। এর মধ্যে আড় বাঁশির দামই বেশি। কারণ পেশাদার বংশীবাদক এবং শিক্ষার্থীরা মূলত এটি ব্যবহার করেন।

শেষের কথা

সরকারি কোনো সহায়তা পান না শ্রীমদ্দি গ্রামের বাঁশির কারিগররা। ক্ষুদ্র কুটির শিল্প হিসেবে তাদের রাষ্ট্রীয় কোনো স্বীকৃতি নেই। মাঝে মাঝে এনজিওগুলো কিছু সহায়তা দিলেও  তাতে জল গরম হয় না বলে জানান মুজিবর মিয়া। আসার আগে তিনি  কোমরে গোঁজা বাঁশি বাজাতে শুরু করেন।

দেখা গেল আশপাশের অনেকের কাছেই বাঁশি আছে, তারাও সুর ধরল। বেলা পড়ে এসছে। সুরে রঙে রাঙছে পশ্চিমাকাশ। শ্রীমদ্দি ছেড়ে বহুপথ। বাঁশির সুর ভাসতে থাকে বাতাসে। সুমনের গান মনে পড়েÑ‘তোমাদের দেশে নাকি সব মানুষই বাঁশি শেখে’।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫