
আপনি কি এমন কোনো জায়গায় যেতে চান, যেখানে প্রতিটি ইট-পাথরে ইতিহাসের গল্প লুকিয়ে আছে, আর প্রকৃতি নিজের হাতে আপনাকে শান্তি উপহার দেয়?
নওগাঁ ঠিক তেমনই এক মায়াময় গন্তব্য। শালবনের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে শতাব্দীপ্রাচীন মসজিদ, জমিদার বাড়ি আর বৌদ্ধ বিহারের নিঃশব্দ ইতিহাস। ছোট ছোট নদী, পদ্মফুলে ঢাকা দীঘি আর অতিথি পাখির কোলাহল এই জেলাটিকে এক অপার্থিব সৌন্দর্যে ঘিরে রেখেছে।
নওগাঁ শুধু মানচিত্রের একটি স্থান নয় এটি সময়ের গায়ে লেখা এক প্রেমপত্র, যা অতীত ও প্রকৃতির মিলনে সৃষ্টি করেছে এক জীবন্ত ইতিহাস।
নওগাঁ জেলা
রাজশাহী বিভাগের অন্তর্গত উত্তরবঙ্গের সীমান্তবর্তী জেলা নওগাঁ। আয়তন প্রায় ৩,৪৩৫ বর্গকিলোমিটার। ১৯৮৪ সালের ১ মার্চ ১১টি উপজেলা নিয়ে এটি জেলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
এই জেলা শুধু আয়তনে বড় নয়, ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যেও এটি অনন্য। এখানে ছড়িয়ে আছে ছোট ছোট নদী, প্রাচীন মসজিদ, মন্দির, গির্জা, জমিদার বাড়ি, শালবন, বৌদ্ধ বিহার এবং অসংখ্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন।
পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার (সোমপুর মহাবিহার)
নওগাঁ জেলার বদলগাছী উপজেলার পাহাড়পুর ইউনিয়নে অবস্থিত এই বিহারটি ১৮৭৯ সালে স্যার কানিংহাম আবিষ্কার করেন এবং ১৯৮৫ সালে ইউনেস্কো এটিকে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করে।
পাহাড়পুর পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বৌদ্ধ বিহার হিসেবে পরিচিত, যার আয়তন প্রায় ৭০ একর। একসময় এটি ছিল বৌদ্ধদের ধর্মচর্চা কেন্দ্র, যেখানে চীন, তিব্বত, মালয়েশিয়া এবং উপমহাদেশের অন্যান্য দেশ থেকে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা ধর্মচর্চা করতে আসতেন। এটি এখন বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃত এবং প্রতি বছর দেশি-বিদেশি পর্যটকরা এখানে আসেন।
বিশাল আকৃতির এই বিহার আপনাকে নিয়ে যাবে হাজার বছর পেছনে। আকর্ষণীয় স্থাপত্য ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব পাহাড়পুরকে একটি অতুলনীয় প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনে পরিণত করেছে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত পতিসর
আপনি যদি সাহিত্যপ্রেমী হন, তাহলে নওগাঁর আত্রাই উপজেলার পতিসরের কাছারিবাড়ি এক অপরিহার্য গন্তব্য। এখানেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার বিখ্যাত কবিতা ‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে’ লিখেছিলেন। এটি আজ একটি মিউজিয়ামে পরিণত হয়েছে, যা কবির জমিদারি জীবনের স্মৃতিকে জীবন্ত রাখে।
১৮৯১ থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত বহুবার তিনি এসেছেন এই পতিসরের কুঠিবাড়িতে। নাগর নদী পথ ধরে বজরায় চড়ে এসেছেন এবং লিখেছেন অসংখ্য গান, কবিতা, উপন্যাস ও নাটক।

আজ এই কুঠিবাড়িটি একটি মিউজিয়াম, যেখানে কবির জমিদারি জীবনের স্মৃতিকে সংরক্ষণ করা হয়েছে। কবির পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরও ১৯৩৪ সালে এখানকার প্রজাদের কল্যাণে আধুনিক কৃষিযন্ত্র প্রথম চালু করেন।
দিবর দিঘী: প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক রত্ন
পত্নীতলা উপজেলার সাপাহার-নওগাঁ সড়কের পাশে অবস্থিত ঐতিহাসিক দিবর দীঘি এক অপরিহার্য স্থান। দীঘির পাড়ে দাঁড়িয়ে আপনি পাবেন শালবন, আম-কাঁঠালের বাগান আর অতিথি পাখির কলকাকলি। এটি প্রকৃতি প্রেমিকদের জন্য এক স্বর্গরাজ্য।
দিঘীর মাঝখানে রয়েছে আট কোণার একটি বিশাল অখণ্ড গ্রানাইট পাথরের স্তম্ভ যা ‘জয়স্তম্ভ’ নামে পরিচিত। স্তম্ভটির উচ্চতা প্রায় ৩১ ফুট ৮ ইঞ্চি এবং এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরল একটি নিদর্শন।

লোকমুখে নানা কাহিনি প্রচলিত এই দীঘি ও স্তম্ভ নিয়ে, যা স্থানীয় ঐতিহ্যের অনন্য দিক তুলে ধরে।
ভারত সীমান্ত ঘেঁষা এলাকায় অবস্থিত এই শালবন ও দীঘি প্রকৃতি প্রেমিকদের জন্য এক স্বর্গরাজ্য। শীতকালে অসংখ্য অতিথি পাখির দেখা মেলে এখানে।
শালগাছের সবুজ ছায়া, পদ্মফুলে ভরা দীঘি আর অতিথি পাখির কলকাকলি আলতাদিঘী শুধু চোখের আরাম নয়, মনকেও শান্ত করে।
আলতাদিঘী জাতীয় উদ্যান: প্রকৃতির নিসর্গের এক অপরূপ দৃশ্য
ধামইরহাট উপজেলার ভারত সীমান্তঘেঁষা এই জাতীয় উদ্যানটি প্রায় ২০০ বছরের পুরনো শালবনের গহীনে।
এখানে রয়েছে বিশাল একটি দীঘি, যেখানে হাজারো পদ্মফুল ফুটে থাকে, আর শীতকালে ভিড় জমায় নানা প্রজাতির অতিথি পাখি।

শালগাছের সবুজ ছায়া, পাখির ডাক আর নির্মল বাতাস মিলিয়ে এই স্থান প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য এক স্বর্গরাজ্য।
এখানে ওষুধি গাছ, বিভিন্ন প্রাণি এবং পাখিদের জন্য অভয়ারণ্য গড়ে তোলা হয়েছে, যা পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
কুসুম্বা মসজিদ: সুলতানি আমলের স্থাপত্যের এক নজির
১৫৬৮ সালে নির্মিত কুসুম্বা মসজিদ, সুলতান গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর শাহের রাজত্বকালে সোলায়মান নামে এক ব্যক্তি নির্মাণ করেন।
এটি সুলতানি আমলের স্থাপত্যকলার অনন্য নিদর্শন এবং স্থানীয়ভাবে 'কালাপাহাড়' নামে পরিচিত।

মসজিদের ভেতরে বিচার কার্য পরিচালনার জন্য একটি উঁচু আসন রয়েছে। এর পাশেই রয়েছে একটি কালো পাথর—যার গায়ে আরবি লিপি খোদাই করা, যা ইতিহাসবিদদের মতে হুসেন শাহের স্মৃতিবহ।
মসজিদের নির্মাণশৈলী, অলংকরণ এবং ঐতিহাসিক গুরুত্ব পর্যটকদের আকর্ষণ করে।
ভ্রমণ উপযোগী স্থানগুলি: নওগাঁ ঘুরে দেখার জন্য
জগদ্দল বিহার: এটি ছিল এক সময়ের বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে হাজার হাজার শিক্ষার্থী বৌদ্ধ ধর্ম ও দর্শন শিখত।
দুবলহাটি রাজবাড়ি: জমিদারি প্রথার সাক্ষী এই রাজবাড়ি আপনাকে নিয়ে যাবে পুরনো বাংলার শাসনকালীন সময়ের ইতিহাসে।
হলুদ বিহার: এই প্রাচীন বিহারটি পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের সমসাময়িক বলে মনে করা হয় এবং এটি একটি গুরুত্বপূর্ন প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান।
যেভাবে যাবেন: ঢাকা থেকে নওগাঁ যেতে হলে আপনি কল্যাণপুর, গাবতলী বা আব্দুল্লাহপুর থেকে সরাসরি বাসে যাতায়াত করতে পারেন। বাসের ভাড়া আনুমানিক ৭০০ টাকা। অথবা ট্রেনে কমলাপুর বা বিমানবন্দর স্টেশন থেকে ‘রংপুর এক্সপ্রেস’ বা ‘কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেসে’ চড়েও আপনি নওগাঁ পৌঁছাতে পারেন। শান্তাহার জংশনে নামার পর সিএনজি বা অটোরিকশায় মাত্র ১৫ টাকায় নওগাঁ শহরে চলে আসা যাবে।
নওগাঁ: ইতিহাস ও প্রকৃতির মেলবন্ধন
নওগাঁ জেলার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মিশ্রণ একটি অদ্বিতীয় ভ্রমণ অভিজ্ঞতা দেবে। ইতিহাসের সাক্ষী হতে চাইলে অথবা প্রকৃতির শান্তি উপভোগ করতে চাইলে, নওগাঁ একটি আদর্শ গন্তব্য। এখানকার প্রতিটি স্থাপনা আপনাকে নিয়ে যাবে অতীতের এক অনন্য সফরে।