
এডমন্ড হিলারির প্রতিষ্ঠা করা খুমজুং স্কুল
১৯৫৩ সালের ২৯ মে অর্থাৎ আজকের এই দিনে প্রথম মানুষ হিসেবে বিশ্বের সর্বোচ্চ চূড়া মাউন্ট এভারেস্ট জয় করেন স্যার এডমন্ড হিলারি এবং শেরপা তেনজিং নোরগে। তবে আজ আর এভারেস্ট জয়ের গল্প না, বলব নেপালের মানুষ এবং শেরপাদের বন্ধু হিলারির গল্প।
১৯৫৩ সালে এভারেস্ট জয়ের পর স্যার এডমন্ড হিলারি নেপালের খুম্বু অঞ্চলে ফিরে এলেন। এক সন্ধ্যায় তিনি তার শেরপা সঙ্গী উরকিয়েনকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমাদের জন্য আমি কী করতে পারি?’ উরকিয়েন উত্তর দেন, ‘আমাদের সন্তানদের জন্য একটি স্কুল চাই।’
আর এভাবেই নেপালিদের সঙ্গে আরো বেশি করে জড়িয়ে গেলেন হিলারি। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ছিলেন নেপালের মানুষ, শেরপাদের অকৃত্রিম এক বন্ধু হয়েই।
মেঘের রাজ্যে এক বিদ্যালয়
বরফঢাকা পাহাড়ের কোলে, খুমজুং নামের ক্ষুদ্র এক গ্রামে একদিন সকালটা শুরু হয়েছিল অন্য রকম এক কোলাহলে। তিন হাজার ৭৫০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত এই গ্রামে সেদিন শিশুরা ভোর থেকেই জেগে উঠেছিল উৎসাহে, কারণ প্রথমবারের মতো তারা বই-খাতা হাতে স্কুলে যাবে।
স্কুল? সেই বরফ আর পাথরের রাজ্যে, যেখানে চিকিৎসা তো দূরের কথা, একটা খোলা মাঠও ছিল না খেলার জন্য, সেখানে স্কুল গড়ে তোলা কি এক রকম স্বপ্ন নয়? এই স্বপ্নেরই নাম এডমন্ড হিলারি। ১৯৬১ সালে তিনি হিমালয়ান ট্রাস্ট গঠন করে খুমজুংয়ে একটি ছোট্ট দুই কক্ষের অ্যালুমিনিয়াম ভবনে শুরু করেছিলেন এই যাত্রা। ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে তিনি শুধু একটা ভবন নির্মাণ করেননি, গড়ে দিয়েছিলেন আশা, সম্ভাবনা আর পরিবর্তনের বীজ।
ছোট্ট সেই স্কুলটি আজ এক বিশাল সেকেন্ডারি বিদ্যালয়। কখনো কাঠের ডেস্কে হাত বুলিয়ে, আবার কখনো হিমালয়ের হিমেল হাওয়ায় বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে বেড়ে উঠেছে বহু শেরপা শিশু, যারা হয়তো কোনো দিন স্বপ্নেও ভাবেনি তারা ডাক্তার, শিক্ষক কিংবা পর্বতারোহী হবে।
এডমন্ড হিলারির কাজ এখানেই থেমে থাকেনি। একের পর এক পাহাড়ি গ্রামে তিনি তৈরি করেছেন আরো ২৬টি স্কুল, হাসপাতাল, সেতু। যেন মানবিকতার এক নিঃশব্দ বিপ্লব ছড়িয়ে পড়েছিল নেপালের প্রত্যন্ত অঞ্চলে।
আর সেই বিপ্লবের এক স্মারক আজকের ‘স্যার এডমন্ড হিলারি ভিজিটর সেন্টার’। ২০২৩ সালে খুমজুং স্কুলের সেই মূল ভবনটি সংস্কার করে তৈরি হয়েছে এই কেন্দ্র। এখানে হিলারির জীবন, তার দানশীলতা, পাহাড়প্রেম আর নেপালের প্রতি ভালোবাসার গল্প ধরে রাখা হয়েছে নিঃশব্দে, শ্রদ্ধায়।
খুন্দে হাসপাতাল : বরফ ঢাকা পাহাড়ে আশার আলো
১৯৬৪ সালের এক শীতল সকাল। খুম্বু উপত্যকায় মেঘে ঢাকা হিমালয়ের চূড়াগুলোর নিচে দাঁড়িয়ে ছিলেন স্যার এডমন্ড হিলারি।
ঠক সেদিনই অল্প জ্বরে এক বৃদ্ধা শেরপা নারীর মৃত্যু দেখেছিলেন তিনি, পৃথিবীর উন্নত অংশে হলে যিনি খুব সহজেই সেরে উঠতেন। কিন্তু এখানে, খুন্দে গ্রামের পাশে কোনো চিকিৎসাকেন্দ্র নেই। পাহাড় বেয়ে নামা মানেই মৃত্যু কিংবা অলৌকিক কিছু ঘটে যাওয়ার অপেক্ষা।
সেই রাতেই তুষারপাতের মধ্যে তার মনে জন্ম নেয় আরেকটি অভিযানের বীজ, এবার আর কোনো পর্বত জয় নয়, বরং মানুষের জীবন রক্ষা করা।
১৯৬৬ সালের জুন মাস। হিমালয়ান ট্রাস্টের অর্থায়নে, হিলারির নেতৃত্বে খুন্দে গ্রামে শুরু হলো এক নতুন নির্মাণ। হেলিকপ্টারে করে আনা হলো আধুনিক যন্ত্রপাতি, সিমেন্ট, মেডিক্যাল বেড। শেরপা স্বেচ্ছাসেবকরা গড়ে তুললেন ভবন। অবশেষে বরফে ঘেরা তিন হাজার ৮০০ মিটার উচ্চতায় দাঁড়িয়ে গেল ‘খুন্দে হাসপাতাল’, নেপালের সবচেয়ে উচ্চতায় নির্মিত চিকিৎসাকেন্দ্রগুলোর একটি। হাসপাতালটি পরিচালনার জন্য হিলারি নিউজিল্যান্ডের চিকিৎসকদের আহ্বান জানান। তারাই প্রাথমিকভাবে এখানে কাজ শুরু করেন। পরে ধাপে ধাপে গড়ে তোলা হয় স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণব্যবস্থা, যারা এখন নিজেরাই এই হাসপাতাল চালাচ্ছেন।
সাগরমাথার ছায়ায় এক পরিবেশযোদ্ধার গল্প
১৯৭০ সালের এক গ্রীষ্মের বিকেল। নামচে বাজার থেকে ফেরার পথে হেলিকপ্টারে বসে হিলারি তাকিয়ে আছেন নিচের দিকে। কোথাও গাছপালা নেই, কোথাও ধোঁয়া উঠছে। আগের মতো সবুজ নয়, বরং লালচে বিবর্ণ পাহাড়ের ঢাল। এ কি সেই হিমালয়, নাকি ধীরে ধীরে মানুষ তাকে হত্যা করছে?
যত পর্যটক আসছে, বাড়ছে কাঠের চাহিদা। আর সেই কাঠ আসছে সরাসরি গাছ কেটে।
এই পরিস্থিতি আর মানতে পারেননি হিলারি। এবার তিনি এগিয়ে এলেন পরিবেশযোদ্ধা হয়ে। তিনি নেপাল সরকারকে বুঝিয়ে বলেন, এই ধ্বংস চলতে থাকলে একদিন এভারেস্টও হারাবে তার জৌলুস, আবেগ। তিনি একটি প্রস্তাব দেন, এভারেস্ট ও আশপাশের এলাকাকে জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করতে হবে।
কিন্তু তখনকার নেপাল সরকারের হাতে অর্থ নেই, আর সবচেয়ে বড় কথা, উদ্যান পরিচালনার কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতাও নেই। আবারও সেই পুরোনো ম্যাজিক হিলারির প্রভাব। নিউজিল্যান্ড সরকারের কাছে অনুরোধ জানান, প্রকৃতি বাঁচাতে তাদের পাশে দাঁড়াতে। তার কথা ফেলতে পারেনি কেউ। শুরু হয় আন্তর্জাতিক সহায়তায় একটি প্রকল্প। প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় স্থানীয়দের, প্রতিষ্ঠা করা হয় বনরক্ষক বাহিনী। ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে বিশ্বের উচ্চতম জাতীয় উদ্যান, সাগরমাথা ন্যাশনাল পার্ক।
১৯৭৬ সালে পার্কটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়, যা ১৯৭৯ সালে স্বীকৃতি পায়। এখনো পার্কের গভীরে কোথাও ভোরে হিম বাতাস বইলে শেরপারা বলেন, ‘ইয়েতি নয়, স্যারের আশীর্বাদ ঘোরাফেরা করছে।’
হৃদয় ভাঙলেও পাহাড় ছাড়লেন না
১৯৭৫ সালের মার্চ মাসের শেষ দিনটি। ছোট্ট একটি বিমান হিমালয়ের বুক চিরে এগিয়ে চলেছে সোলুখুম্বুর পাহাড়ি পথে, গন্তব্য, ফাফলু গ্রাম।
যাত্রীদের মধ্যে ছিলেন লুইজি হিলারি এবং তাদের কন্যা বেলিন্ডা। তারা যাচ্ছিলেন স্যার এডমন্ড হিলারির কাছে, যিনি তখন পরিশ্রম করে যাচ্ছেন পাহাড়ের শিশুদের জন্য একটুখানি সুস্থ ভবিষ্যৎ গড়তে।
বিমানটি ফাফলুর আকাশে পৌঁছায়, কিন্তু তারপর...ঘন কুয়াশা আর বাতাসের প্রবল ধাক্কা বিধ্বস্ত করে দেয় সব পরিকল্পনা। পাইলটের অভিজ্ঞতা বা যন্ত্রপাতির সামর্থ্য, কোনো কিছুই রক্ষা করতে পারেনি ছোট্ট সেই বিমানটিকে। হিলারি যখন জানতে পারলেন তার স্ত্রী ও কন্যা আর নেই, এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেলেন তিনি।
অনেকেই ভাবছিলেন, এই হিলারির শেষ। তিনি হয়তো আর কোনো দিন ফিরে যাবেন না শেরপাদের গ্রামে। কিন্তু হিলারি জানতেন, নিজের শোককে জয় না করলে, পাহাড়ের মানুষের দুর্দশা জয় করা যাবে না। এরপরের দিনগুলোতে হিলারি আরো বেশি নিবেদিত হলেন। হয়তো তিনি বুঝেছিলেন মানবিকতার মধ্যে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া ছাড়া এই পাহাড়ে ব্যথা ভুলে থাকার আর কোনো উপায় নেই।
এক টুকরো কাগজ নয়, এক হৃদয়ের স্বীকৃতি
বছরটা ২০০৩। নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু তখন রাজনৈতিক টানাপোড়েনের মধ্যে। স্যার এডমন্ড হিলারি, যিনি নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন নেপালের জন্য, তার হাতে তুলে দেওয়া হলো নেপালের সম্মানসূচক নাগরিকত্বের সনদ।
কোনো বিদেশির জন্য এমন সম্মান ছিল এটাই প্রথম।
সেদিন কাঠমান্ডুর ভেতর ছিল এক অদ্ভুত আবহ। জটলা ছিল, কিন্তু শৃঙ্খলাবদ্ধ; উপস্থিতি ছিল, কিন্তু নীরব; যেন সবকিছু এক মোহময় শ্রদ্ধায় স্তব্ধ। সনদ গ্রহণ করার মুহূর্তে তার চোখে এক বিন্দু জল চিকচিক করেছিল। নিজেই বলেছিলেন, ‘আমি গর্বিত যে আজ থেকে শুধু হিমালয়ের বন্ধু নই, আমি নিজেই হিমালয়ের সন্তান।’ এই নাগরিকত্ব ছিল না কেবল কাগজের সনদ, এ ছিল নেপালের মানুষের ভালোবাসার আনুষ্ঠানিক রূপ।
হিলারির চিরবিদায়
নেপালের সোলুখুম্বুর সেই পাহাড়ি গ্রামে যখন খবর পৌঁছায়, ‘স্যার এডমন্ড হিলারি আর নেই’, তখন যেন হিমালয়ের একেকটা চূড়া নত হয়ে আসে। তারিখটা ছিল ২০০৮ সালের ১১ জানুয়ারি। ভোরের দিকে কাঠমান্ডুর একটি পুরোনো ট্রানজিস্টারে প্রথম ভেসে আসে সেই খবর, ‘হি ডাইড পিসফুললি ইন অকল্যান্ড।’
খবরটা গ্রামে পৌঁছাতে বেশি সময় লাগেনি, কারণ হিলারির মৃত্যুর খবর ছড়ানোর জন্য সেসব পাহাড়ে টেলিগ্রাফ বা ইন্টারনেটের দরকার ছিল না। তিনি ছিলেন তাদের মননের একজন, তাদের পরিবারের একজন। এক বৃদ্ধা শেরপা নারী তখন শুধু এটুকু বলেছিলেন, ‘তিনি আমাদের স্কুল বানিয়েছিলেন, হাসপাতাল বানিয়েছিলেন, কিন্তু নিজের মতো করে আমাদের হৃদয়েও জায়গা বানিয়ে নিয়েছিলেন।’
খুমজুং স্কুলের বারান্দায় তখন কয়েকজন বাচ্চা ছেলেমেয়ে চুপচাপ বসে। অনেকেই জানত না হিলারি কে ছিলেন, কিন্তু জানত ‘স্যার’ বলে কেউ একসময় এখানেই দাঁড়াতেন, কাঁধে হাত রাখতেন, মিষ্টি করে হাসতেন।
আজও যখন খুমজুং স্কুলের দেওয়ালে তার ছবি ঝুলে থাকে, কেউ কেউ দুঃখ করে বলে, ‘স্যার হিলারি কখনো বিদায় নেননি। তিনি আকাশে আছেন, পাহাড়ের বাতাসে আছেন, আমাদের শ্বাসের ভেতর আছেন।’
তথ্যসূত্র : দ্য গার্ডিয়ান, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, দ্য হিমালয়ান ট্রাস্ট, নেপাল নিউজ