Logo
×

Follow Us

ফিচার

হাতি ভালোবাসেন গারো যুবক কাঞ্চন

Icon

ইশতিয়াক হাসান

প্রকাশ: ০৬ জুন ২০২৫, ১৮:২৯

হাতি ভালোবাসেন গারো যুবক কাঞ্চন

শেরপুর-নেত্রকোনা-জামালপুরের সীমান্তবর্তী গারো পাহাড়ে হাতি-মানুষ লড়াই এখন খুব স্বাভাবিক ঘটনা। বিদ্যুতের ফাঁদসহ নানাভাবে মারা হচ্ছে হাতি। হাতির আক্রমণে মানুষের মৃত্যুর ঘটছে নিয়মিত। হাতিদের হামলায় গারোদের ঘর-বাড়ি, ধানক্ষেতের ক্ষতির পরিমাণও কম নয়। কিন্তু গারো যুবক কাঞ্চন মারাক হাতি ভালোবাসেন। হাতি-মানুষ শান্তিতে বাস করবে পাহাড়ে সেই স্বপ্ন দেখেন। মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করেন হাতি রক্ষার বিষয়ে। ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবসে গারো পাহাড়ের হাতি এবং হাতি-মানুষ দ্বন্দ্বের গল্প শুনিয়েছেন কাঞ্চন। কাঞ্চনের গল্প হাতির প্রতি কৌতূহলের শুরু ছোটবেলা থেকেই। একটি স্মৃতি খুব মনে পড়ে, বাড়ির পাশে যখন একবার হাতি এলো, মা আমাকে পিঠে নিয়ে নিল। আমরা গারোরা পিঠের মধ্যে গামছা দিয়ে বেঁধে শিশুদের নেই। তো কখনো হাতি এলে মা, দিদি, বাবা এভাবে ছোট্ট আমাকে কাঁধে নিয়ে নিরাপদ স্থানে পালানোর চেষ্টা করত। কারণ প্রথম দিকে আমরা হাতির সঙ্গে এতটা পরিচিত ছিলাম না। ষাট-সত্তরের দশকের মানুষও কিন্তু খুব একটা হাতি দেখেনি। দীর্ঘদিন পর হঠাৎ করে যখন ১৯৯৬ সালের দিকে হাতি এলো, দেখলাম যে সবাই মোটামুটি ভয় পাচ্ছে। আমার বাবার হাতিদের প্রতি অন্য রকম একটা ভালোবাসা ছিল। ছোটবেলায় বাবা আমাকে পিঠে নিয়ে হাতিদের জন্য চিনি লবণ নিয়ে যেত। জঙ্গলের ভেতরে একটু নিরাপদ দূরত্ব থেকে লবণ আর চিনি দিয়ে একটু দূরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখত হাতি আসত দলবেঁধে। ওই লবণ আর চিনি খেয়ে আবার জঙ্গলের মধ্যে চলে যেত হাতি। তবে এখন পরিস্থিতি অনেকটাই ভিন্ন। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে ৪০ থেকে ৪৫টি হাতির দলের কথা বলা হয়। কিন্তু আমি ঠিকমতো খেয়াল করে দেখেছি এখন সর্বোচ্চ ৩৫টি পর্যন্ত হাতির দল দেখা যায়। এখন হাতিগুলো ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে গেছে খাবারের খোঁজে।

একটা আশ্চর্য বিষয় লক্ষ করেছি, হাতিরা দলের মধ্যে একজন গোয়েন্দা রাখতে শুরু করেছে। এই হাতি ঘোরাফেরা করে পুরো গ্রামে। আর সে খুবই সাহসী ও বুদ্ধিমান। গোয়েন্দা হাতি পুরো গ্রাম ঘুরে তথ্য নিয়ে কোথায় খাবার আছে জানানোর পর বাকি সঙ্গীদের নিয়ে এসে হামলা করে। কিছুদিন ধরে আমি হাতিদের মধ্যে কিছু পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি, যা এর আগে দেখিনি। কয়েক দিন আগে রাতে একসঙ্গে প্রায় ১০টি ঘরে হামলা করেছে। এখন তারা মানুষের প্রতি এত বিরক্ত হয়ে গেছে যে প্রচণ্ড বাজেভাবে হামলা চালাচ্ছে। হাতি কিন্তু ধান খায় না, ধানের গাছ খায়, কচি পাতা খায়। এটা বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে। আর ধান খেলে তাদের পেট খারাপ হয়। এ তথ্যগুলো আসলে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেওয়া দরকার। বন বিভাগের উচিত কর্মরতদের ট্রেনিং দেওয়া। যখন তারা সব কিছু বুঝবে তাদের দিয়ে ভালো কিছু সম্ভব। তবে বনের উন্নয়ন করতে গেলে স্থানীয়দের সহযোগিতা ছাড়া কখনো উন্নয়ন সম্ভব নয়। হাতির প্রতি কৌতূহলের শুরু ছোটবেলা থেকেই। একটি স্মৃতি খুব মনে পড়ে, বাড়ির পাশে যখন একবার হাতি এলো, মা আমাকে পিঠে নিয়ে নিল। আমরা গারোরা পিঠের মধ্যে গামছা দিয়ে বেঁধে শিশুদের নেই দিনশেষে আমরাই এখানে থাকব। রেঞ্জার আজকে আসবেন, কাল আবার বদলি হয়ে অন্য জায়গায় চলে যাবেন। কিন্তু আমাদের এই জায়গায় থাকতে হবে। তাই বন রক্ষায় স্থানীয়দের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। অতীতে অনেক দামি দামি যে গাছগুলো ছিল, সেগুলো বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এই গাছগুলো পাখির জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

ছোটবেলায় আমাদের আকাশে শকুন উড়ত। এখন কেবল মোবাইলের স্ক্রিনে দেখি। এ রকম অনেক পশুপাখি আজকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বন বিভাগ প্রাকৃতিক গাছের জন্য আর্থিক লাভের জন্য অ্যাকাশিয়া, ইউক্যালিপটাস লাগিয়েছে। গারোদের সঙ্গে হাতিদের সুন্দর একটি সম্পর্ক আছে। হাতিদের সমাজব্যবস্থার সঙ্গেও গারো সমাজের মিল আছে। আমরা তাদের মামা বলে ডাকি। একটু খোঁজ করলে দেখবেন, হাতির পায়ে পিষ্ট হয়ে গারোদের মারা যাওয়ার সংখ্যা একেবারেই কম। আমাদের শেরপুর সীমান্তে যদি হাতির আক্রমণে ১০০ জন মারা যায়, এর মধ্যে সর্বোচ্চ ১০ জন গারো। একইভাবে কোচ বা হাজংদেরও হাতির আক্রমণে মারা যাওয়ার হার কম। এর কারণ নিশ্চিতভাবে জানা নেই আমার। তবে হাতিদের সঙ্গে কীভাবে বাঁচতে হবে এটা আমাদের রক্তের মধ্যে আছে। একসময় হাতি ছাড়াও বাঘ, শিয়াল কিংবা জংলি কুকুর, ভালুক ছিল। জঙ্গলের ভেতর কীভাবে বাঁচতে হবে আমরা সেই টেকনিকটা শিখে ফেলেছিলাম।

আমরা জানি, হাতির সামনে কীভাবে যেতে হবে, হাতি যখন তেড়ে আসবে তখন নিজেকে কীভাবে আত্মরক্ষা করতে হবে। হাতিদের কষ্ট দেখলে আমারও খারাপ লাগে। ২৮ এপ্রিলের কথা। বাড়ির মহিষগুলোকে নিয়ে জঙ্গলের দিকে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ খবর এলো, নালিতাবাড়ি সীমান্তের কাটাবাড়ি গ্রামের উত্তরে, রহিমের পুকুর এলাকায় একটি আহত হাতি পড়ে আছে। মন মুহূর্তেই ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল। জায়গাটি ভারতের সীমান্ত তারকাটার মাত্র ১০০ গজ দূরে, একেবারে সীমানা পিলারের কাছে। ঘণ্টাখানেক পর একজনের কাছে মোষগুলোর দায়িত্ব দিয়ে একাই রওনা দিলাম আহত হাতির খোঁজে। অনেক দূর পথ পেরিয়ে নির্ধারিত স্থানে পৌঁছালাম, কিন্তু কোথাও হাতির চিহ্নমাত্রও পেলাম না। আশপাশে মানুষেরও কোনো সাড়া-শব্দ নেই। গভীর জঙ্গলে একাকী প্রবেশ করা নিঃসন্দেহে বিপজ্জনক, তবুও অজানা এক টানে, আহত প্রাণীটির জন্য উদ্বেগ নিয়ে এগিয়ে চললাম। সেই ফাঁকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘটনাটি শেয়ার করে দিলাম। উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম সবদিকে খুঁজলাম, কিন্তু কোথাও দেখা মিলল না। মনের ভেতর ক্রমে ভয় বাড়তে লাগল। কারণ জানা ছিল, আশপাশে এক দৃষ্টিহীন ও দাঁতভাঙা বিপজ্জনক হাতি ঘোরাফেরা করছে। অবশেষে ফজলগুনির

চিপায় হঠাৎ তার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। হাতিটি আমাকে লক্ষ্য করেই দৌড়ে এলো। প্রাণের তাগিদে আমি দ্রুত ডান দিকের উঁচু জায়গায় উঠে পড়লাম, আর হাতিটি বাঁ দিকে দৌড়ে চলে গেল। বারবার গর্তে হোঁচট খেতে খেতে গাছের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে সে এগিয়ে যাচ্ছিল। ভিডিও ধারণের সুযোগ তখন ছিল না, তবে খুব কাছ থেকেই তার আহত শরীরের করুণ চিত্র দেখতে পেলাম। দেহজুড়ে ক্ষতের অসংখ্য চিহ্ন। বিশেষ করে চোখের পাশে গভীর আঘাত। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল, কোনো মানুষরূপী জানোয়ার তাকে এই অবস্থা করেছে। সম্ভবত ধারালো অস্ত্র দিয়ে তার চোখ নষ্ট করা হয়েছে। কিছু দূর গিয়ে হাতিটি নীরব হয়ে দাঁড়িয়ে কান নাড়াচ্ছিল। বুঝলাম, শ্রবণশক্তির ওপর ভর করেই সে তার চারপাশের শব্দ খুঁজছে। আমি চুপ করে রইলাম, কারণ সামান্য নড়াচড়াতেই হয়তো সে আবার ক্ষিপ্ত হয়ে ছুটে আসবে। পরে হাতিটির বিষয়ে বন বিভাগকে জানানোর চেষ্টা করি। একপর্যায়ে বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃত সংরক্ষণ বিভাগ, শেরপুরের একটি টিম অসুস্থ হাতিটিকে খোঁজাখুঁজি করে ৩০ তারিখে বের করে। ১ মে গাজীপুর সাফারি পার্কের চিকিৎসক এসে চিকিৎসা দেন। কিছুদিন আগে একটি শজারু ছানা রেসকিউ করার সোর্স আমি ছিলাম; তারপরই একটি বার্মিজ পাইথন উদ্ধার করলাম। তবে আমি এসব কাজ নিজের মতোই করতে চাই। আমার ছোটবেলার সঙ্গে এখনকার হাতিদের আচরণে অনেক পার্থক্য। তখন কয়েকজন মানুষ চিৎকার-চেঁচামেচি করলে, বাড়িতে লাইট জ্বালিয়ে রাখলে কিংবা মশাল নিয়ে ওদের সামনে গেলে পালিয়ে যেত। বর্তমান সময়ে কিন্তু এর বিপরীত রূপ আমরা দেখতে পাচ্ছি। বিষয়টি হলো তারা আমাদের এসব কৌশলের সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। এখন লাইট দিলেও তারা পালায় না, বরং তেড়ে আসে। আবার মশাল নিয়ে যদি যান, মশাল শুড় দিয়ে ধরে তারা মানুষকে আক্রমণ করে। এখন আগুনেও ভয় পায় না। একসময় দেখতাম যে পটকা দু-একটা ফোটালেই তারা দল বেঁধে দৌড় দিত। এখন পটকাকে পাত্তাই দেয় না। বর্তমান সময়ে কিন্তু লম্বা দাঁতের কোনো পুরুষ হাতি দেখা যায় না। এই বিশাল দাঁতওলা হাতিগুলো কোথায় গেল ভেবে অবাক হই।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫