Logo
×

Follow Us

ফিচার

১২ বছরের ইকবাল ছিল ৩০০০ শিশুর মুক্তির দূত

Icon

বখতিয়ার আবিদ চৌধুরী

প্রকাশ: ১১ জুন ২০২৫, ১৩:২৯

১২ বছরের ইকবাল ছিল ৩০০০ শিশুর মুক্তির দূত

পাকিস্তানের লাহোরের উপকণ্ঠে ছোট্ট একটি শহর ‘মুরিদকে’। এই শহরের এক দরিদ্র ক্যাথলিক খ্রিষ্টান পরিবারে ১৯৮৩ সালের ১ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন ইকবাল মাসিহ। বাবা সাইফ মাসিহ ছিলেন শ্রমিক এবং মা ইনায়েত বিবি গৃহকর্মীর কাজ করতেন। ইকবাল তার বোনদের কাছে বড় হতে থাকে। ইকবালের বয়স যখন চার, তখন তার বাবা সাইফ মাসিহ টাকার জন্য স্থানীয়

একটি কার্পেট তৈরির কারখানার মালিকের কাছে মাত্র ৬০০ রুপি ঋণের বিনিময়ে বন্ধক রাখেন। শর্ত ছিল সাইফের ঋণ পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত ইকবালকে কার্পেট কারখানায় কাজ করতে হবে। সে সময় পাঞ্জাবের কার্পেট কারখানায় ইকবালের মতো শিশু শ্রমিকদের ব্যাপক চাহিদা ছিল। কারণ শিশুদের আঙুল ছোট এবং নরম হওয়ার ফলে প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের চেয়ে তাদের বুনন দ্রুত ও নিখুঁত হতো। তা ছাড়া পারিশ্রমিকও ছিল নামমাত্র। কারখানায় ইকবালকে সপ্তাহে সাত দিনই ১২ ঘণ্টা করে কাজ করতে বাধ্য করা হতো। যেখানে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ এক দিন ছুটিসহ সপ্তাহে ৪৮ ঘণ্টা কাজ করার সক্ষমতা রাখেন, ইকবালকে সেখানে সারা সপ্তাহে ৮৪ ঘণ্টা কাজ করতে হতো! তাও দৈনিক মাত্র এক রুপির বিনিময়ে। ইকবালের মজুরির পুরো টাকা তার বাবার ঋণ পরিশোধের খাতে কেটে রাখা হতো। কারখানার মালিক আবার এই ঋণের ওপর সুদ ধার্য করেছিলেন। এ ছাড়া খাবার ও কাজের ভুলের অজুহাতে ইকবালের মজুরি কেটে রাখা হতো। এ অবস্থায় ঋণ পরিশোধে কোনো অগ্রগতি সম্ভব হচ্ছিল না। বছরের পর বছর ইকবালকে কাজ করে যেতে হচ্ছিল। একটা সময় কারখানা মালিকের কাছে এই ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৩ হাজার রুপি! 

কারখানায় ইকবাল ধীরে ধীরে বড় হচ্ছিল। একসময় সে জানতে পারে পাকিস্তানে শিশু শ্রম নিষিদ্ধ। ১০ বছর বয়সে ইকবাল কারখানা থেকে পালিয়ে স্থানীয় পুলিশ স্টেশনে যায় এবং বিস্তারিত খুলে বলে। তৈরিতে শিশুশ্রমের অনুমতি দেয়, তাদের পুলিশ সব শুনেও ইকবালকে কারখানার মালিকের কাছে ফিরিয়ে দেয়। স্থানীয় পুলিশ ও প্রশাসন এতটাই দুর্নীতিগ্রস্ত ছিল যে তারা নিয়মিত কার্পেট কারখানাগুলোর মালিকদের কাছ থেকে ঘুষ গ্রহণ করত। ফলে ইকবালকে কারখানায় ফেরত পাঠানো তাদের কাছে স্বাভাবিক ঘটনাই ছিল। কারখানায় ফিরিয়ে আনার পর ইকবালকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়, সঙ্গে কারখানার অন্য শিশুদেরও। কিছুদিন পর ইকবাল দ্বিতীয়বার পালাতে সক্ষম হয়। এবার সে কোনোক্রমে ইড়হফবফ খধনড়ঁৎ খরনবৎধঃরড়হ ঋৎড়হঃ (ইখখঋ)-এর কাছে যেতে সক্ষম হয়। এ সংগঠনটি শিশু শ্রমিকদের মুক্তি এবং শিক্ষা নিয়ে কাজ করত। 

ইকবাল তখন বেশ অসুস্থ। বয়সের তুলনায় শারীরিক উচ্চতা এবং ওজন একবারেই কম। ইকবাল সংগঠনটির পরিচালিত একটি স্কুলে পড়াশোনা করতে শুরু করে। মাত্র দুই বছরের মধ্যে চার বছরের শিক্ষাক্রম শেষ করে সে। এর পাশাপাশি ইকবাল শুরু করে অসম এক লড়াই। ইখখঋ-এর সাহায্যে পাকিস্তানের বিভিন্ন শহর ঘুরে শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে কথা বলতে শুরু করে এবং সরকারের কাছে তাদের মুক্তির দাবি তুলতে থাকে। ইকবাল দেশব্যাপি পরিচিতি লাভ করে। হয়ে ওঠে শিশুশ্রমবিরোধী জনপ্রিয় মুখ। ১৯৯৪ সালের নভেম্বরে ইকবাল শিশুশ্রমবিরোধী একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে সুইডেন গমন করে। সম্মেলনে সে তার বন্দিদশার দিনগুলো সবার সামনে বর্ণনা করে এবং বিশ্বের বিভিন্ন জাতির প্রতি আহ্বান জানায়, যে দেশগুলো কার্পেট থেকে কার্পেট কেনা বন্ধ রাখতে। 

একই বছর ডিসেম্বরে ইকবাল ‘রিবক ইয়ুথ ইন অ্যাকশন অ্যাওয়ার্ড’ গ্রহণের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গমন করে। এরপর ইকবাল পাকিস্তানে তার গ্রামে ফিরে আসে। সেখানে ১৯৯৫ সালের ১৬ এপ্রিল বেশ কয়েকজন বন্ধুসহ সাইকেল চালানোর সময় ইকবাল মাসিহকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ইকবালের হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে পুলিশ জানায়, স্থানীয় একটি খামার শ্রমিকদের সঙ্গে বিরোধের জেরে তাকে হত্যা করা হয়েছে। একজনকে গ্রেপ্তারের দাবিও করে পুলিশ। কিন্তু ইখখঋ দাবি করেছিল ইকবালকে কার্পেট মাফিয়ারা হত্যা করেছে। সূত্র হিসেবে তারা জানায়, এক সপ্তাহ আগে ইকবালকে কার্পেট মাফিয়াদের পক্ষ থেকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছিল। ইকবালের হত্যাকাণ্ডের পর লাহোরে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়। এ বিক্ষোভ মিছিল, সমাবেশগুলোতে যোগ দেওয়া বেশির ভাগই ছিল শিশু শ্রমিক, যাদের বয়স ১২ বা তারও কম। 

ইকবালের হত্যাকাণ্ডের প্রভাব পড়েছিল পাকিস্তানের কার্পেট বাজারে। তার মৃত্যুর কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ১০ মিলিয়ন ডলারের পতন ঘটে কার্পেটের বাজারে। ইকবালের মৃত্যুর আগেও পাকিস্তানি কার্পেটশিল্পে শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে কার্পেটের বাজারে দর পতন শুরু হয়েছিল। লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমসের ১৯৯৫ সালের একটি নিবন্ধ অনুসারে, পাকিস্তান থেকে বিশ্বব্যাপী কার্পেট রপ্তানি ১৯৯২ সালে ১৮৩ মিলিয়ন ডলার থেকে কমে ১৯৯৪ সালে ১৪৯ মিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়। সে সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি ৫৫ মিলিয়ন থেকে কমে ৪২ মিলিয়ন ডলারে ঠেকে। ১২ বছরের ছোট্ট জীবনে শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে ইকবাল কাজ করতে পেরেছিল মাত্র দুই বছর। আর এই স্বল্প সময়ে ইকবালের প্রচেষ্টায় পাকিস্তানে প্রায় তিন হাজার শিশু শ্রমিক কার্পেট কারখানার বন্দিশালা থেকে মুক্তি লাভ করেছিল।

ইকবাল মাসিহ তার কাজের স্বীকৃতিতে ২০০০ সালে মরণোত্তর বিশ্ব শিশু পুরস্কার লাভ করেন। ২০০৯ সালে মার্কিন কংগ্রেস শিশুশ্রম নির্মূলের লক্ষ্যে ইকবাল মাসিহ পুরস্কারের প্রচলন করে। মার্কিন শ্রম বিভাগ প্রতি বছর এই পুরস্কার প্রদান করে আসছে। ইকবাল মাসিহ আইনজীবী হওয়ার স্বপ্ন দেখত। তার জীবনের লক্ষ্য ছিল শিশুশ্রম নির্মূল এবং দাসত্ব থেকে মুক্তি। রিবক ইয়ুথ ইন অ্যাকশন অ্যাওয়ার্ড নিতে ইকবাল যখন আমেরিকায় অবস্থান করছিলেন ম্যাসাচুসেটসের ব্র্যান্ডেস বিশ্ববিদ্যালয় তার স্বপ্নের কথা জেনে কলেজে পড়ার সময় তাকে পূর্ণ বৃত্তি প্রদানের প্রস্তাবও দিয়েছিল। কিন্তু ইকবাল মাসিহ থেমে যায় মাত্র ১২ বছর বয়সে। 

বলে রাখা দরকার, ইকবাল থেমে যায়নি, তাকে থামিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ইকবাল আজও ফিরে ফিরে আসেÑকারখানার বন্দিশালা থেকে মুক্ত হাজার হাজার শিশুর মিছিলে। ইকবালের নামের শেষাংশ ‘মাসিহ’র বাংলা অর্থ ‘একটি জনগোষ্ঠীর ত্রাণকর্তা বা রক্ষাকারী’। বাস্তব জীবনে ইকবাল সত্যিই পাকিস্তানের শিশু শ্রমিকদের রক্ষাকারী কিংবা ত্রাণকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল।


Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫