Logo
×

Follow Us

ফিচার

স্বেচ্ছামৃত্যু: জীবনের শেষ সিদ্ধান্ত

Icon

এহতেশাম শোভন

প্রকাশ: ১৭ জুন ২০২৫, ১৫:২৫

স্বেচ্ছামৃত্যু: জীবনের শেষ সিদ্ধান্ত

বিশ্বের কয়েকটি দেশে আইনি কাঠামোর অধীনে স্বেচ্ছামৃত্যুকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে

দুরারোগ্য ব্যাধি, তীব্র যন্ত্রণা কিংবা বেঁচে থাকার আর কোনো আশা না থাকলে মানুষ জীবনের এই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটি নেয় স্বেচ্ছামৃত্যুর মাধ্যমে। স্বেচ্ছামৃত্যু, অর্থাৎ নিজের জীবন স্বেচ্ছায় শেষ করার এই ধারণাটি যুগ যুগ ধরে বিতর্ক সৃষ্টি করে এসেছে। এর বৈধতা, নৈতিকতা ও মানবিক দিক নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বারবার।

স্বেচ্ছামৃত্যু কী?

স্বেচ্ছামৃত্যু বা ইউথেনেসিয়া বলতে কোনো মারণব্যাধিতে বা অনিরাময়যোগ্য রোগে আক্রান্ত রোগীর নিজের অনুরোধে কিংবা নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে চিকিৎসকের সহায়তায় জীবন অবসান ঘটানোর সিদ্ধান্ত ও প্রক্রিয়াকে বুঝায়। কেউ যখন এমন কোনো শারীরিক বা মানসিক যন্ত্রণায় ভোগেন, যা নিরাময় করা সম্ভব নয় এবং জীবনধারণ তাদের কাছে অসহনীয় হয়ে ওঠে তখন প্রয়োগ হয় এর। স্বেচ্ছামৃত্যু বিভিন্ন রূপে হতে পারে, যেমন বিষ গ্রহণ, ওষুধের অতিরিক্ত মাত্রা সেবন অথবা জীবন রক্ষাকারী চিকিৎসা প্রত্যাখ্যানের মাধ্যমে।

স্বেচ্ছামৃত্যুর ধরন

স্বেচ্ছামৃত্যু মূলত দুই ধরনের হতে পারে। এক. সক্রিয় স্বেচ্ছামৃত্যু, যেখানে চিকিৎসক ওষুধ প্রয়োগ করে রোগীর দুর্বিষহ জীবনের অবসান ঘটান। দুই. নিষ্ক্রিয় স্বেচ্ছামৃত্যু, যেখানে চিকিৎসা বন্ধ রেখে রোগীকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে দেওয়া হয়।

এ ছাড়া অ্যাসিস্টেড সুইসাইড নামেও একটি ধারণা রয়েছে, যেখানে রোগী নিজেই চিকিৎসকের সহায়তায় মৃত্যুর জন্য নির্ধারিত ওষুধ গ্রহণ করেন।

স্বেচ্ছামৃত্যু বৈধ কি?

স্বেচ্ছামৃত্যুর বৈধতা একটি জটিল ও স্পর্শকাতর বিষয়। এর সমর্থনে কিছু যুক্তি তুলে ধরা হয়, যেমন-জীবনের অধিকার মানুষের জন্মগত, তেমনি অনেকে মনে করেন, কষ্টের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য স্বেচ্ছামৃত্যুর অধিকারও ব্যক্তির থাকা উচিত। অনেকে ভাবেন, যখন কোনো ব্যক্তি দুরারোগ্য ব্যাধিতে অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করছেন এবং তার সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা নেই, তখন সেই কষ্ট থেকে মুক্তি দেওয়া মানবিক হতে পারে। আবার অনেকে এও চান তাদের মৃত্যু যেন মর্যাদাপূর্ণ হয়, যেখানে তারা তাদের জীবনের শেষ মুহূর্তগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রাখতে পারেন।

স্বেচ্ছামৃত্যুর বিপক্ষেও অনেকে যুক্তি পেশ করেন- ধর্মীয় ও নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে। চিকিৎসাবিজ্ঞান প্রতিনিয়ত উন্নত হচ্ছে। আজ যা দুরারোগ্য, কাল তার নিরাময় সম্ভব হতে পারে। চরম কষ্টের মুহূর্তে ব্যক্তি হতাশ ও মানসিকভাবে দুর্বল থাকতে পারেন। সেই অবস্থায় নেওয়া সিদ্ধান্ত সুস্থ মস্তিষ্কের নাও হতে পারে। স্বেচ্ছামৃত্যুকে বৈধতা দিলে এর অপব্যবহারের আশঙ্কা থাকে। পরিবার বা অন্য কোনো স্বার্থান্বেষী মহল অসুস্থ ব্যক্তিকে প্রভাবিত করে এই পথ বেছে নিতে বাধ্য করতে পারে।

যেসব দেশে বৈধতা পেয়েছে স্বেচ্ছামৃত্যু

বিশ্বের কয়েকটি দেশে আইনি কাঠামোর অধীনে স্বেচ্ছামৃত্যুকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে, তবে এর প্রক্রিয়া এবং শর্তাবলি খুবই কঠোর।

রোগীর মানসিক স্বাস্থ্য মূল্যায়ন, একাধিক ডাক্তারের মতামত এবং সুস্পষ্ট সম্মতির প্রয়োজন হয়। বেশ কয়েকটি ধাপ পার করে এর অনুমতি নিতে হয়।

নেদারল্যান্ডস : ২০০২ সালে বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে নেদারল্যান্ডস স্বেচ্ছামৃত্যুকে আইনি স্বীকৃতি দেয়। এখানে ‘ইউথেনেসিয়া’ এবং ‘অ্যাসিস্টেড সুইসাইড’ উভয়ই কঠোর শর্তের অধীনে বৈধ।

বেলজিয়াম : একই বছর বেলজিয়ামেও এই প্রক্রিয়া বৈধ হয়। ২০১৪ সালে তারা শিশুদের ক্ষেত্রেও স্বেচ্ছামৃত্যুর অনুমতি দেয় নির্দিষ্ট শর্তে, যা বিশ্বে নজিরবিহীন।

সুইজারল্যান্ড : এখানে ‘অ্যাসিস্টেড সুইসাইড’ বৈধ। কোনো ব্যক্তি যদি স্বেচ্ছায় এবং সচেতনভাবে জীবন শেষ করতে চান, তবে ডাক্তার তাকে প্রাণঘাতী ওষুধ প্রেসক্রাইব করতে পারেন, যা রোগী নিজে গ্রহণ করেন।

কানাডা : ২০১৬ সাল থেকে কানাডায় ‘মেডিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স ইন ডাইং’ বৈধ করা হয়েছে, যেখানে গুরুতর অসুস্থ ব্যক্তি ডাক্তারের সহায়তায় জীবন শেষ করার অনুরোধ করতে পারেন।

অস্ট্রেলিয়া : ভিক্টোরিয়া, ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া, তাসমানিয়া, সাউথ অস্ট্রেলিয়া এবং কুইন্সল্যান্ডের মতো কিছু শহরে কঠোর শর্তের অধীনে অ্যাসিস্টেড ডাইং বৈধ।

যুক্তরাষ্ট্র : ওরেগন, ওয়াশিংটন, মন্টানা, ভার্মন্ট, ক্যালিফোর্নিয়া, কলোরাডো, হাওয়াই, নিউ জার্সি, নিউ মেক্সিকো এবং ডিস্ট্রিক্ট অব কলম্বিয়ায় ‘ফিজিশিয়ান-অ্যাসিস্টেড ডাইং’ বৈধ। এছাড়া লুক্সেমবার্গ, স্পেন এসব দেশেও নির্দিষ্ট আইন অনুযায়ী স্বেচ্ছামৃত্যু বৈধ।

ইতিহাসের পাতায় স্বেচ্ছামৃত্যু

প্রাচীন গ্রিস ও রোমান সভ্যতায় কিছু পরিস্থিতিতে আত্মহত্যাকে সম্মানজনক হিসেবে দেখা হতো। তবে আধুনিক বিশ্বে আইনি কাঠামোর অধীনে স্বেচ্ছামৃত্যুর ধারণাটি মূলত বিশ শতকের শেষ দিকে জনপ্রিয়তা লাভ করে। তবে ১৯৩৫ সালে যুক্তরাজ্যে প্রথম ভলান্টারি ইউথেনেসিয়া সোসাইটি গঠিত হয়। পরবর্তীতে ২০০৬ সালে সংগঠনটির নাম পরিবর্তিত হয় ডিগনিটি ইন ডাইং নামে। এরপর সময়ের পরিক্রমায় বিভিন্ন দেশ এই বিষয়টি নিয়ে আইন প্রণয়ন বা বিতর্ক শুরু করে। ডাচ চিকিৎসক ড. জ্যাকুয়েলিন ওয়ার্নার্স স্বেচ্ছামৃত্যুর অধিকার নিয়ে জোরালো আন্দোলন শুরু করেন। ১৯৮০-র দশকে নেদারল্যান্ডসে এ নিয়ে আইনি লড়াই শুরু হয় এবং ধীরে ধীরে কিছু শর্তের অধীনে স্বেচ্ছামৃত্যু বৈধতা পায়। সুইজারল্যান্ডে ‘ডাইগনিটাস’ এবং ‘এক্সিট ইন্টারন্যাশনাল’-এর মতো সংস্থাগুলো অ্যাসিস্টেড সুইসাইডের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

কতটি স্বেচ্ছামৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে?

স্বেচ্ছামৃত্যুর সঠিক সংখ্যা নির্ধারণ করা কঠিন, কারণ অনেক ঘটনাই নথিভুক্ত হয় না বা গোপন রাখা হয়। তবে যেসব দেশে এটি বৈধ, সেখানকার পরিসংখ্যান কিছুটা ধারণা দিতে পারে।

নেদারল্যান্ডসে প্রতি বছর গড়ে ছয় থেকে সাত হাজারের মতো স্বেচ্ছামৃত্যুর ঘটনা ঘটে। ২০২৪ সালে দেশটিতে মোট ৯ হাজার ৯৫৮ জন স্বেচ্ছামৃত্যুর পথ বেছে নেন। বেলজিয়ামে ২০২৩ সালে এই সংখ্যা ছিল প্রায় তিন হাজার ৫০০। কানাডায় ২০২৩ সালে প্রায় ১৫ হাজার জন চিকিৎসকের সহায়তায় মৃত্যু বেছে নেন। সুইজারল্যান্ডে প্রতি বছর প্রায় এক হাজার থেকে এক হাজার ৫০০ জন অ্যাসিস্টেড সুইসাইডের মাধ্যমে মারা যান, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বিদেশি নাগরিকও থাকেন।

যুক্তরাষ্ট্রের ওরেগন অঞ্চলে ১৯৯৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত দুই হাজার ৮০০ জনের বেশি মানুষ ফিজিশিয়ান-অ্যাসিস্টেড ডাইংয়ের মাধ্যমে মারা গেছেন। এই সংখ্যাগুলো বৈধ স্বেচ্ছামৃত্যুর ঘটনার, অবৈধ বা নথিভুক্ত না হওয়া ঘটনা এর বাইরেও থাকতে পারে। নেদারল্যান্ডসের বাসিন্দা মারিয়া ভ্যান ডাইক, ৭৫ বছর বয়সে স্বেচ্ছামৃত্যুর সিদ্ধান্ত নেন। দীর্ঘদিন ধরে দুরারোগ্য এক ব্যাধিতে আক্রান্ত ছিলেন তিনি। শ্বাসকষ্ট, পঙ্গু অবস্থা এবং অসহনীয় যন্ত্রণা থেকে মুক্তির পথ হিসেবে মৃত্যুকে বেছে নেন। আইন অনুযায়ী কয়েক ধাপ প্রক্রিয়া ও চিকিৎসকের অনুমোদনের পর তিনি সম্মানের সঙ্গে মৃত্যুবরণ করেন।

আইন কী বলে?

অধিকাংশ দেশেই স্বেচ্ছামৃত্যু এবং অ্যাসিস্টেড সুইসাইড আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়। এটিকে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দান বা হত্যা হিসেবে গণ্য করা হয়। তবে যেসব দেশে এর বৈধতা রয়েছে, সেখানে সুনির্দিষ্ট আইন ও নীতিমালা আছে, যা এই প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে।

বাংলাদেশের দণ্ডবিধি অনুযায়ী, আত্মহত্যা করা বা আত্মহত্যায় সহায়তা করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। ফলে স্বেচ্ছামৃত্যু এই সমাজে বৈধ নয়। চিকিৎসক যদি রোগীর জীবন সংক্ষিপ্ত করতে কোনো ব্যবস্থা নেন, তবে সেটিকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়।

স্বেচ্ছামৃত্যুর প্রক্রিয়ায় আছে প্রাণীরাও

হংকংয়ের একটি বিনোদন পার্কের চিড়িয়াখানায় ২০২২ সালের ২১ জুলাই মারা যায় অ্যান অ্যান নামের ৩৫ বছর বয়সী এক পান্ডা। পান্ডাটিকে ইউথেনাইজ করা হয়। ‘শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায়’ এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল বলে জানায় কর্তৃপক্ষ। স্বেচ্ছামৃত্যু এখন কেবল চিকিৎসা বা আইন নয়, একটি মানবাধিকার বিষয়ও। যন্ত্রণামুক্ত মৃত্যুর অধিকার কি একজন মানুষের থাকা উচিত-এ প্রশ্ন নিয়েই এগোচ্ছে বহু দেশের বিতর্ক। তবে বিষয়টির সঙ্গে যুক্ত আইনি, সামাজিক, ধর্মীয় ও নৈতিকতার নানা স্তর। ফলে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে প্রয়োজন সুস্পষ্ট আইন, কঠোর মানদণ্ড ও সামাজিক প্রস্তুতি।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫