
ভাষা হলো মানুষের যোগাযোগের মাধ্যম, যা মুখের বা লিখিত উভয়ই হতে পারে। ভাষা কখন, কীভাবে ব্যবহৃত হবে, সেটা কাজের ওপর নির্ভর করে। যেমন পেশার ভাষা- এটা শুধু একই পেশার মানুষই বোঝে। আবার অপরাধীদের ভাষায়ও আছে ভিন্নতা, যেটা অপরাধীরাই বোঝে। এভাবে বিভিন্ন পেশাজীবী ও সামাজিকভাবে যারা নিম্নবর্গের, তাদেরও ভাষা আছে। সেসব ভাষার ভিন্ন বর্ণ বা ব্যাকরণ নেই। কিন্তু যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে তার বিকল্প নেই। একইভাবে আমরা প্রাত্যহিক নাগরিক জীবনে পাবলিক পরিবহনের মুখোমুখি হই ভিন্ন রকমের ভাষার। এই ভাষার অর্থ সবাই জানেও না বোঝেও না, আবার খেয়ালও যে সবাই করে তা নয়। তার মধ্যেই বাসের হেলপাররা বলে যায় তাদের সাংকেতিক ভাষা। হেলপারদের ব্যবহৃত এই সাংকেতিক ভাষা বলতে মূলত যাত্রী ও পরিস্থিতি সম্পর্কে একে অপরকে দ্রুত তথ্য আদান-প্রদানে ব্যবহৃত কিছু শব্দ বা বাক্যকে বোঝায়। এই ভাষা ব্যবহার করে তারা যাত্রী সংখ্যা, রাস্তাঘাটের অবস্থা, পুলিশের উপস্থিতি এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয় সম্পর্কে সংকেত দেয়।
দিনে দিনে ঢাকার রাস্তায় গাড়ি বেড়েই চলেছে। ব্যস্ত সড়কে গাড়ি চালাতে বাসের চালক ও হেলপারকে চোখ-কান খোলা রাখতে হয় আগের তুলনায় অনেক বেশি। কারণ সামনে রিকশা, বাঁয়ে প্রাইভেট কার, পেছনে পিক আপ, মোড়ে সার্জেন্ট। ভেতরে যাত্রীরাও উত্তেজিত। দুই মিনিট পরপরই ঝগড়া লেগে যাচ্ছে ভাড়া নিয়ে, কখনোবা একটি গাড়িকে আরেকটি গাড়ি দ্রুত অতিক্রম করল কীভাবে? এই ঝগড়াকে সাংকেতিক ভাষায় বলে ‘খ্যাচ’। ‘বাঁয়ে প্লাস্টিক, সামনে পোকা’- প্রাইভেট কার বলতে যে সময় লাগে এ জন্য প্লাস্টিক বললেই ড্রাইভার বুঝে নেন। ড্রাইভার হারিস এ প্রসঙ্গে বলেন, প্রাইভেট কার যতই সুন্দর দেখাক, বাসের ধাক্কা খেলে ভেঙেচুড়ে প্লাস্টিকের মতো চ্যাপ্টা হয়ে যায়। এ জন্যই প্রাইভেট কারকে প্লাস্টিক বলে। সড়কে পোকার মতো মানুষের ভিড় বলে মানুষকে বলা হয় পোকা। বাসের পেছনে বাস থাকলে হেলপার সিগন্যাল দেয় ড্রাইভারকে- পেছনে নাম্বার। কিন্তু নাম্বার গাড়ির সাংকেতিক নাম হলো কেন জিজ্ঞেস করলে ড্রাইভার আবু মুসা জানান, গাড়ির পেছনে নেমপ্লেটে নম্বর লেখা থাকে, এ জন্য বাস, পিকআপ না বলে নাম্বার বলা হয়।
বাসের হেলপার আবিদের মতে, এক ট্রিপে অন্তত ৬০০ মানুষের সঙ্গে কথা বলতে হয়।
বাসের পেছনের গাড়িটিও সামনেরটিকে অতিক্রম করার সুযোগ কোনোভাবেই ছাড়তে চায় না। কারণ যে আগে যাবে সে-ই সামনের স্ট্যান্ডের যাত্রী তুলে নিতে পারবে। এই প্রতিযোগিতা করার প্রক্রিয়াটিকে হেলপাররা সাংকেতিক ভাষায় বলে ‘কাপঝাঁপ’। দক্ষ হেলপারকে বলে ‘কড়কড়া হেলপার’। একজন কড়কড়া হেলপার থাকলে ড্রাইভারের যত শান্তি। কড়কড়া হেলপার গাড়ি চালাতেও পারে, ভাড়া উঠানো, সিগন্যাল দেওয়া, প্রয়োজনে সিগারেট ধরিয়ে এনে মুখে পুরে দেওয়া সবই পারে। ‘টিপ’ ও ‘ডবল’ দুটি সাংকেতিক ভাষা। ‘টিপ’ মানে ছোটখাটো পরিবহন। যেমন রিকশা, মোটরসাইকেল, ইজি বাইক, ঠেলাগাড়ি ইত্যাদি। আর ‘ডবল’ মানে একাধিক প্রাইভেট কার।
তবে শুধু মোটরসাইকেলকে ‘ব্রয়লার’ বলে। চালক হারিছ জানান, ভিড়ের মধ্যে এগুলো ব্রয়লার মুরগির মতো পথ চলতে থাকে। অটোরিকশাকে বলে ইঁদুর। কারণ এগুলো কিছু বোঝার আগেই ইঁদুরের মতো চলে, আবার কখনো বড় গাড়ির নিচে ইঁদুরের মতো ঢুকে যায়। এ জন্য এগুলোকে ইঁদুর বলে। ‘সামনে ভিড়’ বা ‘রাস্তা বন্ধ’ এই সংকেত দিয়ে তারা সামনের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানায়, যাতে বাসচালক সতর্ক হতে পারেন। ‘ডান দিকে মোড়’ বা ‘বাম দিকে মোড়’ গতির সঙ্গে সঙ্গে এ ধরনের সংকেত ব্যবহার করা হয়। ‘যাত্রী উঠছে’ বা ‘যাত্রী নামছে’ সাংকেতিকভাবে এটা ব্যবহার করা হয়। ‘পুলিশ আছে’-এই সংকেত ব্যবহার করে পুলিশের উপস্থিতি সম্পর্কে ড্রাইভারকে সতর্ক করা হয়।
এসব বিষয় জানতে বেশ কয়েকজন বাস হেলপারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় বাসের খুঁটিনাটি অনেক বিষয়। বাসের হেলপার আবিদের মতে, বাসের স্টাফদের এত ধৈর্যশীল হতে হয় যেটা চিন্তাও করা যায় না। মোহাম্মদপুর থেকে আব্দুল্লাহপুর ছয় ট্রিপ দিলে তার কমপক্ষে ৬০০ মানুষের সঙ্গে কথা বলতে হয়। এর মধ্যে অনেকেই হেলপার ও ড্রাইভারের সঙ্গে খালি খারাপ ব্যবহারই করে না, গায়েও হাত তোলে। কিন্তু বাস শ্রমিকরা বিতর্ক ছাড়া অন্য কিছুই করেন না।
বেশির ভাগ যাত্রীর ধারণা, বাসের স্টাফরা মানুষ ভালো না, তারা নিম্নশ্রেণির। গালি না দিলে তাদের সোজা রাখা যায় না। এ কারণে সমাজজীবন বলতে বাস শ্রমিকদের আর কিছু নেই। আর বন্ধু বলতে গাড়ির স্টাফরাই। কারণ দিনরাত তাদের সঙ্গেই কাটে। এই চালক জীবনে যে তারা একটা ভাষা তৈরি করেছে, এটা বললে তারা খুব আনন্দিত হয়। হেলপার নাফিস বলেন, ‘আমরা নতুন করে কিছু করিনি, বেশ আগে থেকেই এটা প্রচলিত। তবে ড্রাইভার গাড়ি চালান সামনের দিকে দৃষ্টি দিয়ে। তার দুই পাশে কী আছে এটা জানান হেলপার। দ্রুত গতিতে বাস চলে, এই দ্রুত গতির ভেতরে সংক্ষেপে ড্রাইভারকে সব জানায় হেলপার।
ভাষার এই সংক্ষিপ্তকরণের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে বাসের হেলপারদের সাংকেতিক ভাষা। বেদেরা যেমন পুলিশ দেখলে একজন আরেকজনকে সতর্ক করতে বলে ‘শাট’ বলে, মানে বিশেষ ধরনের জামা। আবার ব্রিটিশ আমলে মাথায় ক্যাপ বা ঠুলি পড়ত বলে বলা হতো ‘ঠোলা’। এভাবে পেশায় সাংকেতিক ভাষা পেশার উৎকর্ষ সাধন করেছে। বাসচালকদের এই সাংকেতিক ভাষার ওপর ভাষাবিজ্ঞানের দৃষ্টি না পড়লেও একটি বড় গাড়ি সড়কে নির্ঝঞ্ঝাটে চালানোর জন্য এই সাংকেতিক ভাষার বিকল্প নেই। তাই এগুলোকে ছোট করে দেখার কোনো অবকাশ নেই।
তবে ভাষা যেমন পরিবর্তনশীল, হেলপারদের ভাষাতেও পরিবর্তনের ছাঁট আছে। হেলপার নবীন এ প্রসঙ্গে বলেন, আগে মেয়েদের নামানো বা ওঠানোর সময় বলা হতো ‘লেডিছ’। কিংবা লেডিছ উঠবে বা নামবে, এখন বলা হয় মহিলা উঠবে বা নামবে। এভাবে আরো অনেক ভাষা ঢুকবে ও পরিবর্তন হবে। এ কারণে স্বশিক্ষিত মানুষের এই সাংকেতিক ভাষাও সংরক্ষণ করা উচিত।