Logo
×

Follow Us

ফিচার

কবি চন্দ্রাবতীর স্মৃতিচিহ্ন

Icon

সঞ্জয় সরকার

প্রকাশ: ২৩ জুন ২০২৫, ১১:০২

কবি চন্দ্রাবতীর স্মৃতিচিহ্ন

বাংলা সাহিত্যের প্রথম নারী কবি চন্দ্রাবতী। কৃষিভিত্তিক সমাজের নিম্নবর্গীয় প্রান্তিকতাকে ভেদ করে উঠে আসা এক বিদূষী নারী, যার সাড়ে চার শতাধিক বছর আগের রচনা-নিদর্শন আজও বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ হয়ে আছে। শুধু তাই-ই না, চন্দ্রাবতীর জীবনকাহিনি নিয়ে রচিত প্রণয়োপাখ্যানও বাংলা সাহিত্যের আরেক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, যা আজও মানুষের মুখে মুখে ফেরে। চন্দ্রাবতীর উল্লেখযোগ্য পালাকাব্যগুলো হচ্ছে ‘দস্যু কেনারামের পালা’ ও ‘মলুয়া’। দুটিই ড. দীনেশ চন্দ্র সেন সম্পাদিত ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’য় স্থান পেয়েছে। আবার একই গীতিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে তার জীবনকাহিনি নিয়ে নয়নচাঁদ ঘোষ প্রণীত ‘চন্দ্রাবতী’ পালাটিও। আর চন্দ্রাবতীর অসমাপ্ত পালাকাব্য ‘রামায়ণ’ প্রকাশিত হয়েছে ‘পূর্ববঙ্গ গীতিকা’য়। কাজেই বাংলার লোকমানসে অত্যন্ত সমুজ্জ্বল একটি নাম ‘চন্দ্রাবতী’। কিশোরগঞ্জ সদরের পাতুয়াইর গ্রামে অবস্থিত পূর্ব পুরুষের ভিটাবাড়ি, শিবমন্দির ও মনসামন্দির আজও চন্দ্রাবতীর স্মৃতির স্বাক্ষর বহন করছে, প্রতিদিন যা দেখতে যাচ্ছে দূর-দূরান্তের বহু মানুষ।

চন্দ্রাবতীর বংশপরিচয় : ফুলেশ্বরী নদীর পারে অবস্থিত পাতুয়াইর গ্রামের দ্বিজবংশী দাস ভট্টাচার্য ও সুলোচনা দাস ভট্টাচার্যের (অঞ্জনা) কন্যা ছিলেন চন্দ্রাবতী। আনুমানিক ১৫৫০ খ্রিষ্টাব্দে তার জন্ম। দ্বিজবংশী ছিলেন মনসার ভাসান রচয়িতা। অসমাপ্ত কাব্য ‘রামায়ণ’ এর ভূমিকায় চন্দ্রাবতী তার নিজ পরিচয় দেন এভাবেÑ‘ধারাস্রোতে ফুলেশ্বরী নদী বহি যায়/ বসতি যাদবানন্দ করেন 

তথায়/ ভট্টাচার্য বংশে জন্ম অঞ্জনা ঘরণী/ বাঁশের পাল্লায় তাল-পাতার ছাউনী’। কৈশোরকাল থেকেই চন্দ্রাবতী ছিলেন সাহিত্যানুরাগী। পিতা দ্বিজবংশী দাশের ‘মনসামঙ্গল’ রচনায় তার প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ছিল।

চন্দ্রাবতী-জয়নানন্দ প্রণয়োপাখ্যান : নয়ানচাঁদ ঘোষের ‘চন্দ্রাবতী’ পালাকাব্যে জানা যায়, চন্দ্রাবতীর জীবন-ইতিহাস ছিল অত্যন্ত বিয়োগান্তক ও করুণ। তার রূপে-গুণে মুগ্ধ অনেক সম্ভ্রান্ত পরিবারের যুবক তার পানিপ্রার্থী ছিলেন। কিন্তু চন্দ্রাবতীর হৃদয়ের গহিনে ঠাঁই করে নিয়েছিলেন তার শৈশবের খেলার সাথি ও সহপাঠী সুন্ধা গ্রামের ব্রাহ্মণ যুবক জয়ানন্দ। কৈশোর পেরোনোর পর তারা প্রণয়ে আবদ্ধ হন। 

চন্দ্রাবতী কাব্যের বর্ণনা : ‘ডাল যে নোয়াইয়া ধরে জয়ানন্দ সাথি/ তুলিল মালতী ফুল কন্যা চন্দ্রাবতী/ একদিন তুলি ফুল মালা গাঁথি তায়/ সেই না মালা দিয়া নাগরে সাজায়।’ চন্দ্রাবতী-জয়ানন্দের প্রেমকাহিনি জানার পর দ্বিজবংশী দাস সানন্দচিত্তে তাদের বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করেন। আর তখনই ঘটে মর্মস্পর্শী ঘটনা, যা চন্দ্রাবতীর জীবনের গতিপথ পাল্টে দেয়। চন্দ্রাবতীর সঙ্গে সম্পর্ক থাকার পরও বিশ্বাসঘাতক জয়ানন্দ কমলা নামের এক মুসলিম নারীকে ভালোবেসে বিয়ে করে ধর্মান্তরিত হন। অভিমানিনী চন্দ্রাবতী এ বিয়োগব্যথা সইতে না পেরে মুষড়ে পড়েন। আর কোনো দিন বিয়ে করা হয়নি তার। শিবপূজায় মন দিয়ে শুদ্ধাচারিণীরূপে কাটিয়ে দেন জীবন। তার আগ্রহে ফুলেশ্বরী নদীর তীরে একটি শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করে দেন দ্বিজবংশী দাস। অর্থাৎ চন্দ্রাবতী যৌবনেই যোগিনী সাজেন। ত্যাগ করেন জগতের সব মোহমায়া। আশ্রিত হন শিবমন্দিরে। মন নিবিষ্ট করেন কাব্য রচনায়। এদিকে দিনে দিনে অন্তর্দহনে দগ্ধ হতে থাকেন জয়ানন্দ। এক সন্ধ্যায় দেখা করতে আসেন চন্দ্রাবতীর সঙ্গে। কিন্তু অভিমানী চন্দ্রাবতী মন্দিরের কপাট এঁটে দেন। বাইরে দাঁড়িয়ে শত অনুনয়েও যখন ব্যর্থ, তখন মন্দিরের বেদিতে মালতী ফুলের রস দিয়ে চারছত্রের পদ্য লিখে ফুলেশ্বরীর জলে ঝাঁপ দেন জয়ানন্দÑ‘শৈশবকালের সঙ্গী তুমি যৈবনকালের সাথি/ অপরাধ ক্ষমা করো তুমি চন্দ্রাবতী/ পাপিষ্ঠ জানিয়া মোরে না হইলা সম্মত/ বিদায় মাগি চন্দ্রাবতী জনমের মতো।’ দীর্ঘক্ষণ পরে কপাট খুললে জয়নান্দের পদ্যটি চোখে পড়ে চন্দ্রাবতীর। পরক্ষণে ভাবেন, জয়ানন্দের স্পর্শে দেবালয়ের বেদি অপবিত্র হয়েছে। তা ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করতে কলসি কাঁকে জল আনতে যান ফুলেশ্বরীর ঘাটে। কিন্তু গিয়ে দেখেন, তার পরাণসখা জয়ানন্দের মরদেহ জলে ভাসছে। তা দেখে চন্দ্রাবতী নিজেও নিজ নিয়ন্ত্রণ হারান। জয়ানন্দকে দেখা না দেওয়ার অনুশোচনা আর অন্তঃকষ্টে অনুতপ্ত হন। আর সে আক্ষেপে ফুলেশ্বরীর জলে প্রাণ বিসর্জন দিয়ে নিজেও অনুগামী হন জয়ানন্দের। আবার কারো কারো মতে, জয়ানন্দের মৃত্যুর কিছুদিন পর অনুতপ্ত চন্দ্রাবতী স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেন।

চন্দ্রাবতীর স্মৃতিচিহ্ন : ফুলেশ্বরী নদী এখন নিশ্চিহ্ন। কিন্তু চন্দ্রাবতীর শিবমন্দিরটি সেই অমর ট্র্যাজেডিকে ধারণ করে আজও ঠায় দাঁড়িয়ে। আট কোনাকৃতির ১১ ফুট উঁচু মন্দিরটির কারুকার্য  নান্দনিক। তিনটি ধাপে ঊর্ধ্বগামী হয়ে সূচাগ্র শিখরে শেষ হয়েছে। কলস-আকৃতির চূড়ার শেষ প্রান্তে রয়েছে খাঁজকাটা কারুকাজ। আর তার শীর্ষে ‘ফাইনিয়েল’। প্রতিটি ধাপের চারপাশে রয়েছে প্রায় অর্ধ-বৃত্তাকার খিলান। ধাপের কার্নিশগুলো পদ্ম-পাপড়িতে আবৃত। নিচের ধাপটি এক দরজা ও এক কক্ষবিশিষ্ট। তার ভেতরে আছে ৫২ সেমি প্রশস্ত এবং ৯৯ সেমি দীর্ঘ সাতটি কুলঙ্গি। স্থানীয়রা এখনো মন্দিরটিতে পূজা দেয়। তারা জানায়, আগে একটি কষ্টিপাথরের শিবমূর্তি ছিল, তা চুরি হয়ে গেছে। শিবমন্দিরের পাশেই রয়েছে আরেকটি মনসামন্দির। সেটিরও নির্মাতা দ্বিজবংশী দাস। দুটি মন্দিরই এখন প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধীন। স্থানীয় প্রশাসন সেখানে নির্মাণ করেছে ‘চন্দ্রাবতী মঞ্চ’। মন্দিরের আরেক পাশে ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ‘চন্দ্রাবতী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’। চন্দ্রাবতীর পূর্ব পুরুষের দালান বাড়িটিও মন্দিরের খুব কাছাকাছি। তবে অযত্ন-অবহেলায় তা আজ ধ্বংসের পথে।মথ্যাচার উন্মুক্ত

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫