
বর্ষাকাল এসে গেছে। তবে বাংলাদেশে বৃষ্টি শুরু হয়েছে গ্রীষ্মেই। প্রতিবেশী ভারতের পরিস্থিতি আরো জটিল। দিন কয়েক আগে আসামে তো রেকর্ড বৃষ্টিই হয়ে গেল। অর্থাৎ বর্ষাকাল শুরুর আগেই বর্ষা শুরু হয়ে গিয়েছিল। এখন নিশ্চয় আপনার জানতে ইচ্ছা করছে পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয় এমন জায়গা কোনগুলো? তেমনি মনে হয়তো এ প্রশ্নও জাগছে, আমাদের দেশের কোনো শহর কি লিস্টিতে আছে?
সত্যিই পৃথিবীর বুকে এমন কিছু স্থান রয়েছে, যেখানে বৃষ্টি যেন প্রতিদিনের সঙ্গী। এ স্থানগুলো শুধু বিপুল বৃষ্টিপাতের জন্য বিখ্যাত নয়, বরং প্রতিটিই একটি করে গল্প প্রকৃতির অপার রহস্যের।
১. মৌসিনরাম, মেঘালয়, ভারত
প্রতিটি ভোর এখানে শুরু হয় বৃষ্টির শব্দে। মেঘালয়ের খাসি পাহাড়ের কোলে মৌসিনরাম যেন মেঘেদের বাড়ি। প্রতি বছর এখানে ১১ হাজার ৮৭১ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টি হয়। বর্ষায় ছোট্ট ওই শহরটিতে গেলে আশ্চর্য একটি বিষয় খেয়াল করবেন, গ্রামের মানুষ ছাতার বদলে বাঁশের তৈরি ‘কনাপ’ নামের ছাউনি ব্যবহার করে। গোটা শরীর ঢেকে দেওয়া এই ছাউনিগুলো দেখতেও বেশ। এ এলাকার রাস্তায় শুকনো কাপড় পরে থাকা মানুষ পাওয়াটাও খুব কঠিন।
২. চেরাপুঞ্জি (সোহরা), মেঘালয়, ভারত
একটা সময় সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাতের রেকর্ড ছিল ভারতেরই আরেক শহর চেরাপুঞ্জিতে। তবে এখন সে মৌসিনরামের কাছে মুকুট হারিয়েছে। চেরাপুঞ্জির বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ১১ হাজার ৭৭৭ মিলিমিটার। পৃথিবীর প্রাচীনতম রেকর্ডধারী বৃষ্টিপাতের স্থান, চেরাপুঞ্জি এখানে ১৮৬১ সালে ২৬ হাজার ৪৭১ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছিল।
এ শহরে পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ ধরে হাঁটলে মনে হয়, আকাশ কেঁদে চলেছে বিরামহীন। এখানকার মেঘ ও কুয়াশা যেন মাটির এতটাই কাছে, হাত বাড়ালেই ধরা যায়। চেরাপুঞ্জির মানুষ জীবন্ত গাছের শিকড় দিয়ে তৈরি করে ‘লিভিং রুট ব্রিজ’ জীবনের সঙ্গে প্রকৃতির সংলগ্নতা এখানে ছন্দ হয়ে ঝরে পড়ে প্রতিটি বৃষ্টির ফোঁটায়।
৩. তুতুনেন্দো, চোকো, কলম্বিয়া
দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিম প্রান্তে ছোট্ট শহর তুতুনেন্দো, যেখানে বৃষ্টি যেন প্রায় প্রতিদিনই তৈরি করে একটি জলছবি। ১১ হাজার ৭৭০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টি হয় প্রতিবছর! এখানে রোদ একদিনের অতিথি, আর বৃষ্টি চিরকালের বাসিন্দা। শিশুরা স্কুলে যায় কাদা মেখে, বৃষ্টি মাথায় নিয়ে, আর নদীগুলোর বুক ফেটে যেন বেরিয়ে আসে গান।
তুতুনেন্দোর মানুষ বৃষ্টিকে জীবনের অংশ মনে করে। এদের বিশ্বাস, বৃষ্টি শুধু পরিবেশ সৃষ্টির বাহক নয়, এটি তাদের সংস্কৃতিরও অবিচ্ছেদ্য অংশ। স্থানীয়রা বিশেষ করে কৃষিকাজে সাহায্য পায় এই বর্ষণ থেকে, তবে অতিরিক্ত বৃষ্টিতে মাটির ক্ষয়ও শুরু হয়েছে, যা জীববৈচিত্র্যকে হুমকির মুখে ফেলেছে।
৪. ক্রপ রিভার, নিউজিল্যান্ড
মাত্র ৯ কিলোমিটার দীর্ঘ এই নদীর পারে দাঁড়ালে মনে হয়, মেঘেরা এখানে নিজের দেহ মেলে দিয়েছে। বছরে ১১ হাজার ৫১৬ মিলিমিটার বৃষ্টি পড়ে এ এলাকায়। নিউজিল্যান্ডের সাউথ আইল্যান্ডের এ জায়গা যেন পৃথিবীর এক গোপন জলধারা। প্রতি ফোঁটা বৃষ্টি এখানে শান্ত অরণ্যে গাছেদের কানে ফিসফিসিয়ে বলে গল্প।
৫. সান আন্তোনিও দে উরেকা, ইকুয়েটোরিয়াল গিনি
আফ্রিকার গভীর গহ্বরে, বায়োকো দ্বীপে অবস্থিত এই গ্রাম যেন বৃষ্টির কণ্ঠস্বরে ঘুমিয়ে পড়ে, আবার তাতেই জেগে ওঠে। প্রতি বছর ১০ হাজার ৪৫০ মিলিমিটারের মতো বৃষ্টি হয় এখানে। গাছেরা সবুজ নয়, যেন পানির রঙে ধুয়ে রাখা। শিশুরা খেলে কাদায়, নারী-পুরুষ হাঁটে ছাতা ছাড়াই।
এখানকার প্রচণ্ড বৃষ্টিপাত এবং উষ্ণ আবহাওয়া কেবল পরিবেশের ভিন্নতা নয়, স্থানীয় মানুষের জীবনে এক বিশাল পার্থক্য তৈরি করেছে। আফ্রো-কলম্বিয়ান জনগণের জীবনধারা বৃষ্টির সঙ্গে সম্পৃক্ত, যেখানে তারা প্রকৃতিকে নিজের জীবনের অংশ হিসেবে বিবেচনা করে।
৬. দেবুন্দসচা, ক্যামেরুন
মাউন্ট ক্যামেরুনের পাদদেশে অবস্থিত এই ঘন সবুজ গ্রামটি রোমাঞ্চিত করবে যেকোনো প্রকৃতিপ্রেমীকে। প্রতি বছর ১০ হাজার ২৯৯ মিলিমিটার বৃষ্টি পড়ে এ অঞ্চলে। মেঘের ঘনঘটা আর বজ্রের গর্জন দেবুন্দসচার প্রতিদিনকার সংগীত। এখানে প্রতিটি গাছ যেন একটি বৃষ্টিস্নাত শিলালিপি, যেখানে প্রকৃতি নিজের গল্প লিখে যায়।
জায়গাটির মাটি অত্যন্ত উর্বর, তবে অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে বনাঞ্চল ও জীববৈচিত্র্যের হুমকির মুখে পড়েছে।
৭. বিগ বগ, মাউই, হাওয়াই, যুক্তরাষ্ট্র
মাউই দ্বীপের হৃদয়ে অবস্থিত বিগ বগের বাসিন্দাদের সবচেয়ে পরিচিত দৃশ্যগুলোর একটি অঝোরে বারি পতন। বার্ষিক প্রায় ১০ হাজার ২৭২ মিলিমিটার বৃষ্টি এখানে ঝরে পড়ে, ছুঁয়ে যায় মাটি ও মানুষের মন। আকাশে যখন রংধনু ফুটে, তখনো মাটি ভেজা। হাওয়াইয়ান পৌরাণিক গল্পের দেবতারা যেন এখনো বৃষ্টির ফোঁটায় নৃত্য করে ছোট্ট জনবসতিটিতে।
৮. মাউন্ট ওয়াইআলেআলে, কাউয়াই, হাওয়াই
‘জল যেখানে জন্ম নেয়’-এ কথাটি যেন এই পর্বতের জন্যই বলা। প্রতি বছর এখানে ৯,৭৬৩ মিমি বৃষ্টি পড়ে। হাওয়াই দ্বীপের এই শীর্ষ স্থানটি কুয়াশা, ধোঁয়া ও জলের ধ্বনিতে মোড়া। পাখিরা এখানে ভেজা ডানায় গান গায়, আর ঝরনারা মাটির বুকজুড়ে আঁকেন শিল্প।
৯. কুকুই, মাউই, হাওয়াই, যুক্তরাষ্ট্র
পু’উ কুকুই মানে হাওয়াইয়ান ভাষায় ‘আলোক শিখা’ কিন্তু এই শিখা যেন বার্ষিক ৯ হাজার ২৯৩ মিলিমিটার বৃষ্টিতে প্রতিনিয়ত জ্বলছে ভেজা শিখার মতো। এটি এক প্রাচীন আগ্নেয়গিরি, যার গায়ে মেঘের কোমল ছোঁয়া, আর বৃষ্টির ধারায় গভীর নৈঃশব্দ্য।
কুকুই এলাকার পরিবেশ এতটাই ভেজা, যে এখানে স্থানীয় জীববৈচিত্র্য একমাত্র এই পরিবেশে টিকে থাকতে পারে।
১০. এমেই শান, সিচুয়ান, চীন
চীনের অন্যতম পবিত্র পর্বত এমেই শান যেন প্রকৃতির এক ধ্যানমগ্ন সাধক। বছরে আট হাজার ১৬৯ মিলিমিটার বৃষ্টি এখানে পড়ে, মেঘ ঢেকে রাখে পর্বতের চূড়া। সূর্য দেখা যায় খুব কমই। তবে কুয়াশা ও জলের চাদরে মোড়া এই পাহাড় আশ্চর্য প্রশান্তি এনে দেবে শরীর-মনে।
এই স্থানগুলোর প্রতিটিই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এবং বৃষ্টির কারণে জন্ম নেওয়া অনন্য পরিবেশের জন্য বিখ্যাত। তবে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত কখনো কখনো স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়েও দেখা দেয়। তবুও এই স্থানগুলোকে আমাদের প্রকৃতির বৈচিত্র্য এবং অপার রহস্যের চমৎকার উদাহরণ হিসেবেই দেখতে পারি।
সূত্র : উইকিপিডিয়া, জেএমই সায়েন্স, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, ওয়ার্ল্ড মেটেওরলজিক্যাল অর্গানাইজেশন, অ্যাকু ওয়েদার, ইন্ডিয়া মেটেওরলজিক্যাল ডিপার্টমেন্ট, নোয়া ক্লাইমেপ ডাটা রেকর্ড