
খাবার কেবল শরীর নয়, প্রভাব ফেলে মেজাজ, আবেগ আর মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও। এক কাপ চা কিংবা গরম গরম খিচুড়ি খাওয়ার পর কীভাবে যেন মন ভালো হয়ে যায়, তাই না? আবার দিনের পর দিন ঝাল-তেল-মসলা দেওয়া খাবার খেলে শরীর যেমন ক্লান্ত হয়ে পড়ে, তেমন মনেও জমে খিটখিটে ভাব। বিষণ্নতাও বাড়ে। খাবারের সঙ্গে শরীরের সম্পর্ক নিয়ে যতটা সচেতন, মনের সঙ্গে তার সম্পর্কটা নিয়ে কিন্তু ততটা ভাবি না। অথচ আধুনিক গবেষণা বলছে, কী খাচ্ছি, কবে খাচ্ছি আর কীভাবে খাচ্ছি-সবই মনের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে।
মেজাজ বদলের নেপথ্যে কী আছে?
মেজাজ মানে শুধু ‘ভালো’ বা ‘খারাপ’ লাগা নয়-এর পেছনে কাজ করে নিউরোট্রান্সমিটার নামের রাসায়নিক বার্তাবাহক, যেমন-ডোপামিন, সেরোটোনিন ও নোরেপিনেফ্রিন। এসব হরমোন সরাসরি আনন্দ, দুশ্চিন্তা, ঘুম, মনোযোগ ও আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে। মজার বিষয় হলো, এই রাসায়নিক বার্তাবাহকদের উৎপাদনে খাদ্য উপাদানের বড় ভূমিকা রয়েছে। যেমন-সেরোটোনিন; এটি মূলত ‘ফিল গুড’ হরমোন। অনেকেই জানে না, আমাদের দেহের প্রায় ৯০ শতাংশ সেরোটোনিন তৈরি হয় অন্ত্রে-মানে পেটের ভেতর! তাই বলা হয়, আমাদের গাট বা অন্ত্র হচ্ছে ‘দ্বিতীয় মস্তিষ্ক’। অর্থাৎ আপনি কী খাচ্ছেন, সেটাই ঠিক করে দিচ্ছে আপনি কেমন অনুভব করবেন।
যে খাবার মন ভালো রাখে
ডার্ক চকলেট : মনে আনন্দ জাগায় এমন হরমোন নিঃসরণে সাহায্য করে। তবে অবশ্যই পরিমাণে খেতে হবে, নয়তো রক্তচাপ বাড়তে পারে।
শাক-সবজি ও ফলমূল : ব্রকোলি, পালং, কলা, আপেল, বেরিÑএসব খাবারে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, ম্যাগনেসিয়াম ও ভিটামিন বি থাকে, যেগুলো স্ট্রেস কমায় এবং স্নায়ু শান্ত রাখতে সহায়তা করে।
কমপ্লেক্স কার্বোহাইড্রেট : চাল, আলু, ওটস, শিমের দানা ইত্যাদি সেরোটোনিন বাড়াতে সাহায্য করে। তাই কার্বোহাইড্রেটকে ভয় না পেয়ে বরং স্মার্টভাবে বেছে নেওয়া উচিত।
মনের শত্রু যে খাবারগুলো
সব খাবারই মন ভালো করে না। কিছু খাবার আছে, যেগুলো নিয়মিত খেলে মেজাজ খারাপ হতে থাকে, ঘুমের সমস্যা হয়, মনোযোগ কমে যায়।
প্রসেসড ও জাঙ্ক ফুড : ফাস্টফুডে থাকা ট্রান্স ফ্যাট, অতিরিক্ত চিনি ও সোডিয়াম দেহে ইনফ্ল্যামেশন তৈরি করে, যা মানসিক উদ্বেগের এক বড় কারণ। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব মানুষ বেশি জাঙ্ক ফুড খায়, তাদের মধ্যে বিষণ্নতার প্রবণতা বেশি।
সফট ড্রিঙ্কস ও বেশি চিনি : তাৎক্ষণিকভাবে এনার্জি দিলেও পরে তা কমে যায়, যার ফলে মন খারাপ হয়, বিরক্ত লাগে। এমনকি মুড সুইংও দেখা দেয়।
অতিরিক্ত ক্যাফেইন : এক-দুই কাপ কফি বা চা ভালো হলেও অতিরিক্ত ক্যাফেইন উদ্বেগ বাড়ায়, ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়।
খাদ্যাভ্যাস ও মানসিক স্বাস্থ্য
সুস্থ মানসিক অবস্থার জন্য শুধু খাবার নয়, খাবার গ্রহণের ধরনও গুরুত্বপূর্ণ।
সময়মতো খাওয়া : খাবার না খেয়ে লম্বা সময় অতিক্রম করলে ব্লাড সুগার কমে যায়, যা মেজাজ খারাপ করে দেয়।
পানি পান : হাইড্রেশনের অভাবে ক্লান্তি, বিভ্রান্তি ও মেজাজের ওঠানামা হয়।
মনোযোগ দিয়ে খাওয়া : ফোন বা টিভি না দেখে খেলে খাবারের স্বাদ ও সন্তুষ্টি দুই-ই বাড়ে।
পেট ও মন-এই সম্পর্কের গভীরতা
গবেষণা বলছে, অন্ত্র ও মস্তিষ্কের মধ্যে সরাসরি সংযোগ রয়েছে, যাকে বলা হয় গাট ব্রেইন এক্সিস। অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়া মস্তিষ্কে সংকেত পাঠাতে পারে। তাই স্বাস্থ্যকর অন্ত্র মানে সুস্থ মেজাজ। এই ব্যাকটেরিয়ার ভারসাম্য রক্ষায় প্রোবায়োটিক খাবার যেমন দই, ঘোল, কিমচি ও ফার্মেন্টেড খাবার অত্যন্ত উপকারী।
মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসায় খাবার একটি টুল
লাইফস্প্রিংয়ের পুষ্টিবিদ নিগার সুলতানা বলেন, বিষণ্নতা বা উদ্বেগের চিকিৎসায় শুধু ওষুধ নয়, খাদ্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম; যাকে বলে নিউট্রিশন সাইক্রাইট্রি। যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভাড মেডিক্যাল স্কুল বা যুক্তরাজ্যের কিংস কলেজ লন্ডন দুই জায়গাতেই এই বিষয়ে গবেষণা হচ্ছে এবং চিকিৎসায় খাবার অন্তর্ভুক্ত করার প্রক্রিয়া চলছে। আমরা যা খাই, তা-ই হয়ে উঠি-এ কথার ভেতর গভীর সত্য লুকিয়ে আছে। খাবার কেবল পেট ভরানোর বিষয় নয়, এটা মন, আবেগ ও আচরণ নিয়ন্ত্রণেরও এক প্রভাবশালী হাতিয়ার। তাই মন খারাপ থাকলে কেবল কফি নয়, খাবার তালিকাটাও একটু চোখ বুলিয়ে নেওয়া দরকার!