
বেশির ভাগ কর্মজীবী নারীই অন্তর্দ্বন্দ্বে ভোগেন। দায়িত্ব-কর্তব্য আর নিরাপদ ভবিষ্যৎ নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা-এ দুটি বিষয়ের মধ্যে নিত্য চলে নারীর একাকী মানসিক যুদ্ধ। সাধারণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করা নারী যেমন ভুগছেন এই মানসিক দ্বন্দ্বে, উচ্চপদে কাজ করা নারীর বেলায়ও তা-ই। সাধারণভাবে নিজের জ্ঞান আর সামর্থ্যকে কাজে লাগিয়ে পুরুষ সঙ্গীটির সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একটি নিরাপদ ভবিষ্যৎ তৈরির জন্য কর্মক্ষেত্রে যোগ দেন নারী। কিন্তু একই সঙ্গে পরিবারের দায়িত্বে অবহেলা বা পরিবার-পরিজন থেকে দূরে সরে যাওয়ার ভয়ও চেপে ধরে তাকে। কখনো স্বেচ্ছায় আবার কখনো পরিবারের চাপে সরে আসতে হয় কর্মজীবন থেকে। অনেকেই আবার তার উজ্জ্বল ভবিষ্যতের হাতছানিকে উপেক্ষা করেছে পরিবারকে অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে।
গার্মেন্টসকর্মী শাহীনা বেগম, স্বামী রিকশা চালান। কিন্তু সারা দিনে যা আয়, তার বেশির ভাগই জুয়া খেলে নষ্ট করে, নেশাগ্রস্ত স্বামী প্রায়ই বাড়িতে এসে তাকে মারধর করত। গার্মেন্টসে কাজ করা নিয়ে নানা ধরনের অপবাদও দিত। হয় সংসার, নয়তো চাকরি-এমন সীমাও বেঁধে দিয়েছিল। একসময় সন্তানসম্ভবা শাহীনা দাম্পত্যজীবন বাঁচাতে আর অনাগত সন্তানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে ছেড়ে দেন গার্মেন্টসের কাজ। এখন অভাবের সংসারে কেমন আছেন শাহীনা, তার অনেকটাই আঁচ করা যায় তিন মাসের রুগ্ন সন্তানটির দিকে তাকিয়ে।
কদিন বাদেই প্রমোশনের কথা ছিল রুনার। এরই মধ্যে জানতে পারলেন তিনি অন্তঃসত্ত্বা। ব্যস, অনাগত সন্তানের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে পরিবার থেকে চাপ এলো-এ অবস্থায় রোজ অফিস যাওয়া মা আর সন্তান দুজনের জন্যই ঝুঁকিপূর্ণ। তাই ছাড়তে হবে চাকরি। নিজের ক্যারিয়ার বিসর্জন দিয়ে ফুটফুটে কন্যাসন্তানের মা হয়েছেন রুনা। এখন তিনি পুরোদস্তুর গৃহিণী। ‘ভেবেছিলাম মেয়ে একটু বড় হলে আবার কাজে ফিরে যাব। কিন্তু সন্তান দেখভাল আর তাকে রেখে যাওয়ার কথা চিন্তাই করা যায় না।’
কর্মজীবী নারীকে প্রতিনিয়ত অন্তর্দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। বারবার নিজের ধৈর্যের সর্বোচ্চ পরীক্ষা দিয়ে বেছে নিতে হয় পরিবার আর ক্যারিয়ারের মধ্যে যেকোনো একটি। যারা সবদিক সামলে দুটিকেই সমান গুরুত্ব দিয়ে এগিয়ে যান, মানসিকভাবে তারা কতখানি চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যান, সেটি কেবল ওই সব নারীই জানেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তাসনুভা জানান, পড়াশোনা করে একটি মেয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ালে সে কিন্তু তার পরিবারের জন্য একটি শক্ত খুঁটি হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপট মেয়েদের ঘরকন্নার কাজে মনোযোগী দেখতেই বেশি পছন্দ করে। আর যদি মেয়েটি সবদিক সামলে কাজ করতেও পারে, তখন সবাই তার পেছনের নারী স্বাধীনতার নেতিবাচক দিক খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। আর এসব দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগতে থাকা নারীর জন্য নিজের পেশাগত ক্ষেত্রে মনোযোগ দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।
নারীকে স্বাবলম্বী হতে হলে সবার আগে প্রয়োজন তার পারিবারিক সাপোর্ট। পরিবার যখন কর্মজীবী নারীর পাশে এসে দাঁড়াবে, তাকে মানসিক শক্তি জোগাবে, নির্ভরযোগ্য জায়গা হয়ে উঠবে, তখনই কেবল নারী তার দ্বিধা কাটিয়ে উঠে সামনে এগিয়ে যেতে পারবে।