Logo
×

Follow Us

ফিচার

‘জোনাকি হাতে যায় গোনা কি’

Icon

এহতেশাম শোভন

প্রকাশ: ২৮ জুন ২০২৫, ১৫:৪১

‘জোনাকি  হাতে যায়   গোনা কি’

জোনাকি, নামটি শুনলেই স্মৃতির পাতায় ভেসে ওঠে সন্ধ্যাবেলায় মিটিমিটি করে জ্বলতে থাকা অদ্ভুত এক আলোর পেছনে ছুটে বেড়ানো  শৈশব। হাতের মুঠোয় বন্দি করে অবাক হয়ে দেখা জোনাকির আলো। সেই সোনালি দিনগুলো এখন আর নেই। আজকাল মনে হয় সেই সময়গুলো যেন রূপকথার গল্পের মতো। কারণ আমাদের চারপাশ থেকে জোনাকিরা হারিয়ে যাচ্ছে। শৈশবের সেই আলোকিত সন্ধ্যাগুলো যেন ক্রমে ম্লান হয়ে আসছে। আধুনিক সভ্যতার কোলাহলে, কৃত্রিম আলোর শহরে, জোনাকির সেই আলোর ঝিলিক আজ প্রায় অতীত। কিন্তু কেন? কেনই বা এমন দ্রুত জোনাকির সংখ্যা কমছে?

জোনাকি পোকা এক ধরনের বায়োলুমিনেসেন্ট পতঙ্গ, যারা নিজেদের দেহ থেকে আলো ছড়াতে পারে। বৈজ্ঞানিকভাবে এরা মূলত খধসঢ়ুৎরফধব গোত্রের অন্তর্ভুক্ত। পৃথিবীতে প্রায় দুই হাজার প্রজাতির জোনাকি রয়েছে, তবে সব প্রজাতি আলো জ্বালে না। তবে জোনাকিদের শুধু প্রাপ্তবয়স্করাই নয়, এর লার্ভা এমনকি এর ডিমও আলো উৎপন্ন করতে সক্ষম।

জোনাকির আলো এক ধরনের রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফল, যাকে বলে বায়োলুমিনেসেন্স। এতে লুসিফেরিন নামের পদার্থের উপস্থিতিতে জোনাকির শরীর আলো ছড়ায়। এ আলোকে বলা হয় ‘কোল্ড লাইট’ বা শীতল আলো। কারণ জোনাকির আলোর পুরোটাই আলোকশক্তি; এতে কোনো তাপশক্তি নেই। যেখানে একটি ইনক্যানডেসেন্ট বাল্বে মাত্র ১০ শতাংশ এবং ফ্লুরোসেন্ট বাল্বে ৯০ শতাংশ আলোকশক্তি থাকে, সেখানে জোনাকির আলো শতভাগ আলোকশক্তি সম্পন্ন। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এটি পৃথিবীর সবচেয়ে কার্যকর আলোর উৎস। কিন্তু বর্তমানে পৃথিবীতে জোনাকির সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমে যাচ্ছে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকে প্রকাশিত বেলজিয়ামের গবেষক রাফায়েল দ্য ককের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘আমরা আগের তুলনায় এখন আর জোনাকি পোকা দেখি না, কারণ জোনাকির বিভিন্ন প্রজাতি সত্যিই বিলুপ্ত হতে শুরু করেছে। পৃথিবীর নানা প্রান্তে চালানো জরিপ ও গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, কিছু কিছু অঞ্চলে আগের তুলনায় জোনাকির সংখ্যা কমেছে প্রায় ৭০ শতাংশ পর্যন্ত।’

কেন হারিয়ে যাচ্ছে জোনাকি পোকা?

গবেষকরা এর পেছনের কারণ অনুসন্ধান করে বেশ কিছু বিষয় খুঁজে পেয়েছেন। ২০২০ সালে টাফটস বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানের অধ্যাপক সারা লুইসের নেতৃত্বে পরিচালিত একটি গবেষণায় বাসস্থান হারানো, আলোদূষণ এবং কীটনাশকের ব্যবহারকে জোনাকিদের সংখ্যা কমে যাওয়ার প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

কৃত্রিম আলোর দখলে প্রকৃতি

দোকানপাট, মোবাইল টাওয়ার, রাস্তার আলো, সব মিলিয়ে রাতের প্রকৃত অন্ধকার হারিয়ে যাচ্ছে। অধ্যাপক সারা লুইস ও তার দলের গবেষণায় দেখা গেছে, পৃথিবীর মোট স্থলভাগের ২৩ শতাংশেরও বেশি রাতের বেলায় কৃত্রিম আলোয় আলোকিত থাকে। এই কৃত্রিম আলো জোনাকিদের বংশবিস্তারে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। জোনাকিরা তাদের দেহের অভ্যন্তরে বায়োলুমিনেসেন্স নামক রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে আলো তৈরি করে, যা দিয়ে তারা সঙ্গীকে প্রজননে আকর্ষণ করে। কৃত্রিম আলো এই প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে। পুরুষ ও স্ত্রী উভয় জোনাকিই যোগাযোগের জন্য তাদের দেহের আলো ব্যবহার করে। তারা আলোর মাধ্যমেই পরস্পরের সঙ্গে কথা বলে, যৌন মিলনে আকৃষ্ট করে, বাসস্থান রক্ষা করে এবং শত্রুকে সতর্ক করে। অত্যাধিক কৃত্রিম আলোর ফলে জোনাকিদের এই স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডগুলো ব্যাহত হচ্ছে, যার ফলে জোনাকি অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে।  

বাসস্থান হারাচ্ছে জোনাকিরা

জোনাকি পোকা সাধারণত নাতিশীতোষ্ণ ও গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে বেশি দেখা যায়। তারা সবচেয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে আর্দ্র পরিবেশে, যেমনÑজলাভূমি, পুকুরপার, ভেজা বনভূমি, ঝোপঝাড়, পাতার নিচের স্যাঁতসেঁতে মাটি ইত্যাদি জায়গায়।

বেশির ভাগ জোনাকি প্রজাতি তাদের লার্ভা অবস্থায় পুকুর বা জলাধারের পাশে পচা কাঠ এবং বনাঞ্চলে বেড়ে ওঠে। তাদের জন্মস্থানই সাধারণত তাদের স্থায়ী আবাসস্থল হয়ে থাকে। কিছু প্রজাতির জোনাকি জলের ধারে থাকতে পছন্দ করে, আবার কিছু প্রজাতিকে শুকনো অঞ্চলেও দেখা যায়। তবে বেশির ভাগ জোনাকিই মাঠ, বন ও জলাভূমিতে বিচরণ করে।

কিন্তু বিশ্বব্যাপী উন্নয়নের জোয়ারে তাদের এই বাসস্থান আজ হুমকির মুখে। খোলা মাঠ, বনাঞ্চল ও জলাভূমিগুলো বিলীন হয়ে যাচ্ছে। নতুন নতুন ভবন, আধুনিক নৌকা ও জাহাজের চলাচল জোনাকিদের প্রয়োজনীয় অন্ধকার এবং শান্ত পরিবেশ নষ্ট করে দিচ্ছে। তাদের আবাসস্থল যত উন্নয়নের ফাঁদে পড়ছে, তাদের সংখ্যাও ততই কমছে।

কীটনাশকের ব্যবহার

জোনাকিদের লার্ভা যে মাটি ও জলজ পরিবেশে বেড়ে ওঠে, কৃষিকাজে ব্যবহৃত কীটনাশক তার ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। লার্ভা থেকে পূর্ণাঙ্গ জোনাকি হতে কয়েক মাস সময় লাগে। এই সময়ে অতিরিক্ত কীটনাশকের ব্যবহার জোনাকির লার্ভা ধ্বংস করে দিতে পারে। সাউথ কোরিয়ায় পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, কিছু কীটনাশকের কারণে লার্ভা থেকে শুরু করে প্রাপ্তবয়স্ক জোনাকিদের মৃত্যুহার ৮০ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে এবং ডিম পাড়ার সক্ষমতা শূন্য থেকে ৩৩ শতাংশ হ্রাস পেতে পারে। 

ব্যাবসায়িক কাজে জোনাকি সংগ্রহ

কিছু কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠান ব্যাবসায়িক উদ্দেশ্যে জোনাকি সংগ্রহ করে থাকে, যা বেশকিছু দেশে জোনাকির সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণ। ১৯৬০ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের সিগমা কেমিক্যাল কোম্পানি জোনাকি থেকে লুসিফেরেস ও লুসিফেরিন (যা থেকে আলো উৎপন্ন হয়) সংগ্রহের জন্য তিন মিলিয়নেরও বেশি জোনাকি সংগ্রহ করেছে। ২০০৯ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত চীনে থিম পার্ক এক্সিবিশন এবং রোমান্টিক উপহার তৈরির জন্য কয়েক মিলিয়ন জোনাকি সংগ্রহ ও বিক্রি করা হয়েছে। যদিও আন্দোলনের মুখে চীনে এখন ব্যাবসায়িক কাজে জোনাকি সংগ্রহ বেশ কমে এসেছে।

জলবায়ু পরিবর্তন

জলবায়ু পরিবর্তন একটি বৈশ্বিক সমস্যা, যার প্রভাব জোনাকিদের ওপরও পড়ছে। জোনাকিদের বেঁচে থাকার জন্য আর্দ্র পরিবেশের প্রয়োজন, কিন্তু খরা এই পরিবেশ নষ্ট করে দিচ্ছে। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, বরফাচ্ছন্ন এলাকার পরিবেশের পরিবর্তন এবং ঝড়, বৃষ্টি, জলোচ্ছ্বাস ও বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ জোনাকিদের বাসস্থান ও জীবনযাত্রায় ব্যাপক প্রভাব ফেলছে।

এভাবে চলতে থাকলে পৃথিবী থেকে একদিন নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে জোনাকিরা। তাদের সংরক্ষণে তাই প্রয়োজন সম্মিলিত উদ্যোগ। বিশ্বব্যাপী জোনাকি রক্ষা ও সংরক্ষণে জোনাকির আবাসস্থল পুনরুদ্ধার, উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চতকরণ, আলোকদূষণ কমানো অর্থাৎ কৃত্রিম আলো হ্রাস, টেকসই কৃষিচর্চা ইত্যাদি বিষয়ে বিভিন্ন দেশ উদ্যোগ নিচ্ছে।


Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫