ঢাকাইয়া সোব্বাসীদের বিয়ে : বাতপাক্কা থেকে ফেরোল্টা-হারিয়ে যাচ্ছে প্রথা ও ভাষা

মো. শাহাবুদ্দিন সাবু
প্রকাশ: ২৮ জুন ২০২৫, ১৬:১৯

সোব্বাসীদের গায়ে হলুদের দৃশ্য।
‘আয়া ভোসরিকি জানা লাড়কি লেনে কো।
আরে বেটাকা বাপ, লাড়কি যো লেনে আয়া
আচ্ছা শাড়ি লেকে আইয়ো,
আচ্ছা শাড়ি লেকে আইয়ো,
নাইলে যো তোমরা মুমে মারেনে।’
গবেষক শায়লা পারভীন বলেছেন, পুরান ঢাকার হিন্দুদের বিয়েতে বরযাত্রা কনের বাড়িতে পৌঁছালে সোহাগানরা (সধবারা) বরের বাবাকে উদ্দেশ করে উপরোক্ত গান গাইত। কোনো একসময়ের বুলি শত বছর পর যে গালিতে রূপান্তরিত হতে পারে, তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ গানের ‘ভোসরিকি জানা’, যা বর্তমানে সোব্বাসীরা গালি হিসেবে ব্যবহার করে, যদিও এর অর্থ কারো জানা নেই। সময়ের পরিক্রমায় প্রথা ও ভাষা বদলে যাওয়া একটি স্বাভাবিক বিষয়; সোব্বাসীদের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য।
বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা লম্বা সময়ব্যাপী এক বিশাল কর্মযজ্ঞ, যার কিছুটা নিদর্শন সোব্বাসীদের বিয়েতে এখনো দেখা যায়। সাধারণত আনুষ্ঠানিকতার সঙ্গে প্রচলিত লোকবিশ্বাস জড়িত থাকে, যেমনÑসোব্বাসীরা মনে করত রান্নাঘরের মাটির চুলার গায়ে ও হাঁড়িতে যদি ‘আগকা মেসাল’ (স্ফুলিঙ্গ) দেখা যায়, তাহলে বাড়ির বিয়ের উপযুক্ত ছেলেমেয়ের বিয়ে আসন্ন। আবার অনেকেই তাদের পুত্রকন্যাকে মহরমের সাত তারিখে হোসেনি দালানের ‘কায়েচকা লাড্ডু’ বিয়ের জন্য মানত করে খাওয়ায়।
সোব্বাসী সমাজে ‘মোতাসা’ (ঘটক) এখনো অপরিহার্য, যদিও অতীতের মতো অতটা দাপট এখন আর নেই। কনে দেখার ক্ষেত্রেও আছে নানা শুভাশুভ নির্দেশক লোকবিশ্বাস। যেমন-‘কিরিবিরি’ দাঁতের (দাঁতের ওপরে দাঁত) অধিকারী পাত্রী প্রায় সবারই পছন্দের। আবার কারো ‘ফারিদি আখ’ (এক চোখ অন্য চোখের চাইতে ছোট) থাকলে তাকে মনে করা হতো ‘কেসমাতওয়ালি’ (ভাগ্যবতী)।
কনের বাবার বাড়িতেই সাধারণত কনে দেখার ব্যবস্থা করা হলেও ইদানীং রেস্তোরাঁয়ও কনে দেখা হয়। কনে দেখার পর কনের হাতে সালামি দেওয়া রেওয়াজ। উভয় পক্ষ রাজি হলে কনের পিত্রালয়ে ‘বাতপাক্কা’ (কথা পাকা) অনুষ্ঠান হয়, যেখানে মোতাসার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। অভিজ্ঞ মোতাসা বাতপাক্কার আগেই উভয় পক্ষের সব ধরনের চাহিদা পূরণ করার জন্য দুই পক্ষকেই রাজি করাতে সক্ষম হয়, ফলে তার সম্মানীও বাড়ে। বাতপাক্কায় উভয় পক্ষের মহল্লার সর্দাররা, গণ্যমান্য ব্যক্তিসহ মুরব্বিরা উপস্থিত থাকেন। বরপক্ষ পান, সুপারি, সাদা পাতা, পোলাওয়ের চালের জর্দা, ২০ থেকে ৪০ কেজি মিষ্টি, কনের জন্য কাপড়চোপড়, অলংকারসহ উপস্থিত হয়। সবার উপস্থিতিতে দেনমোহর, অলংকার, বাচকান্নার শাড়ি (কনের কমবয়সী আত্মীয়দের), মোরাব্বিয়ানা শাড়িসহ (কনের মুরব্বিদের) অন্য সব ‘দানদাহেজ’ (উপহার যৌতুক)-এর পরিমাণ নির্ধারণ করে দুই কপি ‘মুসাবেদা’ (চুক্তিপত্র) করা হয় এবং তা জোরে পাঠ করে শোনানো হয়। পূর্বে বাতপাক্কার দিনেই বিয়ে, বৌভাতের দিন-তারিখ ঠিক করা হতো। সোব্বাসীরা সাধারণত তেজিকা চান (সফর মাস), মহরম, রমজান মাস বাদ দিয়ে তারিখ নির্ধারণ করে। বর্তমানে কমিউনিটি সেন্টারের বুকিংয়ের ওপর বিয়ে, বৌভাতের তারিখ অনেকাংশে নির্ভরশীল। বাতপাক্কায় অতিথিদের মোরগ পোলাও, মোরগ মোসাল্লাম, নার্গিসি কোফতা, সামি কাবাব,
গরু-খাসি-মুরগির রেজালা, রুই মাছ, চান্দা মাছ, চিংড়ি ভাজা, খাসির পায়ের রোস্ট, শাহিটুকরা, পোলাওয়ের চালের জর্দা, ছানার জর্দা, বোরহানি, নানা রকমের ফল পরিবেশন করা হয়। অতীতে বাতপাক্কার দিনে বর কনের বাসায় আসত না, ইদানীং আসে এবং কনেকে আংটি পরায়। এই দিন রাতে বরের বাড়িতে ‘দুলাকা খানা’ (বরের খাবার) পাঠানো হয়। অনেকে এই খাবার বাতপাক্কার তিন-চার দিন পরও পাঠায়।
কার্ডের প্রচলন শুরু হওয়ার পর সোব্বাসী সমাজে লবঙ্গ, মোনাক্কা, কিশমিশ, পাইপয়সা দিয়ে ‘নেওতা’ (নিমন্ত্রণ) দেওয়া এবং বিয়ের দিন সকালে নিমন্ত্রিত আত্মীয়দের বাসায় সকালের নাশতা পাঠানো পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। ইদানীং কার্ডের পাশাপাশি ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপেও নেওতা দেওয়া হয়। পূর্বে বিয়ের ১০ থেকে ১৫ দিন আগে থেকেই প্রতিদিন রাতে পরিবারের মহিলারা একত্রিত হয়ে গানের আসর জমাত। ফলে মহল্লাবাসী বুঝতে পারত ওই বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠান আসন্ন-এটাও এখন বিলুপ্ত।
বালাবালির আগের দিন বরকনের নারী আত্মীয়রা ‘সোন্দাকোটাই’ এর অনুষ্ঠান দিয়ে বিয়ের মূল পর্বের সূচনা করে। বরকনের গায়ে মাখার জন্য হলুদ, সোন্দা, এক মুঠ গম, সামান্য পোলাওয়ের চাল ‘উখলিমোশাল’ (কাহেলছিয়া) এ দিয়ে সাতজন সোহাগান (সধবা) একসঙ্গে ডান হাতে মোশাল ধরে মোট সাতবার হলুদ কোটে। ‘সাতকোটা’ শেষ হওয়ার পর উপস্থিত বাদবাকিরা (বিধবা, তালাকপ্রাপ্ত আত্মীয় ছাড়া) হলুদ কোটে। জর্দার রং দিয়ে রাঙানো সাদা কাপড়ে কোটা হলুদ-সোন্দা চেলে নিয়ে মাটির ‘হাঁড়িয়া’ (হাঁড়ি) তে নিয়ে ঘরের মাচায় তুলে রাখা হয়, যাতে বদনজর না লাগে। সোন্দাকোটাই সোব্বাসী সমাজে বহুল প্রচলিত একটি নারীকেন্দ্রিক অনুষ্ঠান। পূর্বকালে সোন্দাকোটাইয়ের রাতে পুরুষেরা বাড়ির উঠানে আলপনা করা কাঠের বড় জলচৌকির চার কোনায় চারটি শিকড়সহ কলাগাছ পুঁতে ‘মারোচা’ (মঞ্চ) তৈরি করত। মারোচার ওপরে হলুদ কাপড়ের চাঁদোয়া দিত। মারোচার ওপর বসিয়ে বরকনেকে হলুদ মাখানো হতো। এখন কোথাও আর মারোচা তৈরি করা হয় না, তার পরিবর্তে কমিউনিটি সেন্টারে ইভেন্ট অর্গানাইজারদের দিয়ে মঞ্চ তৈরি করে নেওয়া হয়।
সোন্দাকোটাইয়ের পরদিন ও বিয়ের পূর্বদিন বরকনে উভয়ের নিজ নিজ বাড়িতে ‘বালাবালি/হালদি’ (গায়ে হলুদ) অনুষ্ঠিত হয়। যদিও এখন কমিউনিটি সেন্টারের বুকিংয়ের ওপর বালাবালির তারিখ নির্ভরশীল। তা ছাড়া এখন ভিন্ন ভিন্ন দিনে কনে ও বরের বালাবালি হয়। বালাবালির দিন সকালে বরপক্ষ কনের বাড়িতে ‘দাইমাছলি’ (দই-মাছ) পাঠায়। দই-মাছ নাম হলেও দুটি বড় রুই মাছ, ৩০ থেকে ৪০ হাঁড়ি দইয়ের সঙ্গে পান, সুপারি, সাদাপাতা, খয়ের, পোলাওয়ের চালের জর্দা, বাচকান্নার শাড়ি, মোরাব্বিয়ানা শাড়ি, মুদেখাইকা শাড়ি (কনের জন্য) পাঠায়।
একটা মাছের মুখে সিগারেট আরেকটার মুখে পানের খিলি দিয়ে যে মাছ কুটবে তার জন্য মাছের মুখে টাকাও দেওয়া হয়। পান মুখে দেওয়া মাছের মুখ কাপড়ের ছোট ঘোমটা দিয়ে ঢাকা থাকে। দাইমাছলির খাবারের অর্ধেকটা উকিল বাপকে দিতে হয়। বালাবালির দিন বরকনে গোসল করে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে। গোসলের পর কনে তার বাবার দেওয়া লালপাড়ের সাদা শাড়ি পরত, পরবর্তীকালে লালপাড়ের হলুদ শাড়ির প্রচলন হয়; এখন অন্যান্য রঙের শাড়িও পরে। বর সাদা লুঙ্গি বা পায়জামা, সাদা পাঞ্জাবি, বালাবালির বিশেষ ধরনের সাদা টুপি পরে। মাগরিবের নামাজের পর বালাবালির অনুষ্ঠান আরম্ভ হয়। বরকনে সবাইকে সালাম করে নতুন আলপনা করা শীতল পাটিতে বসে। আগে বরকনের সামনে বা চারদিকে গোল করে শিশুদের বসানো হতো। প্রত্যেক শিশুকে একটি করে হলুদ কাপড়ের ‘পোঁটলা’ দেওয়া হতো। পোঁটলায় পাঁচ ধরনের ফলের টুকরা, মুড়ি, খইওখরা, নোক্কাল ও পয়সা থাকত। শিশুরা পোঁটলার খাবার খাওয়ার পর সোহাগানরা তেলোয়াই শুরু করত। পোঁটলা দেওয়ার রেওয়াজ এখন আর নেই। সাতজন সোহাগান রাখি স্পর্শ করার পর যেকোনো একজন রাখি বরকনের হাতে পরিয়ে দেয়। বরকনের সামনে থাকে আলপনা করা ‘সুপ’ (কুলা), যেটাতে একফানা কাঁচা কলা, ধান, দূর্বা, সোন্দাকোটাইয়ে বাটা হলুদ, বাটা মেহেদি, জ¦লন্ত প্রদীপ, রুটি, পান-সুপারি থাকে। কুলার পাশে এখন কেক, ফল, আঙুর, মিষ্টিও থাকে। সাতজন সোহাগানের প্রত্যেকেই তেলোয়াইয়ের সময় কলার ফানা বরকনের মাথায় তিনবার ছোঁয়াত, প্রদীপসহ কুলা বুক থেকে কপাল অবধি তিনবার ওঠানামা করাত। প্রদীপের আগুনে বরকনের দুই কানে সেক দিয়ে তারপর বাটা হলুদ নিজ ও বরকনের কপালে তিনবার লাগানোর পর মিষ্টিমুখ করাত। বর্তমানে বালাবালিতে কলার ফানা ও প্রদীপের উপাচার বাদে বাকিগুলো পালন করা হয়। সাত সোহাগানের তেলোয়াইয়ের পর অন্যরা তেলোয়াইয়ে অংশগ্রহণ করে। অতীতে বালাবালিতে ‘মেরাসেন’ (গায়িকার দল)-এ নাচগান পরিবেশিত হতো। কলের গান, লাউডস্পিকার এসে মেরাসেনদের জায়গা দখল করেছে। এখন বালাবালির রাতে ব্যান্ড শো, ডিজের আয়োজন বেশ জনপ্রিয়।
বিয়ের দিন সকালে সোহাগানরা সাত তেলোয়াইয়ের পর বরকনের সারা গায়ে হলুদবাটা মাখে, তারপর গোসল করিয়ে হলুদ নামায় (হালদি ওতারনা)। অতীতে অবিবাহিত সাতজন কিশোর বরকনের জন্য বুড়িগঙ্গা নদী থেকে গোসলের পানি আনত; বহুদিন হলো বুড়িগঙ্গার পানি দূষিত হয়ে গোসলের অযোগ্য হয়ে গেছে, ফলে কলের পানিই এখন ভরসা। ঢাকায় পার্লারের আবির্ভাবের পূর্ব পর্যন্ত কনেকে তার আত্মীয়রা ঘরেই সাজগোজ করাত; এখন পার্লার থেকে বিয়ের শাড়িতে কনে সম্পূর্ণ সেজেগুজে আসে। তবে বরকে এখনো বন্ধুবান্ধব, দুলাভাই বিয়ের পোশাক পরতে সাহায্য করে। সাধারণত দুলাভাই চোখে সুরমা ও গায়ে আতর মেখে দেয়। অতীতে বড় চাচি বরকে পাগড়ি ও সেরা (কপালে পরার) পরিয়ে দিতেন; এখন সেরার প্রচলন নেই। তখন মা-চাচিরা বিয়ে করাতে বরযাত্রায় যেতেন না, তাই বরকে ‘দাইমাঙ্গাল’ (দইমঙ্গল)-এর মাধ্যমে বিদায় জানাতেন। এখন বরযাত্রায় মা-চাচিরা উপস্থিত থাকেন এবং দাইমাঙ্গালও করেন। মা ছেলেকে দই অথবা দই, চিনি, পোলাও বা ভাতমাখা খাইয়ে দেন; এরপর উপস্থিত স্বজনরাও দইভাত খেতে পারে।
পুরান ঢাকায় পালকির প্রচলন ছিল না বিধায় বর ও কনের আবাসস্থল কাছাকাছি হলে বর হেঁটে, আবাসস্থল দূরে হলে টমটম গাড়িতে চড়ে কমপক্ষে একবার চকবাজার চক্কর দিয়ে বিবাহস্থলে পৌঁছাত। মোটরগাড়ি আসার পর প্রায় সবাই এখন সজ্জিত মোটরগাড়িতে যায় আর চকবাজারের চক্কর অনেক আগেই বন্ধ হয়েছে। তবে পটকাবাজির রেওয়াজ এখনো আছে। ঢাকায় কমিউনিটি সেন্টার চালু হওয়ার আগে মসজিদে বা মহল্লার বাংলায় ‘নিকাহ’ (বিয়ে) পড়ানো হতো; অবশ্য এখনো অনেকেই জুমার নামাজের পর মসজিদে বিয়ে পড়ায়। এ ক্ষেত্রে মসজিদে উভয় পক্ষের অল্প কয়েকজন মুরব্বি উপস্থিত থাকেন। বর বিবাহস্থলে পৌঁছালে শালাশালি কর্তৃক ‘গেটথামাই’ (গেট ধরা) একটি মজাদার রীতি; বেশ কিছুক্ষণ বরের বন্ধুদের সঙ্গে দরকষাকষির পর একটা ফায়সালা হয়, যদিও বেশির ভাগ বিয়েতেই বাতপাক্কার দিন প্রদেয় অর্থের পরিমাণ নির্ধারিত হয়। বিয়ের দিন শালাশালি বরের নাগরা জুতা চুরি করে পণ আদায়ের রীতি হারিয়ে গেছে।
সোব্বাসীদের বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার পর বরকে নববধূর ডানপাশে বসিয়ে ‘ক্ষীরগুজনি’ করা হয়। বর ও কনে ডানহাতের কনিষ্ঠাঙুলের সাহায্যে ক্ষীর, জর্দা, পায়েস, ফিরনি, মিষ্টির যেকোনো কিছু একে অপরকে তিনবার খাওয়ায়; ইদানীং চামচের সাহায্যে মিষ্টি খাওয়ায়। এক গ্লাস শরবত বা কোমল পানির অর্ধেক বর পান করে বাকি অর্ধেক নিজ হাতে কনেকে পান করায়। তারপর ‘এখলাই’ (বিয়ের ওড়না) দিয়ে উভয়ের মাথা ঢেকে আয়নায় পরস্পরের মুখ দেখিয়ে ‘মুদেখাই’ সম্পন্ন করা হয়। মালাবদলের প্রথা সোব্বাসী সমাজে পূর্বে না থাকলেও এখন মালা বদল করা হয়। মালাবদলের পর বরকনে একত্রে রাতের খাবারে অংশগ্রহণ করে। খাওয়াদাওয়ার পর কনের পিতা বা পিতৃস্থানীয় (পিতার অনুপস্থিতিতে) অভিভাবক বরের পরিবারপ্রধানের হাতে কনের হাত ‘সোপকে’ (সোপর্দ করে) ‘সাফুরাত’ সম্পন্ন করে। কনের পিত্রালয়ে বিবাহকার্য সম্পন্ন হতো বিধায় বিদায়ের সময় কনে দুই হাতে আতপ চাল মাথার ওপর দিয়ে পেছনে ছুড়ে ঘরে ফেলত। এই সময় কনের দাদি বা নানি কেউ একজন জিজ্ঞেস করত, ‘কা কাররাহি?’ (কী কর?)। কনে উত্তর দিত, ‘মা-বাপকা ঘার ভারকে যাতে’ (মা-বাবার ঘর ভরে যাই)। বর্তমানে কমিউনিটি সেন্টারে এই রেওয়াজ পালনের প্রশ্নই ওঠে না।
নববধূকে নিয়ে বর নিজবাড়িতে পৌঁছালে বরকে ঘরের সামনে শীলপাটা ও কনেকে জলচৌকির ওপর দাঁড় করানো হয়। শাশুড়ি ও অন্য নারীরা ‘সুপ’ (কুলা) দিয়ে বরকনেকে বরণ করে নেন। অতীতে কনের দাদি, নানি, ভাবি বা ছোট ভাই-বোন বরের বাড়িতে রাত যাপনের জন্য কনের সঙ্গে আসত।
বিয়ের পরদিন সকালে উকিলবাপ ‘নেহারি’ নিয়ে বরের বাড়িতে আসে, যাকে বলে ‘মাট্টি পারানা’ (মাটি পারান)। ‘নেহারি’ হলো টানা পরোটা, মিষ্টি, বাকরখানি, পনির, মোরগ মোসাল্লাম ইত্যাদি সহযোগে নাশতা যেখানে গরু বা খাসির পায়ের নেহারি থাকে না; হয়তো কোনো একসময় গরু বা খাসির পায়ের নেহারিও নাশতায় থাকত।
ওয়ালিমা বা বৌভাত বিয়ের এক বা দুই দিন পর হয়। পূর্বকালে বৌভাতে কনেপক্ষকে নিমন্ত্রণ করা না হলেও এখন নিমন্ত্রণ করা হয়। বিয়ের আড়াই দিন পরের ‘আড়াইয়া নাইয়ার’ এখন বৌভাতের দিন রাতেই হয়, অর্থাৎ বরকনেকে কনের পিত্রালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।
বর শ্বশুরবাড়িতে দুই দিন থাকে; প্রথম দিন সকালে কাউকে কিছু না বলে বিছানার নিচে টাকা রেখে লুকিয়ে নিজের বাড়িতে চলে আসে। শ্বশুরবাড়ি থেকে নাশতা করার জন্য বরকে আমন্ত্রণ জানানো হলে বর বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়সহ আবার শ্বশুরবাড়িতে আসে এবং সবাই একসঙ্গে নাশতা খায়। এদিন বর শ্বশুরবাড়িতে কাঁচাবাজার করে; মাছ, মাংস, দই, মিষ্টি ইত্যাদি। বিশেষভাবে উল্লেখ্য, বর যদি বাজার না করে তাহলে যতদিন পর্যন্ত বাজার না করবে ততদিন পর্যন্ত শ্বশুরালয়ে মাংস, পোলাও খেতে হবে; ভাত নিষিদ্ধ।
এর পরদিন বরপক্ষের লোকজন যতজন আসবে ততজন প্রতি এক সের মিষ্টি ও এক থালা মালাই নিয়ে কনেকে বরের বাড়িতে ফিরিয়ে নিতে ‘ফেরোল্টা’ এর জন্য আসে। ‘ফের’ অর্থ পুনরায়, ‘ওল্টা’ অর্থ উল্টা।
সমাজের প্রায় সব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ভাষার সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। কোনো রেওয়াজ-রীতি প্রথা বিলুপ্ত হলে তার সঙ্গে সম্পৃক্ত শব্দাবলিও হারিয়ে যায়, যেমন হারিয়ে গেছে সোব্বাসীদের মারোচা, হালদি ওতারনার মতো শব্দ। সাম্রাজ্যবাদের মতই ভিনদেশি সাংস্কৃতিক আগ্রাসন গ্রাস করে নিচ্ছে স্থানীয় সংস্কৃতিকে, ফলে নতুন প্রজন্ম হয়ে উঠছে নিজ ভাষা-সংস্কৃতিতে অজ্ঞ। স্থান, সময় ও অর্থ গুরুত্বের অভাবে এভাবেই হারিয়ে গেছে ও যাচ্ছে সোব্বাসীদের পুরোনো রীতিনীতি, রেওয়াজ আর আওয়াজ।
লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক