
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, সংগীত কিংবা ভাষাগত বৈচিত্র্য-চট্টগ্রামের রয়েছে এক সুবিশাল সমৃদ্ধ ইতিহাস। আর যদি আসে খাবারের প্রসঙ্গ, তবে মেজবানের এলাহী কারবার তো রয়েছেই! চাটগাঁর খাবারের নজর যেহেতু পড়লই, তবে ‘মধুভাত’ সম্পর্কে আজ দু-চারটে কথা বলাই যাক।
মধুভাত হলো বিশেষভাবে তৈরি তরল মিষ্টি ভাত। দেখতে অনেকটা পায়েসের মতো, কিন্তু পায়েস নয়! ‘মধুভাত’ নামটি শুনলে মনে হতেই পারে-এ খাবারের সঙ্গে মধু ‘যোগ’ রয়েছে। আসলে তা নয়। এমনকি চিনি বা গুড়েরও কোনো সম্পর্ক নেই! কিন্তু খেতে মিষ্টি, তাই মধুর সঙ্গে এর তুলনা টানা। এখন নিশ্চয় প্রশ্ন জাগছে, খাবারটি তৈরিতে মধু, গুড় কিংবা চিনির ব্যবহার যদি না-ই হয়, তাহলে স্বাদে মিষ্টি লাগে কী করে? স্বাদের এই মুনশিয়ানা লুকিয়ে আছে মধুভাতের মূল উপাদান ‘জালা চাল’-এর ভেতরেই। এখানে বলে রাখতে হয়, ধানের চারাকে চট্টগ্রামের ভাষায় ‘জালা’ বলা হয়। চারা তৈরির এই ধান থেকে পাওয়া চালই হলো ‘জালা চাল’।
যেভাবে তৈরি হয় মধুভাত
মধুভাত তৈরির মৌসুম শুরু হয় আষাঢ় থেকে। তারপর শ্রাবণ ও ভাদ্র মাস পর্যন্ত থাকে এই মৌসুম। আষাঢ় মাসের শুরুতে আমন ধান সংগ্রহ করে পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয়। ধান অঙ্কুরিত হলে পানি থেকে তুলে রোদে শুকিয়ে টুকরিতে কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয়। ১০ থেকে ১৫ দিন পর সেসব ধান ভাঙিয়ে মাঝারি আকারে গুঁড়া করা হয়। একবারে মিহি গুঁড়া করা হয় না। তারপর আবার এক থেকে দুই দিন রোদে শুকাতে হয়। এরপর আসে রান্নার পালা। প্রথমে চালের অনুপাতে পরিমাণ মতো পানি দিয়ে বড় পাত্রে জাউয়ের মতো করে রান্না করা হয়। এরপর কেজিপ্রতি ২০০ গ্রাম করে জালা চালের গুঁড়া মিশিয়ে আলাদা একটি পাত্রে চামচ অথবা কাঠি দিয়ে ঘুটে ভাতগুলো মোলায়েম করার পর দুধ মেশানো হয়। তারপর অল্প চালের গুঁড়া ছিটিয়ে ভালো করে ঘুঁটে নেওয়া হয়। এরপর পাত্রের মুখ ভালো করে বন্ধ করে কাপড় দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। কোনোভাবেই যেন বাতাস প্রবেশ করতে না পারে, সে জন্যই এই পদ্ধতি। ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা থাকার পর নারকেল ও কিশমিশ দিয়ে পরিবেশন করা হয়। পাত্রের মুখ খোলার পর ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই মধুভাত খেয়ে ফেলতে হয়। নয়তো টক হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তবে ফ্রিজে দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যায়। মধুভাত মূলত রাতে রান্না করা হয়ে থাকে। মূলত রাতভর ঢেকে রাখার পর সকাল সকাল এটি পরিবেশন করার রেওয়াজ।
প্রাকৃতিকভাবেই মধুভাত হয় মিষ্টি ও সুগন্ধি। কিন্তু যারা অধিক মিষ্টতার জন্য অনেকেই খানিকটা চিনি মিশিয়ে নেন। চিনি বা গুড় ছাড়াও মধুভাত দারুণ মিষ্টি।
চট্টগ্রামে এককালে মধুভাত রান্না করে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে পাঠানোর চল ছিল। নতুন বিয়ে হলে মেয়ের শ্বশুরবাড়ি থেকে প্রথম বছর মধুভাত পাঠানো হতো। বর্তমানে আত্মীয়স্বজন কিংবা বিয়ে বাড়িতে মধুভাত পাঠানোর সংস্কৃতি বিলুপ্তির পথে। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার বাসিন্দা মনিরুল ইসলাম মুন্নার ভাষ্যেও তেমন ইঙ্গিত মেলে। মুন্না বলেন, মধুভাত আসলে খুব কাছের মানুষের জন্য রান্না করা হয়। কারণ মধুভাতের পুরো প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল, তাই খুব কাছের মানুষ ছাড়া মধুভাত রান্নার ধকলটা সকলে নিতে চান না।
তিনি আরো বলেন, ‘মধুভাত রান্নার প্রচলন এখন অনেক কমে গেছে। আমাদের বাড়িতে বছরে দু-একবার তৈরি হয় এখনো। আমি গত বছরের আষাঢ়ে শেষবার খেয়েছি, মা রান্না করে দিয়েছিলেন।’
মধুভাতের প্রচলন
মধুভাতের প্রচলন বা উৎপত্তির বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানা যায় না। এ বিষয়ে ইতিহাস গবেষকদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। এক দল গবেষক মনে করেন, আরাকান আমলে ভাতের সঙ্গে মধু মিশিয়ে খাওয়ার প্রচলন ছিল, সেখান থেকেই ‘মধুভাত’ নামটি এসেছে। আরেক দল গবেষক মনে করেন, সুফি সাধক বার আউলিয়ারা যখন চট্টগ্রামে ইসলাম প্রচারের লক্ষ্যে আগমন করেন তখন তাদের মাধ্যমে কিছু খাদ্যাভ্যাসের প্রচলন ঘটে। মধুভাতও হয়তো সে খাদ্যাভ্যাসের একটি, যা কালক্রমে চট্টগ্রামের লোকজ ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে।
মধুভাতের প্রচলন যেভাবেই হোক না কেন, এটি এখন চট্টগ্রামের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অন্যতম বাহক। যদিও এখন এই ঐতিহ্যবাহী খাবারের প্রচলন আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে, তবু একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। কালের খেয়ায় যদি একদিন বস্তুগতভাবে হারিয়ে যায়-ইতিহাসের খসড়া পান্ডুলিপির চট্টগ্রাম অধ্যায়ে মধুভাত ঠিক থেকে যাবে।