Logo
×

Follow Us

ফিচার

আকাশ যখন টানা ৩৩১ দিন কেঁদেছিল

Icon

ইশতিয়াক হাসান

প্রকাশ: ০৭ জুলাই ২০২৫, ১৩:০০

আকাশ যখন টানা ৩৩১ দিন কেঁদেছিল

রাতে বৃষ্টি পড়লে ঘুম ভালো হয়-এ কথাটা সবার জানা। তবে কখনো কি কল্পনা করেছেন এমন এক জায়গার কথা, যেখানে আকাশ এক দিন-দুই দিন নয়, একটানা বছরের পর বছর কেঁদে চলেছে? শুধু কালো মেঘ আর ফোঁটার শব্দ নয়, মাঝেমধ্যে গুড়গুড় গর্জন, আবার অনেক সময় একদম নিঃশব্দে নেমে আসা ভেজা কান্না।

মনে হতে পারে কোনো কবিতার পঙ্্ক্তি কিংবা কোনো মায়াবী উপন্যাসের আবহ। অথচ এসব কিছুই বাস্তব। পৃথিবীর বুকেই ঘটে গেছে এমন ঘটনা, আর তা একবার নয়, দুইবার। দুইবারই হয়েছে প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে ভেসে থাকা একখণ্ড স্বর্গে, হাওয়াইয়ে।

প্রথম গল্পটি শুরু হয় ১৯৩৯ সালের আগস্টে। মাউই দ্বীপের এক নিরিবিলি খামারাঞ্চল, নাম মানুয়াউলু র‌্যাঞ্চ। চারদিকে সবুজে ঢাকা মাঠ, পাহাড়ের ঢালে আখের ক্ষেতে মৃদু বাতাস। সেখানে প্রথম দিন বৃষ্টি হয়েছিল একটু একটু করে। সবাই ভেবেছিল, এক পশলা বৃষ্টি। কিন্তু পরদিনও হলো, তার পরদিনও। এভাবে গুনতে গুনতে পেরিয়ে গেল এক সপ্তাহ, তারপর এক মাস। কেউ কেউ তখন কৌতূহলী হয়ে উঠল। খামারের একজন পুরোনো কর্মচারী বলেছিলেন, ‘আমার মনে হয়, ঈশ্বর আমাদের কিছু বোঝাতে চাচ্ছেন।’

বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকা কৃষিকাজের মাঠ ধীরে ধীরে ভিজে উঠছিল। শুরুতে সেটা আশীর্বাদ মনে হলেও তিন মাস পরে কিছু চাষ বন্ধ করে দিতে হয়। রাস্তা কাদায় ভারী হয়ে পড়ে, গরুর গাড়ি চলতে পারে না, পায়ে হেঁটে যাওয়াও কষ্টকর হয়ে যায়। অথচ আকাশ থামছে না। এমন না যে প্রতিদিন ঝড়, বর্ষণ, কড়া বজ্রপাত; বরং অনেকটা নিঃশব্দ ও স্থির এক ধারা, যেন কেউ দূরে বসে প্রতিদিন ঠিক এক ফোঁটা করে ফেলে দিচ্ছেন পৃথিবীর গায়ে।

এভাবে চলতে চলতে একটানা ৩৩১ দিন ধরে এলাকায় প্রতিদিন পরিমাপযোগ্য বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছিল-মানে প্রতিদিনই কমপক্ষে ০.০১ ইঞ্চি বা ০.২৫ মিলিমিটার পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় আবহাওয়া সংস্থার পরিমাপযোগ্য মান। আজ পর্যন্তও এ ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে দীর্ঘতম টানা বৃষ্টিপাতের বৈজ্ঞানিক রেকর্ড হিসেবে স্বীকৃত।

এই রেকর্ডটা ছিল ১৯৩৯ সালের ২৭ আগস্ট থেকে ১৯৪০ সালের ২২ জুলাই পর্যন্ত। এমন একসময়, যখন পৃথিবীর অন্যত্র ছিল রাজনৈতিক অস্থিরতা, যুদ্ধের প্রস্তুতি আর অর্থনৈতিক টানাপোড়েন, তখন হাওয়াইয়ে প্রতিদিন আকাশ কাঁদছিল, নীরবে।

তবে এরও আগে হাওয়াইয়ের আরেক দ্বীপ ওয়াহোতে ঘটেছিল আরেক আশ্চর্য ঘটনা। ১৯১৩ সালের আগস্ট মাস থেকে শুরু করে টানা ৮৮১ দিন ধরে হনোমু মাউকা নামের এক এলাকায় প্রতিদিন ‘ট্রেস অব রেইন’ রেকর্ড করা হয়েছিল। ‘ট্রেস’ মানে হচ্ছে, বৃষ্টির এমন পরিমাণ, যা এতটাই কম যে পরিমাপের সীমার নিচে পড়ে; যেমন-হালকা ছোঁয়া, এক ফোঁটা, কুয়াশার মতো স্পর্শ। এটা ‘পরিমাপযোগ্য বা মেজারেবল বৃষ্টি’ হিসেবে গণ্য না হলেও প্রাকৃতিকভাবে এটি ছিল এক অলৌকিক ধারাবাহিকতা। এই ঘটনাকে অনেকে বলেন, ‘আকাশের লুকানো কান্না’।

এখানকার মানুষও সেই সময় বলেছিল, ‘এ যেন এক মৌন বর্ষণ। কেউ কাঁদছে আমাদের ছাদের ওপর, কিন্তু শব্দ হয় না। কেবল রাতের নিস্তব্ধতায় জানালার কাচে ছোট ছোট দাগ পড়ে।’ বিজ্ঞানীরা বলেন, ওই এলাকাগুলোর ভৌগোলিক গঠন এমনভাবে তৈরি, যেখানে মেঘ আটকে যায় এবং প্রায় প্রতিদিনই সামান্য হলেও বৃষ্টি পড়ে।

এই দুটি ঘটনা পৃথিবীর আবহাওয়ার ইতিহাসে আজও বিস্ময় হয়ে আছে। একটানা প্রাকৃতিক বৃষ্টিপাত, যেখানে কোনো আধুনিক মেশিন কাজ করে না, কোনো মানুষ নির্দেশ দেয় না, তবু আকাশ নিজের মতো করে ঝরে যায়, দিনের পর দিন, মাসের পর মাস। হাওয়াইয়ের এত দীর্ঘ সময় ধরে বৃষ্টি হওয়ার পেছনে আছে তার ভৌগোলিক অবস্থান ও জলবায়ুর বিশেষ চরিত্র। কয়েকটি কারণ একত্রে কাজ করে।

প্রথমত, হাওয়াই প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝখানে অবস্থিত একটি দ্বীপপুঞ্জ। এর চারপাশে সমুদ্র থাকায় বাতাস সব সময়ই ভিজে থাকে। এই আর্দ্র বাতাস যখন পাহাড়ের গায়ে ঠেকে ওপরে উঠে যায়, তখন ঠান্ডা হয়ে বাষ্প মেঘে পরিণত হয় এবং বৃষ্টি ঝরে পড়ে। এ প্রক্রিয়াকে বলে ওরোগ্রাফিক রেইনফল-বাংলায় সহজ করে বললে, ‘পাহাড়ের গায়ে বৃষ্টির জন্ম’।

দ্বিতীয়ত, এখানে ‘ট্রেড উইন্ড’ বা নির্বিচারে প্রবাহিত পূর্ব দিকের বাতাস থাকে, যা প্রতিনিয়ত সমুদ্র থেকে জলীয় বাষ্প টেনে আনে। তৃতীয়ত, হাওয়াইয়ের অনেক এলাকা এমনভাবে গঠিত যে মেঘ সরে যেতে পারে না, আটকে পড়ে এবং প্রায় প্রতিদিনই কিছু না কিছু ঝরে।

এই সব মিলিয়ে হাওয়াই এমন এক জায়গা, যেখানে বৃষ্টি শুধু কোনো এক দিনের ঘটনা নয়, বরং প্রকৃতির এক স্বাভাবিক, নীরব সংগীতের মতো প্রতিদিনের সঙ্গী। তবে এখনকার হাওয়াই কেমন? আধুনিক হাওয়াই আর আগের মতো নিয়মিত বৃষ্টির দ্বীপ নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের ছোবল এখানেও পড়েছে। কাওয়ি বা মাউয়ি দ্বীপে এখনো বছরে ৩০০-৪০০ ইঞ্চি বৃষ্টি হয়, তবে টানা বৃষ্টির দিন অনেক কমে গেছে। অন্যদিকে ও’য়াহু দ্বীপে খরা ও দাবানলের ঝুঁকি বাড়ছে, বিশেষ করে গ্রীষ্মকালে। তাপমাত্রা বেড়ে চলেছে এবং প্রকৃতির সেই ছন্দময় ধারাবাহিকতা কোথাও যেন থেমে যাচ্ছে। তবুও এখনো কিছু অঞ্চলে, বিশেষ করে হাওয়াইয়ের পাহাড়ি ঢালে মাঝে মাঝে সেই পুরোনো দিনের মতো কয়েক সপ্তাহ একটানা ঝিরঝিরে বৃষ্টি হয়। গ্রামের কিছু প্রবীণ তখন বলেন, ‘এটা আসলেই সেই মানুয়াউলু র‌্যাঞ্চের সময়ের মতো না, কিন্তু কে জানে, হয়তো আকাশ এখনো মাঝে মাঝে আমাদের পুরোনো কথা মনে করে।’

এই দুই ঘটনার গল্প শুধু আবহাওয়ার নয়, এটা এক ধৈর্যশীল পৃথিবীর গল্প। যেখানে আকাশ কান্না করে, মাটি মুচড়ে ওঠে, আর মানুষ ছাতা মাথায় বেঁচে থাকে প্রতিদিন। প্রকৃতি কখনোই হিসাব করে চলে না। সে তার নিজের মতোই ঝরে, হাসে, কাঁদে।

তথ্যসূত্র : ন্যাশনাল সেন্টারস ফর এনভায়রনমেন্ট ইনফরমেশন, যুক্তরাষ্ট্র; গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস; রেডিট

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫